৫৭ বর্ষ ৪৩ ও ৪৪ সংখ্যা / ২৬ জুন ২০২০ / ১১ আষাঢ় ১৪২৭
তাই আমাদের আছে পথ…
বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়
পেট্রোপণ্যের দাম বাড়ার বিরুদ্ধে রানিগঞ্জে ডিওয়াইএফআই’র প্রতিবাদ।
কিছু কিছু জিনিস পেছন থেকে শুরু করাই ভালো। তাতে হাতে কলমে বুঝে নিতে সুবিধে হয়। বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছর বুঝতে গেলে যেমন তার আগের কয়েক দশকের সলতে পাকানোটা জেনে নিতে হয়, মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ বুঝতে গেলে যেমন মোগল সাম্রাজ্যটাকে কিছুটা বুঝে নিতে হয়, এও অনেকটা সেরকম। তাই একটু পেছন থেকেই শুরু করি না হয়।
২০১৪ সাল। দেশের ষোড়শ লোকসভা নির্বাচন। যে নির্বাচনের আগে ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট স্টাইল প্রচারে চোখ ধাঁধিয়ে গেছিল ১২৫ কোটি ভারতবাসীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের। ‘বহুত হুয়া নারী পর অত্যাচার, আবকী বার মোদী সরকার।’ অথবা ‘বহুত হুই দেশ পর মেহঙ্গাই কী মার, অবকী বার মোদী সরকার’। কিংবা ‘বহুত হুই জনতা পর পেট্রোল ডিজেল কী মার, আবকী বার মোদী সরকার’। রঙ বেরঙের পোস্টার, ফ্লেক্স-এ ছেয়ে গেছিল দেশ। সেবার ৯ দফা নির্বাচনের প্রথম দিন ৫২ পাতার নির্বাচনী ইশ্তিহার প্রকাশ করেছিল বিজেপি। যা নিয়ে পরে আপত্তি জানায় খোদ নির্বাচন কমিশন। ২০১৯-এ কমিশনের বক্তব্য ছিলো নির্বাচন শুরুর কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা আগে ইশ্তিহার প্রকাশ করতে হবে। এবার বিজেপি’র ইশ্তিহার নাম বদলে ‘সংকল্পপত্র’ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল নির্বাচন শুরুর তিন দিন আগে।
ইশ্তিহার নিয়ে আলোচনা করব না। অনেক পাতা। অনেক বাক্য। অনেক শব্দ, অক্ষরের ভিড়। রাস্তা হারানোর সম্ভাবনা প্রবল। তাই শুধু না হয় পেট্রোল-ডিজেল নিয়েই থাকি।
দেশে সমস্যা বড়ো কম নেই। তালিবানি জামাতের সদস্যদের মাধ্যমে করোনা সংক্রমণের প্রচার থেকে ‘আচ্ছে দিন’, কিংবা হাতির মৃত্যু – প্রচারের জোরেই দিনকে রাত করে দেওয়া খুব সহজেই সম্ভব হয় ১৩০ কোটির দেশে। কোন্টা ফেক নিউজ আর কোন্টা সত্যি—পরে সে বিচারের চেষ্টা করা হলেও সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটে ততক্ষণে যা প্রচার হবার হয়ে যায়।
এই যেমন ধরা যাক পেট্রোপণ্যের দাম বাড়া-কমা। আসুন বর্তমান কেন্দ্রীয়মন্ত্রী ও আমেথির সাংসদ স্মৃতি ইরানীর এক ট্যুইট বার্তা একটু দেখে নিই – “Chinese incursion, Petrol prices rise again, Rupee falling, 60% of Indians struggling for food n all they speak about is cloak of Secularism”। গোদা বাংলায় যার অর্থ হয় – চীনের আগ্রাসন, পেট্রোলের দাম আবার বেড়েছে, টাকার দাম কমেছে, ৬০ শতাংশ ভারতীয় খাবারের জন্য লড়াই করছে আর এরা শুধু ধর্মনিরপেক্ষতার তত্ত্ব আওড়ে চলেছে। না। এটা ২০২০-র কোনো ট্যুইট নয়। এই ট্যুইট বিজেপি নেত্রী করেছিলেন ১৫ জুলাই ২০১৩। বিরোধী থাকাকালীন।
