E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ২৮ সংখ্যা / ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ১৩ ফাল্গুন, ১৪২৭

সোচ্চার চিন্তা

নাৎসি সাম্রাজ্যবাদের মতো মানসিকতা, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ এবং বিজেপি’র নতুন অ্যাজেন্ডা

পল্লব সেনগুপ্ত


সেদিন সাতসকালেই শ্রীমান ঘণ্টুরাম এসে হাজির হাতে একখানা খবরের কাগজ নিয়ে এবং বেশ উত্তেজিতভঙ্গিতে। ওর এই রকমটা আমি বেশ ভালই চিনি! নিশ্চয়ই কোনো একটা খবর পড়ে ওর মেজাজ টং হয়ে গেছে এবং সেই কথাটা এসে জানানোর জন্যে ভূ-ভারতে ওর একটাই লোকঃ এই অভাজন, ওরফে ওর তিনটে বাড়ি পরের জেঠু! তখনও আমি খবরের কাগজগুলো হাতে পাইনি; তাই ঘটনাটা কী হতে পারে, কিছু আন্দাজ না পেয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালুম শ্রীমানের দিকে। ফটাস্ করে পাকানো কাগজখানা টেবিলের ওপর ছুঁড়ে ফেলে রাগতস্বরে বলল ওঃ ‘দ্যাখো, ওরা ফের কী কাণ্ড করছে!’ কী দেখব, কারা কী করছে, তাতে ঘণ্টুর এত চটে যাবার কারণটা কী - কিছুই বুঝলুম না! তবে, ও-ই তারপরে গড়গড়িয়ে ওর এত উত্তেজনার হেতুটা কী, তা’ বলল। ঘটনাটা আপনাদেরও অজানা নয় এদ্দিনেঃ ত্রিপুরার মান্যবর মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমদ্‌ বিপ্লব দেব মশাই ফের একখানি রাজনৈতিক মূঢ়বাচন উগরেছেন যে, অচিরেই (না-কি) মহামান্য অমিত শাহের নেতৃত্বে বিজেপি প্রতিবেশী নেপাল এবং শ্রীলঙ্কায় নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। বিপ্লব দেব বাবুর নানান হাস্যকর ‘দৈবীবচন’ এর আগেও আমাদের চোখে পড়েছে সংবাদপত্র মারফত, কিন্তু সে সবই ছিল আমাদের দেশের জাতি, সংস্কৃতি, ধর্ম - ইত্যাদির মধ্যেই আবদ্ধ। কিন্তু এবারে তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তাঁর বাক্যবিভূতি ছড়িয়েছেন। আর তাতেই ঘণ্টুরাম এখন কুপিত! এরফলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও খারাপ হয়ে যাবে - এটাই ওর বক্তব্য। ওকে ঠান্ডা করার জন্যে আমি একটু নরম গলাতেই বললুমঃ ‘‘তাতে কী হলো, সেই কতকাল আগেই তো ডি এল রায়, সত্যেন দত্তের মতো বড়ো-বড়ো সব কবিরা তিব্বত, চীন, জাপান, সিংহল, শ্যামদেশ, জাভা, সুমাত্রা, কম্বোজ প্রভৃতি দেশে অতীতে আমাদের উপনিবেশ গড়ার কথা নিয়ে লিখেছিলেন তো! তাতে যখন কোনো সমস্যা হয়নি তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে, তাহলে এখনই বা অশান্তি কেন হবে?’’

ঘণ্টু এর উত্তরে যা বলল, তাতে সত্যিই আমারও আর ওর কথায় সায় না দিয়ে উপায় থাকল না। ঘণ্টুর বক্তব্য, ওসব তো ছিল সাহিত্যের ব্যাপার, পরাধীন দেশের মানুষকে চাগিয়ে তোলার জন্যে। আর এখন কথা বলছে এক উচ্চপদস্থ রাজনীতিওলা - ভারতের শাসকদলের এক বড়ো নেতা, একটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। আর কবিরা তো আসলে ভারতীয় সংস্কৃতি বিস্তারের কথা বলেছেন ওসব দেশের পটভূমিতে, কিন্তু এই ‘বৈপ্লবিক’ ভাষণ যে একেবারে সরাসরি রাজনৈতিক কথাবার্তায় ঠাসা!

