৫৭ বর্ষ ৪৩ ও ৪৪ সংখ্যা / ২৬ জুন ২০২০ / ১১ আষাঢ় ১৪২৭
সংগ্রামের অভিযাত্রী কামাল লোহানী চিরবিদায়
সন্দীপ দে
তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বামপন্থী, প্রগতিকামী, গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা। এই লড়াইয়ে সংস্কৃতি কর্মীদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে তিনি মনে করতেন। তিনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক-সামাজিক পরিবর্তনের জন্য কমিউনিস্ট পার্টিগুলির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার স্বপ্নকে লালন করতেন। তিনি মনে করতেন কেবল বাংলাদেশেই নয়, গোটা উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা, মৌলবাদ-সন্ত্রাসবাদের হিংস্রতা প্রতিরোধে কমিউনিস্টদের অগ্রণী ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি আমৃত্যু এই লড়াইয়েই ব্রতী ছিলেন।
তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামী অভিযাত্রার পরিসমাপ্তি হলো ২০ জুন, ঢাকায়। তিনি বাংলাদেশের প্রগতি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব,ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, পরবর্তীকালে বামপন্থী আন্দোলন, সাংবাদিকদের অধিকার ও দাবি প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের অগ্রগণ্য নেতা, এই উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদ-মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী লড়াইয়ের নির্ভীক সেনানী-সর্বজন শ্রদ্ধেয় কমরেড কামাল লোহানী। এদিন সকাল সওয়া দশটা নাগাদ ঢাকার শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। তিনি ফুসফুসের সংক্রমণ, কিডনির সমস্যা সহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে কিছুদিন আগেই হাসপাতালে ভরতি ছিলেন। তারপর কিছুটা সুস্থ হলে তাঁকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর আবারও তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং শেষপর্যন্ত তিনি করোনায় আক্রান্ত হন। তিনি জীবনে অনেক লড়াইয়ে জয়লাভ করলেও এবারের লড়াইয়ে তাঁকে থেমে যেতে হল।
তাঁর প্রয়াণে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মহম্মদ আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। রাজ্য বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র, অধ্যাপক পবিত্র সরকার প্রমুখও শোক জানিয়েছেন।
কামাল লোহানী ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার খান সোনাতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী, মা রোকেয়া খান লোহানী। মাত্র ৬-৭ বছর বয়সে মার মৃত্যুর পর বাবা তাঁকে পাঠিয়ে দেন কলকাতায় পিসি সালমা খানমের পার্কসার্কাসের বাড়িতে। তখন ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ আবহ। তিনি কখনো কাটিয়েছেন ঘরে, কখনো ট্রেন্সে। সৈয়দ আমির আলি অ্যাভিনিউতে শিশু বিদ্যাপীঠে যেতেন কানে তুলো দিয়ে। তিনি তখন দেখেছেন মন্বন্তর, দেখেছেন ’৪৬-এর ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে তিনি চলে আসেন পাবনায় ছোটো কাকা শিক্ষাবিদ ও লেখক তাসাদ্দুক খান লোহানীর কাছে। ১৯৫২ সালে তিনি ম্যাট্রিকের ছাত্র। সেই সময় ২১,২২,২৩ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের উত্তাল আবহে তিনি জড়িয়ে পড়েন রাজনৈতিক আন্দোলনে। ১৯৫২-তে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভরতি হন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। এখানে ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে আন্দোলনে যোগদান এবং বারবার কারাবরণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি। এই কলেজে থাকার সময়ে তিনি উদ্যোগী হয়ে সমমনা ছাত্রদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘পাইওনিয়ার্স ফ্রন্ট’ এবং ছাত্রসংসদের নির্বাচনী লড়াইয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেন। এই সময় রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হন, সেই সঙ্গে উপস্থাপনা, গ্রন্থনা এবং আবৃত্তিতে পাঠ নেন।
