E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৭ বর্ষ ৪৩ ও ৪৪ সংখ্যা / ২৬ জুন ২০২০ / ১১ আষাঢ় ১৪২৭

ভারত-চীন শান্তি আলোচনা অব্যাহত

লাদাখ সীমান্তে দু’পক্ষই উত্তেজনা প্রশমনে তৎপর


বিশেষ প্রতিনিধিঃ পূর্ব লাদাখে ভারত-চীন প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় শান্তি ও স্থিতাবস্থা বজায় আছে। ১৫ জুন এই অঞ্চলে দু’দেশের সেনার মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ ছাড়াই সংঘর্ষ হয় এবং দু’পক্ষেরই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তারপর থেকে এই সীমান্ত অঞ্চলে নতুন করে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। যদিও দু’পক্ষই তাদের নিজ নিজ এলাকায় সেনা, অস্ত্রশস্ত্র মজুত করেছিল। সংঘর্ষের ঘটনার পর থেকেই দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিকস্তরে ও সেনাবাহিনী পর্যায় একাধিক বৈঠক হয়। সর্বশেষ ২৩ জুন চুসুল-মলডো সীমান্তে ভারতের লেফটেন্যান্ট জেনারেল হরিন্দর সিং এবং চীনা মেজর জেনারেলের বৈঠকে খুবই ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে দুই দেশ। ১১ ঘণ্টার টানা বৈঠকে ঠিক হয়েছে : পূর্ব লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় যে সব এলাকায় দু’দেশের সেনা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে তারা পিছিয়ে আসবে। দু’দেশই তাদের বাড়তি সেনা ও কামান সরিয়ে নেবে। তবে এই কাজটি এক-দু’দিনের বিষয় নয়। সমস্তটা বাস্তবায়িত করতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। তবে সীমান্তে শান্তি ফেরানোর প্রশ্নে এটা যে একটা গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি, তা মনে কর‍‌ছে বিশেষজ্ঞ মহল।

প্রসঙ্গত, কূটনৈতিক স্তরে দু’দেশের বিদেশমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রকের অফিসারদের মধ্যে প্রতিটি বৈঠকে সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমন করে শান্তি ফেরাতে সহমতে পৌঁছানো গিয়েছিল। কিন্তু সীমান্তে সেনাপর্যায়ের বৈঠকগুলি একেবারেই ফলপ্রসূ হয়নি। ২৩ জুন চুসুল-মলডো সীমান্তে বৈঠকে সেই বাধাও দূর হয়ে গেল। এখন দু’দেশ তাদের প্রতিশ্রুত অবস্থান থেকে যদি না সরে আসে, তা হলে আশা করা যেতেই পারে, দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে চিড় ধরেছে তা অচিরেই মেরামত হয়ে যাবে।


অন্যদিকে, ১৫ জুনের সীমান্ত সংঘর্ষের ঘটনা দেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে বিস্তারিত জানাতে কেন্দ্র ১৯ জুন সর্বদলীয় বৈঠক ডাকে। ওই বৈঠকে সব রাজনৈতিক দলের বক্তব্য রাখার পর একেবারে শেষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বক্তব্য রাখেন। তাঁর বক্তব্যের এক জা‌য়গায় প্রধানমন্ত্রী বলেন : ‘‘কোনো অনুপ্রবেশ হয়নি, কেউ দখল নেয়নি, আমাদের ঘাঁটিও কারও নি‌য়ন্ত্রণে চলে যায়নি।’’ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে যথেষ্ট বিভ্রান্তি তৈরি হয়। কেননা, সংঘর্ষের পর বিদেশমন্ত্রক ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল তাতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল : চীনের সেনারা একতরফাভাবে স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করায় হিংসাত্মক সংঘাত ঘটেছে। অর্থাৎ এই কথার অর্থ হলো, চীনা সেনারা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারতের অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল বলেই সংঘাতের ঘটনা ঘটে। বিদেশমন্ত্রক ও সেনাবাহিনীর বক্তব্যের সাথে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের এই অমিলই বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে।

