E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৭ বর্ষ ৪৩ ও ৪৪ সংখ্যা / ২৬ জুন ২০২০ / ১১ আষাঢ় ১৪২৭

ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টদের ভূমিকা উজ্জ্বল

সুপ্রতীপ রায়


ভারতীয় জনতা পার্টি তথা হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণের লক্ষ্য কমিউনিস্টরা। আরএসএস স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের অবদান সম্পর্কে বিকৃত তথ্য পরিবেশন করছে। কিন্তু ঘটনা হলো উলটো। স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে কমিউনিস্টদের বিরূদ্ধে তীব্র আক্রমণ নামিয়ে এনেছিল ব্রিটিশ। এ প্রসঙ্গে ‘At war with C.P.I. during the war’ শীর্ষক প্রবন্ধে কুনাল চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন: “Joshi’s letter to Gandhiji, where Joshi says, In these two years four of our Comrades have been hanged. About 400 are behind bars and 100 are life prisoners. Is this the way the Government is helping us?” (Amrita Bazar Patrika, July 8, 1984).

‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টদের ভূমিকা”তে বি টি রণদিভে (পৃঃ৩৫) লিখেছেন: “এই সময়েই কমিউনিস্ট পার্টির উপর নেমে এল এক অবশ্যম্ভাবী আঘাত। পার্টির কেন্দ্রীয় মুখপত্র ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ এবং বোম্বাই থেকে প্রকাশিত রাজ্যের মুখপত্র ‘ক্রান্তি’-কে নিষিদ্ধ করা হলো।... পার্টি পুরোপুরি নিষিদ্ধ হয়ে গেল এবং তার কাজকর্ম আত্মগোপন অবস্থাতেই চালাতে হ’ল। প্রায় ৫ শত কমিউনিস্ট কর্মী ও নেতাকে বিনা বিচারে আটক করা হলো”।

১৯২১ সালে জাতীয় কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনে মৌলানা হসরৎ মোহানী প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। হসরৎ মোহানী ছিলেন কমিউনিস্ট। ১৯৩৪ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করে ব্রিটিশ। সাইমন কমিশন বিরোধী মিছিলে কমিউনিস্টরাও যোগ দিয়েছিলেন। কমিউনিস্টদের বিরূদ্ধে মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা হয় ১৯২৯ সালে ২০ মার্চ।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন ধারার মধ্যে তিনটি ধারা উল্লেখযোগ্য: (১) কংগ্রেস আন্দোলন, (২) সশস্ত্র জাতীয় বিপ্লবী আন্দোলন ও (৩) কমিউনিস্ট আন্দোলন। স্বাধীনতা আন্দোলনের তৃতীয় ধারাটি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে যে কারণে তার মধ্যে অন্যতম ছিল সশস্ত্র জাতীয় বিপ্লবীদের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান।

কমিউনিস্ট পার্টি ব্রিটিশকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিল। তাই কমিউনিস্টদের বিরূদ্ধে বারেবারে আক্রমণ নেমে এসেছে। অনন্ত সিং, গণেশ ঘোষ, জয়দেব কাপুর, পৃথ্বী সিং আজাদ, হরেকৃষ্ণ কোঙার, বিনয় চৌধুরী, প্রমোদ দাশগুপ্ত, নিরঞ্জন সেনগুপ্ত, সুধাংশু দাশগুপ্ত, সরোজ মুখার্জি প্রমুখ’র বিপ্লবী কার্যকলাপ কি মুছে ফেলা যাবে?

