৫৮ বর্ষ ২৮ সংখ্যা / ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ১৩ ফাল্গুন, ১৪২৭
রেগার প্রকৃত রূপায়ণের জন্য চাই দেশব্যাপী দৃঢ় শ্রমিক আন্দোলন
‘এই প্রকল্প দেশের শ্রমিকদের অলস করে দিচ্ছে’। ‘এখন এই শ্রমিকরা কাউকে মানতে চায় না’। ‘এদের নিয়ে চলা এখন অসম্ভব হয়ে উঠেছে’। দৈনন্দিন জীবনে রেগা শ্রমিকদের সম্পর্কে আকছার এই ধরনের মন্তব্য কোথাও কোথাও শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার আরও এক ধাপ এগিয়ে বলছেন, এবং প্রশ্ন তুলছেন এই প্রকল্পের যৌক্তিকতা সম্পর্কে। অবিলম্বে এই প্রকল্প বন্ধ করার পক্ষে সওয়াল করছেন কিছু মানুষ। মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট (এমএনরেগা) প্রকল্প সম্পর্কে বেশ কিছুদিন ধরেই এই ধরনের নানা মন্তব্য আমাদের কানে আসছে। গ্রাম্য ধনী সম্প্রদায় পর্যন্ত এই প্রকল্প সম্পর্কে তাদের অপছন্দ ব্যক্ত করেছেন বারবার। এর পাশাপাশি আবার অনেকেই মনে করেন গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের জন্য এই প্রকল্প সহায়তামূলক।
এই প্রকল্প আইন ইউপিএ সরকারের মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। হাজার হাজার মিছিল-মিটিং কনভেনশন সংগঠিত হয় এই আইন পাশ করানোর দাবি নিয়ে। সরকারের কাছে দাবি করা হয় অবিলম্বে কর্মসংস্থান করতে হবে অথবা গরিবদের দু’মুঠো অন্নের সংস্থান করতে হবে। দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের ফসল হিসেবে এমএনরেগা বাস্তবায়িত হয়।
জরুরি অবস্থা শেষ হবার পশ্চিমবঙ্গে কমরেড জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার পর (১৯৭৭) যে প্রকল্প শুরু করে সেই দিশা অনুসরণ করেই এই রেগা প্রকল্প তৈরি হয়। সে সময় সীমিত ক্ষমতার মধ্যে থেকেও বামফ্রন্ট সরকার বেকারদের ভাতা দেওয়া শুরু করে। একই সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে মানুষের হাতে কাজ না থাকলে প্রতিদিন এক কিলো চাল এবং এক টাকা করে পরিবার পিছু বন্টন করা শুরু করে। বামফ্রন্ট সরকারের নেওয়া এই পদক্ষেপ সহ অন্যান্য নানা জনমুখী উদ্যোগে বামফ্রন্ট সরকারের জনপ্রিয়তা গ্রামীণ এলাকায় দ্রুত বিস্তার লাভ করতে শুরু করে।
এই প্রকল্পের সুবিধাপ্রাপকদের বর্তমান পরিস্থিতি এবং সম্পদ সৃষ্টিতে তাদের শ্রমের প্রভাব পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। এটা করলেই প্রকল্প লাগু করার প্রেক্ষিত এবং গুরুত্ব বোঝা যাবে। সরকার কি এই প্রকল্পে শ্রমিকদের জন্য টাকার জোগান দিয়ে তার টাকা নষ্ট করছে, নাকি শ্রমিকরা শোষিত হচ্ছেন এটাও আজকের দিনের অন্যতম প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন।
শ্রমিকরা বিভিন্ন চরম পরিস্থিতির সম্মুখীন হন রুজির প্রশ্নে। প্রখর গ্রীষ্মে ঝুঁকি নিয়ে বাধ্য হন কঠিন পরিশ্রম করতে। লেক বা খাল থেকে, জলাধার থেকে কাদা মাটি তোলার মত দুরূহ কাজে যুক্ত থেকে তাঁরা বাধ্য হন রুজি-রুটির জোগাড় করতে। ওই সময় অন্যান্য কাজ পাওয়া যায় না। সমাজের অন্যান্য অংশের মানুষ যখন ছায়ায় থাকে পাখার তলায় থাকেন, এসি বা কুলার চালিয়ে বিশ্রাম নেন তখন দিনমজুররা তাদের যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘাম ঝরিয়ে শ্রম দিয়ে জীবিকা অর্জন করেন। এইসময় মহিলা শ্রমিকরাও পিছিয়ে থাকেন না। তারা জলাধার বা খাল থেকে তোলা মাটি বহু দূরে নিয়ে যাওয়ার কাজে নিয়োজিত থাকেন। এইসব যাবতীয় কাজের ছবি ও বিবরণ ইতিবাচক ভাবে মিডিয়াতে ফলাও করে ছাপাও হয়।