আর ২০২০তে এই মুহূর্তে দেশের কী অবস্থা। আজ বুধবার ২৪ জুন। গত ১৮ দিন ধরে লাগাতার দেশে পেট্রোপণ্যের দাম বেড়েছে। শুধুমাত্র দিল্লিতে গত ১৮ দিনে পেট্রোল এবং ডিজেলের দাম লিটার প্রতি বেড়েছে যথাক্রমে ৮.৫০ এবং ১০.৪৮। এই সময়েই লাদাখ নিয়ে চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ হয়েছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী গত শুক্রবার ১৯ জুন এই প্রসঙ্গে সর্বদলীয় বৈঠকে বলেছেন – ভারতের সীমানায় কোনো চীনা সেনা প্রবেশ করেনি। এক ইঞ্চি জমিও কেউ নেয়নি। যে বিবৃতি নিয়ে শোরগোল হবার পর সেই বিবৃতির সংশোধনী আসে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে। যেখানে বলা হয় - উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রধানমন্ত্রীর গতকালের মন্তব্যের অন্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আরও এক বিবৃতিতে জানানো হয় – প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, ভারত এলএসি অতিক্রম করার যে কোনো চেষ্টাকে প্রতিহত করবে, সরকার এলএসি’তে কোনো পরিবর্তন ঘটতে দেবে না। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, এমন একটা সময়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে, যখন আমাদের সাহসী সৈন্যরা সীমান্ত রক্ষার জন্য লড়াই চালাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি...
এই মূহূর্তে দেশে ঠিক কতজন খাবারের জন্য লড়াই করছেন, তা জানতে গত ২৪ মার্চ রাত ৮টায় মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে লকডাউন ঘোষণার পরবর্তী সময়ের খবরাখবর একটু নিরপেক্ষভাবে নেবার চেষ্টা করলেই হবে। তবে সংখ্যাটা যে ৬০ শতাংশের অনেক বেশি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মার্কিন ডলারের অনুপাতে টাকার দাম আজ আরও বেশি নড়বড়ে।
আর ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে ভারতের বর্তমান অবস্থান ঘিরে প্রশ্ন তো আন্তর্জাতিক মহলেই উঠে গেছে। দেশের মানুষ কী মনে করছেন, কতটা ভাবছেন সে প্রশ্ন গৌণ। বরং ভাবা উচিত যারা তা ভাবছেন বা ভাবার চেষ্টা করছেন তাঁদের প্রতি রাষ্ট্রের ব্যবহার নিয়ে।
মাননীয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বছর সাতেক আগের করা এক ট্যুইট নিয়ে হয়তো একটু বেশিই বলা হয়ে গেল। আসলে ট্যুইটার ঘাঁটলে এরকম ‘কড়া সমালোচনা’ করা একাধিক ট্যুইট খুঁজে পাওয়া যায়। ‘ক্রোনোলজি’ বুঝে উঠতে গেলে মাঝে মাঝে এরকম একটু খুঁজে দেখা যেতেই পারে।
যাই হোক। যেখানে ছিলাম। ছিলাম পেট্রোপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে। সেখানেই ফিরি। আমরা বরং একবার দেখে নিই বিগত কয়েক বছরে পেট্রোপণ্যের গড় দাম কী অবস্থায় ছিল। গত ২৩.০৫.২০১৩-র হিসেব অনুসারে দেশের চার মেট্রো শহর – চেন্নাই, মুম্বাই, কলকাতা, দিল্লিতে পেট্রোলের দাম ছিল যথাক্রমে – ৬৫.৯০, ৭১.১৩, ৭০.৩৫ এবং ৬৩.০৯ টাকা। ২০১৪ সালের ৭ জুন তারিখে এই দাম ছিল ৭৪.৭১, ৮০.১১, ৭৯.৩৬ এবং ৭১.৫১ টাকা। ২০১৮ সালের ২৯ মে তারিখে এই দাম ছিল ৮১.৪৩, ৮৬.২৪, ৮১.০৬ এবং ৭৮.৪৩। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তে সেই দাম হয় – ৮৬.৭০, ৯০.৭৫, ৮৫.২১ এবং ৮৩.৪০।
এর পাশাপাশি দেশের চার মেট্রো শহর চেন্নাই, মুম্বাই, কলকাতা ও দিল্লিতে ২০১৩ সালের মে মাসের ২৩ তারিখ ডিজেলের দাম ছিল যথাক্রমে – ৫২.৯২, ৫৭.১৭, ৫৩.৯৭ এবং ৪৯.৬৯। ২০১৪ সালের ৭ জুন তা হয় ৬১.১২, ৬৫.৮৪, ৬১.৯৭ এবং ৫৭.২৮। ২০১৮ সালের ২৯ মে দাম ছিল ৭৩.১৮, ৭৩.৭৯, ৭১.৮৬ এবং ৬৯.৩১। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮-তে দাম হয় ৭৮.৯১, ৭৯.২৩, ৭৬.৪৮ এবং ৭৪.৬৩ টাকা।