নারায়ণ রায়
সতীশ পাকড়াশী
নিরঞ্জন সেনগুপ্ত
প্রমোদ দাশগুপ্ত
সুধাংশু দাশগুপ্ত

‘কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত স্মরণে’ (গণশক্তি, ৩ জানুয়ারি, ১৯৮৩, পৃঃ ৩) শীর্ষক প্রবন্ধে সুধাংশু দাশগুপ্ত লিখেছেন: “১৯২৮-এ বিসিএল-র (বেঙ্গল ক্রিমিন্যাল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট বাংলার বিপ্লবী তরুণদের বিনা বিচারে আটক রাখার জন্য ব্রিটিশ সরকার এই কুখ্যাত কালাকানুন চালু করেছিল।) বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে এসে অনুশীলন পার্টির তরুণ নেতা নিরঞ্জন সেনগুপ্ত বরিশাল ও বহরমপুরের যে’কটি তরুণকে নিয়ে নব পর্যায়ে বিপ্লবী আন্দোলন শুরু করার উদ্যোগ গ্রহণ করলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত সেই সব তরুণেরই একজন ... ১৯৩০-এর ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ সরকার শুরু করল মেছুয়াবাজার বোমার মামলা। এই মামলায় অভিযুক্ত হলেন নিরঞ্জন সেনগুপ্ত, সতীশ পাকড়াশি, মুকুল সেন, পান্নালাল দাশগুপ্ত, সত্যব্রত সেন প্রমুখ। কিন্তু পুলিশ এই মামলায় প্রমোদ দাশগুপ্তকে অভিযুক্ত করতে পারল না। ১৯৩১ সালের... দ্বিতীয়ার্ধে তিনি বগুড়ায় বিসিএল-এ-তে গ্রেপ্তার হয়ে যান। বিনাবিচারে তার এই বন্দীদশা চলে ১৯৩৭-এর শেষ পর্যন্ত। এই দীর্ঘ বন্দী জীবনেই বিপ্লববাদীদের একাংশের মতন তিনিও গভীর অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের আদর্শ উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেন।’’

জাতীয় বিপ্লবীদের কার্যকলাপকে খাটো করার জন্য “সন্ত্রাসবাদী” শব্দটি ব্যবহার অনেকেই করেছেন। একথা ঠিক “সন্ত্রাসবাদী”কার্যকলাপের সীমাবদ্ধতা ছিল। এই সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করেই এই বিপ্লবীদের ভাল অংশ সাম্যবাদী আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এদের অবদান অনস্বীকার্য। চিন্মোহন সেহানবিশ লিখেছেন: “যে জাতীয় বিপ্লবীদের এক সময়ে এদেশে terrorist (সন্ত্রাসবাদী) বা anarchist (নৈরাজ্যবাদী) বলা হতো। অসম সাহসিকতা বা চূড়ান্ত আত্মদানের মাপকাঠিতে কিন্তু আমাদের দেশে তাঁদের স্থান কারো চাইতে নিচে নয়।” (চিন্মোহন সেহানবিশ: আমাদের মুক্তি আন্দোলনের নয়া ধারা [সূর্য সেন স্মারক বক্তৃতা], ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেল্থ এডুকেশন প্রজেক্ট, আমেদনগর, বর্ধমান, এপ্রিল, ১৯৮৭, পৃঃ ২২)।

১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের প্রভাব পৃথিবীর দেশে দেশে পড়ে। নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাব ভারতেও পড়ে। এই বিপ্লবের প্রভাব পড়ে জাতীয় বিপ্লবীদের একটি অংশের উপর। বাংলায় জাতীয় বিপ্লবীদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন ছিল—যুগান্তর ও অনুশীলন সমিতি। নভেম্বর বিপ্লবের পর অনুশীলন সমিতির সদস্যদের একটি অংশ উপলব্ধি করেন কেবলমাত্র সন্ত্রাসবাদী’পথেই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আসতে পারে না, স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়যুক্ত হতে পারে ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। রুশ বিপ্লব থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন—জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ শ্রমিক-কৃষকের অংশগ্রহণেই স্বাধীনতা আসতে পারে।

রুশ বিপ্লবের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে অসংখ্য তরুণ বৈপ্লবিক সন্ত্রাসবাদের পথ পরিত্যাগ করে সাম্যবাদকে রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেন। ১৯২৬ সালে একদল যুবক অনুশীলন সমিতি পরিত্যাগ করে শ্রমিক, কৃষকদের সংগঠিত করার কাজ করতে থাকেন। ১৯২৬ সালের শেষ দিকে অনুশীলন বিপ্লবীদের একটি অংশ মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজান্টস পার্টিতে যোগদান করেন। ১৯২৮ সালে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজান্টস পার্টির কয়েকজনের উদ্যোগে কলকাতায় ইয়ং কমরেডস লীগ নামে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। আলোচ্য সময়ে বেশ কিছু সংখ্যক যুগান্তর বিপ্লবীও সাম্যবাদী মতাদর্শ গ্রহণ করেন।

জাতীয় বিপ্লববাদ থেকে সাম্যবাদে আসার ক্ষেত্রে সমসাময়িক বেশ কিছু বাংলা সংবাদপত্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ধূমকেতু, লাঙ্গল, গণবাণী, প্রবাসী, সাম্যবাদী প্রভৃতি পত্রিকা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। ‘শঙ্খ’ পত্রিকায় (মার্চ ১৯২১-ফেব্রুয়ারি ১৯২২) ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় শচীন্দ্রনাথ সান্যালের প্রবন্ধ ‘লেনিন ও সমসাময়িক রাশিয়া‘। ফণীভূষণ ঘোষের ‘লেনিন’ নামক পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয় ১৯২১ সালে। এটি বাংলা ভাষায় লেনিন সম্পর্কে প্রকাশিত প্রথম পুস্তিকা। ‘আত্মশক্তি’ পত্রিকায় (১৮ এপ্রিল-২৩ মে ১৯২৩) অমূল্যচরণ অধিকারীর ‘লেনিনের জীবনকথা’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সাম্যবাদী মতাদর্শের সমর্থনে শিবরাম চক্রবর্তীর ‘মস্কো বনাম পন্ডিচেরি’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ রচনা।