এই রেগা শ্রমিকদের মুখ্য সমস্যা হলো সঠিক মজুরি না পাওয়া। যে মজুরি তাঁদের দেওয়া হয় তা তাঁদের কাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, অত্যন্ত কম। উদাহরণ হিসেবে অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তেলেঙ্গানার কথা তুলে ধরা যেতে পারে। এই দুটি রাজ্য সরকার প্রকল্প শ্রমিকদের জন্য দু’রকম মজুরি দিচ্ছেন। আট ঘন্টা খোঁড়াখুড়ির কাজের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন আর কৃষিকাজের জন্য দিন পিছু ৫ ঘন্টা নির্দিষ্ট। কোনও ক্রমে বেঁচে থাকা এবং দু’মুঠো অন্নের জন্য শ্রমিকরা এই বৈষম্যমূলক শর্তেও কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই মজুরেরা দিন পিছু মজুরি পান মাত্র ২৩৭ টাকা। আমাদের দেশের গণতন্ত্রের মহিমা হল, শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এই শ্রম ঘণ্টা এবং মজুরি ঠিক করে না শাসকশ্রেণি।
এই রাজ্যগুলিতে সরকারগুলির লক্ষ্য হলো জলের উৎসের পরিমাণ বাড়ানো। তবে মজুরির টাকা জেলা ভেদে এক এক রকম। দিন পিছু কোন জেলায় ২৩৭ টাকা আবার কোন জেলায় ৪৩৯ টাকা। রুজির কোনও বিকল্প না থাকায় শ্রমিকরা এই বৈষম্য মেনে নিতে বাধ্য হন।
কৃষিক্ষেত্রে রেগা শ্রমিকদের ব্যাপক অবদান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাঁধ থেকে খাল, কৃষিজমি থেকে বৃক্ষরোপণ- সর্বত্রই জলের উৎস থেকে সামাজিক উৎসগুলি সমৃদ্ধ হচ্ছে।
কিন্তু বাস্তব হলো এই ২৩৭ টাকাও এই শ্রমিকরা পান না। অদ্ভুত হিসেবের জেরে তাঁরা বঞ্চিত হন। অন্ধ্রপ্রদেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, যে কাজের স্লিপ এই শ্রমিকদের দেওয়া হচ্ছে সেখানে কর্ম দিবস হিসেবে লেখা রয়েছে ৭ দিন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রবিবার দিনটিকেও যুক্ত করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদের দেওয়া হয়েছে মোট ৪২৮ টাকা। অদ্ভুত যুক্তি দিয়ে বলা হচ্ছে, প্রতি কিউবিক মিটার পিছু মাটি তোলার হিসাব ২৩৭ টাকা ধরে এই টাকা মজুরি হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ দিন প্রতি ৬১ টাকা ১৪ পয়সা হিসেবে সপ্তাহের শেষে তাদের হাতে তুলে দিয়ে ঠকানো হচ্ছে।
রেগা প্রকল্পের শ্রমিকদের যন্ত্রণা এখানেই শেষ হচ্ছে না। কাজের ক্ষেত্রেও সরকারের সুপারভাইজার এবং সোশ্যাল অডিট টিম শোষণ করতে কসুর করছে না। নির্ধারিত সময়ের কাজের বাইরেও তাদের বাড়তি শ্রম দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। অতিরিক্ত মাটি কেটে বা অন্যান্য কাজে।
অন্ধ্রপ্রদেশে রেগার জব কার্ড রয়েছে ৯৪ লক্ষ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ৪.১১ লাখ পরিবার ১০০ দিনের কাজ পেয়েছে। অর্থাৎ মাত্র ৪.৩৬ শতাংশ। আইন অনুযায়ী যে কার্ড হোল্ডার শ্রমিক কাজ পেলেন না তাকে বেকার ভাতা দেওয়ার কথা সরকারের। কিন্তু সরকারগুলি এসব নিয়ে ভাবতে রাজি নয়।
কাজের দিন এবং ঘণ্টার হিসেবে বৈষম্য এবং অসততা আর কার্ড থাকা সত্ত্বেও কাজ না পেয়ে যাঁরা বেকার ভাতাটুকু পেলেন না, তাঁদের মনে এই রেগা সম্পর্কে হতাশা জাগিয়ে তোলার প্রবণতা সরকারের এবং শাসকশ্রেণির তরফে স্পষ্ট। দেখা গেছে রেগার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকরা অধিকাংশই দলিত এবং গিরিজন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। এই সম্প্রদায়গুলি থেকে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও বেঁচে থাকার তাগিদে ৪০ শতাংশ মানুষ আসছেন। আর বাকি ৫৯ শতাংশ হলেন গ্রামীণ মহিলা। সরকারগুলির পক্ষ থেকে সমাজের পিছিয়ে থাকা অংশের মানুষকে সামনে তুলে আনা বা সামাজিক ন্যায় দেওয়ার ভাষণ তাই দেশের বিভিন্ন রাজ্যগুলিতে পরিণত হয়েছে ফাঁকা বুলিতে। গ্রামীণ শ্রমিকদের দৃঢ় আন্দোলনই পারে এই অবস্থার বদল ঘটিয়ে রেগার প্রকৃত রূপায়ণ নিশ্চিত করতে।