৫৮ বর্ষ ৩২ সংখ্যা / ২৬ মার্চ, ২০২১ / ১২ চৈত্র, ১৪২৭
উলুবেড়িয়া উত্তর
তৃণমূলের সন্ত্রাস-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ মানুষ জোট বাঁধছে
শংকর মুখার্জি
উলুবেড়িয়া উত্তর কেন্দ্রে প্রচারে সংযুক্ত মোর্চা প্রার্থী অশোক দলুই। ছবিঃ মনিরুল হক।
তৃণমূলের সন্ত্রাসে গত দশ বছরে সারারাজ্যে হাজার হাজার সিপিআই(এম) সহ বামপন্থী কর্মী ঘরছাড়া হয়েছেন। হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া উত্তর (তপশিলি জাতি) বিধানসভা কেন্দ্রের চন্দ্রপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় এখনও ঘরছাড়া ৩৫০শেরও বেশি সিপিআই(এম) কর্মী। এঁদের অনেকে ঘরছাড়া হয়েছেন ২০০৯ সাল থেকেই। এগারো বারো বছর তাঁরা বাড়ি ফিরতে পারছেন না তৃণমূলের সন্ত্রাসের কারণে। তাঁদের নিজের ঘরে ফেরাতে সরকার প্রশাসনের কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু এখানে যেটা নতুনত্ব তা হলো, তৃণমূলের সন্ত্রাসে মহম্মদ ফারুক, আলেমা বেগম, সাবিনা বেগমের মতো বেশ কয়েকজন তৃণমূল কর্মীও ঘরছাড়া। মহম্মদ ফারুক আবার গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান; আলেমা বেগম, সাবিনা বেগমরা গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য। আরও কয়েকজন তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্যও ঘরছাড়া। এর থেকেই বোঝা যায় তৃণমূলের অত্যাচারের শিকার শুধু বামপন্থীরা, সাধারণ মানুষরা নন, তৃণমূলীরাও এই অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না।
এই বিধানসভা কেন্দ্রের চন্দ্রপুর, পাড়োলার মতো কিছু অঞ্চল গত দশ বছর ধরেই তৃণমূলের সন্ত্রাসে দীর্ণ। “বিধানসভা,লোকসভা কোনো নির্বাচনেই এখানকার মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে না, সব তৃণমূলীরা লুট করে নেয়” - বলছিলেন এই কেন্দ্রের সংযুক্ত মোর্চার সিপিআই(এম) প্রার্থী অশোক দলুই। তিনি সিপিআই(এম)’র সর্বক্ষণের কর্মী এবং জেলার খেতমজুর আন্দোলনের নেতা। গত বিধানসভা নির্বাচনেও এই দুই এলাকার জন্যই তৃণমূল প্রার্থী নির্মল মাঝি জিতে যান। এবারেও তৃণমূল তাঁকেই প্রার্থী করেছে। যদিও গতবার এই কেন্দ্রে বাম-কংগ্রেস জোটের কংগ্রেস প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
উলুবেড়িয়া উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রের পুরোটাই পঞ্চায়েত এলাকা। ১৪টা গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে এই কেন্দ্রে। একদিকে যেমন তৃণমূলী বিধায়ককে প্রয়োজনে না পওয়া, তাঁর খারাপ ব্যবহারে সাধারণ মানুষ এমনকি তৃণমূলীরা পর্যন্ত বিরক্ত; একইভাবে পঞ্চায়েতের দুর্নীতিতে এখানকার সর্বস্তরের মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বিশেষকরে রেগার দুর্নীতির কথা উল্লেখ করতেই হয়। সব জবকার্ড এখানে পঞ্চায়েতের তৃণমূলী মাতব্বররা নিজেদের হেফাজতে রেখে দেয়। প্রাপ্য মজুরি থেকে একটা নির্দিষ্ট অংশ তাদের দিলেই একমাত্র পরেরবার কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে। কেউ যদি এই কাটমানি দিতে অস্বীকার করে তাহলে তার আর ভবিষ্যতে কাজই মিলবে না। অন্যদিকে আমফানের ত্রাণে পঞ্চায়েতের তৃণমূলীরা অন্যলোকের ভাঙা বাড়ির ছবি দেখিয়ে টাকা তুলে নিয়েছে। এই ধরনের পুকুর চুরির ঘটনা এখানে একাধিক জায়গায় ঘটেছে।
বামফ্রন্টের সময় উলুবেড়িয়া গ্রোথ সেন্টার, এই বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে হাওড়া-আমতা রোড ও আমতা-উলুবেড়িয়া রোড এবং সামগ্রিকভাবে ৬নং জাতীয় সড়কের ধারে যে অসংখ্য নতুন শিল্প গড়ে উঠেছিল তাতে এই কেন্দ্রেরও হাজার হাজার মানুষের কাজ হয়েছিল। কিছুটা হলেও কমেছিল বেকারত্ব। কিন্তু বর্তমানে কাজের সঙ্কট এক ভয়ানক জায়গায় পৌঁছেছে। একদিকে রেগার দুর্নীতিতে অদক্ষ কর্মক্ষম মানুষরাও ঠিকভাবে কাজ পাচ্ছেন না; আবার নতুন শিল্পও একটা গড়ে ওঠেনি,পুরনো শিল্পও বেশ কয়েকটা বন্ধ। যে শিল্পগুলি খোলা আছে তাদের মালিকরাও নাকি পঞ্চায়েতের তোলাবাজি-মাসোহারা দেওয়ার ঠেলায় অতিষ্ঠ।তবে এই তোলাবাজি-মাসোহারা দেওয়ার সুযোগ নিতে ছাড়ছে না শিল্পমালিকরা। এই সব শিল্পে কর্মরত শ্রমিকরা প্রকাশ্যেই বলছেন, তোলাবাজি-মাসোহারা দেওয়ার বিনিময়ে মালিকরা, ঠিকাদাররা অবাধ শ্রমিক শোষণের ছাড়পত্র পেয়েছে। ন্যূনতম মজুরিতো মেলেই না উল্টে খাটতে হয় প্রতিদিন বারো ঘণ্টা করে।কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নও করা যায় না। শ্রমিকরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করলেই তাদের ওপর তৃণমূলীদের আক্রমণ নেমে আসে।