অভিজ্ঞতা থেকে জাতীয় বিপ্লবীদের অনেকে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর নলিনী গুপ্ত কলকাতায় এসেছিলেন। তিনি ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়ের প্রতিনিধি। নলিনী গুপ্ত কলকাতায় প্রথমে অনুশীলন ও যুগান্তর দলের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এছাড়া তিনি কাকাবাবু ও কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন।

১৯২২ সালের শেষ দিকে নলিনী গুপ্ত পুনরায় কলকাতায় আসেন। ওই একই বছরে অবনী মুখোপাধ্যায় কলকাতায় আসেন। ১৯২৩ সালের প্রথমদিকে গোপেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে অনুশীলন সমিতির পক্ষ থেকে মস্কোতে পাঠানো হয়। ১৯২৬ সালে বিপ্লবোত্তর রাশিয়া ও কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করে গোপেন চক্রবর্তী ভারতে ফিরে আসেন।

জাতীয় বিপ্লবীদের সাম্যবাদী মতাদর্শে আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। ১৯২৫ সালে ডঃ দত্ত দেশে ফিরে আসেন। যুব জাতীয় বিপ্লবীদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ পথের সীমাবদ্ধতা বোঝাবার ক্ষেত্রে তিনি কার্যকর ভূমিকা নিয়েছিলেন। মার্কসবাদে দীক্ষিত করে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিতে উৎসাহিত করেছিলেন।

বিপ্লবীদের ব্রিটিশ সরকার আন্দামান সেলুলার জেলে পাঠাত। আন্দামানে বন্দী অবস্থাতেই তাঁরা বুঝে ছিলেন নতুন সমাজ,নতুন ভারত গঠন করতে গেলে কমিউনিস্ট হতে হবে। বাংলা-বিহার-যুক্তপ্রদেশ-পাঞ্জাব মিলিয়ে মোট ৩৯ জন বন্দী সাম্যবাদী মতাদর্শ গ্রহণকারী জাতীয় বিপ্লবীদের বড় অংশ ১৯৩৫ সালে ২৬ এপ্রিল আন্দামানের সেলুলার জেলে গোপনে কমিউনিস্ট কনসলিডেশন গঠন করেন। ১ মে সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছিল। যাঁরা প্রাথমিকভাবে কমিউনিস্ট কনসলিডেশনের সদস্য হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন ডাঃ নারায়ণ রায়, নিরঞ্জন সেনগুপ্ত, গোপাল আচার্য, হরেকৃষ্ণ কোঙার, বটুকেশর দত্ত, নলিনী দাস প্রমুখ।

আন্দামান ও বিভিন্ন জেলখানায় রাজবন্দীদের আমরণ অনশন ও দেশজুড়ে আন্দোলন ব্রিটিশ সরকার রাজবন্দীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়। এখানে উল্লেখ্য, প্রায় একইসময়ে ভারতের বিভিন্ন বন্দীশিবিরেও কমিউনিস্ট কনসলিডেশন গঠিত হয়েছিল। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, মন্টেগু-চেমর্স ফোর্ড সংস্কার অনুযায়ী ঠিক হয়েছিল ১৯২০-র পর আর কোনো রাজনৈতিক বন্দীকে আন্দামানে পাঠানো হবে না। কিন্তু চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার অভিযানের নায়ক গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিং, লোকনাথ বল সহ ২৩জনকে আন্দামানে পাঠানো হয়।

১৯৩৫-৩৬ সালে বেশ কয়েকজন রাজবন্দী মুক্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৩৭ সাল থেকেই মূলত বন্দীদের মুক্তি শুরু হয়। কয়েকটি ব্যাচে তাদের ফিরিয়ে আনা হয়। ১৯৩৮ সালের ১৯ জানুয়ারি সর্বশেষ ব্যাচ আসে। মুক্তিপ্রাপ্ত বিপ্লবীদের ভালসংখ্যক কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।

