৫৭ বর্ষ ৪৩ ও ৪৪ সংখ্যা / ২৬ জুন ২০২০ / ১১ আষাঢ় ১৪২৭
হুল দিবস স্মরণে
শংকর মুখার্জি
১৮৫৫-৫৬ সাল। সিপাই বিদ্রোহের গোলার আঘাতে কোম্পানি শাসনের ভিত তখনও নড়ে ওঠেনি। তার আগেই পূর্ব ভারতের বীরভূম, রাজমহল, ভাগলপুর প্রভৃতি অঞ্চলে সাঁওতাল বিদ্রোহের আগুন জ্বলেছিল। দগ্ধ হয়েছিল কোম্পানি শাসন।
কোম্পানি শাসকদের প্রত্যক্ষ মদতে জমিদার, মহাজনরা অকথ্য অত্যাচার চালাত সাঁওতাল জনগণের উপর। জমিদার, মহাজনদের অত্যাচার নিপীড়নের অসংখ্য কাহিনি ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ আছে। উনিশ শতকের প্রথম থেকেই শুরু হয়েছিল এই ব্যবস্থা। সাঁওতাল জনগণ জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছিল, বিদেশি শাসনের অবসানেই তাদের এই দুঃখের জীবন থেকে মুক্তি ঘটবে।
সেই বিদেশি শাসন উৎখাতের লড়াইতে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন ভগনাডিহি গ্রামের চার—ভাই সিদু, কানহু, চাঁদ ও ভৈরব। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন সমগ্র সাঁওতাল জাতিকে ভগনাডিহির মাঠে আসার ডাক দেন সিদু-কানহু। দশ হাজারেরও বেশি সাঁওতাল মানুষ সেদিন তাদের ডাকে ভগনাডিহির মাঠে জড়ো হয়েছিল। সিদু-কানহু ভাষণ দিয়েছিলেন। তারা শোষণহীন স্বরাজ প্রতিষ্ঠার শপথ গ্রহণের আহ্বান জানান। সমবেত সাঁওতাল মানুষরা একসঙ্গে বলেছিল : ‘‘দেলায়া বিরিদ্ পে, দেলায়া তিঙ্গুন পে’’—‘‘জাগো ওঠো, সাঁওতালরাজ কায়েম কর’’। সমাবেশে ঘোষণা করা হয়েছিল : মহাজন, জমিদারদের উচ্ছেদ করে সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চল দখল করা হবে। প্রতিষ্ঠা করা হবে স্বাধীন শাসনব্যবস্থা। শুরু হলো ১০ হাজারেরও বেশি সাঁওতালের তীর-ধনুক, টাঙি, বল্লম, কুড়ুল হাতে কলকাতার অভিমুখে পদযাত্রা। তারা উচ্ছেদ করতে চেয়েছিল মহাজন, জমিদারদের। এর জন্য পরাস্ত করতে হবে বিদেশি শাসকদের। তাই তাদের শাসনব্যবস্থার সদরদপ্তর কলকাতা অভিমুখে ছিল তাদের অভিযান। সাঁওতাল জনগণের সেই বিদ্রোহকে স্মরণ করতেই ৩০ জুন পালিত হয় হুল উৎসব।
উপনিবেশিক শাসনকালের বহু ব্রিটিশ ঐতিহাসিকই সাঁওতাল বিদ্রোহের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনবিরোধী চরিত্রের উপাদান খুঁজে পান নি। ওই ঐতিহাসিকদের মতে এটা ছিল মূলত মহাজন ও জমিদারদের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের আন্দোলন। পরবর্তী সময়ে যা পুলিশ, দারোগা, আদালতের বিরুদ্ধে আক্রমণে পরিবর্তিত হয়েছিল। একদল দেশি ঐতিহাসিকও ওই ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সাঁওতাল বিদ্রোহের অনুরূপ ব্যাখ্যা হাজির করেছিলেন।
তবে সেই অপচেষ্টা বন্ধ হয়েছে। আধুনিক ঐতিহাসিকরা বিশেষ করে মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই-প্রতিরোধের উপাদান সাঁওতাল বিদ্রোহের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন।