অস্বীকার করতে পারলুম না ওর কথা। ততক্ষণে আমাদের বাড়ির কাগজও এসে গেছে, পাতা উলটে খবরটা নিজেও দেখা গেল। এবং নেপাল ও সিংহলের সরকার যে সঙ্গে-সঙ্গেই তীব্র প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছে বিপ্লবচন্দ্রের অমন বুঝ্‌ভুম্বলি মূঢ়তার বিরুদ্ধে, সেটাও দেখলুম। অতএব এই অভাজনকেও ব্যাপারটার রাজনৈতিক দিক নিয়ে শ্রীমানকে কিছু কথা বোঝাতে হলো। নইলে হঠাৎ করে এইসব নিয়ে ত্যাড়াব্যাঁকা পদ্য লিখে সেটা হয়ত ফেসবুকে দেবে, আর পরিণামে রাষ্ট্রদ্রোহ-ট্রোহের অভিযোগে অ্যারেস্ট হয়ে বেফায়দা পুলিশি ধোলাই খাবে! আর নয়ত নব্যগেরুয়াধারী কিছু উঠতি গুন্ডা এসে ওর বাড়িতে হামলা করবে। সুতরাং ওকে যতটা না, ওর বয়স্ক বাবা-মা’কেই নিরাপদে রাখার চেষ্টায় শ্রীমানকে আমার কথাবার্তা শোনানোর জন্যে জোর করেই প্রায় - চায়ের কথা-টথা বলে বসালুম।

।। দুই ।।

ঘণ্টুকে বোঝালুম যে, বিপ্লব দেব বাবু হরহামেশাই লোকহাসানো-ভুলভাল বকেন ঠিকই - কিন্তু এই বারের নেপাল, সিংহলে ‘‘আগলি বার, ভাজপা সরকার’’ মার্কা দুর্ভাষণটি ওঁর ছেমোপনা নয়, রীতিমতো ওঁদের পার্টির ঘোষিত পলিসির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।... আসলে এই নেপালে, শ্রীলঙ্কায় ‘বিজেপি রাজ’ আইডিয়াটার উদ্‌গাতা হচ্ছে আরএসএস, যারা বস্তুত বিজেপি’র তাত্ত্বিক ঠিকেদার! ওদের একটা পরম আহ্লাদের জিগির হচ্ছে ‘অখণ্‌ড্‌ ভার্ত’ - অর্থাৎ, ‘অখণ্ড ভারত’ যার অন্তর্গত বলে বলা হচ্ছে কান্দাহার থেকে আরাকান অবধি, তিব্বত থেকে সিংহল পর্যন্ত, পুরো অঞ্চলটাকেই। ঘণ্টুকে দেখালুম ওদের মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এর একটা স্পেশাল আর্টিকেল-এর একটা প্রবন্ধের কাটিং। সেখানে যা লেখা হয়েছে (আমার অপটু অনুবাদেই যেটা আপনাদের কাছে তুলে দিচ্ছি) - তাহলো এইঃ ‘‘অখণ্ড ভারতের ধারণাটির উদ্‌গাতা হলেন চাণক্য, খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে তাঁর লেখা ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে এটি প্রথম আলোচিত হয়েছিল। এখন যাকে ভারতীয় উপমহাদেশ বলা হয়, তার অন্তর্গত আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, তিব্বত, ভুটান, বাংলাদেশ ও ব্রহ্মদেশ - সবই সেই ‘অখণ্ড ভারত’ চিন্তার মধ্যে ছিল। চাণক্যর সময়ে এই সমস্ত এলাকা ছোটো ছোটো বহু রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। চাণক্যর এই ভাবনার মূল কথা হলো, এই বিরাট ভূখণ্ডের সর্বত্রই একই শক্তির শাসনাধীন থাকা।’’ (স্মরণযোগ্যঃ ‘অর্থশাস্ত্র’ বইটি রচিত হয়েছিল কৌটিল্যের নামে!) ওর রাগ কিছুটা কমলেও, পুরো নিরসন হলো না। তখন বাধ্য হয়েই আলমারি থেকে ধুলো ঝেড়ে ‘অর্থশাস্ত্র’-র রাধাগোবিন্দ নাথের করা পূর্ণাঙ্গ অনুবাদটা বার করে, খুঁজে-পেতে প্রাসঙ্গিক পৃষ্ঠাটি ওকে পড়ালুম। কিন্তু তার পরেই ঘণ্টু যে মোক্ষম প্রশ্নগুলি করল, তার জবাব ভাই তৎক্ষণাৎ মুখে জোগালো না আমার! পরে ওসব নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা করা যাবে’ খন এই বলে তখন ওকে কোনোরকমে নিরস্ত করা গেল বটে, কিন্তু ওর প্রশ্নগুলোর যুক্তি কিন্তু মনে-মনে মানতেই হল!

।। তিন ।।

ঘণ্টুর বক্তব্য ছিলঃ (এক) ২৪শো বছর আগে কৌটিল্য-ওরফে-চাণক্যে’র ‘অর্থশাস্ত্র’ বইতে যা লেখা আছে, সেটা এখনও অনুসরণ করতে চাওয়াটা কতখানি সুস্থ বুদ্ধির লক্ষণ? বিপ্লব দেব মশাই না হয় একক ব্যক্তি (তাও তিনি ‘অর্থশাস্ত্র’-র মতো জটিল বইটি পড়া তো দূরের কথা, নামও শুনেছেন কি না, সন্দেহ!) - কিন্তু এতবড়ো একটা পার্টি, যারা দাবি করে পৃথিবীর বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদেরকে, তারা এহেন রাজনৈতিক মূঢ়তা দেখায় কী করে? তাও সেটা নিজেদের তাত্ত্বিক মুখপত্রে?