কিন্তু কেমন ছিল আন্দামান সেলুলার জেল? আন্দামানে দ্বীপান্তরিত মানুষ জানতেন আর তাঁরা স্বদেশে আপনজনের কাছে ফিরতে পারবেন না। আন্দামান ছিল এক বিভীষিকাময় স্থান। আন্দামানে প্রথম শাস্তিপ্রাপ্তদের পাঠানো হয়েছিল ১৮৫৮ সালে। কিন্তু কুখ্যাত সেলুলার জেলের নির্মাণকার্য আরম্ভ হয় ১৮৯৬ সালে। সেলুলার জেলটি ছিল অনেকখানি বৃত্তাকার। প্রত্যেকটি কুঠরি ছিল ১০ ফুট লম্বা ও ৮ ফুট চওড়া। সমুদ্র থেকে অল্প দূরে একটা ছোটো পাহাড়ের উপর ছিল সেলুলার জেল। সেল বা কুঠরিগুলিতে জানালা ছিল না। পিছনে উঁচুতে ছিল প্রায় চৌকো আকারে গর্ত। আলো বা বাতাস কার্যত প্রবেশ করতে পারত না।

আন্দামান সেলুলার জেলে শাস্তি ছিল মারাত্মক। জেলার বা সুপারিনটেনডেন্টের সঙ্গে তর্ক করলে নির্মম শাস্তি দেওয়া হতো। কেমন ছিল সে শাস্তি—“...একটা ‘তেকাটা’ (Triangle) ছিল। লোহার ঢালাই বা Whipping rack-এ খুব টান করে এক সঙ্গে হাত দুটো যতদূর সম্ভব মাথার উপর উঁচু করে টেনে হাতকড়া লাগিয়ে এবং পা দুটো যতটা যায় ফাঁক করে তেকাটার পায়ের সঙ্গে আটকে উলঙ্গ করে দশ, বিশ, ত্রিশ ঘা বেত মারা হতো। রক্ত ঝরছে, সংজ্ঞাহীন হয়ে মাথা ঢলে পড়েছে, হাত কড়া বাঁধনে দেহ মাটিতে পড়তে না পেরে ঝুলছে, কিন্তু তখনো পাঁচ ঘা বাকি—যখন গুনতিতে মিলল বিশ ঘা, তখন বাঁধন খুলে নির্দিষ্ট কুঠরীতে ধরাধরি করে ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্ত।’’ (সূত্র : জাগরণ ও বিস্ফোরণ (২ খণ্ড)-কালীচরণ ঘোষ)। নিমর্ম, অমানবিক শাস্তির কারণেই উল্লাসকর দত্ত উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন।

আন্দামানে রাজবন্দীরা মার্কসবাদের বই চর্চা করে বুঝেছিলেন মার্কসবাদই মানবমুক্তির পথ। জেলখানায় পড়েছিলেন কার্ল মার্কস-এর লেখা ‘শ্রম মজুরি ও মুলধন’। পড়েছিলেন লিয়েনটিয়েভের লেখা “মার্কসীয় অর্থনীতি”।

“দ্বীপান্তরের বন্দী”তে নলিনী দাস লিখেছেন, “অর্থনীতি পাঠের মধ্য দিয়ে দেখলুম অর্থনীতির সঙ্গেই যুক্ত মানবসভ্যতার অগ্রগতি, উত্থান, পতন এবং তার ক্রমবিকাশ। নতুন উৎপাদনী শক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে, সমাজে দ্বন্দ্ব আসছে, সংঘাত বাড়ছে। আবার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নতুন পরিবর্তিত সমাজ জন্ম নিচ্ছে। দেখলুম ধনতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদনী শক্তির সীমাহীন অগ্রগতি, বিজ্ঞান ও কারিগরী বিদ্যার কল্পনাতীত শ্রীবৃদ্ধি। কিন্তু এই সীমাহীন অফুরন্ত শক্তি জনগণের কল্যাণে ব্যবহৃত হচ্ছে না। এটা ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য ব্যবহৃত না হয়ে সমাজের সকলের জন্য ব্যবহৃত হলে সকলে সুখ শান্তিতে বসবাস করতে পারে এবং সমাজ থেকে অনাহার, অশিক্ষা, বিনা-চিকিৎসা, বাসস্থানের অভাব—সব শেষ করে দেওয়া যায়। এটা একমাত্র সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে সম্ভবপর। এরই নাম সমাজতন্ত্র।’’ সেলুলার জেল হয়ে উঠেছিল মাকর্সবাদ চর্চার কেন্দ্র।