স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজরাও সাঁওতালদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাল। কামান, বন্দুকে সজ্জিত প্রশিক্ষিত ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে সে এক অসম লড়াই। কিন্তু সাঁওতালরা আত্মসমর্পণ কি জিনিস জানত না। ইংরেজরা আত্মসমর্পণের ঘোষণাপত্রও প্রচার করেছিল। সাঁওতালরা তা প্রত্যাখ্যান করে। বীরভূমের তালডাঙা, সাঁইথিয়া, রাজমহল, ভাগলপুরে সাঁওতালদের আধিপত্য কায়েম হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাঁওতালদের পরাজয় ঘটে। ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিধু ধরা পড়ে যায়, তাঁকে গুলি করে হত্যা করে ইংরেজরা। কানহুও ওই সময়ে ধরা পড়ে। তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। এর আগে ভাগলপুরে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে চাঁদ ও ভৈরব প্রাণ হারান। রক্তের বন্যা বইয়ে ইংরেজরা সাঁওতাল বিদ্রোহ দমন করে।
আদালত এই বিদ্রোহের জন্য ২৫১ জনকে অভিযুক্ত করেছিল। এদের মধ্যে ৬০ জন ছিল নিম্নবর্ণের হিন্দু। বাকিরা সাঁওতাল। এঁদের ফাঁসি, কারাদণ্ড হয়। এ ছিল সরকারি তথ্য। প্রকৃতপক্ষে হাজার হাজার সাঁওতালকে হত্যা করেছিল ইংরেজরা।
।। এক ।।
বাংলা-বিহারের এই অরণ্য অঞ্চলের উপর কোম্পানির শাসকদের নজর পড়েছিল আরও ৭৫-৮০ বছর আগে। আঠারো শতকের ৭০-এর দশকে, পলাশী যুদ্ধে জয়ী হবার সুবাদে বাংলা বিহারের দেওয়ানি লাভের পর।
১৭৮০ সাল নাগাদ ভাগলপুরের কালেক্টর ক্লিভল্যান্ডের উদ্যোগে রাজমহল পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপনের চেষ্টা হয়। বসতির নাম রাখা হয় ‘দামিন-ই-কোহ্’—‘পাহাড়ের প্রান্তদেশ’। জঙ্গলের ভিতর, পাহাড়ের উপর যারা থাকত তারা পাহাড়িয়া নামে পরিচিত ছিল। এদের থেকে খাজনা আদায় শুরু হলো। খাজনা দিতে রাজি হলো না এই পাহাড়িয়ারা। তিলকা মুর্মুর নেতৃত্বে সাঁওতালরা (পাহাড়িয়া) ১৭৮৪ সালের জানুয়ারি মাসে বিদ্রোহ করল, প্রথম সাঁওতাল বিদ্রোহ। ১৭৮৫ সালে তিলকা মুর্মুর ফাঁসি হয়। তবু পাহাড়িয়াদের এই বিদ্রোহ আরও ৫-৬ বছর চলেছিল। বীরভূম জেলার প্রায় সমস্ত অংশে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজরা বিদ্রোহীদের দেখা মাত্রই হত্যা করত। কিন্তু এভাবে তারা বিদ্রোহ দমন করতে ব্যর্থ হলো। শেষে বন-জঙ্গল কেটে চাষ-আবাদ করে নতুন গ্রামসমাজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করল তারা। সফল হলো। ১৭৯০ সাল নাগাদ বিদ্রোহের অবসান ঘটল। পার্শ্ববর্তী বহু স্থান থেকে সাঁওতালরা দামিন-ই-কোহ্-তে এসে বসবাস শুরু করল। বনজঙ্গল কেটে স্থাপন করল বসতি।
দ্রুত বদলে যেতে থাকল দামিন-ই-কোহ্-র চেহারা। একটা তথ্যে জানা যায়, ১৮৫১ সাল নাগাদ এখানে ১৪৩৭টি গ্রাম গড়ে উঠেছিল, যেখানে ৮০ হাজারেরও বেশি সাঁওতাল বসবাস করত।
ইতিমধ্যে দেশের ভূমিব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। ১৭৯৩ সালে বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেছে কোম্পানি। গ্রামে তৈরি হয়েছে নতুন জমিদার, মহাজনি সম্প্রদায়। কোম্পানিকে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব দেওয়ার পরিবর্তে একটা বিশাল পরিমাণ জমির উপর খাজনা আদায়ের অধিকার পেত জমিদাররা। তারা যে কোনো উপায়ে, এবং তাদের নিজেদের