E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ২৮ সংখ্যা / ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ১৩ ফাল্গুন, ১৪২৭

অন্তঃশুল্কের বিরাট বোঝা-ই পেট্রোল-ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণ

টোডর মল


মহারাষ্ট্রের পারভানি জেলায় গত চোদ্দই ফেব্রুয়ারি পেট্রোলের দাম ছুঁয়েছিল লিটার প্রতি ১০০ টাকা ৬০ পয়সা। রাজস্থানে দাম হয় লিটার প্রতি ৯৯ টাকা। ওই দিন দেশের সব মেট্রো ও বড়ো শহরগুলিতেও এক লিটার পেট্রোলের দাম ঘোরাফেরা করেছে ৯০ থেকে ৯৬ টাকার মধ্যে। কয়েকদিন ধরেই কে পেট্রোলের দাম ১০০ ছুঁতে পারে তার যেন একটা দেশজুড়ে প্রতিযোগিতা চলছিল। ডিজেলেরও এক লিটারের দাম ওই দিন ছিল ৯০ টাকার বেশি। পেট্রোলের দাম মোদী জমানায় এর আগেও ১০০ টাকা ছুঁয়েছে, গত বছর দিল্লিতে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এলপিজি সিলিন্ডারের দামও। গত দু’মাসে সিলিন্ডার পিছু দাম বেড়েছে প্রায় ১৭৫ টাকা।

সরকার এবং তেল কোম্পানিগুলি এই অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়াকেই দায়ী করেছে। কিন্তু এটা যে সর্বৈব মিথ্যা তার যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। আসলে আমাদের দেশে পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়ার পেছনে বিভিন্ন ধরনের অন্তঃশুল্কের বোঝা-ই একমাত্র কারণ হিসেবে কাজ করে।

ভারত মূলত যেসব দেশ থেকে অপরিশোধিত তেল কেনে সেখানে দাম ২০১৪-১৫ সালের তুলনায় ২০২০-২১ সালে বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭.৬ শতাংশ। অথচ এই সময়কালে দাম বেড়েছে পেট্রোলের ৫৫.৩ শতাংশ এবং ডিজেলের ৭২.৫ শতাংশ। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের দেশে পেট্রোল-ডিজেলের দাম বেড়েছে তার থেকেও অনেক বেশি হারে। আলোচ্য ২০১৪-১৫ এবং ২০২০-২১ সময়কালে কেন্দ্রের মোদী সরকার পেট্রোপণ্যের ওপর কেন্দ্রীয় অন্তঃশুল্ক ও সেস বৃদ্ধি করেছে প্রায় ১২৫ শতাংশ।এটাই দাম বাড়ার প্রধান কারণ। এমনকি অতিমারীর সময়েও দু' বার কেন্দ্রীয় সরকার অন্তঃশুল্ক বাডিয়েছে। প্রথমটি হলো ২০২০ সালের মার্চ মাসের ১৪ তারিখে পেট্রোল ও ডিজেলে লিটার প্রতি ৩ টাকা; এবং দ্বিতীয়বার হলো ওই বছরের ৬ মে। সেবার আরও বেশি, পেট্রোলে লিটার প্রতি ১০ টাকা এবং ডিজেলে লিটার প্রতি ১৩ টাকা। এরকম অমানবিক সিদ্ধান্ত নিতেও পিছপা হয়নি কেন্দ্রীয় সরকার। যদিও রাজ্য সরকারগুলিও এই ৬ বছরে মূল্য যুক্ত কর (ভ্যাট) বাড়িয়েছে। তবে সেটার পরিমাণ অনেক কম, ৩৭.৫ শতাংশ। বর্তমানে দিল্লিতে পেট্রোলের দামে করের পরিমাণ ৬৩ শতাংশ। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় অন্তঃশুল্ক ৪০ শতাংশ এবং রাজ্যের ভ্যাট ২৩ শতাংশ।

