৫৭ বর্ষ ৪৩ ও ৪৪ সংখ্যা / ২৬ জুন ২০২০ / ১১ আষাঢ় ১৪২৭
বেসরকারি হাতে কয়লাখনি তুলে দেবার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে
২ থেকে ৪ জুলাই দেশজুড়ে কয়লা শিল্পে ধর্মঘট
গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি
কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি জোট সরকার অন্যতম জাতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ কয়লা দেশি-বিদেশি কর্পোরেট সংস্থার মালিকদের হাতে তুলে দেবার বন্দোবস্ত পাকা করে ফেলেছে। এর ফলে দেশের একটি মহারত্ন কোম্পানি ‘কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড’ও গভীর বিপদে গিয়ে পড়বে।
মোদী সরকার ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ‘কোল মাইনস স্পেশাল প্রভিশনস অ্যাক্ট ২০১৫’ এবং ‘মাইনস অ্যান্ড মিনারেল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেশন অ্যাক্টস ১৯৫৭’—এই দুই আইনের উপর আরও একটি অর্ডিন্যান্স জারি করেছে। এই নিয়ে ওই দুই আইনের উপর ষষ্ঠবার অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়েছে। এই নতুন অর্ডিন্যান্সের নাম দেওয়া হয়েছে ‘দি মিনারেল (অ্যামেন্ডমেন্ট) অর্ডিন্যান্স ২০২০’।
এই অর্ডিন্যান্সও এখন আইনে পরিণত হয়েছে যা ‘দি মিনারেল ল (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট ২০২০’ নামে পরিচিত হয়েছে। এই নতুন আইনের বলে ইতিমধ্যেই ১৮ জুন ৫০টি কয়লা ব্লক নিলামের প্রক্রিয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে উপস্থিত থেকে শুরু করে দিয়েছেন। এখন দেশে দু’ধরনের কয়লা উৎপাদন ব্যবস্থা চলবে। একটি ব্যবস্থা হলো ‘দি মিনারেল ল (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট ২০২০’ এবং ‘কোল মাইনস (স্পেশাল প্রভিশনস) অ্যাক্ট ২০১৫’ এবং অপর ব্যবস্থাটি হলো ‘কোল মাইনস ন্যাশনালাইজেশন ১৯৭৩’। ‘কোল মাইনস ন্যাশনালাইজেশন-১৯৭৩’ ব্যবস্থায় সরকারি নিয়মকানুন, নিজস্ব বেতনব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু নতুন যে দুটি আইনের ব্যবস্থা হলো সেখানে সরকারি বেতন কাঠামো এবং সামাজিক সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। সবই নির্ধারণ করবে বেসরকারি মালিক কর্তৃপক্ষ। চলবে মধ্যযুগীয় কায়দায় শ্রমিক শোষণ যা ১৯৭৩-এ কয়লা শিল্প জাতীয়করণের পূর্বে ছিল কার্যত সেই যুগকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করল বিজেপি সরকার। এছাড়াও আরেকটি বড় বিপদ! তা হলো এই নতুন আইনে প্রত্যেকটি ব্লকের কয়লার গুণমান অনুসারে ফ্লোর ভ্যালু যা সরকার ঠিক করে দেবে সেই দামে বা তার থেকেও বেশি দামে নিলামদার কোম্পানিগুলো কয়লা বিক্রি করে সরকার নির্ধারিত শতাংশের হিসেবে সরকারকে দাম দেবে। এবং এরা কত পরিমাণ কয়লা বিক্রি করে কত পরিমাপের দাম দেবে তার কোনো মা বাপ থাকবে না—জাতীয় সম্পদ লুঠের এক ধরনের যাঁতাকল হলো এই নতুন আইন। স্বভাবতই এদের সাথে প্রতিয়োগিতায় কোল ইন্ডিয়া পেরে উঠবে না এবং ধীরে ধীরে রুগ্ণ হয়ে লোকসান করতে করতে দেউলিয়া হয়ে এক সময় লাটে উঠে যাবে এই মহারত্ন কোম্পানি।