নির্ধারিত হারে প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করত। কার্ল মার্কস বাংলাদেশের এই বন্দোবস্তকে ‘‘ভূমি ব্যবস্থার এক অদ্ভুত প্রহসন’’ বলে বর্ণনা করেছেন। এই উচ্চহারে খাজনা দিতে গিয়েই ঋণের জন্য মহাজনের দ্বারস্থ হতো কৃষক প্রজারা। সেখানেও এক অকল্পনীয় সুদের হার। নিজেদের রাজস্ব আয়কে সুনিশ্চিত করতে কোম্পানি সমস্ত রকম প্রশাসনিক মদত দিত জমিদারদের। জমিদার, মহাজন, পুলিশ, লাঠিয়ালের সম্মিলিত নিপীড়ন অত্যাচারে গ্রামীণ জীবনে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। দামিন-ই কোহ্-তেও একদল রক্তচোষা মহাজন, ব্যবসায়ী, জমিদারদের ভিড় হলো।
বনজঙ্গল পরিষ্কার করে জমিতে সোনার ফসল ফলাল সাঁওতালরা। তার উপর তাদের কোনো অধিকারই রইল না। সবই উঠতে লাগল ইংরেজ বণিকগোষ্ঠীর কুঠিতে, জমিদার-ব্যবসায়ী-মহাজনদের গুদামে। ১৮৩৮ সালে দামিন-ই-কোহ’তে কোম্পানি খাজনা আদায় করেছিল ২ হাজার টাকা। আর ১৮৫৪-৫৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৮ হাজার ৩৩ টাকা। মাত্র ১৭ বছরে ২৯ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল খাজনা। এই সরল নিরীহ মানুষদের শোষণ করতে, ঠকাতে সব জায়গা থেকে প্রতারক, লোভী ব্যবসায়ী, মহাজনদের সম্মিলন ঘটেছিল দামিন-ই-কোহ্-তে। এরা ঋণগ্রস্ত সাঁওতালদের সারাজীবন বেগার খাটাতে পারত। এদের শোষণ প্রতারণা অত্যাচারে মদত দিত কোম্পানির পুলিশ-প্রশাসন। সাঁওতালদের যখন খুশি গ্রেপ্তার করা, মারধর করা এমনকি মেরে ফেলাও যেত। এই অকল্পনীয় শোষণ-অত্যাচারের অবসানেই ১৮৫৫ সালে সাঁওতালরা বিদ্রোহ করেছিলেন। তাঁরা জীবনের এই অভিজ্ঞতাতেই বুঝেছিল বিদেশি শাসনের অবসানেই তাঁদের এই দুখের জীবনের অবসান ঘটবে।
।। দুই ।।
১৮৫৫-এর সাঁওতাল বিদ্রোহের ৯১ বছর পর দেশ স্বাধীন হয়। বিদ্রোহের অবসানের পর সাঁওতাল পরগনা নামক নন রেগুলেটেড জেলা তৈরি হলো ওই অঞ্চলে। আর এই জেলায় মহাজন, ব্যবসায়ীদের বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ হলো। মিশনারিরা কাজকর্ম আরম্ভ করলেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্যের কিছু কাজ তারা করেছিল। এর বেশি কিছু আর উপনিবেশিক শাসনে হয় নি।
স্বাধীনতার পর সাঁওতাল সহ সমগ্র উপজাতি মানুষদের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা তৎকালীন রাষ্ট্রনায়কদের ভাবনায় ছিল। সংবিধানে তার প্রতিফলন ঘটেছিল। সংবিধানের ৪৬নং ধারায় বলা হয়েছিল : ‘‘রাষ্ট্র বিশেষ যত্ন সহকারে, জনগণের দুর্বলতর বিভাগের এবং বিশেষত তফশিলি জাতি ও তফশিলি উপজাতিসমূহের শিক্ষাবিষয়ক ও অর্থনীতিক স্বার্থের উন্নতিবিধান করিবে এবং তাহাদের সামাজিক অবিচার ও সর্বপ্রকার শোষণ হইতে রক্ষা করিবে।’’ সাংবিধান গ্রহণের ৬৭ বছর পরও সংবিধানের এই নির্দেশ সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া একেবারেই মানা হয়নি।
