E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৭ বর্ষ ৪৩ ও ৪৪ সংখ্যা / ২৬ জুন ২০২০ / ১১ আষাঢ় ১৪২৭

পরিবেশ আলোচনা

মহামারীকালে পশ্চাতে ছুরিকাঘাত

তপন মিশ্র




লকডাউনের সুযোগে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক দেশের গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চলগুলিতে ৩০টি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে। এখানে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা (Wildlife management plan) নেওয়া হয়নি। এরমধ্যে কেবল অরুণাচলের দেবাং ভ্যালি প্রকল্পে ২.৯ লক্ষ গাছ কাটা যাবে বলে সরকার বলছে। এই বিপুল দূষণের ভার আমরা কি নীরবে সইব? এর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ ধ্বনিত হোক।

আমরা যখন কোভিডের ভয়ে ঘরবন্দি, আকাশ থেকে পুষ্প বৃষ্টি দেখে হাততালি দিচ্ছি, জানালার ধারে থালি বাজাচ্ছি তখনই পশ্চাৎভাগে বেশ কয়েকটি আঘাত হেনেছে দিল্লির সরকার। আঘাতের এমন সুযোগ ছা‌‌‌ড়বেই বা কেন? যা নিয়ে আমরা খুব একটা আলোচনা করি না, আমরা যারা ভাবি পরিবেশের সমস্যা নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে বা এটা রাজনীতির বিষয় নয়—পরিবেশের বিষয়, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু যাদের কাছে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ লুট, মুনাফাখোর পুঁজির হাতে ছেড়ে দেওয়া এক রাজনৈতিক অপরাধ তার কাছে পরিবেশরক্ষার বর্মগুলি ভেঙে ফেলার বিরুদ্ধাচরণ না করতে পারলে অজান্তে এক বড় ভুল করা হয়ে যাবে।

ইআইএ কি ও কেন?

এখনও দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ অবাধ লুঠের যে কয়েকটি রক্ষাকবচ রয়েছে তার মধ্যে এদেশের এনভাইরনমেন্টাল ইমপাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ)ব্যবস্থা অন্যতম। ইউপিএ-১ সরকারের আমলে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা সম্পর্কিত দুটি বিরল আইন তৈরি হয়। বিরল কারণ, ভারতের ইতিহাসে এমন কোনো আইন অতীতে তৈরি হয়নি। প্রথমটি হলো, সংক্ষেপে অরণ্যের অধিকার রক্ষার আইন (Forest Right Act) এবং দ্বিতীয়টি ইআইএ নোটিফিকেশন (Environmental Impact Assesment Notification)। প্রথম আইনের মাধ্যমে বনবাসী-আদিবাসীদের অরণ্য রক্ষার সঙ্গে আরও বেশি করে যুক্ত করার সম্ভাবনা তৈরি হয় এবং দ্বিতীয়টির মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ আহরণের উপর লাগাম টানার চেষ্টা হয়। ১৯৮৬ সালে যে পরিবেশরক্ষা আইন (Environmental Protection Act)— ইপিএ তৈরি হয়েছিল তার প্রয়োগের অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম হলো ইআইএ। ১৯৯৪ সালে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলির অবাধে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ইপিএ-র উপর ভিত্তি করে একটি দুর্বল নোটিফিকেশন হয়। কিন্তু নখ-দন্ত হীন এই ব্যবস্থা খুব একটা কার্যকরী হয়নি। ২০০৬ সালে তাই নতুন ব্যবস্থা তৈরি করতে হয়। মুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বহুজাতিক এবং এদেশের কর্পোরেটসংস্থাগুলি ২০০৬ সালে আরও আগ্রাসী হয়ে উঠেছিল। তাই এদের উপর নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে পড়েছিল। প্রথম ইউপিএ সরকার তাই সঠিক কারণেই ইআইএ নোটিফিকেশন ২০০৬ আনে।