এক ভয়ঙ্কর সর্বনাশের সামনে দাঁড়িয়ে, এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে কয়লা শিল্পের সমস্ত শ্রমিক সংগঠন এককাট্টা হয়ে লড়াইয়ে ময়দানে নেমেছেন। আগামী ২ জুলাই থেকে ৪ জুলাই কোল ইন্ডিয়ার সমস্ত খনিতে হরতালের ডাক দিয়েছে সমস্ত শ্রমিক সংগঠন। চলছে জোরকদমে প্রচার। গত ১৮ জুন কোল ইন্ডিয়ার সমস্ত সাবসিডিয়ারির প্রধান দপ্তরে সমস্ত ইউনিয়ন হাজার হাজার কয়লা শ্রমিকের মিলিতভাবে জমায়েত এবং বিক্ষোভ প্রদর্শনের মধ্যে জমা করেছে হরতালের নোটিশ। সর্বত্র চলছে বিক্ষোভ। ইতিমধ্যে গত ১৯ জুন ঝাড়খণ্ড সরকার এই আইনের বলে কয়লা ব্লক বণ্টনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছে। ঝাড়খণ্ড সরকারের মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি এর বিরোধিতা করতে শুরু করছেন। ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রীর সাথেও কথা বলবেন বলে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছেন। কিন্তু আমাদের রাজ্যের মাননীয়া এখনো কিছুই বলেননি। ওনার দলের কয়লা শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের কাছেও এই হরতালকে সমর্থন করার আপিল করেছে হরতালি শ্রমিক সংগঠনগুলো। এখনো জানা যায়নি এরা এই হরতাল সমর্থন করবেন, না, অন্যবারের হরতালে যেমন বিরোধিতা করেছিলেন তেমনই করবেন। সে যাই হোক কয়লা শিল্পে ২-৪ জুলাই হরতাল হবেই।
।। এক ।।
১৯৭০ দশকের গোড়ায় কয়লা খনি জাতীয়করণ হবার অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই পুনরায় বিরাষ্ট্রীয়করণের খেলা শুরু হয়েছিল। মোদী সরকারের শাসনে সেই খেলা চূড়ান্ত রূপ পেল। সেই ইতিহাস একটু পর্যালোচনা করে দেখা যাক।
ভারতে ১৯৭২ এবং ১৯৭৩ সালে ‘কোকিং’ এবং ‘নন কোকিং কয়লা’ খাদানগুলো জাতীয়করণ করা হয় ‘কোল মাইনস ন্যাশনালাইজেশন অ্যাক্ট-১৯৭৩’ অনুসারে। ১৯৭৩ সালের ৩০ মে থেকে এই আইনে মাটির নিচে সমস্ত কয়লা জাতীয় সম্পদ হিসাবে ঘোষিত হলো। কয়লা শিল্প জাতীয়করণ হলেও দেশি এবং বিদেশি শিল্পমালিকদের ভারতের এই অমূল্য খনিজের উপরে দীর্ঘদিন ধরেই লোভ ছিল। কিন্তু ভারতীয় শিল্পমালিকদের সেই সময় কয়লা খনি চালানোর মতন পুঁজি ছিল না। অতএব হাতে পুঁজি তৈরি করার মতো সময় দরকার ছিল। এদের খনিগুলো কব্জা করার সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না। ‘ফলে যখন যেমন তখন তেমন’ নীতি অনুসারে জাতীয়করণের কয়েক বছর পর থেকেই শুরু হলো ভারত সরকারের পর্যায়ক্রমে কয়লা শিল্পের বিরাষ্ট্রীয়করণের খেলা।
প্রথমবার বিরাষ্ট্রীয়করণের প্রক্রিয়া শুরু হয় ‘ক্যাপটিভ মাইনস’-এর নাম করে। ১৯৭৬ সালে ‘কয়লা খনি জাতীয়করণ আইন-১৯৭৩’-র সংশোধনী আনা হয় এবং ইস্পাত শিল্পের জন্য ‘ক্যাপটিভ মাইনসের’ ছাড়পত্র দেওয়া হলো। কিন্তু বলা হয় রেলে এই কয়লা পরিবহণ করা যাবে না। এর ফলে দেশের সরকারি এবং বেসরকারি ইস্পাত শিল্পের পক্ষে সহজ হলো কয়লা খাদান লিজ নেওয়া।