ভারতে ৬৯৮টি উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করেন। ভারতে সঞ্চিত কয়লার ৯০ শতাংশ এবং অন্যান্য খনিজ সম্পদের প্রায় ৫০ শতাংশ উপজাতি মানুষদের বসবাসের অঞ্চলেই রয়েছে। এছাড়াও জল, জঙ্গল ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ তাদের বাসস্থান অঞ্চল। স্বাধীনতার পর উন্নয়নমূলক প্রকল্প যেমন বৃহৎ বাঁধ, খনি, অরণ্য সংরক্ষণ প্রৃভৃতির সিংহভাগ উপজাতি মানুষদের বসবাসের এলাকাতেই রূপায়িত হয়েছে। কেন্দ্রীয় উপজাতি সংক্রান্ত মন্ত্রকের দেওয়া এক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এ ধরনের উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য যত মানুষ নিজেদের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন তার ৫৫ শতাংশই উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ। সংখ্যাটা প্রায় ৮৫ লক্ষ। ১৯৯০ সালে দেশের জনসংখ্যায় উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল মাত্র ৮ শতাংশ। কিন্তু উচ্ছেদ হওয়ার সিংহভাগ যন্ত্রণা তাদেরই ভোগ করতে হয়েছে।
১৯৯১ সালে দেশে নয়া-উদারনীতির যুগ শুরু হওয়ার পর অবস্থাটা আরও খারাপ হয়েছে। লগ্নিপুঁজি-নিয়ন্ত্রিত উদারনীতির শর্ত মেনে জল, জমি সহ খনিজ সম্পদের অবাধ বেসরকারিকরণ চলছে। ইস্পাত, ধাতু শিল্পের বৃহৎ বেসরকারি শিল্পস্থাপনের জন্য হাজার হাজার একর জমি তুলে দেওয়া হচ্ছে বৃহৎ কর্পোরেটদের হাতে। ১৯৯১-উত্তর সময়ে এই সব প্রকল্পের জন্যও সবচেয়ে বেশি উচ্ছেদের শিকার হয়েছেন উপজাতি মানুষ। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ ওডিশার জগৎসিংপুর জেলায় পসকো, কালাহান্ডি জেলার নিয়ামগিরি পাহাড়ে স্টারলাইট ইন্ডিয়ার প্রকল্প। যদিও পসকো প্রকল্প সম্প্রতি বাতিল ঘোষণা হয়েছে। ১৯৯০-পূর্ব সময়ে উচ্ছেদের জন্য ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হতো না, আর ১৯৯১-উত্তর সময়ে এসব প্রায় উঠে গেছেই বলা যায়। তার উপর বি জে পি সরকার ভূমি আইন ২০১৩-র পরিবর্তনের জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। যদিও কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে তা আটকানো গেছে, তবে বিপদ কিন্তু এখনও যায়নি।
স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে এই যে বিশাল সংখ্যক উপজাতি মানুষকে তাদের বাসস্থান, জীবনধারণের উপায়সমূহ থেকে উচ্ছেদ ঘটানো হয়েছে তা সংবিধানের পঞ্চম তফশিলকেও লঙ্ঘন করেছে। উপজাতি মানুষদের জীবনধারণের ধরন অনুযায়ী প্রাকৃতিক সম্পদ বিশেষ করে বনজ সম্পদ ও জমির উপর তাদের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ জরুরি। পঞ্চম তফশিলে সে ব্যবস্থাই রাখা হয়েছিল। উপজাতি মানুষের স্বার্থ, স্বশাসন, জমির উপর অধিকার প্রভৃতি রক্ষিত হয়েছিল সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফশিলের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সে সবই লঙ্ঘিত হয়েছে। বর্ধিত করা হয়নি তফশিলভুক্ত অঞ্চলের পরিসীমাও।