হাওড়া জেলার কয়েক লক্ষ মানুষের রুজি রোজগারের ঠিকানা হচ্ছে জরি শিল্প।উলুবেড়িয়া উত্তর কেন্দ্রেরও হাজার হাজার মানুষ এই পেশায় যুক্ত। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নোটবন্দির সিদ্ধান্তে এই শিল্প মারাত্মকভাবে সঙ্কটে পড়ে। নোটবন্দির পর চার বছর কেটে গেলেও, এখনও সেই সঙ্কট থেকে এই শিল্প মুক্ত হতে পারেনি। অসংখ্য মানুষ এই শিল্পে কাজ হারিয়েছেন,যাঁরা এখনও টিকে আছেন তাঁদেরও আয় তলানিতে ঠেকেছে। এই সামগ্রিক পরিস্থিতিতে কাজের সঙ্কট ব্যাপক। সংযুক্ত মোর্চা প্রচারে দুর্নীতি, সন্ত্রাসের মতো বিষয়গুলির সাথেই নতুন কাজ তৈরির প্রসঙ্গটাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।
কৃষির অবস্থা ভালো থাকলে এই সঙ্কট থেকে এলাকার মানুষের কিছুটা সুরাহা মিলত। সেখানেও গত দশ বছরে কোনো গঠনমূলক কাজ হয়নি। যার পরিণতিতে বামফ্রন্ট সরকারের সময় গড়ে ওঠা সেচ পরিকাঠামোগুলি এবং লকগেটগুলির অবস্থা খুবই শোচনীয়। কৃষির সামগ্রিক সঙ্কটের সঙ্গে এটা বাড়তি সম্যসা তৈরি করেছে। কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলের মানুষের বিপদের সময় বামফ্রন্ট আমলে পঞ্চায়েত ছিল একটা বড়ো ভরসার জায়গা। সেটা এজমানায় সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। আসলে সেই গণতান্ত্রিক পঞ্চায়েত ব্যবস্থারই আজ আর কোনো অস্তিত্ব নেই। অতিমারী লকডাউনের সময় সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো তো দূরে থাক, তৃণমূল মাতব্বররা পঞ্চায়েত দপ্তরে তালা ঝুলিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। এলাকার বিধায়ক, সাংসদ সব তৃণমূলের হওয়া সত্ত্বেও এই কেন্দ্রের বিভিন্ন রাজ্যে থাকা কয়েক হাজার পরিযায়ী শ্রমিক বিপদের দিনে তাঁদের পাশে পায়নি। কিন্তু বামপন্থীরা এলাকার সাধারণ মানুষ, পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে সাধ্যমতো থাকার চেষ্টা করেছে। সংযুক্ত মোর্চার প্রচারে সাধারণ মানুষের মুখে সেসব কথা শোনাও যাচ্ছে।
পাড়োলার মতো সন্ত্রাসদীর্ণ এলাকায় ইতিমধ্যে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী প্রচারে গেছেন।গত নির্বাচনগুলিতে এইসব জায়গায় বামপন্থীরা সেইভাবে প্রচারই করতে পারেনি। কিন্তু এবারে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছে। গত ২১ মার্চ সংযক্ত মোর্চার প্রার্থী যখন ওই এলাকায় প্রচারে যান সাধারণ মানুষ সেই প্রচারে ব্যাপক সংখ্যায় অংশ নেয়।কয়েকদিনের মধ্যেই আরেক সন্ত্রাসদীর্ণ এলাকা চন্দ্রপুরেও সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী প্রচারে যাবেন। সেখানকার সাধারণ মানুষও যে পাড়োলার মতো ব্যাপক সংখ্যায় সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থীর সমর্থনে অংশ নেবে সেই পরিস্থিতিও তৈরি হচ্ছে।
এই কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী করেছে চিরন দেব-কে। একট অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে প্রচারে। জুয়ারগোড়ি অঞ্চলে যখন সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী প্রচারে গেছেন তখন বিজেপি প্রার্থীর দুই কাকা সিপিআই(এম) প্রার্থীর হয়ে প্রচারে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আসলে যত সময় এগোচ্ছে সংয়ুক্ত মোর্চার প্রার্থীর প্রচারে এই কেন্দ্রের বিভিন্ন অংশের মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এমনিতেই এই কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী নির্মল মাঝি রাজ্যের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্নীতিতে শিরোপা অর্জন করেছেন। এই কেন্দ্রের যেকোনো সচেতন ভোটারের কাছে তা লজ্জার বিষয়। সচেতন সাধারণ ভোটাররা এবিষয়টা একদমই মেনে নিতে পারছেন না। তাদের একটাই প্রশ্নঃ পিজিতে কুকুরের ডায়ালিসিস, ডক্তারি পরীক্ষা, মেডিক্যাল কলেজে নিয়োগের মতো একাধিক কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার পরও কিভাবে এই বিধায়কের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়না। এই লজ্জা থেকে মুক্তি চাইছে এই কেন্দ্রের মানুষ। অশোক দলুইকে জয়ী করার মধ্যদিয়েই সেই লজ্জা থেকে এলাকার মানুষদের স্থায়ী মক্তি দেওয়ার লক্ষেই জানপ্রাণ লড়াই চালাচ্ছে সংযুক্ত মোর্চা।