১৯৯০-এর পর বিশ্ব অর্থনীতির চালচিত্র বদলে যেতে থাকে, শুরু হয় উদারনীতির বৃহত্তর উল্লফন। ফলে আবার দ্বিতীয়বার ১৯৯৩ সালে ‘কয়লা খনি জাতীয়করণ আইন-১৯৭৩’ সংশোধন করে ব্যক্তি ও সরকারি মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য ‘ক্যাপটিভ খনির’ অনুমতি দেওয়া হয়। এখানে এও বলা হয় সরকারি, বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর যদি বিদ্যুৎ উৎপাদনের অভিজ্ঞতা নাও থাকে তারা সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানির সাথে যৌথ উদ্যোগে কয়লা উত্তোলন করতে পারবে। এবং রেলে কয়লা পরিবহণের যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা প্রত্যাহার করা হয়। এর ফলে আরও কিছু কয়লা খনি চলে গেল বেসরকারি হাতে। এখানেই পুঁজিবাদীরা বিশ্রাম নিল না।
তৃতীয়বার আবার ভারত সরকার ১৯৯৬ সালে ‘কয়লা খনি জাতীয়করণ আইন-১৯৭৩’-কে সংশোধন করে ব্যক্তি মালিকদের সিমেন্ট ও সার কারখানার জন্য ‘ক্যাপটিভ মাইনসের’ অনুমতি দিল। এরপর ২০০৮ সাল পর্যন্ত কয়লা শিল্পকে আবার নতুন করে বেসরকারিকরণ বা ভেঙে ফেলার চেষ্টা তদানীন্তন কেন্দ্রীয় বিজেপি বা কংগ্রেস সরকারের পক্ষ থেকে লাগাতার করা হলেও কয়লা শ্রমিকদের এবং জনগণের চাপে করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু আবার ‘ক্যাপটিভ মাইন’ নাম করে কয়লা ব্লক বণ্টনের প্রক্রিয়া চলতে থাকে এবং ২০০৮-২০১৩ পর্যন্ত ২১৪-টি কোল ব্লক ‘ক্যাপটিভ মাইনের’ নামে বণ্টন করা হয়। এক্ষেত্রে স্মরণ রাখা দরকার ২০০৩-২০০৮ পর্যন্ত ইউপিএ-০১ সরকারের সমর্থনে ছিল বামপন্থীরা যার ফলে নতুন করে কয়লা শিল্প বেসরকারিকরণের কোনো পদক্ষেপ তারা এই সময় নিতে পারেনি। ২০০৮ সালের জুলাই মাসে ইউপিএ-০১ সরকার থেকে সাম্রাজ্যবাদের কৌশলের সাথে কংগ্রেস সরকারের সমঝোতার বিরুদ্ধে নীতিগত অবস্থান নিয়ে বামপন্থীরা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেন। তখন উদারনীতির পথে মনমোহনের পথ নিষ্কণ্টক হলো।
এ ক্ষেত্রে এটাও আমাদের স্মরণ রাখা দরকার পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার এবং লোকসভা ও রাজ্য সভাতে বামেদের উল্লেখযোগ্য শক্তি থাকার ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের কয়লা শিল্প বেসরকারিকরণে অনেক আশাই বানচাল হয়ে গিয়েছিল। যেমন ২০০০ সালে ইসিএল-কে রুগ্ন শিল্প হিসেবে ঘোষণা করে দিয়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি বিআইএফআর-এ পাঠানো হয়। (বিআইএফআর কেস নং ৫০১/২০০০) তখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু। সিআইটিইউ বামফ্রন্টকে হাতিয়ার করে বিআইএফআর থেকে ইসিএল-কে বার করে আনার জন্য শুরু করে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন। দীর্ঘ লড়াই আন্দোলনের ফলে ২০১০ সালে ইসিএল মুক্ত হয়ে আসে বিআইএফআর থেকে। ধীরে ধীরে লাভের মুখ দেখতে শুরু করে ইসিএল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তা কংগ্রেস বা বিজেপি যাই হোক না কেন যেখানে এদের মূল লক্ষ্য বেসরকারিকরণ এবং পুঁজির তোষণ সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের বদল না হলে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে রক্ষা করা কোনো মতেই সম্ভব নয়। ফলত বিরামহীনভাবে কয়লা শিল্পের উপর আঘাত এসেছে অসংখ্য বার।
