E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৭ বর্ষ ৪৩ ও ৪৪ সংখ্যা / ২৬ জুন ২০২০ / ১১ আষাঢ় ১৪২৭

যৌথভাবে মোকাবিলা করতে হবে করোনা-আমফানের

কৌস্তুভ চ্যাটার্জি


নীলপুরে কমিউনিটি কিচেনে সূর্য মিশ্র।

একান্নবর্তী পরিবার - একসাথে থাকা, একসাথে খাওয়া, পড়াশোনা, বেঁচে থাকা— একটা সময় এটাই ছিল মানুষের জীবনসংগ্রামের ইতিকথা, ‘সমষ্টি’ ছিল জীবনধারণের একক। ‘দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ’ — এটাই ছিল জীবনের মূলমন্ত্র, লড়ে যাওয়ার রসদ!

এখন যুগ বদলে দেওয়ার তাগিদ! পরিবর্তনের জোয়ার! সেই অদল বদল ইতিবাচক হচ্ছে কি হচ্ছে না, দরকার কি সেইসব বিষয়ের সুলুক সন্ধানের? বদল দরকার। সেই বদলে দেশের ভালো হবে কি? দরকার আছে সেই খবরের? দশের মঙ্গল হবে কি? কি প্রয়োজন এইসব এলোপাতারি খবর দিয়ে? আমার ভালো হবে তো? ব্যাস। তাহলেই চলবে। আমার ভালো তো, সবার ভালো। আমার মন্দ তো, সবারই মন্দ—এই শিক্ষা এখন  বিশ্বায়ন নামক খুড়োর কলে বিচার করছে সমস্ত কিছুর!

তবে এই বিশ্বায়নের যুগে কানা গলিতে আটকে পড়েছে মানুষ ও তার সত্তা! মানুষকে বিচার করা হচ্ছে কেবল তার চাঁদির চক্করের দায়ভার দিয়ে। মেধাকে বিচার করা হচ্ছে কাঞ্চনকৌলিন্যের দাপটে। মন-মননশীলতা-মানবিক-মানবতা, এই শব্দগুলোকে চলছে জাদুঘরে চালান দেওয়ার এক উদ্ভট কলাকৌশল।

সমষ্টি শব্দটা ক্রমশ আত্মবিশ্বাস হারাতে হারাতে একদম তলানির শেষপ্রান্তে এসে ঠেকেছে। ঘর ভাঙে দেশ ভাঙে, ভাঙে বিশ্ব, তাই মানুষের অন্তরে আজ মানুষটাও নিঃস্ব। সময় কোথায় সেই নিঃস্বতার সুলুক সন্ধানের? সময় কোথায় আজ রিক্ততাকে পূর্ণতায় অভিষিক্ত করবার? কেবল একলা রবি ঠাকুর পূর্ণমুগ্ধতায় বসে গাইতে থাকেন; পাষাণে রচিছে কত কীর্তি ওরা সবে বিপুল গরবে। —রবীন্দ্রনাথ তাই একলা ভিজে আমাকে ভেজান।

ভেঙে যাচ্ছে দেশ। ভাঙছে পরিবার! টুকরো হয়ে যাচ্ছে মানুষে মানুষে বন্ধন! বাঁধনকে শক্ত করে বাঁধাকে অতিক্রম করা হয়। প্রাচীন প্রবাদ, বজ্র আঁটুনির ফস্কা গেরোর মত হয়ে যাচ্ছে দেশ-সময়-সমাজ এবং অতি অবশ্যই মানুষ। হারিয়ে যাচ্ছে বিশ্বাস নামক বস্তুটি। হারিয়ে যাচ্ছে চেতনা নামক যাপনচিত্রের বোধটি। পৃথিবীটা হয়ে গেছে এক মস্ত রেসকোর্স এবং সেই রেসকোর্সে মানুষ হয়েছে যন্ত্রচালিত ইঁদুর। ক্রমেই অসহায় হয়ে পড়ছে মানুষ। ‘তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে’—আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে লেখা একটা গান আজ কি ভীষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে মানবজীবনে! মুনাফা চাই, শুধু মুনাফা। মুনাফার লোভ মানুষকে দিগ্‌বিদিকজ্ঞানশূণ্য করে তুলছে। ঝগড়া, মারপিট এমনকি তৈরি হচ্ছে যুদ্ধ পরিস্থিতি। মানুষ মানুষের থেকেই নিজেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দিচ্ছে কিভাবে ‘একা একা’ বড়ো হতে হয়! কিভাবে নিজেরটা গুছিয়ে নিতে হয়!