১৯৫৩ সালে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন, যিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনে ছাত্র হত্যাকারী, তাঁর আগমন ও মুসলিম লিগের সম্মেলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করায় অনেক অধ্যাপক ও ছাত্রের সঙ্গে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় ‘গভর্নর শাসন’ চালু হলে আবার তিনি গ্রেপ্তার হন, ১৯৫৫ সালে রাজশাহী জেল থেকে মুক্তি পান। কারামুক্তির পর অভিভাবকদের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে মতবিরোধের জেরে কাকার কাছ থেকে মাত্র ১৫ টাকা নিয়ে রাজনীতির বন্ধুর পথে পা বাড়ান, জীবনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়।
ঢাকা এসে তিনি তাঁর খুড়তুতো ভাইয়ের সাহায্যে ‘দৈনিক মিল্লাত’ পত্রিকায় সহ সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। শুরু হলো তাঁর সাংবাদিক জীবন। ১৯৫৫ সালে তিনি মৌলানা ভাসানির ‘ন্যাপ’-এ যোগ দিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে দেশ বিপন্ন হলে তিনি আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। কিছুদিন পর গ্রেপ্তারির আশঙ্কা কেটে গেলে তিনি আবার পত্রিকায় যোগ দেন। পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার নেবার সূত্রে নৃত্যগুরু জি এ মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ এবং পরে তাঁর কাছেই নৃত্য শিক্ষা করেন। মান্নানের প্রযোজনায় ‘নকশি কাঁথার মাঠ’ নৃত্যনাট্যে তিনি অংশ নেন, এই দলের সঙ্গে ১৯৫৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশ এবং ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে ইরান, ইরাক সফর করেন।
তিনি ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ অর্জন করেন। পরবর্তীকালে পার্টির বিভাজন হলে তিনি আর সদস্য থাকেন নি। তবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মার্কসবাদের উপর তাঁর আস্থা অটুট ছিল। বামপন্থী চেতনাকে ধারণ করেই তিনি তাঁর পথে চলেছেন।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ পালনে স্বৈরশাসনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি এবং সনজিদা খাতুন।
১৯৬২ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকা থেকে কাজ সেরে ফেরার পথে গ্রেপ্তার হন। এই সময় তিনি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমেদ, হায়দার আকবর খান রনো, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম প্রমুখের সঙ্গে ছিলেন। সাড়ে তিন মাস পর তিনি মুক্তি পান। এরপর তিনি বিভিন্ন সময়ে ‘দৈনিক সংবাদ’, (১৯৬২), ‘পাকিস্তান ফিচার সিন্ডিকেট’ (১৯৬৬), ‘দৈনিক পয়গাম’ (১৯৬৯), ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ (১৯৬৯) প্রভৃতি পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৭০ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৬২ সালে তিনি আবারও কিছুদিনের জন্য কারাবাস করেন। এরপর সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’-এর সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৭ সালে তিনি নীতিগত কারণে ছায়ানট ছেড়ে মার্কসবাদী আদর্শে গড়ে তোলেন ‘ক্রান্তি’।এই সাংস্কৃতিক সংগঠনের হয়ে তিনি ‘ধানের গুচ্ছে রক্ত জমেছে’ (গণ সংগীতের অনুষ্ঠান) আয়োজন করেন। এছাড়া ‘আলোর পথযাত্রী’ নাটক পরিচালনা ও অভিনয় করেন এবং ‘জ্বলছে আগুন খেতে খামারে’ শীর্ষক নৃত্যনাট্যে বিবেকের ভূমিকায় নাচে অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সাংস্কৃতিককর্মী ও সংগঠনগুলোকে একত্রিত করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’ গঠনে তৎপর হন। তখন অবস্থার ক্রমশ অবনতি হওয়ায় কুমিল্লার চান্দিনা হয়ে নৌকায় ভারত সীমান্ত হয়ে আগরতলা পৌঁছান। তারপর কলকাতা আসেন। এখানে এসে আমহার্স্ট স্ট্রিটে আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলেন। তিনি তখন মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের সূত্র খুঁজতে থাকেন