৫৮ বর্ষ ২৮ সংখ্যা / ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ১৩ ফাল্গুন, ১৪২৭
শ্রমআইনের আক্রমণে শ্রমিক আক্রান্ত
বিশ্বম্ভর মণ্ডল
দেশে কৃষক আন্দোলন নিয়ে সরকার খুব চাপে আছে। নিজেদের মনের মতো সমাধানে কিছুতেই রাজি করানো যাচ্ছে না, এটাও সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে আছে, সেটাও সর্বাংশে সত্য - তাতেও সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটাই শেষ সত্য নয়। দেশের সরকারের কাজের একটা ধরন এরা একটা ইস্যুতে আটকে গেলে গোপনে অন্য ইস্যুকে এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে। এই প্রবন্ধে তেমনই একটি ইস্যু নিয়ে আলোচনা করব, যা কৃষক আন্দোলনের সাফল্যের উত্তাল শিখার আড়ালে যেন ঢাকা পড়ে না যায়।
দেশে অর্থনীতি পুনর্গঠনের নামে কর্পোরেট শিবির সরকারকে জানিয়েছে, দেশ থেকে তিন বছরের জন্য শ্রমআইন তুলে দিতে হবে। কর্পোরেটমুখী সরকার শ্রমিকদের মঙ্গলের গল্প আর আশ্বাসবাণী শুনিয়ে মোট চারটে আইন করে ফেলেছে। কোড অব ওয়েজ বিল ২০১৯, অকুপেশনাল সেফটি-হেলথ অ্যান্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশনস কোড ২০২০, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস কোড ২০২০ এবং কোড অন সোশ্যাল সিকিউরিটি ২০২০। এছাড়াও উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ অধ্যাদেশ জারি করে যথাক্রমে ৪০টি ও ৩৮টি শিল্পকে শ্রমআইন থেকে ছাড় দিয়েছে। গুজরাটে সাময়িকভাবে শ্রমআইন তুলে দেওয়া হয়েছে। ত্রিপুরা সহ ৬টি রাজ্যে কাজের সময় ৮ ঘণ্টার বদলে ১২ ঘণ্টা করা হয়েছে। শ্রমআইন তুলে দেবার মানে কারখানা আইন, শ্রম বিরোধ আইন সহ যাবতীয় শ্রমিক সুরক্ষার ব্যবস্থা তুলে দেওয়া। নতুন শ্রমআইনগুলির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক উল্লেখ করছি। পাঠক বিবেচনা করবেন সেগুলো শ্রমিক স্বার্থে করা পদক্ষেপ বলা যায় কি না।
কোনো রাজ্যে কোনো ঠিকাদার সংস্থার অধীনে কতজন কাজ করেন, নতুন আইনে তার কোনো হিসাব পাওয়া যাবে না। সবাই জানি যার হিসাব থাকে না, সরকারের কাছে তার কানাকড়ি মূল্য নেই। যে সব কারখানায় ২০ জন বা তার বেশি শ্রমিক কাজ করেন, যেখানে বিদ্যুৎ লাগে এবং যে সব কারখানায় ৪০ জন বা তার বেশি শ্রমিক কাজ করেন, যেখানে বিদ্যুৎ লাগে না, এমন কারখানার শ্রমিকরা নতুন লেবার কোডের বাইরে থাকবেন। কাজের জায়গায় দুর্ঘটনা, স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন হলে সরকার ন্যূনতম দায়িত্ব নেবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৫০ শতাংশ ও বেসরকারি সংস্থার ৭০শতাংশ চুক্তিশ্রমিক। অথচ ‘কন্ট্রাক্ট লেবার অ্যাক্ট’টাই তুলে দেওয়া হয়েছে। যেসব ঠিকাদার সংস্থায় ৫০ জনের কম ঠিকাশ্রমিক কাজ করেন তাঁদের আর লাইসেন্স লাগবে না। অর্থাৎ এই সব সংস্থার ঠিকাশ্রমিকদের ন্যূনতম অধিকারটুকুও থাকছে না। কন্ট্রাক্ট লেবার অ্যাক্ট ও সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে স্থায়ীপদে নিযুক্ত ঠিকা চুক্তিশ্রমিকদের একই বেতন ও অন্যান্য সুবিধার যে অধিকার ছিল, তা তুলে দেওয়া হয়েছে নতুন কোডে। ঠিকাশ্রমিকদের বেতন ও সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে এতদিন মূল নিয়োগকর্তার যে বাধ্যবাধকতা ছিল সেটা তুলে দেওয়া হয়েছে। ঠিকাশ্রমিকদের বেতন সংক্রান্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য ‘সেন্ট্রাল অ্যাডভাইসরি কন্ট্রাক্ট লেবার বোর্ড’-এর মাধ্যমে ত্রিপাক্ষিক আলোচনার যে সুযোগ ছিল তাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের ওভারটাইমের মজুরির সুযোগ থাকছে না। বাড়তি