বড় কোনো প্রকল্প বা সংরক্ষিত অঞ্চল যেমন বনভূমি বা জলাভূমি বা অসংরক্ষিত অঞ্চল যেমন কৃষিভূমি ইত্যাদিতে ভূমি ব্যবহারের রূপ পরিবর্তন করা হলে পরিবেশের উপর তার কি প্রভাব পড়বে তার সমীক্ষা করা দরকার হয়। এগুলি যেমন রাস্তা, জল, বায়ু, মৃত্তিকা, জৈববৈচিত্র্য ইত্যাদির উপর যে কুপ্রভাব পড়ে তাকে শুধরানোর ব্যবস্থা ইআইএ এবং তারই সঙ্গে যুক্ত এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান (ইএমপি)-এর সঙ্গে যৌথভাবে করা হয়। কর্পোরেট সংস্থাগুলি দূষণ রোধে ব্যবস্থা গ্রহণের খরচ কমাতে যতটা সম্ভব এই ব্যবস্থা এড়িয়ে যায়। ২০১৪ সালের পর এই পথের কাঁটা দূর করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে বিজেপি সরকার। এর জন্য বিভিন্ন সময়ে কিছু আদেশনামাও জারি করা হয়। কিন্তু মূল কাঠামো বদলাতে না পারলে ২০০৬-র ইআইএ নোটিফিকেশন-এর বিভিন্ন ধারা থেকে পদে পদে বাধা আসতে থাকে।

ইআইএ নোটিফিকেশন ২০০৬-এর পরিবর্তনের আবশ্যকতা অনুভূত হচ্ছিল। কারণ ২০০৬-র পর ভারতের নদীগুলির জল আরও কয়েকগুণ দূষিত হয়েছে, বায়ুমণ্ডলের দূষণের পরিমাণ বেশ কিছু শহরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছেছে, ঘন এবং প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের পরিমাণ কমেছে এবং সর্বোপরি বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। ইতিমধ্যে কর্পোরেটদের পরিবেশরক্ষা আইন এবং ইআইএ-র বিজ্ঞপ্তির ফাঁকফোকর খোঁজার দক্ষতা অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। অতএব আইনের পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এই পরিবর্তন যে পুরোপুরি কর্পোরেটদের পক্ষে হবে এটা কেউ ভাবতে পারেনি।

২০২০-র বিজ্ঞপ্তি
কেন বিরোধিতা করতে হবে?

প্রথম কারণ হলো, সরকারের অত্যন্ত অনৈতিক আচরণ। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক ২৩ মার্চ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে যাতে বলা হয়: ৬০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ২২ মে-র মধ্যে আইন অনুযায়ী মতামত দিতে যার পোশাকি নাম ‘পাবলিক কনসালটেশন’। দেশে কোভিডের কারণে লকডাউন ঘোষিত হয় ২৪ মার্চ। তাই পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ সহ অনেকেই দাবি করে সময়সীমা পরিবর্তনের। পরিবর্তন করা হয় ৩০ জুন পর্যন্ত। কিন্তু এখন কি সেই স্বাভাবিকতা তৈরি হয়েছে যার ফলে দেশজোড়া আলোচনা করা যেতে পারে? অর্থাৎ সরকার সামাজিক দূরত্ব বিধি মান্য করার সুযোগ নিয়ে পরিবেশরক্ষা সংক্রান্ত বিরুদ্ধ মতকে দমন করার পাকা ব্যবস্থা করছে।

দ্বিতীয়ত, এই বিজ্ঞপ্তিতে পরিবেশ ছাড়পত্র না নিয়ে প্রকল্পের কাজ শুরুর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যার অন্যনাম ‘Post-facto approve.’ অর্থাৎ বনাঞ্চল ধ্বংস করে, জলাভূমি ভরাট করে, বা কৃষিজমির চরিত্র পরিবর্তন করে নির্মাণ কাজ চলবে এবং পরে যদি মনে হয় যে পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়া দরকার তাহলে তার আবেদন করতে হবে। যদি কোনো বেআইনি কাজ চোখে পড়ে তাহলে জরিমানা হতে পারে। প্রাকৃতিক পরিবেশের কোনো ক্ষতিই একশো শতাংশ পূরণ করা যায় না। তাই লুটের পর ক্ষতিপূরণের দাবির কোনো মানে হয় না। এর বিরুদ্ধে মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট এক মামলার রায়ে বলেন যে, এই ধরনের ব্যবস্থা অনুচিত ‘Derogation of fundamental principles of environmental jurispruden’ অর্থাৎ পরিবেশরক্ষার সাধারণ নিয়মের উল্লঙ্ঘন। ২০১৪ সালের পর গুজরাটে আদানি-হাজারি সমুদ্র বন্দর এভাবেই পরিবেশ আইন উল্লঙ্ঘন করে। পরে অবশ্য মামলা সর্বোচ্চ আদালতে যায়।

