৫৮ বর্ষ ২৮ সংখ্যা / ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ১৩ ফাল্গুন, ১৪২৭
রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে মিছিল সমাবেশে বিকল্প সরকার গড়ার ডাক
কেশপুর থেকে আনন্দপুর বামফ্রন্ট কংগ্রেসের যৌথ পদযাত্রা।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ সামনে বড়ো লড়াই। একদিকে রাজ্যের গণতন্ত্র বিরোধী স্বৈরাচারী শক্তি, অন্যদিকে চরম সাম্প্রদায়িক-ফ্যাসিস্টধর্মী হিংস্র বিজেপি - এই দুই দলের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের জীবনজীবিকা ও রুটি রুজির স্বার্থে বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির লড়াই। তারই আবহে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে মিছিল-সমাবেশে এখন লালপতাকার দীপ্ত সমারোহ। তারই দুরন্ত উদ্ভাস মূর্ত হবে ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্রিগেড প্রান্তরে। সেদিন বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির ডাকে বিশাল সমাবেশে পাহাড় থেকে সমুদ্র বিস্তীর্ণ প্রান্তের লক্ষ-অযুত মানুষের উপস্থিতিতে উত্তাল জনতরঙ্গ বার্তা দেবে বিকল্প সরকার গড়ার। তারই অনুষঙ্গে বর্ধমানের দেওয়ানদিঘিতে ২২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এক বিশাল সমাবেশে সিপিআই(এম)-র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র বলেছেন, পাঞ্জাবের মানুষ বিজেপি-কে সাফ করে দিয়েছে, এখানেও বিজেপি-কে হঠাতে না পারলে মানুষের বড়ো বিপদ হবে। ঘাসফুল উপড়ে দিন, তাহলে বিজেপি মাথা তুলতে পারবে না। বিজেপি-কে জায়গা করে দিচ্ছে তৃণমূলই। এই দুই দলের বিরুদ্ধে সব ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি জোটবদ্ধ হচ্ছে।
এদিন দেওয়ানদিঘিতে শহিদ কমরেড প্রদীপ তা ও শহিদ কমরেড কমল গায়েনের স্মরণে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এই দুই পার্টিনেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল তৃণমূলের ঘাতক বাহিনী। এদিন সিপিআই(এম) পূর্ব বর্ধমান জেলা কমিটির ডাকে এই স্মরণ সমাবেশে এলাকায় ভূলুণ্ঠিত গণতন্ত্র পুনুরুদ্ধার ও হিংসার রাজনীতিকে পরাস্ত করার শপথ নিতে উপস্থিত ছিলেন কৃষক, খেতমজুর, শ্রমজীবী সহ বিভিন্ন অংশের মানুষ।
দেওয়ানদিঘিতে জনসভায় বক্তা সূর্য মিশ্র।
সমাবেশে সূর্য মিশ্র বলেন, খুন ও হিংসার রাজনীতি কায়েম করার জন্য যারা কমরেড প্রদীপ তা ও কমরেড গায়েনকে খুন করেছে তাদের ভুলবেন না, খুনিদের যাতে সাজা হয় সেই শপথ নিয়ে ফিরে যেতে হবে আমাদের। তিনি রাজ্য ও কেন্দ্রের দুই সরকারের জনবিরোধী নীতি ও নানা পদক্ষেপের উদাহরণ তুলে ধরে এই দুই শক্তির বিরুদ্ধে মানুষকে সংগঠিত করে শক্তিশালী বিকল্প গড়ার আহ্বান জানান। সমাবেশে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন পার্টির জেলা সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিক, পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য ও প্রদেশিক কৃষক সভার সভাপতি অমল হালদার প্রমুখ।
