৫৭ বর্ষ ৪৩ ও ৪৪ সংখ্যা / ২৬ জুন ২০২০ / ১১ আষাঢ় ১৪২৭
কে এই শ্যামাপ্রসাদ?
নেতাজিকে মুছে দিতে যাঁকে সামনে আনছে বিজেপি
গৌতম রায়
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নামাঙ্কিত কলকাতা বন্দরের দু’টি অংশ সহ গোটা বন্দরটিকে কেন্দ্রে বিজেপি নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির নামাঙ্কিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কিছুদিন আগে তাঁর কলকাতা সফরকালে এই ঘোষণা করেছিলেন। কোভিড ১৯ জনিত লকডাউনের ভিতর পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা সহ দেশের হাজারো সমস্যাবলীর থেকে শ্যামাপ্রসাদের নামে কলকাতা বন্দরের নামের বদলটিই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এখন সবথেকে গুরুত্ব পেয়েছে।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে শ্যামাপ্রসাদের বিন্দুমাত্র ইতিবাচক ভূমিকা এবং অবদান নেই, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নাম বদলে, সেই শ্যামাপ্রসাদের নামে বন্দরের নামকরণের পিছনে একমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হলো ব্রিটিশের স্বার্থরক্ষাকারী শ্যামাপ্রসাদের যাবতীয় নেতিবাচক দিক থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া।এই প্রেক্ষিতে পর্যায়ক্রমে আমাদের বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার ব্রিটিশ শাসনে বাংলা বা গোটা ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তারের ভিতর দিয়ে শ্যামাপ্রসাদ যেভাবে বিদেশি শাসকদের স্বার্থকে সবরকমভাবে রক্ষা করে গিয়েছেন, তার সার্বিক প্রেক্ষাপটটিকে।
ফজলুল হক মন্ত্রীসভার সদস্য হয়েও প্রিমিয়ার হক সাহেব সম্পর্কে শ্যামাপ্রসাদের অভিমত ছিল, হক সাহেব একাধারে বিরাট সম্পদও বটে, আবার বিরাট বাধাও বটে। হক মন্ত্রীসভার সদস্য হিসেবে নিজের ডাইরিতে শ্যামাপ্রসাদের এই আত্মোপলব্ধি থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, কেবলমাত্র ব্যক্তিস্বার্থে আর সাম্প্রদায়িকতার পালে হাওয়া দিয়ে ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে আরও জোরদার করা ছাড়া, দেশের কোনো স্বার্থে, মানুষের কোনো স্বার্থে শ্যামাপ্রসাদ ফজলুল হক মন্ত্রীসভার সদস্য হননি।
মুখে মধু হৃদয়ে ক্ষুর নিয়েই যে শ্যামাপ্রসাদ শের-ই বাঙ্গালের মন্ত্রীসভাতে যোগ দিয়েছিলেন, তা তাঁর সেই সময়ের দিনলিপি বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি সম্পর্কে প্রথম থেকেই একটা বিদ্বেষমূলক আচরণ নিয়ে চলতেন শ্যামাপ্রসাদ। কৃষক প্রজা পার্টি মুখে গরিব কৃষকদের কথা বললেও , কাজে তাঁরা ছিল জমিদারদের প্রজাদের দল—এই মানসিকতা খুব পরিষ্কারভাবে শ্যামাপ্রসাদ তাঁর দিনলিপিতে ফজলুল হক এবং তাঁর দল সম্পর্কে রেখেছেন। এই মানসিকতা নিয়ে যে মানুষটি হক মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়েছিলেন, সেই যোগ দেওয়ার ভিতরে যে এতোটুকু আদর্শগত তাগিদ, দেশপ্রেমজনিত মূল্যবোধ ছিল না, কেবল ব্যক্তি এবং শ্রেণি-সম্প্রদায়জনিত স্বার্থই ছিল— সে কথা কি আর আলাদাভাবে বলবার দরকার আছে? হক সাহেবের সঙ্গে শ্যামাপ্রসাদ তাঁর পিতা স্যার আশুতোষের ব্যক্তি সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে মন্ত্রীসভায় ঢুকেও ফজলুল হক বা তাঁর দলের মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি দায়বদ্ধতা, মানুষের প্রতি কর্তব্যবোধ—এইসব বিষয়গুলিকেই অত্যন্ত উপহাসের চোখে দেখতেন। তাই ফজলুল হকের দলের সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই—এমন কথা শ্যামাপ্রসাদ পোষণ করলেও কৃষক প্রজা পার্টিকে কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ দলের মর্যাদা তিনি কখনো দিতে পারেননি। ফজলুল হক বহু প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও শ্যামাপ্রসাদের প্রতি স্নেহশীলতার নানা পরিচয় রেখেছিলেন। অথচ শ্যামাপ্রসাদ এই ভাবনাই পোষণ করে গেছেন ফজলুল হক সম্পর্কে যে, ইসলামকে হক সাহেব ব্যবহার করেছেন তাঁর ব্যক্তিস্বার্থে। অর্থাৎ, নিজের রাজনৈতিক চরিত্রটি তিনি ফজলুল হকের উপর আরোপ করে, নিজের যাবতীয় সাম্প্রদায়িক অপকর্ম, ব্রিটিশ তোষামোদ, উচ্চবর্ণের হিন্দু অভিজাতদের স্বার্থরক্ষা, হিন্দু ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষার মতো বিষয়গুলি আড়াল করে, গোটা পরিস্থিতিকে অন্য খাতে বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছেন।
নিজে হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধি ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। রাজনৈতিক হিন্দু স্বার্থকে দেখাই ছিল তাঁর একমাত্র কাজ। সমন্বয়ী হিন্দুর স্বার্থবাহী কোনো কাজ তো দূরের কথা, এ সম্পর্কে একটি শব্দ পর্যন্ত গোটা জীবনে তিনি উচ্চারণ করেননি। এহেন ঘোরতর সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব মুসলিম লিগকে সাম্প্রদায়িক বলে, সেই মুসলিম লিগের ‘খপ্পরে’ ফজলুল হকের পড়ে যাওয়াকে সমালোচনা করছেন শ্যামাপ্রসাদ, অথচ সেই হক সাহেবের মাধ্যমে ক্ষমতার অলিন্দে নিজের প্রবেশকে গৌরবান্বিত করছেন তিনি।
এই পরস্পর বিরোধিতার ভিতর দিয়ে নিজেদের সঙ্কীর্ণ দলীয় রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করা আর সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে চরিতার্থ করা—এটাই ছিল ঘোরতর রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক চরিত্রের সবথেকে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। তিনি অন্যকে যে ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন, সেইসব অভিযোগের প্রতিটি বৈশিষ্ট্য যে তাঁর রাজনৈতিক চরিত্রের ভিতরে খুব বড়ো করে থেকে গিয়েছে, এই বিষয়গুলিকে তিনি যথেষ্ট ভালোভাবে বুঝতেন। আর এই বিষয়গুলিকে ভালোভাবে বুঝতেন বলেই, সাধারণ মানুষ যাতে সেগুলি কোনো অবস্থাতেই বুঝতে না পারেন, সেই দিকে চেষ্টার ত্রুটি ছিল না শ্যামাপ্রসাদের। তাই তিনি নিজের স্বার্থ, সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, কদর্য মুসলিম বিরোধিতা—এইসব আড়াল করতেই হক মন্ত্রীসভার ভিতরে বসেই হক সাহেবের এভাবে চরিত্র হনন করে গিয়েছেন।
