৫৮ বর্ষ ৩২ সংখ্যা / ২৬ মার্চ, ২০২১ / ১২ চৈত্র, ১৪২৭
চণ্ডীতলায় সংযুক্ত মোর্চার প্রচারে উন্নয়ন গণতন্ত্র মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা আশা জাগাচ্ছে
সন্দীপ দে
চণ্ডীতলা বিধানসভার নৈতিগ্রামে ভোট প্রচারে মহম্মদ সেলিম।
তৃণমূলের শাসনের দশ বছরের বন্ধ্যা দশা থেকে এবারে মুক্তি চাইছে চণ্ডীতলা। ২০১১ সালে অনেক বেশি প্রত্যাশা নিয়ে ‘পরিবর্তন’ নিয়ে এসেছিল এই কেন্দ্রের মানুষ। তারপরের অভিজ্ঞতা কী? এই কেন্দ্রে কোনো দৃষ্টান্তমূলক উন্নয়নের উদ্যোগ বা চিহ্ন দেখেনি মানুষ। উলটে ব্যাপক দুর্নীতি, স্বজন পোষণ, পুরনো যা কিছু ছোটোখাটো শিল্প ছিল, সেগুলি হয় বন্ধ, না হয় রুগ্ণ হয়ে উঠে যাবার মুখে। ফলে কর্মহীন ও বেকার যুবকেরা নিরুপায় হয়ে রুটি-রুজির সন্ধানে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছেন অন্য রাজ্যে। রাজ্যের অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও এমনই হতাশার চিত্র প্রকট। তাই মানুষ এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ খুঁজছেন। তাঁদের সামনে আশার সঞ্চার করছে সংযুক্ত মোর্চার প্রচার। এই কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী হয়েছেন সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং সুদক্ষ সাংসদ হিসেবে তাঁর ভূমিকার কথা সম্যকভাবেই জানেন এই এলাকার মানুষ। কাজেই তাঁর মতো একজন জনপ্রিয় জনদরদি নেতাকে প্রার্থী হিসেবে পেয়ে আশায় বুক বাঁধছেন চণ্ডীতলার মানুষ। মহম্মদ সেলিমের এলাকা পরিক্রমার সময়ে, মিছিলে, বৈঠকে, পথসভায় পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশেষ করে যুব-ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপক হারে অংশগ্রহণ সংযুক্ত মোর্চার প্রচারে বাড়তি মাত্রা সংযোজন করছে।
চণ্ডীতলা সহ গোটা হুগলি জেলার মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে, সিঙ্গুরে কীভাবে প্রায় ৯০ শতাংশ তৈরি হওয়া গাড়ি শিল্প ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের মধ্যদিয়ে শেষ করে দিয়েছিল আজকের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। ওদের ওই নৈরাজ্যবাদী আন্দোলন সিঙ্গুর ও সংলগ্ন অঞ্চল বা জেলাই শুধু নয়, গোটা রাজ্যের শিল্প সম্ভাবনা এবং বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানের স্বপ্নকেই সেদিন গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। সিঙ্গুর সংলগ্ন চণ্ডীতলার মানুষ, বিশেষকরে অল্পবয়সি তরুণ প্রজন্ম স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণা নিয়েও তৃণমূলের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, রাজ্যসরকারের উন্নয়নের কর্মসূচির প্রচারের বাগাড়ম্বরে অনেকটাই আচ্ছন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু দিন-মাস-বছর গড়িয়ে তৃণমূলের দীর্ঘ দশ বছরের শাসন কেবলমাত্র তাদের হতাশা আর বঞ্চনাকেই প্রকট করেছে। তাই সবাই এর প্রতিবিধান চাইছেন।
