৬০ বর্ষ ৩ সংখ্যা / ২৬ আগস্ট, ২০২২ / ৯ ভাদ্র, ১৪২৯
অখণ্ড নয় এ বিশ্ব
পার্থ মুখার্জি
বিশ্ব শান্তি দিবস ও প্রবলভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা সমার্থক শব্দ। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর হিটলারের ফ্যাসিস্ট বাহিনী পোল্যান্ড আক্রমণ করে। সূত্রপাত হয় পররাজ্য গ্রাসের প্রথম পদক্ষেপ। ১৯৪১ সালের ২২ জুন নাৎসি বাহিনী তার সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে আক্রমণ করে সোভিয়েত ইউনিয়নকে, বদলে যায় যুদ্ধের সামগ্রিক চরিত্র। ত্রিশের দশকে (১৯২৯-৩৩) ভয়াবহ পুঁজিবাদী আর্থসামাজিক সংকট থেকে উদ্ভূত হয় ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিবাদের প্রধান লক্ষ্যই হলো বুর্জোয়াদের ক্ষয়িষ্ণু দশাকে টিকিয়ে রাখা,আর ক্রমাগত মানবিক মূল্যবোধগুলিকে ধ্বংস করা। কিন্তু প্রতিরোধেরও একটা বিশ্বময়তা থাকে। এই ঘৃণ্য ফ্যাসিবাদের পতন ঘটেছিল স্তালিনের হার না মানা দৃঢ় সংকল্প ও লাল ফৌজের অকুতোভয় প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে। গোপনে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছিল হিটলারকে। এই ইতিহাস কেউ ভোলে, আবার কেউ ভোলে না। গিরগিটি যেমন তার রং বদলায় কিন্তু তার চরিত্র বজায় রাখে, সাম্রাজ্যবাদও নিজেকে যতই ভদ্রস্থ করে মানবতার সামনে প্রচারের ফানুস বানাক না কেন তা দখলদারি রাষ্ট্রের চরিত্রই গ্রহণ করে। গণতান্ত্রিক, আধা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোকে নিজেদের মতো খাপ খাইয়ে নিতে পাকা দক্ষ অভিনেতার মতো গণতন্ত্র প্রেমের রং মেখে সাধারণ মানুষের বন্ধু ও দরদি সাজতে চায়। আর নিজস্ব এই স্বার্থ চরিতার্থ করতে দেশে দেশে তৈরি করে বশংবদ দালালদের, যাতে সহজেই সাম্রাজ্যবাদ তার নিজস্ব নীতিকে সংশ্লিষ্ট দেশে কার্যকর করতে পারে। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত পিয়ের হেলি’র সত্তরের দশকে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ শীর্ষক গ্রন্থের মুখবন্ধে হ্যারি ম্যারাডফ্ উল্লেখ করেছিলেন - সচরাচর মার্জিত শিক্ষিত বিদ্বজ্জনেরা সাম্রাজ্যবাদ শব্দটির ব্যবহার পছন্দ করতেন না। তারা এটিকে অরুচিকর ও অবৈজ্ঞানিক বিবেচনা করতেন। আজকের দিনে ঠিক এইভাবেই সাম্রাজ্যবাদের বিশ্লেষণ সত্য নয় বলেই অনেকে বিবেচনা করেন। আলোচনা প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, সাম্রাজ্যবাদের এই চরিত্র সম্পর্কে কিছুটা ইতিবাচক(?) মনোভাবের জন্ম হয়েছিল, বুশ প্রশাসনের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তথাকথিত যুদ্ধের পটভূমিতে। সাম্রাজ্যবাদী ধূর্ততার ক্রমবর্ধমান প্রকাশ বর্তমানে প্রায় অনিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। আবার এটাও ঠিক দেশে দেশে বহুগুণ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। ১৯৩৫ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসে জর্জি ডিমিট্রভ বলেছিলেন - “ফ্যাসিবাদ যে কোনো মুখোশই ধারণ করুক, যেকোনো রূপেই নিজেকে উপস্থাপিত করুক এবং যেকোনো পথেই ক্ষমতায় আসুক তবুও