৫৮ বর্ষ ৩২ সংখ্যা / ২৬ মার্চ, ২০২১ / ১২ চৈত্র, ১৪২৭
ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্রের মানুষ দুর্নীতি তোলাবাজি ও সন্ত্রাসে তিতিবিরক্ত
আবার ধরতে চান বামপন্থীদের হাত
শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়
ডায়মন্ডহারবার বিধানসভা নির্বাচনে সংযুক্ত মোর্চার সিপিআই(এম) প্রার্থী প্রতীক উর রহমানের ওয়ার্ড পরিক্রমা।
ডায়মন্ডহারবার বিধানসভা নির্বাচনে সংযুক্ত মোর্চার সিপিআই(এম) প্রার্থী প্রতীক উর রহমান ওয়ার্ড পরিক্রমায় এসেছিলেন বস্তিবাসী প্রান্তিক মানুষদের কাছে। তখনই ১৬ নম্বর ওয়ার্ড সংলগ্ন খালপাড়ে ২০১১ সালের ডায়মন্ড হারবারের ফকিরচাঁদ কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সময় ঘটা এক তৃণমূলী সন্ত্রাসের ঘটনার স্মৃতিচারণ উঠে এলো বস্তিবাসিনী গায়ত্রী পুরকায়স্থ’র জবানিতে। ‘...ওর কষ বেয়ে রক্ত পড়ছিল। ওকে মারতে মারতে মাটিতে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি ওদের হাত থেকে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসি। ওরা রেগে চলে যায়, কিন্তু দলবল জুটিয়ে আবার ফিরে আসে। ততক্ষণে আমি ওকে আমার বাড়ির বাথরুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। ওরা এসে বলে, ওকে বার করে দাও। আমি বলি, এখানে কেউ নেই। তখন ওরা জোর করে বাড়িতে ঢুকতে চায়। আমি দরজা ছাড়ি না, বলি আমি একা বাড়িতে আছি, যে ঢুকবি তাকে কাটবো। ওরা ভয় পেয়ে পিছু হটে’। প্রবল তৃণমূলী সন্ত্রাসের মুখে অকুতোভয় নাইয়া পাড়া খালপাড়ের বস্তির ওই ‘মা’ সেদিন বাঁচিয়েছিলেন সদ্য আঠারো পেরনো ওই কলেজের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক যুবক প্রতীক উরকে। সন্তান-সম প্রতীক উরের ধর্ম দেখেননি। অথচ প্রতীক উরের জনপ্রিয়তা আর প্রচারের গতির সঙ্গে তাল রাখতে না পেরে ধর্মের নামে ভয় দেখাতে ছাড়ছে না তৃণমূল-বিজেপি। যেমন নূরপুর সংলগ্ন কৃষিজীবী অধ্যুষিত এলাকার মানুষ, মূলত সংখ্যালঘু যাঁরা, তাঁদের প্রচ্ছন্নভাবে হুমকির সুরে বলা হচ্ছে ভোটের পর তাঁদের ‘ব্যবস্থা’ হবে। এর জবাবে প্রতিরোধের আঁচ টের পাচ্ছে তৃণমূল-বিজেপি। তবে মানুষ সন্ত্রাসকে উপেক্ষা করে প্রশ্ন তুললেও বলা হচ্ছে না কর্মপ্রার্থী মানুষের জন্য এতদিন এই সরকারগুলো কী করল।
আর প্রতীক উরের কাছে অভিযোগ করছেন বিভিন্ন অংশের গরিব মানুষ। আমফানের ক্ষতিপূরণ থেকে বিধবা ভাতা - ওরা পাননি কিছুই। মনের সব ক্ষোভ জড়ো করে বলছিলেন প্রতিমা হালদাররা, ‘যে খাচ্ছে তানার তো খাওয়া শেষ হচ্ছে না। বস্তি বস্তি-ই আছে। সিপিএম আমলে কারেন্ এসেছে, জল এসেছে। গত ১০ বছরের সরকারি সাহায্য বলতে কিছুই পাইনি আমরা’। গোটা ডায়মন্ড হারবারের ছবিটা এরকমই।
ওই খালপাড়ের বস্তি এবং ৯ নম্বর ওয়ার্ডের রেলের জমিতে বাম আমলে লড়াই করে গড়ে ওঠা ইন্দিরা নগরসহ অন্যান্য গরিব মহল্লায় প্রতীক বুঝিয়ে বলছেন বামফ্রন্টের ইশ্তিহারের কথাগুলো - ‘কুড়ি বছর ধরে বসবাসকারী মানুষদের বসবাসের অধিকারকে নিশ্চয়তা দিতে এক টাকার বিনিময়ে ৯৯ বছরের লিজ দেওয়া হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের জমিতে অনুমোদন আদায় করে আইনি লিজ দেওয়া হবে’। সন্ত্রাসের আতঙ্কে ভোট দিতে না পারা মানুষ মন দিয়ে শুনছেন সেসব আর এবারের ভোটে বুথ রক্ষার জন্য এককাট্টা হচ্ছেন তাঁরা।