অবশ্য এরপরই ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এবং বিদেশমন্ত্রক। কিন্তু তাদের দেওয়া বিবৃতিতে বিভ্রান্তি কমার বদলে আরও বেড়ে যায়। সেখানে মূলত বলা হয় : প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আমাদের এলাকায় চীনের সেনারা ঢুকতে পারেনি আমাদের জওয়ানদের বীরত্বের জন্য। এই বিবৃতিতেই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর দাবি করেছে, গত ৬০ বছর ধরে ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূ-খণ্ড চীনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিবৃতিতে এসব অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের উল্লেখ থাকলেও, ভারতীয় সেনারা দেশের ভূ-খণ্ডে না চীনের ভূ-খণ্ডে কোথায় নিহত হয়েছেন তার জন্য একটা বাক্যও খরচ করা হয়নি। সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি খুব সঠিকভাবেই বলেছেন : ‘‘আগে প্রধানমন্ত্রী মনস্থির করুন, তারপর বলুন। অন্যথায় নানারকম বার্তা যাচ্ছে, এতে কূট‍‌নৈতিকভাবেও আমাদের অসুবিধা হবে। সর্বদলীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী আর কী কী বলেছেন, যা তিনি বলতে চাননি তার তালিকা পেলে ভা‍‌লো হয়।’’


সিপিআই(এম) প‍‌লিট ব্যুরোও কেন ভারত-চীন সংঘাত হলো, ঠিক কোন্‌ জায়গায় সংঘাত হয়েছে, কেনই বা এত সেনা প্রাণ দিলেন তার সুস্পষ্ট জবাব কেন্দ্রের সরকারের কাছে দাবি করেছে। পলিট ব্যুরো মনে করে : এইসব প্রশ্নের সদুত্তর পেলেই একমাত্র যেসব বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে তা দূর হবে। একইসাথে উত্তেজনা প্রশমন এবং লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় শান্তি ও স্থিতাবস্থা ফেরানোর সরকারি উদ্দে‍‌শের যে কথা বলা হচ্ছে সেই পরিস্থিতি তৈরি করতে সাহায্য করবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য আমাদের বীরসৈনিকদের সাহসী লড়াইয়ের ন্যায্যতাকেই বড়ো ধরনের আঘাত করেছে। এমনকী বিতর্কের অবসানে আমাদের কূটনৈতিক উদ্যোগের শক্তিকেও খাটো করা হয়েছে। সর্বদল বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও বিদেশমন্ত্রক যে ব্যাখ্যা হাজির করেছে তা আরও বিভ্রান্তি বাড়িয়ে দেবে বলেই পলিট ব্যুরো মনে করেছে।

১৫ জুন রাতে সীমান্তে সংঘর্ষ

পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারত-চীন সীমান্তে ১৫ জুন রাতে দু’দেশের সেনার মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে সংঘর্ষে ৩ সেনা মারা গেছেন এবং আহত ১৭ সেনা প্রবল ঠাণ্ডায় প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন ৭৬ সেনা। এই ২০ নিহত ভারতীয় সেনার মধ্যে এক অফিসারও আছেন। চীনও সরকারিভাবে ওই সংঘর্ষে তাদেরও একজন কমান্ডিং অফিসারের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে। তবে এই সংঘর্ষে কোনো গোলাগুলি চলে নি, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয় নি। পাথর ও রড নিয়েই দু’পক্ষের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সেনাবাহিনীর বিহার রেজিমেন্ট এই সীমান্তে মোতায়েন ছিল। ১৯৯৬ ও ২০০৫ সালে ভারত ও চীনের দু’টি বোঝাপড়া হয়েছিল। যার ভিত্তিতে সীমান্তে কোনো পক্ষই অস্ত্র ব্যবহার করে না। প্রসঙ্গত, প্রায় ৪৫ বছর পর ভারত-চীন সীমান্তে সংঘর্ষে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটল। ১৯৭৫ সালে অরুণাচল প্রদেশে চীন সীমান্তে সংঘর্ষে প্রাণহানি হয়েছিল।