১৯৩৫-এর ভারত শাসন অনুযায়ী নির্বাচন হয় ১৯৩৭ সালে। এই নির্বাচনে ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হয়। হক সাহেব কোনো অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িক মুসলিম লিগের খপ্পরে পড়তে চাননি। শরৎ বসুর সঙ্গে কংগ্রেসকে নিয়ে কোয়ালিশন সরকার করবার ভাবনাতে তিনি অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। এই অবস্থায় শরৎ জায়া বিভাবতী বসুর দ্বারা ভয়ঙ্করভাবে অপমানিত হয়ে ফজলুল হক কিভাবে রাতারাতি মুসলিম লিগের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার করেন, তার যাবতীয় বিবরণ রেখে গিয়েছেন আবুল মনসুর আহমদ। এই প্রসঙ্গটিকেও সম্পূর্ণভাবে একটা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে দেখেছেন শ্যামাপ্রসাদ। বিভাবতী বসুর আচরণ তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত, নাকি কংগ্রেসের জাতীয় নেতৃত্বের শরৎ বসুর উপর চাপজনিত প্রতিক্রিয়া — সেইসব বিচার বিশ্লেষণের ধারপাশ দিয়ে শ্যামাপ্রসাদ তাঁর দিনলিপির চতুর্থ পরিচ্ছেদে একটি বারের জন্যেও যাননি। কংগ্রেসকে হিন্দু স্বার্থবাহী হিসেবে না দেখার বেদনার ভিতর দিয়ে কৌশলে শ্যামাপ্রসাদ সেই দলটিকে সাম্প্রদায়িক বলে চালাতে চেয়েছেন। আদর্শগত অবস্থান থেকে কংগ্রেস জাতীয় আন্দোলনের কালে একটি বারের জন্যেও নিজেদের সাম্প্রদায়িক বলেনি। অথচ ফজলুল হকের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার তৈরি না করার ঘটনাকে অবলীলায় কংগ্রেস কর্তৃক হিন্দু স্বার্থের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার মতো কাজ বলে বর্ণনা করেছেন শ্যামাপ্রসাদ। তাঁর এই হীন মানসিকতা থেকেই বুঝতে পারা যায় যে, সাম্প্রদায়িকতার চশমাটা তিনি এতো আঁটোসাঁটো করে চোখে পড়েছিলেন যে, তাঁর পক্ষে সাম্প্রদায়িকতার পরিমণ্ডলের বাইরে কোনো কিছু দেখাটাই আর আদৌ সম্ভবপর ছিল না।
শরৎচন্দ্র বসুর পত্নী বিভাবতী দেবীর ব্যক্তিগত দম্ভ, অপরকে শ্রদ্ধা না করার মানসিকতা, ফজলুল হকের মতো নেতাকে শরৎ বসুর সঙ্গে দেখা করতে না দেওয়া, শরৎ বাবুর মাথা ধরেছে, তাই তিনি দেখা করতে পারবেন না বলে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে আগত সপার্ষদ ফজলুল হককে ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা বাংলার রাজনীতিতে, তথা দেশের সার্বিক পরিবেশে কতোটা বিয়োগান্তক পরিবেশের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল, তা বোঝার মতো মানসিকতা কি শ্যামাপ্রসাদের ছিল? বিভাবতী বসুর কাছে অপমানিত ফজলুল হক কোন্ মানসিক অবস্থায় হাত ধরেছিলেন মুসলিম লিগের তা বোঝার মতো মেধা কি শ্যামাপ্রসাদের ছিল? গোটা ঘটনাক্রম কিন্তু শ্যামাপ্রসাদের না জানা থাকার মতো বিষয় না। কারণ, দিদি কমলার গৃহশিক্ষক হিসেবে, পিতার একদা জুনিয়র হিসেবে ফজলুল হকের কাছে শ্যামাপ্রসাদের ছিল অবারিত দ্বার। হক সাহেব সেই সম্পর্ককে সব সময়েই মর্যাদা দিয়ে এসেছেন। শ্যামাপ্রসাদ কিন্তু হক সাহেবের দেওয়া সেই মর্যাদা থেকে সবরকমের রাজনৈতিক সুযোগ নিয়েছেন, কিন্তু একটিবারের জন্যেও যোগ্য রাজনীতিক আচরণ করেননি তাঁর প্রতি। বিভাবতী বসু যেভাবে অপমান করেন ফজলুল হককে, তার প্রতিক্রিয়া রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কিভাবে পড়েছিল, তার ভাবগম্ভীর, নিরপেক্ষ সাক্ষ্য এবং মূল্যায়ন আবুল মনসুর আহমদ করে গিয়েছেন। শ্যামাপ্রসাদ এই ঘটনাক্রম সবটাই জানতেন ফজলুল হকের সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্কের দৌলতে। কিন্তু একটিবারও তিনি হক সাহেবের প্রতি সুবিচার করে কোনো কার্যক্রম তো দূরের কথা, নিজের ডাইরির পাতাতেও একটা ইতিবাচক শব্দ পর্যন্ত লেখেননি। এ থেকেই শ্যামাপ্রসাদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক চরিত্রের অভিমুখটা অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।