অনেকগুলো পরিসংখ্যান দিয়ে ফেলেছি। একটু হয়তো বিরক্ত হচ্ছেন। কিন্তু আর ক’টা পরিসংখ্যান না দিলে লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই বিরক্তি নিয়েই জেনে রাখুন — তেলের দাম বাড়লেই ধুয়ো তোলা হয় আন্তর্জাতিক বাজারের। সেটা আপনিও জানেন। গত ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ৯৭.৯৮ মার্কিন ডলার। ২০১৪-তে ৯৩.১৭, ২০১৫-তে ৪৮.৬৬, ২০১৬-তে ৪৩.২৯, ২০১৭-তে ৫০.৮০, ২০১৮-তে ৬৫.২৩, ২০১৯-এ ৫৬.৯৯ ডলার এবং আজকের তারিখে আন্তর্জাতিক বাজারে ব্রেন্ট ক্রুড ব্যারেল প্রতি দাম ৪২.১২ মার্কিন ডলার। গতকাল দাম ছিল ৪২.৪০ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়েছে বলে দেশে এই সময় পেট্রোপণ্যের দাম বেড়েছে, সেই যুক্তি ধোপে টেকে কি? না। টেকে না। পাশাপাশি মনে রাখতে হবে — গত মাসেই কেন্দ্রীয় সরকার পেট্রোল এবং ডিজেলের ওপর ১০ এবং ১৩ টাকা লিটার প্রতি এক্সাইজ ডিউটি বাড়িয়েছে। বাড়ানো হয়েছে ভ্যাট। বিশেষজ্ঞদের মতে বর্তমানে জ্বালানি তেলের খুচরো দামের ৭০ শতাংশই বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্স।
এত কিছুর পরেও যে কথাটা না বললেই নয়। হাতির মৃত্যু থেকে চীনের আগ্রাসন কিংবা চীনা পণ্য বর্জন – সবকিছুতেই ফেক নিউজের মাধ্যমে যাদের আক্রমণের নিশানা করা হয়, ‘দেশদ্রোহী’র তকমা সাঁটানোর চেষ্টা করা হয়, এক্ষেত্রে লাগাতার পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ প্রথম করেছে সেই বামেরাই। এর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলনের কথা ঘোষণা করে বলা হয়েছে — করোনা মহামারী ও তার জেরে গত তিন মাস ধরে দেশব্যাপী জারি করা অপরিকল্পিত লকডাউনের কারণে দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা ইতিমধ্যেই ধ্বংসের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে মোদী সরকার। এর ওপর লাগাতার পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি তাঁদের জীবনকে আরও অসহায় করে তুলছে।
বামেদের সুস্পষ্ট দাবি: অবিলম্বে পেট্রোপণ্যের ওপর শুল্ক প্রত্যাহার করে দাম কমানো হোক। আয়কর দেন না এমন পরিবারগুলোকে আগামী ছ’মাস প্রতি মাসে ৭,৫০০ টাকা করে দেওয়া হোক। প্রত্যেক দরিদ্রকে ১০ কেজি করে খাদ্যশস্য দেওয়া হোক। যার মধ্যে শেষ দু’টো দাবি লকডাউনের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত লাগাতার করে এসেছে একমাত্র বামেরাই। কেন্দ্রীয় সরকারের অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের ফলে আর্থিক, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষের দুর্দশা দূর করতে একদিকে কমিউনিটি কিচেন চালিয়েছে, বিনামূল্যের বাজার বসিয়েছে, মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দেবার চেষ্টা চালিয়েছে। পাশাপাশি বারবার দাবি জানিয়ে গেছে কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকারের কাছে। পরিস্থিতির অপব্যবহার করে বাজার গরম করা ট্যুইটার ট্রেন্ডিং নয়, বামেদের লড়াই মানুষের স্বার্থে। মানুষের জন্য।