এবং সাংবাদিক বন্ধু মোহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরীর সূত্রে ‘জয়বাংলা’ পত্রিকায় কাজ করতে থাকেন। এভাবে এক সময় আমিনুল হক বাদশার সঙ্গে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে যান। সেখানে তখন আয়োজন চলছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ উদ্বোধনের। এখানে বেতার কেন্দ্র চালু হলে তিনি অন্যতম শব্দ সৈনিক হিসেবে যোগ দেন এবং সংবাদ বিভাগের দায়িত্ব নেন। এই কাজে যুক্ত থেকে তিনি সংবাদপাঠ, কথিকা লেখা ও প্রচার, আবৃত্তি, স্লোগান ইত্যাদিতে অংশ নেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতারে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রথম বার্তাটি লিখেছিলেন তিনি এবং তাঁর কণ্ঠেই এটি পৌঁছেছিল বিশ্ববাসীর কাছে।
১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর তিনি ঢাকায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঢাকা আগমনের ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন। ২৫ ডিসেম্বর তিনি ঢাকা বেতার কেন্দ্রের দায়িত্ব নেন এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে তিনি আস্ফাকুর রহমান খানের সঙ্গে ধারাবিবরণী দেন।
পরবর্তীকালে কামাল লোহানী নীতিগত কারণে বেতারকেন্দ্রের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিকতার কাজে ফিরে আসেন। ‘দৈনিক জনপদ’, ‘দৈনিক বঙ্গবার্তা’, ‘দৈনিক বাংলার বাণী’ প্রভৃতি পত্রিকায় কাজ করেন। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হন। তিনি জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকাতে কমনওয়েলথ রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলনে প্রেসিডেন্সিয়াল এন্টুরেজের সদস্য হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর চিরাচরিত পোশাক পাজামা পাঞ্জাবি ছেড়ে স্যুট কোট পরতে অস্বীকার করেন এবং বিদেশ না যাবার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৮১ সালে তিনি ‘বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট’-এর প্রকাশনা পরিচালক এবং ‘ডেপথ নিউজ বাংলাদেশ’ এর সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। পরে পি আই বি’র অ্যাসোসিয়েট এডিটর পদে নিযুক্ত হন।
১৯৮৩ সালে তিনি আবার সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হন এবং বাংলাদেশ গণ শিল্পী সংস্থা গঠন করেন এবং এর সভাপতি হন। এছাড়া তিনি একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা এবং অগ্রণী সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি ছিলেন।
কামাল লোহানী ১৯৯১ এবং ২০০৮ সালে দু’দফায় শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এর পাশাপাশি একুশের চেতনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, স্বাধীন বাংলা বেতার পরিষদের উপদেষ্টা, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মূলত তাঁর উদ্যোগেই ২০১৬ সালের ১৯-২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘সাউথ এশিয়ান কালচারাল কনভেনশন এগেইনস্ট ইমপিরিয়ালিজম অ্যান্ড কমিউনালিজম’। এই কনভেনশনে কলকাতা তথা ভারত সহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
তাঁর রচিত ‘আমাদের সংস্কৃতি ও সংগ্রাম’, ‘আমরা হারব না’, ‘লড়াইয়ের গান’, ‘রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতার’, ‘মুক্তি সংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার’ ‘মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার’, ‘শব্দের বিদ্রোহ’ ইত্যাদি গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।
শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী তাঁর নানা কীর্তির স্মারক হিসেবে বিভিন্ন সময়ে একুশে পদক, শহিদ জননী জাহানারা ইমাম পদক, মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক পদক, শহিদ কাদরী পুরস্কার সহ নজরুল সাহিত্য পুরস্কার, ভাসানী সাহিত্য পুরস্কার, জসীমউদ্দিন সাহিত্য পুরস্কার, চে-গুয়েভারা সাহিত্য পুরস্কার ইত্যাদি অর্জন করেছেন।