পরবর্তী সময়ে পি ই এস এ ১৯৯৬ এবং ২০০৬ সালে অরণ্য অধিকার আইন তৈরি হয়েছে। পি ই এস এ-তে বলা হয়েছিল : কোনো উন্নয়নমূলক প্রকল্প রূপায়ণের জন্য, সংশ্লিষ্ট স্থানের গ্রামসভায় তা অনুমোদন করাতে হবে। উপজাতি বসতি অঞ্চলে এই আইন বর্তমানে কার্যকর করাই হয় না। আর ২০০৬ সালে প্রথম ইউ পি এ সরকারের আমলে বামপন্থীদের চাপে অরণ্য অধিকার আইন গৃহীত হয়েছিল। এই আইনে অরণ্য অঞ্চলে বাসবাসকারীদের জমির অধিকার দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল অর্থাৎ তারা জমির পাট্টা পাবে। ইউ পি এ-২ সরকারের আমলে অরণ্য আইন বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব হঠাৎ পরিবেশ ও বনদপ্তরের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তারপরেই আদিবাসী পরিবারগুলির দাবি বাতিল করার সংখ্যা খুব বেড়ে গেছে। এই আইন প্রণয়নের ১৪ বছর পর দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তিগত দাবির ৬১ শতাংশ এবং সম্প্রদায়গতভাবে দাবির ৬৩ শতাংশ বাতিল করা হয়েছে। মোদী ক্ষমতায় আসার পর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। প্রতি ১০টি দাবির ৮টিই এখন বাতিল করা হচ্ছে।
।। তিন ।।
দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার ৭০ বছর পরও আদিবাসী, উপজাতি মানুষদের জমি, অরণ্য সম্পদের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। বরঞ্চ যতটুকু অধিকার অর্জিত হয়েছিল তাও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে উত্তরোত্তর তফশিলি উপজাতি মন্ত্রকের বরাদ্দ কমানো হচ্ছে। যার পরিণতিতে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য তৈরি ট্রাইবাল সাব প্লান-এর বরাদ্দ কমছে।
স্বাধীনতার পর থেকেই উপজাতি মানুষদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বৈষম্যের কারণে নিরক্ষর, দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেনি। ২০১১ সালে আদমসুমারি অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যায় ৮.৬ শতাংশ উপজাতি মানুষ। সংখ্যায় ১০ কোটি ৪৩ লক্ষ। সাক্ষরতার হার মাত্র ৫৯ শতাংশ। দেশের গড় সাক্ষরতার থেকে ১৪ শতাংশ কম। দরিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যার চিত্রটা আরও করুণ। তেন্ডুলকর কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী (২০০৯-১০) গ্রাম অঞ্চলে ৪৭.৪ শতাংশ এবং শহরাঞ্চল ৩০.৪ শতাংশ উপজাতি-আদিবাসী মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করেন। জাতীয় গড় হারের থেকে দু’টিই প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি।
উপজাতি মানুষদের অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ, তাদের প্রতি আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের চোরাগলিতে নকশাল রাজনীতির প্রবেশ ঘটেছে। খুন-সন্ত্রাস-হিংসার পথে তারা এই উপজাতি সমস্যার সমাধান করতে চায়। দীর্ঘ চার-পাঁচ দশকের এই রাজনীতি উপজাতি সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। উল্টে গণ আন্দোলনের অন্যান্য শক্তির এবং জনগণের সমর্থন হারিয়েছে। শাসকশ্রেণিকে উপজাতি মানুষের উপর আরও আক্রমণ নামিয়ে আনার সুযোগ করে দিয়েছে। অর্থাৎ ওই রাজনীতি পরোক্ষে শাসকশ্রেণিকেই সাহায্য করেছে।