শ্রমের জন্য বাড়তি মজুরির ধারণা তুলে দেওয়া হচ্ছে। বলা হয়েছে সপ্তাহে ৬ দিন কাজ। তবে সরকার চাইলে সপ্তাহের ১ দিন ছুটিটা ২ মাসের মধ্যে কোনো দিন দিতে পারে। যে কোনো কারখানায় বা শিল্প সংস্থায় শ্রমিকদের পেশাগত নিরাপত্তা, দুর্ঘটনা এড়ানোর নিয়মবিধি মানা হচ্ছে কিনা দেখার জন্য ইন্সপেক্টররা যখন খুশি নজরদারি চালাতে পারতেন। নতুন কোডে, সরকারের রেজিস্টার্ড পোর্টাল থেকে অনুমতি নিয়ে নজরদারি চালাতে হবে। মিনিমাম ওয়েজ ইন্সপেক্টরদের ক্ষমতাও ছাঁটাই করা হয়েছে। আইন ভঙ্গকারী মালিকদের বিরুদ্ধে পুরনো আইনে যে শাস্তির ব্যবস্থা ছিল তাও লঘু করে দিয়েছে। আগে ১০০ জনের কম কর্মী আছে এমন কোনো সংস্থায় ছাঁটাই বা ক্লোজার করতে গেলে সংশ্লিষ্ট সরকারের কোনো অনুমতি নিতে হতো না। এখন নিয়ম হয়েছে ৩০০ জনের কম কর্মী থাকলে নিয়োগের প্রধান শর্তে আর বিধিবদ্ধ চুক্তি করতে হবে না। মানেটা জলের মতো পরিষ্কার। মানে হলো মালিকের হাতে তুলে দেওয়া হলো আরও ব্যাপক ছাঁটাই ও ক্লোজারের অধিকার। এই মূহুর্তে দেশে ৭৪শতাংশ ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল এস্টাব্লিশমেন্টে কর্মী সংখ্যা ৩০০-র কম। ধর্মঘট করার ক্ষেত্রে চড়া জরিমানা, জেল, নানান কঠোর শর্ত চাপানো হয়েছে যে, ধর্মঘটের অধিকার আক্রান্ত বলা যায়। ‘মাস ক্যাজুয়াল লিভ’-কেও ধর্মঘট হিসাবে ধরা হবে, শাস্তি দেওয়া হবে গণহারে। ধর্মঘটের নোটিশ দেবার দিনকে বোঝাপড়া শুরুর দিন হিসাবে ধরে নেওয়া হবে, যতক্ষণ না বোঝাপড়া হবে ততক্ষণ ধর্মঘট ডাকা যাবে না। আগে কাজ চলাকালীন সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকরা ‘আবাসিক বন্দোবস্ত ও রক্ষণাবেক্ষণ’-এর বাধ্যতামূলক সুবিধা ভোগ করতেন। বর্তমান আইনে উক্ত সুবিধা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকরা আগে ‘উৎখাত হওয়ার ভাতা’ পেতেন। সেটাও তুলে নেওয়া হয়েছে। পরিবর্তে বছরে বাড়িতে ফেরার জন্য একটা থোক টাকা দেওয়া হবে। অনেক লড়াইয়ের পরে নির্মাণ শ্রমিকদের জন্যে দু’টো আইন করা সম্ভব হয়েছিল। তাও তুলে দেবার ব্যবস্থা হয়েছে।
আইন পাশ হবার দিনে কেন্দ্রের শ্রমমন্ত্রী বলেছেন, ‘শ্রমিক কল্যাণে দিনটি মাইলফলক হয়ে থাকবে’। শ্রমমন্ত্রী দাবি করেছেন, নতুন শ্রমআইনগুলিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের সুবিধাকেও ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়েছে। এই পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর দাবি ‘ন্যূনতম সরকার, সর্বোচ্চ প্রশাসনের’। তাঁর দাবি, শ্রম সংস্কার সুনিশ্চিত করবে ‘ব্যবসাকে নিরুদ্বেগ স্বাচ্ছন্দ্য করার কাজ’, সেই সাথে লাল ফিতের ফাঁস, ইন্সপেক্টর রাজ থেকে মুক্ত করবে সংস্থাগুলোকে। শ্রমিক সংগঠনের মতে, কর্পোরেটের জন্য ব্যবসাতে যাবতীয় স্বাচ্ছন্দ্য আনতে মরিয়া হয়ে উঠেছে কেন্দ্র।
লকডাউনকে ব্যবহার করে নতুন কৃষি আইন, শ্রমআইন, জাতীয় শিক্ষানীতিতে আরও হাজার একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে যে কোনো আইনের পরিবর্তন, বা পরিমার্জন করাটাই আধুনিক মননের দাবি। নতুন আইন প্রণয়ন বা আইনের আধুনিকীকরণ প্রয়োজন হতেই পারে, সেই নিয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু দুর্বলের স্বার্থ যাতে অক্ষুন্ন থাকে সেটা দেখাও জরুরি। শ্রমআইনের পরিবর্তন, পরিমার্জন বা আধুনিকীকরণ নিয়ে প্রশ্ন নেই, শুধু শ্রমিক যাতে বারবার অকারণ শোষণের শিকার না হন, তা শুধু মালিকের স্বার্থপূরণের সহায়ক শক্তি, কর্পোরেটের স্বাচ্ছন্দ্য পূরণের হাতিয়ার না হয়ে ওঠে সেটা দেখতে হবে। কারণ, কর্পোরেটের স্বাচ্ছন্দ্য মানে শ্রমিকের দাসত্ব।