তৃণমূলের শাসন এখানকার মানুষদের সামনে শুধু সীমাহীন মিথ্যাচার আর ভাঁওতাকেই প্রকট করেনি, ওদের লাগামহীন দুর্নীতি, তোলাবাজি ও লুটপাটের ঠেলায় অতিষ্ঠ হয়েছেন সাধারণ মানুষ। অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও একশো দিনের কাজ নিয়ে বিস্তর দুর্নীতি হয়েছে। কোনো কাজ না করে ভুয়ো মাস্টাররোলে বা অন্য কারও জবকার্ডে কাজ দেখিয়ে টাকা লুটে নিয়েছে তৃণমূলের বিভিন্ন এলাকার মাতব্বররা। এই এলাকায় আমফানের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বিপুল। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে সরকার বা শাসকদল কাউকেই দেখা যায়নি। উলটে ক্ষতিপূরণের টাকা দেদার নয়ছয় করেছে। ওদের নির্লজ্জতা এমনই যে গরগাছা পঞ্চায়েতের প্রধানের দোতলা বাড়ি, কোনো ক্ষতি না হওয়া সত্ত্বেও আমফান ঝড়ে ক্ষতিপূরণের টাকা আত্মসাৎ করে নিয়েছেন। এই এলাকায় এমন ঘটনা প্রচুর। এখানে করোনার ভয়াবহ প্রকোপে বিপন্ন মানুষ এবং কাজ হারানো মানুষদের সাধ্যমতো সাহায্য করেছে সিপিআই(এম) কর্মীরাই। বিশেষকরে ভিন রাজ্য থেকে এলাকায় ফিরে পরিযায়ী শ্রমিকরা যখন চরম বিপদে পড়েছেন, তখন পার্টি কর্মীরাই তাদের সাহায্য করেছে।
চণ্ডীতলা বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে ১১টি গ্রামপঞ্চায়েত এবং ডানকুনি পৌরসভা রয়েছে। এই সবগুলিতেই তৃণমূলের আধিপত্য সত্ত্বেও কোনো গঠনমূলক কাজ হয়নি। তাই দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ জমেছে। এর ফলে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে তৃণমূলের ভোটলুটের মধ্যেও কিছু জায়গায় মানুষ বিজেপি-কে সমর্থন করেছেন। লোকসভা নির্বাচনের সময়েও অনেক ক্ষুব্ধ মানুষের সমর্থন গেছে বিজেপি’র দিকে। এখন এই মানুষদের অনেকেরই যে মোহভঙ্গ হচ্ছে, তা সংযুক্ত মোর্চার প্রচারে ক্রমশ টের পাওয়া যাচ্ছে।
এই কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান বিধায়ক স্বাতী খন্দকার এবং বিজেপি প্রার্থী করেছে অভিনেতা যশ দাশগুপ্তকে। এদের প্রচারে মানুষের জীবন-জীবিকা, উন্নয়ন, জনস্বার্থের প্রসঙ্গ নেই। এই কেন্দ্রের মানুষ দেখেছেন বিগত কয়েক বছরে অসংখ্য ছোটো শিল্প, বিশেষ করে নাইলন দড়ি শিল্প বন্ধ হয়েছে। বেগমপুরে তাঁত শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া বাঁকসায় বড়শির হুইল তৈরির কারখানা, খানপুরের পাটশিল্প বন্ধ এবং কিছু ধুঁকছে। এখানকার অন্যতম শিল্প ডানকুনি কোল কমপ্লেক্স বন্ধের মুখে। মাদার ডেয়ারি এবং ছোটো ছোটো অসংখ্য বিস্কুট কারখানা তীব্র সঙ্কটের মুখে পড়েছে। বন্ধ হয়েছে প্লাইউড কারখানা। এগুলিকে সচল রাখার কোনো উদ্যোগ তৃণমূলের বিধায়কের ছিল না। আর নতুন শিল্প গড়ার উদ্যোগ তো অনেক দূরের ব্যাপার। এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই শাসকদল তৃণমূল এবং বিজেপি’র কাছে।
এর বিপরীতে সাধারণ মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকেই সংযুক্ত মোর্চার প্রচারে তুলে ধরা হচ্ছে। মহম্মদ সেলিম এলাকা পরিক্রমার সময়ে, বিভিন্ন প্রচার সভায়, বৈঠকে বলছেন তৃণমূল-বিজেপি’র ভাঙনের রাজনীতি ও মিথ্যাচারের কাহিনি। এর পাশাপাশি তুলে ধরা হচ্ছে বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্পের কথা। মানুষের রুটি-রুজি, জীবন-জীবিকা ও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার কথা। সাধারণ মানুষের জীবন-সংশ্লিষ্ট এই বিষয়গুলি অগ্রাধিকার দেওয়ার ফলে সংযুক্ত মোর্চার প্রচারে মানুষ একাত্মতা বোধ করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিচ্ছেন। ক্রমশ বাড়ছে জনসমর্থন। তারই আভাস মিললো নৈতি গ্রামপঞ্চায়েতের বিভিন্ন অঞ্চল পরিক্রমার