ফ্যাসিবাদ হলো শ্রমিক শ্রেণির এবং সমস্ত মেহনতি মানুষের সবচেয়ে ঘৃণ্য শত্রু, কিন্তু তবুও ফ্যাসিবাদ অনেক ক্ষেত্রে জনগণকে আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়। কারণ জনগণের সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন ও দাবিগুলির কাছে সে বাগাড়ম্বরে আবেদন করে। ফ্যাসিবাদ শুধু জনগণের মধ্যে গভীরভাবে বদ্ধমূল সংস্কারগুলিকেই উসকিয়ে দেয় না, উপরন্তু নানাভাবে তাদের বিপ্লবী ঐতিহ্যকে কাজে লাগায়।” তিনি এও বলেন, ফ্যাসিবাদের ক্ষমতা লাভ এক বুর্জোয়া সরকার থেকে অপর এক সরকারের মামুলি উত্তরণ নয়। এ হলো বুর্জোয়া শ্রেণি কর্তৃত্বের একটি রাষ্ট্রীয় রূপ বলা যায়। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ফলে এক রাষ্ট্রীয় রূপের প্রকাশ্য সন্ত্রাসমূলক প্রতিষ্ঠা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে বিশ্ব পুঁজিবাদ কতকগুলি নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। ফলে যুদ্ধের পর থেকে ১৯৭০-এর প্রথম দু এক বৎসর পর্যন্ত এর অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটে। ১৯৪৫ সালে ব্রেটনউড চুক্তির দ্বারা বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডার গঠিত হয়। এই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য এবং কেইনসীয় অর্থনীতি রাষ্ট্রগুলিকে অধিকতরভাবে সরকারি খরচ ও অনুদানে উৎসাহ দেয় এবং সরকারি মালিকানায় বিভিন্ন শিল্প এবং শিক্ষা স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ইত্যাদি খাতে সরকারি খরচ যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধির পরামর্শ দেয়, যাতে পুঁজিবাদের একটা সুস্থ বিকাশ ঘটতে পারে এবং বেকার সমস্যাও হ্রাস পায়। উলটোদিকে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির অগ্রগতিও পুঁজিবাদী জনগণের ওপর প্রবল ছাপ ফেলতে শুরু করে। এই কারণে রক্ষাকবচ হিসেবে পুঁজিবাদী দেশগুলি এমন কতকগুলি ব্যবস্থা গ্রহণ করে যাতে মানুষের মনে হতে পারে পুঁজিবাদের মধ্যেই তার সুখ সম্ভব। আর এই লক্ষ্য নিয়েই গড়ে ওঠে কল্যাণকামী রাষ্ট্র।
বর্তমানে সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই, বিশ্বব্যাপী নেই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সেই রমরমা, সোভিয়েতের বিপর্যয়ের পর সোচ্চারে ব্যক্ত করা হয়েছিল সেই কথা - ‘ইতিহাসের মৃত্যু হয়েছে’। ব্রেজনেস্কি বলেছিলেন, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা একটি মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঐতিহাসিক বিভ্রম মাত্র। সোভিয়েত রাশিয়ার গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এবং বিশ্বায়ন বাজার অর্থনীতির প্রক্রিয়া পুনরায় চালু হওয়ায় তৃতীয় দুনিয়ায় যে দুর্দশার সৃষ্টি হয়েছে, তার কোনো তুলনাই চলে না। পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের মূল কথাই হলো সরকারি শিল্পকে ভেঙে দিয়ে ব্যক্তি মালিকানায় নিয়ে আসা এবং সরকারি ব্যয় কমিয়ে দেওয়া আর এই নীতিগুলির ফলেই তৃতীয় বিশ্বের জনগণ প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। ভয়াবহ ছাঁটাইয়ের সম্মুখীন শ্রমিক কর্মচারীরা।