দেশ স্বাধীন হলেও উপজাতি মানুষদের উপরে শোষণ অত্যাচার, যৌন নিপীড়নের ঔপনিবেশিক শাসনের সময়কার চিত্রের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। দেশের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বুর্জোয়া-ভূস্বামীদের প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলি যে এই চিত্র পরিবর্তনে উদ্যোগ নেবে না তা অভিজ্ঞতাই বলে দিচ্ছে। আর এখন তো কর্পোরেটদের স্বার্থে উপজাতি মানুষদের জীবনধারণের বিরুদ্ধে আক্রমণ আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। উপজাতিদের বিরুদ্ধে এই অত্যাচার, আক্রমণের খবর দেশের মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমগুলিতে স্থান পায় না। পরিবর্তে তথাকথিত উন্নয়নের জন্য উপজাতি মানুষদের উচ্ছেদকে পরোক্ষে সমর্থন করে এই সংবাদমাধ্যমগুলি। ১৮৫৫ সালে সাঁওতাল বিদ্রোহের সময়ও একই ছবি প্রত্যক্ষ হয়েছিল। সে যুগের কলকাতার বিখ্যাত সংবাদপত্র সংবাদ প্রভাকর, ক্যালকাটা রিভিউ সাঁওতাল বিদ্রোহ দমনের জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানিয়েছিল কোম্পানি প্রশাসকদের কাছে।
।। চার ।।
উপজাতিদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রকৃত উন্নয়ন ও তাদের সমস্যার সমাধানের বিকল্প ও বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে একমাত্র সিপিআই(এম) এবং মূলস্রোতের বামপন্থী দলগুলির। সিপিআই(এম) পার্টি কর্মসূচিতে বলেছে : ...‘‘আদিবাসী ও উপজাতি মানুষ নির্মম পুঁজিবাদী ও আধা সামন্ততান্ত্রিক শোষণের শিকার। জমি থেকে তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন, অরণ্যের অধিকার থেকে তাঁরা বঞ্চিত, ঠিকাদার ও জমিদারদের সস্তা ও দাসশ্রমের রসদ হিসেবে তাঁরা কাজ করেন। কিছু রাজ্যে উপজাতি জনগণের সন্নিবদ্ধ অঞ্চল আছে যাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যে পূর্ণ। নিজেদের পরিচিতি সত্তা ও সংস্কৃতি বজায় রেখেই অগ্রগতির অধিকারের সপক্ষে উপজাতি জনগণের নতুন চেতনা জাগ্রত হয়েছে। পরিচিতি সত্তা এমন কি অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ায় এবং বুর্জোয়া-জমিদার শাসকদের উদাসীন নীতির কারণে উপজাতি জনগণের কিছু অংশের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী ভাবাবেগ জন্ম নিয়েছে। তাদের অধিকার রক্ষায় উপজাতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সন্নিহিত অঞ্চলে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি গণতান্ত্রিক ও ন্যায়সঙ্গত দাবি। পুঁজিপতি-ভূস্বামী-ঠিকাদার চক্র নেতৃত্বকে কিছু সুবিধা পাইয়ে দিয়ে উপজাতি মানুষের চিরাচরিত সংহতি বিপর্যস্ত করতে চায়। এরা উপজাতিদের ন্যায্য অধিকার অস্বীকার করে, নির্মম শক্তি প্রয়োগ করে তা দমন করে।’’ (৫.৬ ধারা) কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা মনে করে ক্ষমতা ও উন্নয়ন পরিকল্পনার গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ এবং আমূল ভূমিসংস্কারের মধ্যেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