কেন সরকারি বরাদ্দ এবং প্রকল্পের টাকা পাননি এই মানুষগুলো? প্রচারে নেমে অধুনা বিজেপি প্রার্থী, তৃণমূলের টিকিটে গতবারে জেতা বিধায়ক দীপক হালদার দুর্নীতি আর চুরির অভিযোগের ক্ষোভ সামলানোর পাশাপাশি এসব জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না। যার সম্পর্কে মানুষ বলছেন, ভাইপোর সঙ্গে তোলাবাজির বখরা নিয়ে বনিবনা না হওয়াতে তিনি বিজেপি-তে। তবে নতুন দলের কর্মীদের ‘ভালবাসা’ সামলাতে এখন জেরবার তিনি। শহরের নিন্দুকেরা আরও বলছে, ভোটারদের কাছে জবাবদিহি এড়াতে দীপক হালদার পদ্মে ভিড়েছেন। বিজেপি প্রার্থী হিসেবে তিনি এবং তাঁর দলবল যাবতীয় ব্যর্থতার দায় পৌরসভা, পঞ্চায়েত এবং ভাইপো সাংসদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছেন।
কিন্তু এই অভিযোগ মানতে চাইছে না জোড়া ফুলের এখনকার প্রার্থী পুরসভার চেয়ারম্যান পান্নালাল হালদার সহ ঘনিষ্ঠ মহল। অতএব দুই ফুলের পারিষদদের পরস্পরের দিকে কাদা ছোঁড়া অব্যাহত। দমিয়ে রাখা মানুষ এবার কৈফিয়ৎ চাওয়ায় চাপে পড়ে গেছেন, ভয় পাচ্ছেন দুই ‘ফুলতুতো’ প্রার্থী। কৈফিয়ৎ তারা দিতে অভ্যস্ত নন। কিন্তু কৈফিয়ৎ না দিলে কি হতে চলেছে তা টের পাচ্ছেন।
অন্যদিকে প্রতীক উর রহমান কাজহীন যুবদের সরকারের শুন্যপদে নিয়োগের কথা, কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম, গরিব মানুষের জন্য ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিলে সরকারি ভরতুকি দেবার কথা, বছরে ১৫০ দিন রেগা’র কাজ এবং মজুরি বৃদ্ধির কথা বলে মানুষের ক্ষোভকে পরোক্ষে উসকে দিয়েছেন। তার তারুণ্যে ভরা নির্বাচনী পরিক্রমার গতির সঙ্গে একেবারেই তাল রাখতে পারছেন না ওরা।
গত এক দশক ধরে ডায়মন্ডহারবারে গরিব মানুষের ওপর নানা জুলুম ও লাগামহীন তোলাবাজি চলছে। বামপন্থী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অপরাধে ছোটো দোকানদারের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে, পার্টিকর্মীদের চাকরিস্থলে উপরওয়ালাকে দিয়ে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে, কলকাতায় পরিচারিকার কাজ করেন আর গ্রামে বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মহিলাদের কাজের বাড়িতে গিয়ে স্থানীয়স্তরের তৃণমূলীদের দিয়ে তাঁদের কর্মচ্যুত করার জন্য চাপ তৈরি করা হয়েছে।
২০১৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে এসডিও দপ্তরের বাইরে শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপ্রেরণায় মাস্কেট বাহিনী হাজির ছিল বামপন্থী সহ বিরোধীদের মনোনয়ন দাখিল রুখতে। প্রতিবাদে কয়েক হাজার মানুষ জড় হন সেখানে। প্রবল জনরোষের তোড়ে পিছু হঠে মাস্কেট বাহিনী। তখন পুলিশ আসরে নামে। মনোনয়ন দিতে আসা মানুষকে ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করে। আর হিংসার মিথ্যা অপরাধে জেল খাটানো হয় সিপিআই(এম) কর্মীদের। মানুষ তৃণমূলের এই ভূমিকার কথা মনে রেখেছেন।
এই অঞ্চলের বড়ো অংশের মানুষ রুজির খোঁজে নিয়মিত যেতেন হলদিয়া শিল্পাঞ্চলে। প্রশ্ন উঠছে, এভিজি সহ ওখানকার বেশ কিছু কারখানা কেন বন্ধ হলো? এই ‘শিল্প তাড়াও’ পালার অধিকারীদের ভূমিকায় অভিযোগের তীরে বিদ্ধ হচ্ছে বিজেপি-ও। আবার ফলতার শিল্পাঞ্চল, যা ছিল এই এলাকার মানুষের অন্যতম কর্মস্থল, সেখানে এখন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। বামফ্রন্ট সরকারের সময় এখানে সংগঠিতভাবে সিপিআই(এম)’র নেতৃত্বে শ্রমিকরা দর-কষাকষি করতে পারতেন। কিন্তু তৃণমূল সরকারে আসার পর সেসব বন্ধ হয়। মালিকপক্ষ এই সুযোগে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন বকেয়া ফেলতে লাগলেন। ২০১১ সালে দুর্গাপুজোর আগে পরিস্থিতি চরমে পৌঁছায়। প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক বেতন ও বোনাসের দাবিতে এককাট্টা হয়ে অবস্থানে বসেন। মধ্যস্থতার নাম করে জমায়েতের শ্রমিকদের ওপর পুলিশি লাঠি চার্জে জখম হন বহু মানুষ। শুধুমাত্র বোনাসের নামে সামান্য কিছু টাকা শ্রমিকদের দিয়ে মালিকপক্ষ তৃণমূল নেতাদের পকেট ভারি করে পরিস্থিতি সামাল দেন। সেটাই তাঁদের কাল হলো। কারণ তোলার দাবিতে অতিষ্ঠ হয়ে কিছুদিনের মধ্যেই অধিকাংশ কারখানাকে পাট গোটাতে হয়। কর্মচ্যুত হন কয়েক হাজার অসংগঠিত শ্রমিক। এসব কেন হলো তা নিয়ে সোজা সপাট প্রশ্নে মুখে কুলুপ দু’পক্ষেরই।
ডায়মন্ডহারবারের মানুষ আরও বলছেন। বলছেন মাটি কেলেঙ্কারির কথা। বিভিন্ন এলাকা থেকে পরিকল্পিতভাবে মাটি তুলছে মাটি মাফিয়ারা। পাচার করা হচ্ছে অন্যত্র। ভয় দেখিয়ে মালিকের থেকে জমি কিনে বা প্রলোভন দেখিয়ে এই মাটি তোলা হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে চাষ, বদলে যাচ্ছে জমির চরিত্র। কারণ পাশের জমির লেভেল অসমান হওয়ায় ভুমিক্ষয় আর জলজমার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষিজীবীরা। আবার মাটি ফেলে বোজানো হচ্ছে বহু নিকাশি নালা থেকে খাল পর্যন্ত। ভরাট করার পর জমি হিসাবে বেচে দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে নিকাশির দূষিত জল পাশের জমিতে জমে নুনের পরিমাণ বাড়াচ্ছে কৃষিজমিতে। একফসলি জমি দীর্ঘ দিন ফেলে রেখে বা যাবতীয় পরিচর্যা করেও চাষযোগ্য করা যাচ্ছে না। এছাড়াও রয়েছে অন্যতর একাধিক সমস্যা। শহরের দু’টি ব্লক এলাকাতেই একাধিক খাল যা দিয়ে সেচের জলের জোগান পেতেন চাষিরা, ড্রেজিং-এর অভাবে সেসব খালে জল কমেছে। নোনা হয়ে যাচ্ছে জল। ভুগছেন কৃষকসহ বিধানসভা এলাকার প্রায় সমস্ত মানুষ। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে জল সরবরাহ প্রকল্প তৈরি হলেও তা কাজে লাগছে না। পরিশ্রুত জলের হাহাকার এই প্রাচীন বন্দর নগরী ঘিরে। অথচ ৩৫ টাকা হারে জলকর চাপানো হয়েছে। মমতা ব্যানার্জি প্রকাশ্য জনসভায় এ বিষয়ে পুরসভার চেয়ারম্যানকে তা প্রত্যাহার করতে বললেও কর আদায় চলছেই। জলকষ্টের সঙ্গে তাল দিয়ে বাড়ছে জলবাহিত নানা রোগ। নামে সুপার স্পেশালিটি হলেও ডায়মন্ডহারবার হাসপাতাল মানুষের যথাযথ চিকিৎসা পরিষেবা দিতে অপারগ পরিকাঠামোর অভাবে। মানুষ এসবের যোগ্য জবাব দিতে তৈরি এবার। আরও অভিযোগ, ঝুলন্ত উদ্যানের নামে অপরিকল্পিতভাবে গঙ্গার পাড় সৌন্দর্য্যায়নের জেরে বেশ কয়েক কোটি টাকা নষ্ট হয়েছে, যা ঝুলিতে গেছে ভাইপো বাহিনীর।
এখন এসব অভাব অভিযোগ শোনবার ধৈর্য নেই বিধায়ক বা পৌর প্রশাসনের। আর সাংসদ তো সেখানে অনেক দূরের তারা। এসব প্রশ্নেই সোচ্চার মানুষ তাদের মতো করেই তাঁদের জবাব সাজাচ্ছেন। তাই সংযুক্ত মোর্চার মিছিলে তারুণ্যের সমাবেশ একটু বেশি চোখ টানছে। পাশাপাশি প্রবীণরাও রয়েছেন। স্লোগান দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছেন নবীনদের, বেশি বেশি করে বলতে বলছেন সারদা, নারদা-সহ দু’পক্ষের অপশাসন, দুর্নীতির কথা, জাতপাতের বিভাজনের বিরুদ্ধে রুটির দাবিতে একজোট হওয়ার কথা। এসবের জবাবে তাঁদের প্রতিনিধি হিসাবে সংযুক্ত মোর্চার প্রতীক উরকেই প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে গণতন্ত্র আর আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে বেছে নিতে চাইছেন বন্দর নগরীর বৃহৎ অংশের মানুষ।