সময়। উত্তরআদান গ্রামের জেলেপাড়া থেকে শুরু হওয়া পদযাত্রা এগোনোর সাথে সাথে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বাড়তে লাগল। বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মহিলা-পুরুষেরা দাঁড়িয়ে স্বাগত জানালেন মহম্মদ সেলিমকে। অনেক জায়গাতেই ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে প্রার্থীকে অভ্যর্থনা জানালেন মহিলারা। এভাবে আদান কালিতলা, বাঁকাগাছা, বাঁকাগাছা কালীতলার বিভিন্ন রাস্তা পরিক্রমার পর যখন প্রার্থী মহম্মদ সেলিম জনাই স্টেশনমুখী মূল সড়কে পা রাখলেন তখন দেখা গেল তাঁকে সামনে রেখে দীর্ঘ মিছিল তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ ৭ কিলোমিটার অতিক্রমের পর লাল পতাকা শোভিত স্লোগান-মন্দ্রিত মিছিল এসে জনাই স্টেশন সংলগ্ন বাজার পরিক্রমা করে সভায় মিলিত হলো। তখন সভা মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে বহু মানুষ। তাঁরা অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষায় ছিলেন মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য শোনার জন্য।
মহম্মদ সেলিম সভায় প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরলেন তৃণমূল-বিজেপি’র মিথ্যার রাজনীতি, জনস্বার্থ বিরোধী নানা কার্যকলাপের কথা। তিনি বললেন, সুজলাং সুফলাং ভারতে আজ মানুষের দুর্দশার শেষ নেই। মোদীর শাসনে দেশের অর্থনীতি বরবাদ হয়ে গেছে। মোদী বলছেন সত্তর বছরে যা হয়নি, উনি নাকি তাই করে দিয়েছেন। এখানে দিদি বলছেন, তিনি নাকি সব কিছু করে দিয়েছেন! রাজ্য ও দেশের মানুষ এসব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী আজ সোনার বাংলা গড়ার কথা বলছেন। উনিতো সাত বছর সময় পেয়েছেন, তারমধ্যে কেন তা করলেন না? চাষিরা ধানের দাম পাচ্ছেন না। তিন মাস ধরে চাষিরা দিল্লির উপকণ্ঠে ধরনায় বসেছেন। মোদী একবারও তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় পেলেন না! আজ ভোটের মুখে প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী হেলিকপ্টার করে ঘুরছেন। চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত নেতারা তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে দলে দলে ভিড়ছে। বিজেপি-তে গিয়ে কলঙ্কিত নেতারা ভাবছে তারা সব মহান হয়ে গেছে। তিনি উল্লেখ করেন, ভোট এলেই মোদী সিবিআই’র ঝাঁপি খোলেন। আসলে চোর কখনো চোরকে ধরতে পারে না। কৃষকের ফসলের দাম, খেতমজুরদের মজুরি, একশো দিনের কাজ, বেকারদের চাকরি, মহিলাদের সমানাধিকারের দাবি আদায় করতে লাল ঝান্ডার প্রয়োজন।
মহম্মদ সেলিম তাঁর প্রচারে বলছেন, গত ১০ বছর ধরে এখানে এমএলএ-এমপি সবই ছিল তৃণমূলের। এদেরকে কেউ কখনো পাশে পায়নি। এবারে এখানে এবং রাজ্যে অন্য এক মডেল দেখবে মানুষ। এবারের নির্বাচন শুধুমাত্র এমএলএ নির্বাচনের জন্য নয়, লড়াইটা মহাকরণ দখলের জন্য, মানুষের গণতন্ত্র, অধিকার রক্ষার জন্য, দাবি আদায়ের জন্য মহারণ। সেই মহারণের মধ্য দিয়ে লাল পতাকার ঐতিহ্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে আমাদের। মানুষকে ভাগ করে নয়, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ভাঙাবুকের পাঁজর দিয়ে নয়া বাংলা গড়ার শপথ নিতে হবে আমাদের।
এই আহ্বানই আজ ছড়িয়ে যাচ্ছে চণ্ডীতলার প্রতিটি প্রান্তে - মানুষের মনের গভীরে।