অন্যদিকে শাসক বুর্জোয়া দলগুলির অ্যাজেন্ডায় এই বিষয়টা কখনই গুরুত্ব পায়নি। উন্নয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ, আর্থিক বিকাশ, নকশাল সমস্যা প্রভৃতির সঙ্গে উপজাতি মানুষদের সমস্যাকে এক করে দেখিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছে তারা। বর্তমানে আরএসএস এবং হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলি আদিবাসী মানুষদের খ্রিস্টধর্মে রূপান্তরের বিরোধিতা এবং ‘ঘর-ওয়াপসি’-র নামে হিন্দু ধর্মান্তরিত করার আন্দোলন, পরিচিতি সত্তার আন্দোলন আরেক নতুন সমস্যার জন্ম দিয়েছে। প্রকৃত সমস্যাগুলি থেকে জনগণের দৃষ্টিকে আরও দূরে সরিয়ে দেবার চেষ্টা চলছে।
কার্যক্ষেত্রে যখনই সুযোগ পেয়েছে সিপিআই(এম)-র নেতৃত্বাধীন বামপন্থী সরকারগুলি তখনই সেই বিকল্প নীতি তারা হাজির করেছে। পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের সময় পঞ্চায়েতিরাজ ব্যবস্থা কায়েম ও ভূমিসংস্কারের ফলে আদিবাসী ও উপজাতি মানুষদের জীবনমানের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছিল। তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা হয়েছিল। সর্বোপরি জঙ্গলের সম্পদ ও জমির উপর তাদের অধিকার কায়েম হয়েছিল। চা-বাগান এলাকায়ও উপজাতি-আদিবাসী শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়নে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের নীতির কারণেই ত্রিপুরায় উপজাতি এলাকায় স্বশাসিত উন্নয়ন পরিষদ—এডিসি সারা দেশে নজর কেড়েছে। ত্রিপুরায় উপজাতি মানুষদের মধ্যে শিক্ষার হার প্রায় ৮০ শতাংশ যা জাতীয় গড়ের থেকে প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যাও জাতীয় গড়ের অনেক তলায়। লোকসভায় বামপন্থীদের ৬০ জন সংসদের চাপে ও সংসদের বাইরের দীর্ঘ আন্দোলনেই ২০০৬ সালে অরণ্য অধিকার আইন গৃহীত হয়েছিল।
জমি, কাজ, অধিকার রক্ষায় উপজাতি ও আদিবাসী মানুষদের আন্দোলন দেশের শাসকশ্রেণিগুলির বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনেরই অংশ। কোনো বিচ্ছিন্ন লড়াই নয়। উপজাতি-আদিবাসী মানুষরা একা লড়ে তাদের দাবি-অধিকার আদায় করতে পারবে না। উপজাতি-আদিবাসী মানুষদের এই লড়াইয়ে বামপন্থী শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুর আন্দোলনগুলিকে পাশে থাকতে হবে।
১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের সময়েও সাঁওতালরা কুমার, তেলি, কর্মকার, মোমিন (মুসলমান তাঁতি), চামার, ডোমদের আক্রমণ করবে না বলে স্থির করেছিল। তাদের সঙ্গে সাঁওতালদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বিদ্রোহে তাদের পাশে পেয়েছিল সাঁওতালরা। অর্থাৎ সে সময়ে সাঁওতালরাও তাদের শ্রেণিমিত্রদের সম্পর্কে সচেতন ছিল। এখনও সেই শাসকশ্রেণি এবং লগ্নিপুঁজি-নিয়ন্ত্রিত উদার অর্থনীতি যা উপজাতি আদিবাসী মানুষদের জীবন যন্ত্রণাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধেও ঐক্যবদ্ধ শ্রেণিআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ কাজে কমিউনিস্টদের এবং বামপন্থীদেরই বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে। সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬৪ বছর পর সেই দায়িত্বই উপস্থিত হয়েছে।