তৃতীয়ত, পরিবেশ ছাড় পাওয়ার পর যে এলাকায় প্রকল্প রূপায়িত হবে সেখানে সাধারণ মানুষের সামনে প্রকল্পের পরিবেশ ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর কি প্রভাব পড়তে পারে এবং সেগুলি নিরাময়ের জন্য কি কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে তার জনশুনানি (Public hearing) হয়। এর জন্য ৩০ দিনের নোটিশ দেওয়ার ব্যবস্থা আগে ছিল। সেই সময় কমিয়ে এনে ২০ দিন করা হয়েছে। অনেকেরই দাবি ছিল, এই সময়সীমা ৪৫ দিন করা এবং প্রভাবগুলি ও ব্যবস্থা সমূহ আঞ্চলিক ভাষায় অনুবাদ করে জনসমক্ষে নিয়ে আসা হোক। সরকার সে পথে হাঁটেনি। এই দায়িত্ব প্রশাসনের হওয়ায় এখানেই অনেক ফাঁকফোঁকর রয়ে যায়, যেগুলি পূরণের কোনো চেষ্টাই এবারের বিজ্ঞপ্তিতে করা হয়নি।

চতুর্থত, বলা হয়েছে, যে কিছু কিছু প্রকল্প ইআইএ প্রক্রিয়া থেকে বাদ থাকবে। যেমন রাস্তা, ক্যানাল ইত্যাদির মতো রৈখিক প্রকল্প (Linear project), ১৫০ হেক্টর পর্যন্ত এরিয়া ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প যেমন গুচ্ছ বাড়ি বা উপনগরী তৈরি বা যদি কোনো জাতীয় উদ্যান, সংরক্ষিত অঞ্চল, গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি ইত্যাদির মধ্যে রৈখিক প্রকল্প গ্রহণ করার পরিকল্পনা হয় তাহলে তার কোনো ইআইএ লাগবে না। উপনগরী বা এরিয়া ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পে গ্রিন হাউস গ্যাসের (Green house gas) সব থেকে বেশি উদ্গীরণ হয় কারণ বৃক্ষরোপণ প্রায় হয় না বরং এসি ইত্যাদি বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রপাতির ব্যবহার অনেক বেশি হয়। এখানে নিত্যদিনের বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণও অনেক বেশি। আসলে ট্রাম্পের রিয়াল এস্টেটে ভারতে ঢুকতে খুব অসুবিধা হচ্ছে।

একটি বনভূমিকে দ্বিখণ্ডিত করে দিলে বন্যপ্রাণের চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়। ভারতের অনেকস্থানে রাস্তায় বন্যপ্রাণ চাপা পড়ার ঘটনা আকছার ঘটছে। এই সমস্ত ক্ষেত্রে ইআইএ করা গেলে দূষণের পরিমাণ যেমন কমানো যায় তেমনই বন্যপ্রাণের খণ্ডিত আবাসস্থলকে কিছুটা বন্যপ্রাণ যাতায়াতের উপযোগী করা যায়।

উন্নয়ন প্রকল্পের বিরোধিতা আমরা কেউ করছি না। কিন্তু সরকার উন্নয়ন প্রকল্পের সাথে পরিবেশরক্ষা, বন্যপ্রাণরক্ষা ইত্যাদির যে ব্যবস্থাপনা করা দরকার তা করছে না। বরং কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে আরও ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থা পাকাপাকি করছে। এই লকডাউনের সুযোগে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক দেশের গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চলগুলিতে ৩০টি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে। এখানে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা (Wildlife management plan) নেওয়া হয়নি। এরমধ্যে কেবল অরুণাচলের দেবাং ভ্যালি প্রকল্পে ২.৯ লক্ষ গাছ কাটা যাবে বলে সরকার বলছে। এই বিপুল দূষণের ভার আমরা কি নীরবে সইব? এর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ ধ্বনিত হোক।