(দুই) যে বিজেপি, এই বিশাল কৃষক-আন্দোলন সম্পর্কে ভিন দেশের একটা অল্পবয়সিনী মেয়ে কিছু ট্যুইটার পোস্টিং করলেও, আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ‘নাক গলানো’ হচ্ছে বলে ফুঁসে ওঠে, তারাই আবার অন্য দুই পড়শি দে‍‌শের রাষ্ট্রক্ষমতা নিজেদের হাতে পাবার খোয়াব দেখে কোন্‌ নির্লজ্জতায়? এ তো ‘নাক গলানো’ নয়, মুণ্ডু থেকে পায়ের পাতা অবধি সবটাই গলিয়ে দেবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ নয় কি?

(তিন) এমনিতেই তো নেপাল এবং শ্রীলঙ্কা - দুই দেশের সঙ্গেই মোদীবাবুর আমলে ভারতের কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কে নানান টানাপড়েন চলছে যেখানে, সেখানে এই ধরনের সেয়ান-পাগলামি কি আসলে রাজনৈতিক কাঁচাবুদ্ধিরই পরিচয় দিচ্ছে না?

(চার) ঠিক এইভাবেই তো একদা হিটলারি-শাসনের সময়ে জার্মানি ইয়োরোপের ছোটো-ছোটো রাষ্ট্রগুলোকে ‘‘এক রাজছত্রতলে বেঁধে’’ দেবার উদ্‌যোগ নেয় এবং ইঙ্গ-ফরাসি-অবিমৃষ্যকারিতায়, তাতে সফলও হয়। তাহলে চাণক্যর দোহাই পেড়ে বিজেপি’র এই আগ্রাসনের আকাঙ্ক্ষা কি পুরোদস্তুর ফ্যাসিবাদী ঘরানারই নয়?

(পাঁচ) এই ধরনের কথাবার্তা বলার জন্য বিপ্লব দেবকে মোদীবাবু এবং শাহবাবু কোনওভাবে সেন্সর না করায়, এটাই কি বুঝতে হবে, এমন ভাবনার উৎস ওঁরাই-তথা-কেন্দ্রীয় সরকারই? এতে তো অচিরেই প্রতিবেশী মহলে ভারত নির্বান্ধব হয়ে যাবে না-কি! (ঘণ্টু তখনও জানত না, কিন্তু পরের দিনই নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রদীপ গাওয়ালি এবং শ্রীলঙ্কার নির্বাচন কমিশনার নির্মল পুনচিহেওয়া ওই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সরকারিভাবে দুই দেশও তাদের বিরক্তি জানিয়েছে, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার পত্রপত্রিকাও এ ব্যাপারে তীব্র মনোভাব - অবশ্যই ভারতবিরোধী - জানিয়েছে)।

আসলে, ‘অর্গানাইজার’ পত্রিকায় যেটা লেখা হয়েছে ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থের দোহাই পেড়ে, সেটা গত শতক থেকেই গোলওয়ালকর তাঁর লেখাপত্রে, ভাষণে কম বেশি ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। এখন বিজেপি তাঁর সামগ্রিক প্রতিষ্ঠা চাইছে ভারতের তাত্ত্বিক দিশারি হিসেবে, তাই যত্রতত্র তাঁর বিপজ্জনক চিন্তাগুলোকে জনমানসে ঢুকিয়ে দিতে চাইছে। যে কথাগুলো বিপ্লব দেবের মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে তার প্রত্যক্ষ প্রেরণা ‘অর্গানাইজার’ পত্রিকার ওই প্রবন্ধ হলেও, পর্দার আড়ালে রয়েছে গোলওয়ালকারী ভাবনাই। সুতরাং, শেষ অবধি ব্যাপারটা নিয়ে জল আরও ঘোলা হলে, বিপ্লব দেবের কথাটাকে ‘‘অনুমোদন করি না’’ বলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এড়িয়ে যাবে। ‘অর্গানাইজার’-এ খুব বেশি হলে দু’-একটি আপত্তি জানানো চিঠি বেরোবে। ব্যস! কিন্তু ‘গুরুজি’ থাকবেন মেঘের আড়ালে, তাঁর গায়ে নিন্দের ছিটেফোঁটাও লাগবে না! অথচ অমন বিপজ্জনক একটা ভাবনাকে জনমানসের সামনে ভাসিয়েও দেওয়া যাবে। ভাই, এটা পুরোদস্তুর ‘গোয়েবল্‌সীয়’ কায়দা। ...ঘণ্টুকে ব্যাপারটা বোঝাতে হবে।