এই সংঘর্ষের আগে গত পাঁচ সপ্তাহ ধরেই পূর্ব লাদাখ ও গালওয়ান উপত্যকায় ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে সমস্যা চলছিল। ১৫ জুনের সংঘর্ষের ঘটনায় দু’দেশই সীমান্ত নীতি লঙ্ঘন করার ব্যাপারে একে অপরকে অভিযুক্ত করেছে। সংঘর্ষের ঘটনার ১০ দিন আগে ৫ জুন ভারতের বিদেশমন্ত্রকের যুগ্ম সচিব নবীন শ্রীবাস্তব এবং চীনের বিদেশমন্ত্রকের ডিরেক্টর জেনারেল উ জিয়াঙহাও ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেন। উভয়দেশের পক্ষ থেকেই জানানো হয় : ভারত ও চীনের মধ্যে শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল, ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বিশ্ব পরিস্থিতির স্থিতিশীলতার পক্ষে ইতিবাচক উপাদান। দু’দেশই একমত হয়েছে উভয়পক্ষের সংবেদনশীলতা, উদ্বেগ, আশাকে মাথায় রেখে মতপার্থক্য শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করবে, সমস্যাকে বিরোধে পরিণত হতে দেবে না। এরপর ৬ জুন সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমনে দু’দেশের সেনাদের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। বৈঠকে সীমান্তে শান্তি ও স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে উভয়পক্ষই সহমতে পৌঁছায়। ভারত ও চীনের সেনাপর্যায়ের এই বৈঠক নিয়ন্ত্রণরেখায় চীনের অংশ মলডো’য় হয়েছিল। কিন্তু ১৫ জুনের সংঘর্ষের পর উভয় দেশই বৈঠকে সহমতের বিষয় লঙ্ঘন করার ব্যাপারে একে অপরকে অভিযুক্ত করে। ভারতের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব ১৬ জুন বলেন, চীনের পক্ষ থেকেই বৈঠকের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করা হয়। ১৫ জুন সন্ধ্যা ও রাতে চীনের পক্ষ থেকে স্থিতাবস্থা একতরফাভাবে বদলানোর চেষ্টাকে কেন্দ্র করে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে যায়। প্রায় একই বক্তব্যেরই বিপরীতভাবে প্রতিফলন ঘটে চীনের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ানের কথাতেও। তিনি বলেন: বিস্ময়করভাবে ১৫ জুন ভারতীয় সেনারা বৈঠকের সহমতকে গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করে। দু’বার অবৈধ কাজ করতে চীনের সীমান্ত অতিক্রম করে। তারা চীনের জওয়ানদের প্ররোচনা দেয় ও আক্রমণ করে। তা থেকে দু’দেশের সেনাদের মধ্যে গুরুতর শারীরিক সংঘর্ষ ঘটেছে।

এই পরিস্থিতির মধ্যেই ১৭ জুন দু’দেশের বিদেশমন্ত্রী — ভারতের এস জয়শঙ্কর এবং চীনের ওয়াঙ ই ফোনে কথা বলেন। দুইজনই সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমনে সহমত পোষণ করেন। বলেন, যতশীঘ্র সম্ভব সমঝোতা চুক্তি অনুসারে সীমান্তে শান্তি ও স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। ভারতের বিদেশমন্ত্রী বলেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই সংঘাতের গুরুতর প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়ে যাচ্ছে। চীনের বিদেশমন্ত্রকের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে; ‘‘দু’তরফই সংঘাতের ফলে উদ্ভূত গুরুতর পরিস্থিতি অত্যন্ত ন্যায্য এবং নিরপেক্ষভাবে মেটানোয় সহমত পোষণ করেছে। দু’তরফের সামরিক বাহিনী পর্যায়ে বৈঠক করা হবে সীমান্তে শান্তি ফেরানোর লক্ষ্যে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শান্তি ফিরিয়ে আনার পক্ষেই সহমত হয়েছে দু’পক্ষ।’’ ভারতও চীনকে পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে সঠিক পদক্ষেপ নিতে বলেছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, মেজর জেনারেল পর্যায়ের বৈঠক ফলপ্রসূ হয়নি। তবে ১৫ জুনের ঘটনার পর গালওয়ান সীমান্তে নতুন করে কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। আলোচনা মতো শান্তি ও স্থিতাবস্থা বজায় আছে।