ইতিমধ্যেই করোনা আর আমফান এসে বুঝিয়ে দিল কতটা অসহায়, কতটা একা আমরা! পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু থেকে কৃষক আত্মহত্যা, কিছুই ভাবাচ্ছেনা মানুষকে! প্রতিনিয়ত এই ‘রাষ্ট্রীয় হত্যা’র মাঝে মানুষ নিজেদের কাছে নিজের অস্তিত্বটাকে নিয়ে শুধু বেঁচে আছে। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার পরিবর্তে শুরু হয়েছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা আর তা ক্রমশ পরিণত হচ্ছে মারাত্মক মানসিক দূরত্বে! এই ভীষণ পরিস্থিতি মানুষকে বারবার শিখিয়ে দেয়, বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় একসাথে থাকা, আরও বেঁধে বেঁধে থাকা।

নয়া-উদারনীতিবাদ মানুষকে ক্রমাগত শিখিয়ে যাচ্ছে, ‘যা বলছো তা করোনা, যা করছো তা বোলোনা’! চূড়ান্ত ভোগবাদের মধ্যে ডুবে আছে একটা অংশ, আর বিপরীতে বিরাট অংশ ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে অর্থনৈতিক মন্দার চোরাস্রোতে। রাজ্য এবং কেন্দ্র উভয় সরকারই পড়ন্ত অর্থনীতিকে জাগিয়ে তোলার বদলে ভোট প্রচারকেই এই সময়ে শ্রেয় মনে করছে!

আর ঠিক এই সময়েই এসে যায় করোনা-লকডাউন-আমফান, আর ঠিক তখনই ব্যক্তিস্বার্থ ভুলে সমষ্টিগত স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে, সমাজের স্বার্থে নেমে পড়ি আমরা, বামপন্থীরা! রাজ্যজুড়ে বাজারনীতিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে, মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছি আমরা। চাল, ডাল, সবজি, মশারি, খাতা, পেন থেকে শুরু করে সর্বোপরি ‘জনতার রান্নাঘর’ — বামপন্থীরা দেখিয়ে দিচ্ছে, ‘সরকারে না থাকলেও দরকারে আছি!’ আট থেকে আশি, ছাত্র যুব নবীন প্রবীণ সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমেছেন রাস্তায়! যাদবপুর অঞ্চলে জনতার রান্নাঘর সরাসরি রূপ নিয়েছে স্থায়ী ‘শ্রমজীবী ক্যান্টিনে’! সারা বাংলা জুড়ে চলছে মানুষের জন্য মানুষের রান্নাঘর। যৌথ খামারকে অস্ত্র করে পথ দেখিয়ে চলেছে বামপন্থীরা। ইতিহাস বলে দেয়, তেতাল্লিশের মন্বন্তর থেকে কুড়ির করোনা-আমফান, রান্নাঘরকে সামনে রেখে আমজনতার পেট ভরিয়েছে বামপন্থীরাই। এখানে কেউ কারও নেতা না, কেউ কারও কর্মচারী না, নেই কোনও শ্রেণিবৈষম্য, নেই কোনো ধর্মের জাঁতাকল! এখানে সবাই মানুষ, মানুষের পাশে মানুষ। আমাদের লক্ষ্য এখন হওয়া উচিত বৃহত্তর স্বার্থে সরকারের অরাজকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, নিজেদের প্রশ্ন করা, ‘‘আমার দেশেও সক্কলে খেতে পায় কি? বন্ধু এদেশ তোমারও তুমি কী ভাবছো?’’ রাত যতই দীর্ঘ হোক, ভোর আসবেই, আমাদেরকেই আনতে হবে। মানুষকে বুঝে নিতে হবে, রাষ্ট্র নয়, মানুষই ক্ষমতার আসল উৎস!