১৯৩৫-৩৯ এই সময়কালের মধ্যে বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে আন্দোলন বিকশিত হয়। যা ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনকে বেগবতী করে তুলেছিল। আন্দামান জেল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত বিপ্লবীরা এবং বিভিন্ন ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত জাতীয় বিপ্লবীদের ভালসংখ্যক অংশ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এই সময় বেঙ্গল লেবার পার্টির সদস্যরা কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হন।

আন্দামান ছাড়াও অন্যান্য জেলেও যাঁরা ব্রিটিশ-বিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত থাকার কারণে দীর্ঘমেয়াদি কারাদন্ডে দণ্ডিত ছিলেন তাঁদের উল্লেখযোগ্য অংশ বন্দী অবস্থায় মার্কসবাদ অধ্যয়ন করেছিলেন। এঁরা মার্কসবাদী চিন্তাধারা গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৩২ সালের ২২ জুন ২০জনকে হিজলি জেল থেকে দেউলি জেলে পাঠানো হয়েছিল। এঁদের মধ্যে কমিউনিস্ট নেতা মনোরঞ্জন রায় ছিলেন। বাংলার বিভিন্ন জেল থেকে প্রায় ১০০ জন রাজবন্দীকে দেউলি জেলে পাঠানো হয়েছিল। এঁদের মধ্যে অনেকেই মার্কসীয় দর্শন পাঠ করে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। বক্সার জেলের মধ্যেও অনেকেই কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং জেলমুক্ত হয়ে অনেকে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। হিজলি জেলেও অনেকে মার্কসবাদী পথ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৩৬ সালের প্রথমদিকে নিরঞ্জন সেনগুপ্ত আন্দামান থেকে মুক্তি পেলেও তাকে রাজবন্দী হিসাবে দেউলি জেলে রাখা হয়। দেউলি জেলেও কমিউনিস্ট কনসলিডেশন গড়ে ওঠে।

আন্দামানে দ্বীপান্তরিত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বড় অংশই পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হয়েছিলেন। যেমন আব্দুল হালিম। ১৯২১ সালে তিনি অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। মার্কসবাদ অধ্যয়ন করে তিনি শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। হালিম আন্দামানে কয়েক বছর দ্বীপান্তর বাস করেছিলেন। হিজলি বন্দীশিবিরেও তিনি বন্দী ছিলেন। হরেকৃষ্ণ কোঙার ১৯৩০ সালে (নবম শ্রেণীর ছাত্র) আইন অমান্যে যোগ দিয়ে ৬ মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। পরবর্তীতে তিনি বিপ্লববাদী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৩০ সালে তিনি আন্দামানে নির্বাসিত হন। আন্দামানে কমিউনিস্ট কনসলিডেশনে যোগ দেন। ডাঃ নারায়ণ রায় কলকাতার বোমার মামলায় জড়িত হয়ে ১৫ বৎসর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। তাঁকে আন্দামান সেলুলার জেলে পাঠানো হয়। আন্দামান থেকে ফিরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।

নিরঞ্জন সেনগুপ্ত ছাত্রাবস্থাতেই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। তিনি অনুশীলন সমিতির সদস্য হয়েছিলেন। ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে ১৯২৫ সালে বোম্বাইয়ের রত্নগিরি জেলে পাঠানো হয়। ১৯৩০ সালে তিনি কলকাতা মেছুয়াবাজার বোমা মামলায় যুক্ত হয়ে সাত বৎসর কারাদন্ডে দন্ডিত হন। বিভিন্ন জেলে থাকার পর তাকে আন্দামানে পাঠানো হয়। কারাবাস শেষে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।

সতীশ পাকড়াশী অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯২৩ সালে তিনি বন্দী হন—১৯২৮ সালে তিনি মুক্তি পান। কিন্তু ১৯৩৩ সালে মেছুয়াবাজার বোমার মামলায় ধরা পড়ে সাত বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। তিনি মার্কসবাদী আদর্শকে গ্রহণ করে কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হন।

অসংখ্য স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম উল্লেখ করা যায়—যাঁরা এদেশের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজে সারাজীবন উৎসর্গ করেছিলেন। কমিউনিস্টরা খুব সঠিকভাবেই মনে করতেন ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হলে গণআন্দোলন করতে হবে। শ্রমিক-কৃষকদের বাদ দিয়ে গণ-আন্দোলন সম্ভব নয়, স্বাধীনতা অর্জনও অসম্ভব। ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে শ্রমিক-কৃষকদের যুক্ত করেছিলেন কমিউনিস্টরা। জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কমিউনিস্টরা। আরএসএস স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্বাসঘাতকতার ভূমিকা নিয়েছিল।