এছাড়াও সূর্য মিশ্র ২০ ফেব্রুয়ারি পুরুলিয়ার কাশীপুর ও পাড়াতে দু'টি কর্মীসভায় ভাষণ দিয়েছেন। কাশীপুরের তরুণ লাইব্রেরি মাঠে আয়োজিত সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রেখেছেন সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বাসুদেব আচারিয়া, সিপিআই(এম) জেলা সম্পাদক প্রদীপ রায় সহ বামপন্থী দলের নেতৃবৃন্দ। সভাপতিত্ব করেন সিপিআই (এম) নেতা কাশীনাথ ভট্টাচার্য। পাড়ার দুবড়া আমবাগানে পাড়া বিধানসভা কেন্দ্রের কর্মীসভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এম)কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অমিয় পাত্র। সভাপতিত্ব করেন পার্টি নেতা দীননাথ লোধা।
এই সমাবেশের আগের দিন (২১ ফেব্রুয়ারি) জামালপুরের নেতাজি ময়দানের এক জনাকীর্ণ সমাবেশে ভাষণ দিয়েছেন সূর্য মিশ্র। এই সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা যায় মানুষের মধ্যে। ধামসা-মাদল বাজিয়ে, লাল পতাকা নিয়ে আদিবাসী সম্প্রদায়ের অসংখ্য মানুষ আসেন সমাবেশে। গ্রাম-গঞ্জের মানুষ আসেন মিছিল করে। সমাবেশে শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।
সিঙ্গুরে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের যৌথ মিছিল।
সমাবেশে সূর্য মিশ্র বলেন, বাংলায় তৃণমূল-বিজেপি কেউ সরকার গড়তে পারবে না। ওদের এমন অবস্থা করুন যাতে একে অপরের সাথে জোট করেও সরকার গড়তে না পারে। সিপিআই(এম) জামালপুর ১ ও ২ এরিয়া কমিটির ডাকা এই সমাবেশে এছাড়াও বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এম) নেতা সমর ঘোষ, স্থানীয় বিধায়ক সমর হাজরা।
সিপিআই(এম) পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম ২২ ফেব্রুয়ারি কলকাতা ও হাওড়ার নিশ্চিন্দায় দু'টি সমাবেশে ভাষণ দিয়েছেন। সিআইটিইউ কলকাতা জেলা কমিটির ডাকে কলকাতা কর্পোরেশনের সদর দপ্তরের পাশে অনুষ্ঠিত সভায় অসংখ্য শ্রমিক-কর্মচারী জমায়েত হয়েছিলেন। সভায় মহম্মদ সেলিম বলেন, সত্যিকারের লড়াইয়ের বিউগল বাজবে ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্রিগেডে। তৃণমূল এবং বিজেপি'র কাছে শিরদাঁড়া বিকোবে না এমন সবাইকে জোটবদ্ধ করে এই লড়াই হবে।
সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের কলকাতা জেলা কমিটির সভাপতি খোকন মজুমদার। বক্তব্য রাখেন জেলা সম্পাদক দেবাঞ্জন চক্রবর্তী, মিতা ঘোষ প্রমুখ।
হাওড়ার টিকিয়াপাড়া থেকে পি এম বস্তি পর্যন্ত মহামিছিলে রয়েছেন মহম্মদ সেলিম সহ নেতৃবৃন্দ।
এদিন নিশ্চিন্দা দেশবন্ধু তরুণ সঙ্ঘের মাঠে সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেসের আহ্বানে আয়োজিত জনসভায় উপস্থিত ছিলেন বিশাল অংশের মানুষ। এই সমাবেশে মহম্মদ সেলিম বলেছেন, দীর্ঘ লকডাউনে শ্রমজীবী ক্যান্টিনের মাধ্যমে গরিব মানুষের পাশে ছিলেন বামপন্থীরা। তখন কেন্দ্র ও রাজ্য কোনো সরকারকেই দেখা যায়নি। এখন ভোটের আগে গরিব মানুষের প্রতি তারা দরদ দেখাচ্ছে। মানুষকে এদের চিনে নিতে হবে। সমাবেশে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এম)নেতা উত্তম বেরা ও কংগ্রেসের শুভংকর চক্রবর্তী।
এছাড়াও মহম্মদ সেলিম ২৩ ফেব্রুয়ারি নদীয়ার হরিণঘাটা বিধানসভা নির্বাচন কমিটি ও কল্যাণী বিধানসভা নির্বাচন কমিটির ডাকে দু’টি সভায় বক্তব্য রেখেছেন।
এই সমাবেশগুলি ছাড়াও সম্প্রতি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশপুর, হুগলির সিঙ্গুর, উত্তরপাড়া ও ডানকুনির বিভিন্ন অঞ্চলে সুদীর্ঘ মিছিলে মানুষের ঢল নামে। মিছিলগুলিতে রক্ত পতাকার উত্তাল স্রোতের সঙ্গে দেখা মেলে তেরঙ্গা পতাকাও।
২২ ফেব্রুয়ারি এক সময়ে তৃণমূলের সন্ত্রাস কবলিত কেশপুরে সিপিআই(এম) দপ্তর শহিদ জামশেদ আলি ভবনের সামনে থেকে দীর্ঘ ১০ বছর পর মহামিছিলের সূচনা হয়। সেখান থেকে আনন্দপুর বাজার পর্যন্ত ৯ কিলোমিটার জুড়ে লাল পতাকার প্লাবন দেখা যায়। দেখা যায় তেরঙ্গা পতাকাও। এই মিছিলে পুরুষ, মহিলা, যুবক, ছাত্র সহ সব অংশের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। দৃপ্ত স্লোগানে মুখরিত এই মিছিল কেবল সন্ত্রাসের আগল ভাঙেনি, প্রতিরোধেরও বার্তা দিয়েছে। ব্রিগেড সমাবেশকে সফল করার পাশাপাশি তৃণমূল-বিজেপি'র বিরুদ্ধে বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গড়ার আহ্বান সোচ্চারিত হয়েছে। মিছিল শেষে আনন্দপুর বাসস্ট্যান্ডের প্রচার সভায় বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এম)’র জেলা সম্পাদক তরুণ রায়, পার্টি নেতা তাপস সিনহা, রামেশ্বর দোলই।
২০ ফেব্রুয়ারি তৃণমূল-বিজেপি'র জনবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক নীতির বিরুদ্ধে বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির জোট সরকার গড়ার আহ্বান জানিয়ে হুগলি জেলার ডানকুনি থেকে থেকে কৃষ্ণরামপুর পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ মহামিছিল এবং বিকেলে মানকুণ্ডু সার্কাস মাঠে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। মহামিছিলে অংশ নেন এবং জনসভায় বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এম) নেতা মহম্মদ সেলিম, বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান, সিপিআই জেলা সম্পাদক দেবব্রত ঘোষসহ বিভিন্ন বামপন্থী দলের নেতৃবৃন্দ।
এছাড়াও ২১ ফেব্রুয়ারি হুগলির উত্তরপাড়া ও সিঙ্গুরে বাম-কংগ্রেসের যৌথ উদ্যোগে মহামিছিল হয়েছে। এই দু'টি মহামিছিলেই জনতার ঢল তৃণমূল-বিজেপি'র বিরুদ্ধে বিকল্প গড়ার লড়াইয়ের বার্তা দিয়েছে।
সিপিআই(এম) দুর্গাপুর পূর্ব ১, ২ ও ৩ নং এরিয়া কমিটির যৌথ আহ্বানে ২৩ ফেব্রুয়ারি দুর্গাপুরে এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিধানসভায় বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, কান্না, ঘাম, রক্তে ভেজা বাংলা আবার মাথা তুলবে। মানুষের সম্মিলিত শক্তির জমি আরও চওড়া করে তুলুন। জবাব দেবার সময় হয়ে এসেছে। ধ্বংসের সৌধের ওপর প্রাণের স্পন্দন ছড়িয়ে দিতে হবে। আমরা পারব। এই সমাবেশে তিনি ছাড়াও বক্তব্য রাখেন পার্টি নেতা ও বিধায়ক সন্তোষ দেবরায়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন পার্টি নেতা পঙ্কজ রায়। এভাবে রাজ্যের নানা প্রান্তে মিছিল-সমাবেশে বিজেপি-তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিকল্প গড়ার প্রস্তুতি চলছে।
২৪ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতার বিস্তীর্ণ অঞ্চল লাল পতাকার দৃপ্ত মিছিলে উত্তাল হয়েছে। এদিন ফতোসিংপুরের ঝাড়বনী থেকে ধাদিকা - দীর্ঘ ১৪ কিলোমিটার ব্যাপী পদযাত্রায় যৌবনের ঢল নামে। দীর্ঘ পদযাত্রায় শামিল শত-সহস্র প্রতিবাদী মানুষ হিংসা-সন্ত্রাসকে প্রতিহত করে রুটি-রুজির সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে এবং গণতন্ত্রী পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ বিক্প সরকার গড়ার প্রত্যয় ধ্বনিত করেন। এই সুদীর্ঘ পদযাত্রার সূচনা করেন সিপিআই (এম) জেলা সম্পাদক তরুণ রায়। মিছিলে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পার্টিনেতা তাপস সিনহা, তপন ঘোষ, দিবাকর ভুঁইয়া প্রমুখ।