তাঁর স্ত্রী দীপ্তি লোহানী আগেই প্রয়াত হয়েছেন। একপুত্র সাগর, দুই কন্যা বন্যা, ঊর্মি রয়েছেন।
কলকাতার সঙ্গে ছিল তাঁর অন্তরঙ্গ যোগ। হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস, উৎপল দত্ত, মৃণাল সেন প্রমুখের সঙ্গে বিশেষ সখ্য ছিল তাঁর। পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ-র আয়োজনে কলকাতায় বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে (১৯৯৪) আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সমুদ্র গুপ্ত, বশির আল হেলাল, সেলিনা হোসেন প্রমুখ। এই সংগঠনের পাশাপাশি ভারতীয় গণনাট্য সংঘ-র সাথেও যোগসূত্র ছিল তাঁর। এই দুই সংগঠনের পক্ষ থেকেও তাঁর জীবনাবসানে শোকজ্ঞাপন করা হয়েছে।
দেশহিতৈষী পত্রিকার সঙ্গেও তাঁর দীর্ঘ সম্পর্ক ছিল। বিভিন্ন সময়ে শারদ সংখ্যায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
কামাল লোহানীর জীবনাবসানের মধ্যদিয়ে এই উপমহাদেশের বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সাম্রাজ্যবাদ-মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনের এক অগ্রগণ্য নেতা ও সংগঠকের জীবন পরিক্রমা থেমে গেল। শারীরিক নানা অসুস্থতা এবং প্রায় দৃষ্টিশক্তি চলে যাওয়া সত্ত্বেও তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন জীবনের প্রায় অন্তিম পর্ব পর্যন্ত। এমনকি এই উপলক্ষ্যে ২০১৮ সালেও পুত্রের সাহায্য নিয়ে ছুটে এসেছিলেন কলকাতায়। তাঁর লক্ষ্য ছিল কলকাতা ও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলির যৌথ উদ্যোগে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদ বিরোধী এক দুর্বার আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি হোক। বিশেষত ভারতে ও বাংলাদেশে প্রগতিকামী মুক্তচিন্তার মানুষদের সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তির দ্বারা একের পর এক হত্যা ও নৃশংস আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে এই ভাবনা তাঁর মনে আলোড়িত হয়েছিল।
তিনি ২০১৭ সালে ঢাকায় এই প্রতিবেদককে এক সাক্ষাৎকারে ভারতে বিজেপি’র মতো সাম্প্রদায়িক শক্তির ক্ষমতা দখলে গভীর উদ্বেগের কথা ব্যক্ত করেছিলেন। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের অবসানের ফলে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন, বামপন্থীদের আদর্শে দৃঢ় থেকে বারে বারে মানুষের কাছে যাওয়া, মানুষকে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প পথ নেই। সেই আলাপচারিতায় বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিভাজন ও দুর্বলতার জন্য আক্ষেপের কথাই উঠে আসছিল বার বার। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বামপন্থী, প্রগতিকামী, গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা। এই লড়াইয়ে সংস্কৃতি কর্মীদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে তিনি মনে করতেন। তিনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক-সামাজিক পরিবর্তনের জন্য কমিউনিস্ট পার্টিগুলির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার স্বপ্নকে লালন করতেন। তিনি মনে করতেন কেবল বাংলাদেশেই নয়, গোটা উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা, মৌলবাদ-সন্ত্রাসবাদের হিংস্রতা প্রতিরোধে কমিউনিস্টদের অগ্রণী ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি আমৃত্যু এই লড়াইয়েই ব্রতী ছিলেন। নানা হতাশা অন্ধকারের মধ্যেও তাঁর মধ্যে বিরাজ করত এক উজ্জ্বল আশাবাদ। মার্কসবাদী চেতনায় আলোকিত এই সংগ্রামের অভিযাত্রী মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন রক্তপতাকার অগ্রযাত্রা কোনোদিন স্তব্ধ হবে না। তিনি দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের এক উজ্জ্বল ইতিহাসের পাতা মেলে ধরেই চিরবিদায় নিলেন। দুই বাংলায়, এই উপমহাদেশে বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রণী সেনানী কামাল লোহানীর স্মৃতির প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও সংগ্রামী অভিবাদন।