নবাব মোশাররফ হোসেন আর তিনি নিজে ছাড়া মন্ত্রীসভাতে ফজলুল হক মুসলিম লিগের হাতের পুতুল ছিলেন—এই অভিযোগ শ্যামাপ্রসাদ তাঁর দিনলিপির আগাগোড়া করে গিয়েছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাথমিক স্তরের একজন ছাত্রও জানেন যে, মন্ত্রীসভার ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর পদটি হচ্ছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ আমলেও যেমন, স্বাধীন ভারতেও তেমনই, ইংলন্ডের আইনসভার মতোই যদি অর্থবিল আইনসভাতে পরাজিত হয়, তাহলে সরকারের পতন ঘটে।
শ্যামাপ্রসাদের কথা অনুযায়ীই যদি ফজলুল হক মুসলিম লিগের হাতের পুতুল হয়ে গিয়ে থাকেন অখণ্ড বাংলার প্রিমিয়ার হিসেবে, তাহলে তিনি কি করে মুসলিম লিগের মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার ঠিক বিপরীত মেরুতে অবস্থান করা, হিন্দু সাম্প্রদায়িক, হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধি শ্যামাপ্রসাদকে তাঁর মন্ত্রীসভাতে অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন? শ্যামাপ্রসাদ রাজনৈতিক হিন্দুদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখবার ভিতর দিয়ে মুসলিম লিগের রাজনৈতিক মুসলমানদের স্বার্থ সুরক্ষিত করবার বিষয়টি সুনিশ্চিত করবেন—এটাই কি শ্যামাপ্রসাদ- হিন্দু মহাসভা এবং সোহরাওয়ার্দি-মুসলিম লিগের ভিতরে গোপন বোঝাপড়া ছিল? সেই উদ্দেশেই কি মুসলিম লিগ আর হিন্দু মহাসভা, উভয়েই উভয়ের শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা করবার তাগিদ থেকে মুসলিম লিগের মোকাবিলা করতে নলিনীরঞ্জন সরকারের ভূমিকা ঘিরে নিজের মনগড়া কথা শ্যামাপ্রসাদ বলেছেন। বস্তুত ফজলুল হক সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে একটা সন্দেহের বাতাবরণ তৈরির কদর্য মানসিকতা নিয়েই নলিনীরঞ্জন সরকার, প্রিমিয়ার ফজলুল হককে, মুসলিম লিগকে জব্দ করবার প্যাঁচ পয়জার শেখাতেন বলে বিকৃত তথ্য পরিবেশন করে গিয়েছেন শ্যামাপ্রসাদ। এভাবে হক সাহেবের কৃষক প্রজা পার্টির অসাম্প্রদায়িক চেতনাকেও কলঙ্কিত করতে চেষ্টার কসুর করেননি শ্যামাপ্রসাদ। কদর্যতার শেষ পর্যায়ে এসে নলিনী বাবু, হক সাহেবকে পরামর্শ দিতেন লিগকে শায়েস্তা করবার। তাই লিগের চাপে নলিনীবাবুকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। এমন রুচিহীন, অনৈতিহাসিক কথা বলে তিনি ফজলুল হক এবং নলিনীরঞ্জন সরকার, দুইজনেরই একই সঙ্গে চরিত্র হনন করেছিলেন।