এরপরেও উদ্ভূত পরিস্থিতিকে স্বভাবিক করতে দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক স্তরে কথাবার্তা জারি রাখা হয়। ১৮ জুন দু’দেশের বিদেশমন্ত্রকের শীর্ষপর্যায়ের অফিসাররা টেলিফোনে নিজেদের মধ্যে কথা বলেন। ওই দিন বেজিঙে থাকা ভারতীয় রাষ্ট্রদূতও চীনের বিদেশমন্ত্রকের সাথে কথা বলেন। চেষ্ঠা চালানো হয় সমস্ত বিষয়টিকে নিয়ে সহমতে পৌঁছে একটি যৌথ বিবৃতি দেওয়ার।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বিভ্রান্তি

গত দেড় মাস ধরে পূর্ব লাদাখ ও গালওয়ান সীমান্তে কী ঘটছে, কী প্রেক্ষিতেই দু’দেশের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল, দু’পক্ষ শান্তি-স্থিতাবস্থা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দেবার পরও কেন সংঘর্ষ হলো কিংবা গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল কিনা — সেসব প্রশ্নের বিশ্বাসযোগ্য উত্তর দেবে কেন্দ্রীয় সরকার ১৯মে সর্বদলীয় বৈঠকে এই আশা করেছিল বিরোধী দলগুলি ও সর্বোপরি দেশের মানুষ। কিন্তু বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্যে এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর ছিল না। উল্টে তাঁর বক্তব্যে বিভ্রান্তি বেড়েছে। একেবারেই সেনাবাহিনীর বক্তব্যের বিপরীত কথা শোনা গেছে তাঁর মুখে। একেবারে বৈঠকের শেষে, যখন সব দলের বক্তব্য রাখা হয়ে গেছে তখন প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যের এক জায়গায় বলেন : ‘‘ভারত ভূ-খণ্ডে চীনের সেনারা ঢোকেনি। কেউ ভারতের সীমান্ত ঘাঁটি দখলও করেনি। ২০ জওয়ান মারা গেছেন ঠিকই কিন্তু তাঁরা দেখিয়ে দিয়েছেন ভারতের সীমান্ত সুরক্ষিত থাকবে।’’ এইখানেই সেনাবাহিনীর বিবৃতির সঙ্গে তাঁর বক্তব্যের মিল থাকে নি। বৈঠকের শুরুতে পরিস্থিতির বিবরণ দেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।

প্রধানমন্ত্রীর এহেন বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের পরই সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেন : তাহলে সংঘাত কোথায় হলো? সর্বদলীয় বৈঠকেরই বা কী অর্থ? শুধুই ইয়েচুরিই নন, অনেকেই এই প্রশ্ন তুলেছেন।

বৈ‌ঠকে সীতারাম ইয়েচুরি

সর্বদলীয় বৈঠকেও সিপিআই(এম)’র পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সীতারাম ইয়েচুরি। তিনি তাঁর বক্তব্যের শুরুতে নিহত ভারতীয় জওয়ানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। দেশের সার্বভৌমত্ব ও সীমান্ত বজায় রাখার কথা বলেন।

সীতারাম ইয়েচুরি তাঁর বক্তব্যের শুরুতে ভারত ও চীনের বিদেশমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠকের পর ভারতের পক্ষ থেকে যে বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছিল তা উদ্ধৃত করেন। তাতে বলা হয়েছিল : ‘‘আলোচনার উপসংহারে স্থির হয়েছে সামগ্রিক পরিস্থিতি দায়িত্বশীলভাবে পরিচালনা করা হবে। ৬ জুন যে সমঝোতা হয়েছিল উভয়পক্ষই তা আন্তরিকভাবে রূপায়ণ করবে। সেনা সরে যাবার প্রশ্নে ওই সমঝোতা হয়েছিল। পরিস্থিতি ঘোরালো হয় এমন কোনো কাজ উভয়পক্ষই করবে না, বরং দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও প্রোটোকল অনুযায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা নিশ্চিত করবে।’’ ভারত সরকার এই অবস্থান মেনে নিয়েছে। এই অবস্থানকে সিপিআই(এম) সমর্থন করছে। এরপরে ভারত সরকারের উচিত উচ্চপর্যায়ের আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া, যাতে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার স্পষ্ট চিহ্নিতকরণ করে সীমান্তে শান্তি ও সুস্থিতি বজায় থাকে।