চতুর্থবার আবার ‘কয়লা খনি জাতীয়করণ আইন-১৯৭৩’-এর উপর আঘাত আসে ২০০৮ সালে। মনমোহন সিং-এর তদানীন্তন কংগ্রেস সরকার কয়লা খনির ‘ক্যাপটিভ মাইনের’ নাম করে ২১৪ ব্লক বণ্টন সহ ১০ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করার দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এমন কি এও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, কয়লা শ্রমিকরাও শেয়ার কিনতে চাইলে তারাও তা কিনতে পারবেন। কিন্তু একজন শ্রমিকও কয়লা খনির শেয়ার কিনতে আসেননি উল্টে এই শেয়ার বিক্রি করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কয়লা শ্রমিকরা ৫ মে ২০১০-এ কয়লা শিল্পে বৃহত্তম হরতাল সংগঠিত করেন। যদিও এর পর সংসদের পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির নজরে এই ‘ক্যাপটিভ ব্লক’ বণ্টন নিয়ে আলোচনার প্রেক্ষিতে ১,৮৬,০০০ কোটি টাকার দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশ্যে আসে, ফলত সিবিআই তদন্ত এবং মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। এবং সুপ্রিম কোর্টের আদেশে এই ক্যাপটিভ ব্লকগুলির বণ্টন বাতিল হয়।
।। দুই ।।
এর পর সকলেই জানেন ২০১৪-তে সাধারণ নির্বচনে ইউপি-২ সরকারের পতন ঘটে। মোদীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার গঠিত হয়। বিজেপি সরকার ২০১৪-তে ক্ষমতায় এসে কয়লা শিল্পকে বেসরকারিকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং পঞ্চমবার বিজেপি সরকার ‘কোল মাইনস ন্যাশনালাইজেশন অ্যাক্ট-১৯৭৩’-কে বজায় রেখে এই আইনের বাঁধনকে লঘু করার জন্য আরও একটা নতুন অর্ডিন্যান্স আনে, তার নাম হয় ‘কোল মাইনস (স্পেশাল প্রভিশন) অর্ডিন্যান্স-২০১৪’। এই অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বিভিন্ন কয়লা ব্লক দেশের সরকারি এবং বেসরকারি মালিকদের কাছে নিলামে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই অর্ডিন্যান্সে যারা কয়লা ব্লক নিলামে কিনবে তাদের কয়লা উৎপাদন এবং বিক্রয়ের অনুমতি দেওয়া হয়। এই অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে আবার কয়লা শ্রমিকরা যৌথ আন্দোলনে নামেন। এই অর্ডিন্যান্স যখন আনা হয় তখনই অল ইন্ডিয়া কোল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের (সিআইটিইউ) আহ্বান জানিয়েছিল যে, এই অর্ডিন্যান্স অনুসারে যেদিন থেকে সরকার কয়লা ব্লক নিলাম করবে সেদিন থেকেই কয়লা শ্রমিকরা হরতালে নামবেন। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়লা শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ, মানববন্ধন, কালো ব্যাচ পরিধান, বিক্ষোভ, মিছিল, ধরনা সহ নানা ধরনের আন্দোলনে নামেন এবং কয়লা শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে অভূতপূর্ব ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের জোট গড়ে ওঠে। ফলে বিজেপি সরকার এই অর্ডিন্যান্সকে ৬ মাসের মধ্যে আইনে পরিণত করতে পারেনি। ফলত এই অর্ডিন্যান্স বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু বিজেপি সরকার হাল ছাড়েনি। আবার ২০১৫ সালে নতুন করে সংসদে ‘কোল মাইনস (স্পেশাল প্রভিশন)-২০১৫,’ নামে বিল আনে। এই বিল লোকসভাতে বিজেপি, তৃণমূল সহ কিছু দলের সমর্থনে পাশ হয়। এই সময় রাজ্যসভাতে বিজেপি’র সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না, তবুও এখানেও বিজেপি, তৃণমূল, বিএসপি এবং কংগ্রেস সহ কয়েকজন সাংসদ মিলে এই বিলকে ভোট দিয়ে পাশ করে। পরে রাষ্ট্রপতি ৩০ মার্চ ২০১৫ এই বিলে সাক্ষর করেন। ফলে এই বিল আইনে পরিণত হয়ে নাম হয় ‘কোল মাইনস (স্পেশাল প্রভিশন) অ্যাক্ট-২০১৫’।