গত ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল প্রতি ব্যারেল ৬৪.৩ ডলার। এপ্রিল মাসে তা কমে দাঁড়ায় ১৯ ডলারে। ওই বছরের জুন মাসে বিশ্ববাজারে গড় দাম হয় ব্যারেল প্রতি ৪০ ডলার।২০২১ সালের জানুয়ারিতে সেটা হয়েছে সামান্য বেড়ে ব্যারেল প্রতি ৫৪.৮ ডলার। কিন্তু ২০২০-র জানুয়ারির তুলনায় এই দাম ১৪ শতাংশ কম। এর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে এই জানুয়ারিতে চীনে ১.৪ শতাংশ, আমেরিকায় ৭.৫ শতাংশ, ব্রাজিলে ২০.৬ শতাংশ এবং ব্রিটেনে ১.৮ শতাংশ পেট্রোপণ্যে দাম কমেছে। প্রসঙ্গত, পেট্রোলের পাইকারি দামে করের অংশ জার্মানি ও ইতালিতে ৬৫ শতাংশ, ব্রিটেনে ৬২ শতাংশ, জাপানে ৪৫ শতাংশ এবং আমেরিকায় ২০ শতাংশের আসেপাশে।

দেশবাসী ভেবেছিল গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং অতিমারীর ফলে মানুষের দুর্দশার কথা ভেবে কেন্দ্রীয় সরকার হয়তো এই বাজেটে পেট্রোপণ্যের ওপর কেন্দ্রীয় করের বোঝা কিছুটা কমাবে।কিন্তু মোদী সরকার সেপথে হাঁটেনি। এর পরিবর্তে তারা নতুন করে কৃষি ও পরিকাঠামো উন্নয়ন সেস বসিয়েছে। এর পরিমাণ লিটার প্রতি পেট্রোলে ২ টাকা ৫০ পয়সা আর ডিজেলে ৪ টাকা। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেন, যে হারে সেস বাড়ানো হয়েছে ঠিক সমহারে কেন্দ্রীয় কর কমানো হয়েছে, যারফলে সাধারণ মানুষের ওপর বাড়তি বোঝা পড়বে না। আসলে এর মধ্য দিয়ে রাজ্যগুলিকে বঞ্চনা করেছে কেন্দ্র সরকার। যেকোনো কেন্দ্রীয় অন্তঃশুল্কে রাজ্যগুলির ভাগ থাকে। কেন্দ্র ও রাজ্যের এই অনুপাত আগে ছিল ৬০:৪০, ২০২১ সালের জানুয়ারি-মার্চ মাসে তা কমে হয়েছে ৬৫:৩৫। তবে কেন্দ্রের বসানো সেসে রাজ্যের কোনো ভাগ থাকেনা।

মোদী সরকার রাজস্ব আদায়ের একটা সহজ উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছে পেট্রোপণ্যকে। ২০২০-২১ সালের রাজস্ব আদায়ের যে তথ্য সংসদে সরকার পেশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, সরকার কর রাজস্ব আদায়ে যে লক্ষমাত্রা ঠিক করেছিল বাস্তবে আদায় হয়েছে তার থেকে ১৭.৮ শতাংশ কম। অন্যদিকে লক্ষ্যমাত্রার থেকে ৩৫ শতাংশ বেশি আদায় হয়েছে অন্তঃশুল্ক। চলতি আর্থিক বছরে দেশের অর্থনীতি সংকুচিত হতে চলেছে প্রায় ৭.৫ শতাংশ।এই সময় বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কম বা সামান্য বাড়া সত্ত্বেও দেশে পেট্রোপণ্যের ওপর অন্তঃশুল্কের বিরাট বৃদ্ধি প্রকারান্তরে সাধরণ মানুষের ওপরই বোঝা বাড়াবে। মানুষের আয় বাড়ার কোনো সুযোগ সৃষ্টি না করে এই অন্তঃশুল্ক ও সেস বৃদ্ধি মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে আরও কমিয়ে দেবে। যা রুদ্ধ করে দেবে অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে বেরনোর পথকেও।