ইয়েচুরি বলেন, এই মুহুর্তে দেশ ও জনগণের ঐক্য জরুরি। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যাতে, বিভেদকামী ভাবাবেগ তৈরি, ভুয়ো খবর ছড়ানো কঠোরভাবে বন্ধ করা যায়। আমরা ভেবেছিলাম, এই বৈঠকে সরকার জানাবে ৪৫ বছরের মধ্যে এই প্রথম প্রাণহানি ঘটা সংঘাত ঠিক কিভাবে হলো। কী ঘটল গত তিনমাস জুড়ে? কিন্তু সরকার তা জানাল না। অনেক প্রশ্নই উঠ‍‌ছে। জওয়ানদের প্রাণ কি রক্ষা করা যেত? গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল কি না। কারগিল সংঘর্ষের পরে বাজপেয়ী সরকার সুব্রহ্মণম কমিটি গঠন করেছিল। ত্রুটি ছিল কিনা খতিয়ে দেখতে ওই কমিটির মতো কিছু গঠনের কথা কি ভাবা হচ্ছে? ভারত বিশ্বকে পঞ্চশীল নীতি দিয়েছে। স্বাধীন বিদেশনীতি অনুসরণ করেছে। দেখতে হবে এ থেকে যেন আমরা বিচ্যুত না হই।

বৈঠকে সোনিয়া গান্ধী, মমতা ব্যানার্জি, কে চন্দ্রশেখর রাও, মায়াবতী, নীতীশ কুমার, শারদ পাওয়ার প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

সাম্রাজ্যবাদী ও উগ্রজাতীয়তাবাদী প্ররোচনা

ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষের মধ্যেই ঘোলা জলে মাছ ধরতে উদ্যোগী হয়েছে আমেরিকা। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে ভারত-চীন সীমান্ত উত্তেজনা প্রশমনে ‘‘প্রস্তুত ইচ্ছুক এবং দক্ষ বলে জানি‌য়েছে।’’ তিনি আরও বলেছেন: ‘‘বড্ড কঠিন সময় চলছে। ওই দুই দেশের সঙ্গে কথা চালাচ্ছে আমেরিকা। দেখা যাক কী করা যায়।’’ চীন খুব স্বাভাবিকভাবে ট্রাম্পের এই বক্তব্যে কোনো গুরুত্বই দেয়নি। ভারত অন্তত এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের ইচ্ছার সঙ্গে সরকারিভাবে সহমত পোষণ করতে পারেনি। বাণিজ্যিক লড়াইয়ে বার বার ‍‌পিছিয়ে-পড়ে সবদিক দিয়ে চীনকে ঘিরে ফেলার যে নীতি নিয়ে আমেরিকা চলছে, সেই লক্ষ্যেই ট্রাম্প ভারত-চীনের দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে নাক গলাতে চেয়েছিল। তবে এখনো পর্যন্ত সে এব্যাপারে সফল হয়নি।

অন্যদিকে, ভারত সরকার তিন বাহিনীকেই সরাসরি অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কেনার ছাড়পত্র দিয়েছে। সেই অস্ত্র ব্যবসার দিকেও মার্কিন সরকারের লক্ষ্য যে নেই তা একেবারেই বলা যাবে না। তবে পূর্ব নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী মস্কোয় ২৪ জুন ভারত-চীন-রাশিয়ার মধ্যে বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে চীন ও ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে দেশের মধ্যে হিন্দুত্ববাদীরা তীব্র চীন -বিরোধী উগ্রজাতীয়তাবাদী প্রচার শুরু করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির চীনা দ্রব্য বয়কটের ডাক। এমনকি, সর্বদল বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনা বিনিয়োগ বন্ধ করার আবেদন করেছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে।