৫৮ বর্ষ ২৮ সংখ্যা / ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ১৩ ফাল্গুন, ১৪২৭
চোরেদের চাপান-উতোর
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ তৃণমূল এবং বিজেপি’র নেতা এবং নেত্রীদের কয়লা আর গোরু পাচারের টাকার বখরা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢোকা এবং মাদক কাণ্ডে যোগ নিয়ে পারস্পরিক চাপান উতোরের মধ্য দিয়ে রাজ্যের মানুষকে বিভ্রান্ত করার বিষয়টি গোটা রাজ্যের প্রেক্ষিতে একাংশের মিডিয়ার চেষ্টা সত্ত্বেও ধরা পড়ে গেছে সবার কাছে। বিজেপি’র যুবনেত্রী পামেলা গোস্বামীর মাদক পাচারের সময় হাতেনাতে ধরাপড়া আর নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির স্ত্রী রুজিরা নারুল (ব্যানার্জি)কে তার কালীঘাটের বাড়িতে গিয়ে সিবিআই আধিকারিকরা জেরা করার ঘটনায় এখন অন্য মাত্রা পেয়ে গেল তৃণমূল কংগ্রেস এবং রাজ্য বিজেপি’র শীর্ষস্তরের নেতৃত্বের দুর্নীতি যোগের বিষয়টি। কারণ দু’টি দলই পরস্পরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার অভিযোগ তুলেছে। তবে রাজ্যের বহু মানুষের জিজ্ঞাসা, সাংসদের স্ত্রীকে বাড়তি সুবিধা দিতে তাকে বাড়িতে জেরা করা হলো কেন।
২৩ ফেব্রুয়ারি দুই মহিলা আধিকারিক সহ সাত জন সিবিআই আধিকারিক রুজিরা নারুলা (ব্যানার্জি)কে জেরা করেন। এর আগে ২১ ফেব্রুয়ারি সিবিআই আধিকারিকদের তিন সদস্যের একটি দল সমন ধরাতে গিয়েছিলেন তাঁকে। তিনি অবশ্য সেদিন বাড়িতে ছিলেন না। তবে ২৩ ফেব্রুয়ারি সিবিআই আধিকারিকদের তদন্তকারী দল পৌঁছনোর কয়েক মিনিট আগে মমতা ব্যানার্জি অভিষেক ব্যানার্জির বাড়ি ‘শান্তিনিকেতনে’ পৌঁছে গিয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমের হিসেব অনুযায়ী তিনি সেখানে ছিলেন প্রায় ৯ মিনিট। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর এক অভিযুক্তের বাড়িতে সিবিআই’র জেরার ঠিক আগে যাওয়ার প্রসঙ্গে ওঠা বিতর্কের জেরে সাফাই দিতে শোনা যাচ্ছে অন্যত্র মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, পারিবারিক অভিভাবক হিসেবেই তিনি সিবিআই জেরার আগে অভিষেক ব্যানার্জির বাড়িতে গিয়েছিলেন। তিনি চলে যাবার পরই সিবিআই তদন্তকারীদের দল ঢোকে অভিষেক ব্যানার্জির বাড়িতে।
নরেন্দ্র মোদী ২২ ফেব্রুয়ারি এরাজ্যে এলেও মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোর বাড়িতে সিবিআই আধিকারিকদের তদন্ত করতে যাওয়া প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করেননি সরাসরি। তাই রাজ্যজুড়ে প্রশ্ন উঠেই গেছে এতদিন চুপচাপ বসে থাকার পর হঠাৎ করে সিবিআই’র জেগে ওঠা কি বিধানসভা ভোটের মুখে তৃণমূল-বিজেপি’র ছদ্ম কুস্তির পয়লা রাউন্ড?
নির্দিষ্ট প্রশ্নের ভিত্তিতে মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোর বউকে প্রায় ঘণ্টাখানেক জেরা করার পর সিবিআই আধিকারিকরা চলে যান। জানা গেছে, রুজিরা নারুলা (ব্যানার্জি)কে জেরা করে নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত বেশ কিছু প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাননি তাঁরা। বেশ কিছু বিষয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে বলে মনে করছেন সিবিআই গোয়েন্দারা। রুজিরার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকার উৎসের সন্ধানে রুজিরার আয়ব্যয়ের নথি পেতে এখন সচেষ্ট সিবিআইয়ের দুর্নীতি দমন শাখার অফিসারেরা। গোয়েন্দাদের প্রশ্ন, রুজিরা কি কোনো সংস্থার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন? না কি তিনি গৃহবধূ? যদি গৃহবধূ হন, তা হলে প্রতিমাসে তাঁর অ্যাকাউন্টে বিপুল পরিমাণে টাকা কোথা থেকে আসত? আর যদি তা না হয়, তা হলে তিনি কোন্ সংস্থার (রেজিস্টার্ড) সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন? ওই সংস্থার আয়ব্যয়ের তথ্যের সঙ্গে তাঁর পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট সংক্রান্ত নথিপত্রও খতিয়ে দেখার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সংবাদে প্রকাশ রুজিরা নারুলা (ব্যানার্জি)র বোন মেনকা গম্ভীরকে এর আগে কলকাতাতে তার অ্যাকাউন্টে ঢোকা টাকা সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর পঞ্চসায়রের বাসভবনে দীর্ঘক্ষণ জেরা করে সিবিআই। মুখ্যমন্ত্রীর পারিবারিক অভিভাবকত্বে থাকা এই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের জেরার ঘটনায় শাসক তৃণমূল গোটা ঘটনাকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে অভিযোগ করেছে। অভিষেক ব্যানার্জি ট্যুইট করে জানিয়েছেন, ‘আমাদের মাথা নত করা যাবে না’। তবে সিবিআই’র হাতে যে তথ্য এসেছে তাতে তৃণমূলের মাথা উঁচু করে চলার সুযোগ কম। কয়লা পাচারের বিপুল পরিমাণ টাকা একাধিক ভুয়ো সংস্থা হয়ে ঢুকেছে ব্যাঙ্ককের একটি ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে। টাকার পরিমাণ মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। টাকা ঢুকেছে নিয়ম করে। টাকা ঢুকেছে একাধিক সংস্থার মাধ্যমে। সেই সব সংস্থা আসলে ভুয়ো বা শিখণ্ডি। সেই সব সংস্থা মূলত কয়লা মাফিয়া লালা ও গোরু পাচারের কিংপিন এনামুল হকের তৈরি। সমন্বয় রক্ষা করে টাকা প্রতি মাসে ঐ নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ, যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক বিনয় মিশ্রের মাধ্যমে। অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের নাম রুজিরা নারুলা (ব্যানার্জি)।
শাসকদলের অন্যতম শীর্ষনেতা যাকে তৃণমূলের অন্দরেই ‘ওয়েটিং চিফ মিনিস্টার’ বলা হয়, অভিযোগ, সেই সাংসদের স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে ঢুকছে কয়লা-গোরু পাচারের টাকা। সেই কয়লা পাচারের তদন্তে গত পাঁচ মাস দেশছাড়া যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক - পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এই চিত্র বেমানান ছিল এক দশক আগে পর্যন্ত।
এ প্রসঙ্গে পরে জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, বিজেপি’র হাতে বাংলার মা-বোনেরাও নিরাপদ নয়। ঘরের বউকে কয়লা চোর বলছে। আমার বাড়িতে ঢুকে বউকে অপমান করেছে। তবে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতা বিমান বন্দরে সোনা চোরাচালানে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছিল রুজিরা নারুলা (ব্যানার্জি) ও তাঁর এক আত্মীয়ের বিরুদ্ধে। মুখ্যমন্ত্রী তখন চুপচাপ ছিলেন। মন্তব্য করেননি। কেন করেননি উঠেছে সেই প্রশ্নও।
বিজেপি এখন যাই বলুক দলে তৃণমূলের দাগীদের নেওয়ার আগে তারা বলেছিল, সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত হবে, কয়েক লক্ষ প্রতারিত মানুষের টাকা যারা লুট করেছিল বা লুটে সাহায্য করেছিল তাদের কোমরে দড়ি পরানো হবে, শাস্তি হবে। এই সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ। কিন্তু কিছু হয়নি। নারদ স্টিং অপারেশনেও প্রকাশিত ঘুষ নেবার ঘটনার পরেও তাই-ই ঘটেছে। অভিযুক্তদের অনেকে এখনও তৃণমূলে। আর কয়েকজন বিজেপি-তে গিয়েছেন।
রাজ্যের মানুষের অভিজ্ঞতা হলো, একের পর এক দুর্নীতিতে অভিযুক্ত তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্তের কাজ চলছে কচ্ছপের গতিতে। নির্বাচন আসলেই তা নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হয়। চোরেরা খুলেআম ঘুরে বেড়ায়, দল বদলে অন্য দলে যায় আর আগের দলকে চুরি আর দুর্নীতির আখড়া বলে। আর পুরনো দল তাদের লুটেরা বলে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজন পোষণের অভিযোগ আনে। তৃণমূল-বিজেপি দু’পক্ষই সমান - এটাই মানুষের উপলব্ধি।
তৃণমূল সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির বাড়িতে সিবিআই’র জেরা প্রসঙ্গে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেছেন, চোর ধরার নামে তৃণমূল বিজেপি’র নাটক চলছে। সত্যিকারের সদিচ্ছা থাকলে এখনই ধরুক সিবিআই। তার বদলে তামাশা চলছে।
২৮ ফেব্রুয়ারি ব্রিগেড আছে বলে নজর ঘোরাতে এসবই পরিকল্পিত নাটক। কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা ইডি, সিবিআই-কে ব্যবহার করা হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারির মেজাজকে ভয় পেয়ে এসব করা হচ্ছে।