প্রসঙ্গত, এই ‘কোল মাইনস (স্পেশাল প্রভিশন) অ্যাক্ট-২০১৫’ লাগু হওয়ার পুর্বে বহুবার ‘কোল মাইনস ন্যাশনালাইজেশন অ্যাক্ট ১৯৭৩’ সংশোধন হওয়া সত্ত্বেও খোলাবাজারে কয়লা বিক্রির অধিকার এবং দাম নির্ধারণ ‘কোল ইন্ডিয়া’ ছাড়া আর কাউকেও দেওয়া হয়নি। এমনকি মনমোহন সরকারের বিতর্কিত ২১৪ ‘ক্যাপটিভ কয়লা ব্লক’ বণ্টনের ক্ষেত্রেও বাজারে কয়লা বিক্রির কোনো অধিকার কাউকেই দেওয়া হয়নি। বিজেপি সরকারই প্রথম ‘কোল মাইনস (স্পেশাল প্রভিশন) অ্যাক্ট-২০১৫’ এনে কয়লা শিল্পের বেসরকারিকরণের হাইওয়ে চালু করে দিয়ে কার্যত ‘কোল মাইনস ন্যাশনালাইজেশন অ্যাক্ট ১৯৭৩’-এর এক্তিয়ার খতম করে দিল। এর ফলে এখন থেকে কয়লা খনন এবং বিপণনের উপরে কোল ইন্ডিয়ার আর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থাকল না।
কারণ, নতুন আইনে অর্থাৎ ‘কোল মাইনস ( স্পেশাল প্রভিশন) অ্যাক্ট-২০১৫’ অনুসারে যারা কয়লা ব্লক নিলামে নেবে তাদের কয়লা খনন, বিক্রি এবং কয়লার দাম নির্ধারণের অধিকার দেওয়া হয়েছে।
।। তিন ।।
কিন্তু দেখা গেল এই ‘কোল মাইনস (স্পেশাল প্রভিশন) অ্যাক্ট-২০১৫’ আইনে এমন কিছু অনুচ্ছেদ ছিল যাতে ব্লক নিলামে বেশ কিছু অসুবিধা হচ্ছিল। যেমন প্রথমত, যে কোম্পানিগুলো যে কয়লা ব্লক নিলামে কিনবে তাদের কয়লা খনন করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, যারা এই কয়লা ব্লক নিলামে কিনবে তাদের একমাত্র ভারতীয় কোম্পানি হতে হবে। বিদেশের কোনো কোম্পানি যদি কয়লা ব্লক নিলামে কিনতে আসে তাহলে তাদেরকে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি নিতে হবে। তৃতীয়ত, এই ব্লক যারা নেবে তাদের সেই নির্দিষ্ট সমস্ত কয়লা ব্লকে যত কয়লা মজুত আছে সেই মজুতের উপর যা দাম ঠিক হবে সেই দামের ৪ শতাংশ অগ্রিম দিয়ে কয়লা ব্লক নিতে হবে। এই কঠোর শর্ত থাকার জন্য ২০১৫ সালের পর থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কোনো কোম্পানি কয়লা ব্লক নিলামে অংশ নিতে আগ্রহ দেখায়নি। কারণ, মোট মজুত কয়লার উপর ৪ শতাংশ অর্থ অগ্রিম দেওয়ার মতন অর্থ তাদের কাছে ছিল না আর যাদের কাছে ছিল তাদের হয়তো দেখা যাবে কয়লা তোলার কোনো অভিজ্ঞতা নেই; এবং বিদেশের বড়ো বড়ো কোম্পানি ছাড়া মোট কয়লা রিজার্ভের উপরে ৪ শতাংশ অর্থ অগ্রিম দাম দিয়ে কয়লা ব্লক নেওয়ার ক্ষমতা আমাদের দেশের কোনো ব্যক্তিমালিকদের বা কোম্পানির ছিল বলে মনে হয় না। এই আইনের বিরুদ্ধে কয়লা শিল্পে সমস্ত ইউনিয়ন মিলে ২০১৫ সালের ৫ থেকে ১০ জানুয়ারি হরতাল আহ্বান করে এবং ৫ ও ৬ দু’দিন হরতাল হওয়ার পরে কয়লা মন্ত্রীর কথাতে অন্য ইউনিয়নগুলো বাকি চার দিন অর্থাৎ ১০ তারিখ পর্যন্ত হরতাল স্থগিত রাখে। সিআইটিইউ এই সিদ্ধান্তের সাথে দ্বিমত পোষণ করলেও কোনো স্বাক্ষর না করেও যৌথ আন্দোলনের