’৩৭-এর যে নির্বাচন, যেখান থেকে ফজলুল হকের সঙ্গে মন্ত্রীসভায় গিয়েছিল হিন্দু মহাসভা, মন্ত্রী হয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ, সেই নির্বাচনের ভোটার তালিকা তৈরি হয়েছিল ’৩১ সালের আদমসুমারির ভিত্তিতে। সেদিনের ভোটার তালিকা কিন্তু আজকের মতো তৈরি হতো না।অর্থাৎ, সর্বসাধারণের সেদিন ভোটাধিকার ছিল না। আজ যেমন জনগণনার ভিত্তিকে না মেনে আলাদা করে এনআরসি করতে চাইছে বিজেপি, ’৩১ সালের জনগণনার সময়েও ঠিক তেমনভাবেই জনগণনা ঘিরে হিন্দু মহাসভা যথেষ্ট বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল। সেই বিভ্রান্তির দায় আশ্চর্যজনকভাবে কংগ্রেসের উপর হিন্দু মহাসভা সেদিন চাপিয়েও দিয়েছিল। আর বিভ্রান্তিজনিত সুবিধার ফসল নিজেদের ঘরে তুলতে এতোটুকু দেরি করেনি হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লিগ—এই দুই সাম্প্রদায়িক সংগঠনই।
অত্যন্ত অনৈতিক প্রচারের ভিতর দিয়ে ’৩১ সালের জনগণনাকে ঘিরে এটা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল হিন্দু মহাসভা যে, মুসলমান জনসংখ্যাকে এই গণনাতে ইচ্ছাকৃতভাবে বেশি দেখানো হয়েছে। এই অসত্য প্রচারের দায়ও চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল কংগ্রেসের উপর। শ্যামাপ্রসাদ জনগণনার মুহূর্তে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে খুব বেশি সক্রিয় ছিলেন না। তবে জনগণনাতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুসলমানের সংখ্যা বেশি করে নথিবদ্ধ করা হয়েছে, এই প্রচারকে গোটা বাংলাতে ছড়িয়ে দিতে শ্যামাপ্রসাদ অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
’৩১ সালের জনগণনাকে ব্যবহার করে ’৪১ সালের জনগণনার আগে হিন্দু মহাসভা গোটা বাংলা জুড়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক প্রচার চালাতে থাকে। এই প্রচার চালানোর ক্ষেত্রেও শ্যামাপ্রসাদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। শ্যামাপ্রসাদ গোটা বাংলার সামাজিক কাঠামোটাকে এই সময়ে তছনছ করে দিতে সক্রিয় হন। এপ্রসঙ্গে তাঁর ’৪৫ সালের দিনলিপি থেকে জানা যাচ্ছে যে, তাঁর নাকি মনে হয়েছিল, নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের একটা বড়ো অংশের ভিতরে নিজেদের হিন্দু পরিমণ্ডলের বাইরে থাকার প্রবণতাটা তীব্র হয়ে উঠতে শুরু করেছে (দিনলিপির অষ্টম পরিচ্ছদ)।
গোটা দেশজুড়েই অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সেই সময়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তার জের বাংলাতেও আসতে শুরু করেছিল। আম্বেদকরের আন্দোলনের জের বাংলাতে এসেছিল। সেই প্রবাহকে বাংলাতে সবল করেছিলেন যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের মতো রাজনীতিকেরা। অপর পক্ষে ‘বনবাসী কল্যাণ আশ্রমে’র ভাবনা তখনই আরএসএস করতে শুরু করে দিয়েছিল। ফলে নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের বর্ণোন্নতির কিছু মিথ্যে মোহ দেখিয়ে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের ছাতার তলায় আনতে সঙ্ঘ এবং তার তৎকালীন রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভার যে কার্যক্রম, তারই ছায়া পড়েছে শ্যামাপ্রসাদের দিনলিপিতে। সেই ছায়ার রেখাপাতই ’৪১ এর আদমসুমারিতে আমরা একটা ভয়ঙ্করভাবে দেখতে পাই। হিন্দুদের একত্রীকরণের ভিতর দিয়ে জাতিভেদের চেষ্টা নাকি তাঁরা করেছিলেন—এমনটাই দাবি শ্যামাপ্রসাদের। অথচ অভিজাত ব্রাহ্মণ্যবাদের বাইরে একটি পদক্ষেপও হিন্দু মহাসভা সেদিন নেয়নি।