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি, ১৯৯১ সালে সোভিয়েতের পতন অর্থাৎ ইতিহাসের মৃত্যু এবং আদর্শেরও মৃত্যু হয়েছে। সোভিয়েত বিপর্যয়ের পরই প্রচার করা হয়েছিল অখণ্ড বিশ্বের তত্ত্ব, যার অর্থ হচ্ছে পুঁজিবাদ আমাদের মাথার ওপরে চেপে বসবে মতাদর্শগত স্তরে, সামাজিক স্তরে, অর্থনৈতিক স্তরে, সামরিক স্তরে। কিন্তু এ প্রশ্নেও থেকে যাচ্ছে শ্রমজীবীদের এত শক্তিশালী ও দৃঢ় মতাদর্শ থাকা সত্ত্বেও ধনতন্ত্রের এই দক্ষতাকে অস্বীকার করা যাচ্ছে না, কেননা ওরা অধিস্তরে পরাস্ত করতে পারছে। ফলে বর্তমানে চ্যালেঞ্জটি যেমন সাংগঠনিক স্তরে, সামাজিক স্তরে বৈপ্লবিক স্তরে পাশাপাশি বোধিস্তরে বলা যেতে পারে, শ্রমিক শ্রেণিরও মস্তিষ্কে সংগোপনে তার নিজস্ব শৈল্পিক চরিত্রকে তুলে ধরে এক ভয়ঙ্কর ধ্বংস সাধনে ব্রতী হয়েছে। বিশ্ব জুড়ে সাম্রাজ্যবাদের এই ভয়ংকর নীতিগুলির বিরুদ্ধে কী লড়াই হয়নি? ‘অকুপাই ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট’ সহ অসংখ্য আন্দোলন বিশ্বব্যাপী রাজপথকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। স্লোগান উঠেছিল বিকল্প বিশ্ব সম্ভব। কিন্তু বিকল্পটি কী? তার একটাই উত্তর-সমাজতন্ত্রই একমাত্র বিকল্প, আবার এটাও মনে রাখতে হবে, সমাজতন্ত্র মানেই সোভিয়েত মডেল নয়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বারে বারে আলোচনা করেছে সোভিয়েত বাইরে থেকে ভাঙেনি, ভেঙেছে ভেতর থেকে। বাইরে থেকে ভাঙলে তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেই ভাঙতে পারতো। মনে রাখতে হবে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলিকে যেকোনো মূল্যেই রক্ষা করতে হবে। একবিংশ শতাব্দীতে জীবনের গুণমান (Quality Of Life) বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে উৎপাদন ব্যবস্থার একটি সামাজিক চরিত্র আছে, কিন্তু মালিকানা ব্যক্তিগত। কিন্তু ভবিষ্যতে পাবলিক সেক্টরই একমাত্র ফর্ম হবে, এটা নিয়ে আলোচনা চলতে পারে। সমবায় সহ আরও অনেক কিছুই আলোচনায় আসতে পারে। সমাজতন্ত্র গঠনে বেশ কতকগুলি বিষয়ের উপর নজর রাখতে হবে -
১) নাগরিকের মৌলিক অধিকার সমূহের উপরে যেন হস্তক্ষেপ না হয়।
২) ব্যক্তি স্বাধীনতার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করতে হবে।
৩) প্রসার ঘটাতে হবে গণতান্ত্রিক অধিকার সমূহের। যে কোনো মতেরই বিরোধিতা করার অধিকার থাকতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
আসলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয় থেকে কতকগুলি ইতিবাচক দিক সূচিত না হলে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আদর্শগত যুদ্ধে পিছিয়ে পড়তে হবে। বর্তমান বিশ্বের চলার পথ কণ্টকাকীর্ণ। রক্তাক্ত হচ্ছি আমরা। পরিচিতিসত্তার নিগড়ে আক্রমণ যেন আরও তীব্র। তবু যতই আমরা রক্তাক্ত হই না কেন সত্যদ্রষ্টা কবির ভাষায় বলি যে -
“সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে গো ফুল ফুটবে
সকল ব্যথা রঙিন হয়ে গোলাপ হয়ে উঠবে”।