স্বার্থে ইউনিয়নগুলোর সাথে ভবিষ্যতে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য বাকি ৪ দিন হরতাল থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। এবং দিল্লিতে যন্তর মন্তরে ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ বৃহত্তর শ্রমিক সমাবেশের মাধ্যমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। কিন্তু বিজেপি সরকার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। তারা ‘কোল মাইনস (স্পেশাল প্রভিশন) অ্যাক্ট-২০১৫’ কে কার্যকর করতে উঠেপড়ে লেগে পড়লেও কোল ব্লক নিলামে কেউই ২০১৯ পর্যন্ত অংশ নেয় নি তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা থেকে সরকার ঠিক করে যে, শুধু ‘কয়লা খনি জাতীয়করণ আইন-১৯৭৩’ নয় ‘কোল মাইনস (স্পেশাল প্রভিশনস) ২০১৫’ আইনকেও আবার সংশোধন করা দরকার। এর সাথে ‘মাইনস অ্যান্ড মিনারেল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেশন অ্যাক্ট ১৯৫৭’-কেও সংশোধন করা দরকার।
বিজেপি সরকার ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে এই দুই আইনের উপর অর্ডিন্যান্স নিয়ে আসে। যে কথা শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। এই অর্ডিন্যান্সে বলা হলো : প্রথমত, যারা কয়লা ব্লক নিলামে অংশ নেবে সেইসব মালিকের কয়লা খননের কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও চলবে। দ্বিতীয়ত, যারা কয়লা ব্লক নিলামে অংশ নেবে তারা দেশি-বিদেশি যে কেউ হতে পারে। তৃতীয়ত, এখন থেকে কয়লা ব্লক নিলামে যারা অংশ নেবে তাদের ওই নির্দিষ্ট ব্লক নেওয়ার আগে মোট মজুত কয়লার দামের ৪ শতাংশ অর্থ আগাম দিতে হবে না। সরকার কয়লার যা দাম নির্ধারণ করবে সেই দামে (ফ্লোর ভ্যালু) বা তার থেকে বেশি দামেও বিক্রি করে তারপর সরকারের নির্ধারিত দামের ৪ শতাংশ সরকারকে দিতে হবে। তাও বিভিন্ন কিস্তিতে দিলেও চলবে এবং সেই কিস্তির যা দিন ধার্য করা হয়েছে সে এক জটিল প্রক্রিয়া। তা হলো কয়লা উত্তোলন এবং বিক্রয়ের একশো কুড়ি দিন বা তার বেশি দিনের মধ্যে এই দাম দিতে হবে।
এইভাবেই ‘কোল মাইনস ন্যাশনালাইজেশন অ্যাক্ট ১৯৭৩’ এবং ‘মাইনস অ্যান্ড মিনারেল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেশন অ্যাক্ট ১৯৫৭’-তে কয়লা উত্তোলন, বিপণন এবং দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে সব বাধা ছিল এক এক করে তা দূর হলো। এভাবেই দেশের একটি মহারত্ন কোম্পানির কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার কাজ বিজেপি সরকার করে ফেলল। ১৯৭৩ সালে কয়লা শিল্প জাতীয়করণ হয়েছিল কয়লা শিল্প শ্রমিক এবং দেশের জনগণের আন্দোলনের ফলে। কয়লা শিল্পে যেভাবে ব্যক্তিমালিকদের মধ্যযুগীয় কায়দায় শোষণ এবং নিপীড়ন চলত তা শেষ করার ক্ষেত্রে ‘কোল মাইনস ন্যাশনালাইজেশন অ্যাক্ট ১৯৭৩’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই আইন অনুসারে কয়লা খনন, উত্তোলন, বিপণন এবং কয়লার দাম নির্ধারণ করার একচেটিয়া অধিকার ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোল ইন্ডিয়ার। কোল মাইনস স্পেশাল ২০১৫ আইনে এগুলো সব খর্ব করে দেওয়া হলো।