৫৮ বর্ষ ৩২ সংখ্যা / ২৬ মার্চ, ২০২১ / ১২ চৈত্র, ১৪২৭
বাগনান কেন্দ্র
অত্যাচার বঞ্চনার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ প্রতিবাদের ভাষাই মূর্ত হচ্ছে সংযুক্ত মোর্চার প্রচারে
শংকর মুখার্জি
বাগনান কেন্দ্রে প্রচারে সংযুক্ত মোর্চা প্রার্থী বসির আহমদ। ছবিঃ মনিরুল হক।
দামোদর রূপনারায়ণ দিয়ে ঘেরা হাওড়া জেলার বাগনান বিধানসভা কেন্দ্র। বর্তমানে পুরো কেন্দ্রটা পঞ্চায়েত এলাকা হলেও, শহরের ছাপ বহু বছর ধরেই ধিরে ধিরে প্রকট হচ্ছিল সর্বত্র। পঞ্চায়েতিব্যবস্থা, গ্রামোন্নয়নের কর্মসূচি এলাকার আর্থিক চালচিত্রের যে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটিয়েছিল এসব ছিল তারই বহিঃপ্রকাশ। সেইদিকে খেয়াল রেখেই পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার বাগনানকে পুরসভায় রূপান্তরিত করার কাজ হাতে নিয়েছিল। প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক কাজও প্রায় শেষ হয়। তৃণমূলও ২০১১ সালে নির্বাচনী প্রচারে বাগনানকে পুরসভায় রূপান্তরিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ওই নির্বাচনে বাগনানেও জিতেছিল তৃণমূল, রাজ্যেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তৃণমূলের সরকার। ২০১৬ সালে একটা বিধানসভা নির্বাচন হয়ে আরও একটা বিধানসভা নির্বাচনের দোরগোড়ায় বাগনানবাসী। সময়ও কেটে গেছে দশ বছর, প্রতিশ্রুতি এখনও পূরণ হয়নি। এবারে এই কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী সিপিআই(এম)’র বসির আহমদ। তাঁর প্রচারে এলাকার কৃষির ও সেচের সম্যসা, কাজের আকাল, সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির মতো বিষয়গুলির সাথেই বাগনানবাসীর দীর্ঘদিনের এই আকাঙ্ক্ষার কথাও ফুটে উঠছে। বসির আহমদ প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক,জেলা পরিষদের প্রাক্তন সদস্য।
দুটি ঘটনা বাগনানের মানুষকে খুব নাড়া দিয়ে গেছে। যদিও কয়েক বছর আগের ঘটনা। আসলে এধরনের ঘটনা বামফ্রন্ট সরকারের সময় একেবারেই অকল্পনীয় ছিল। এই কেন্দ্রের সবস্তরের ভোটারদের কথাতেও তা ঘুরেফিরে আসছে। সমস্ত বিষয়টা পরিষ্কার হতে গেলে আমাদের কয়েকটা বছর পিছিয়ে যেতে হবে।
দুটি ঘটনা। দুটিই ঘটেছিল বাগনান স্টেশন সংলগ্ন লাইব্রেরি মোড়ে। ২০১১ সালে রাজ্যে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার পরই এখানে মসজিদ ভাঙচুর হয়। ঘটনার পর স্থানীয় বিডিও সর্বদলীয় সভা ডাকে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেদিন তৃণমূলের বিধায়ক অরুণাভ সেন ওই সভায় অনুপস্থিত ছিলেন। ২০১১ সাল থেকেই তিনি বাগনান কেন্দ্রের বিধায়ক। এবারও তৃণমূল তাঁকেই প্রার্থী করেছে। দ্বিতীয়টি ২০১৬ সালের নির্বাচনের পর। এই কেন্দ্রের খালোল গ্রাম পঞ্চায়েতের হেতমপুর গ্রামের কয়েকজন সংখ্যালঘু মানুষ উলুবেড়িয়ার গোরুহাটে গোরু বেচতে যচ্ছিলেন। তাঁদের ব্যাপক মারধোর করা হয় ওই লাইব্রেরি মোড়ে। অর্থাৎ তাঁরা মবলিঞ্চিঙের শিকার হন। ওই লাইব্রেরি মোড়েই হিন্দু সংহতির অফিস। বাগনান কেন্দ্রের প্রাক্তন বিধায়ক সিপিআই(এম)’র আক্কেল আলি বলছিলেন,এই ঘটনার প্রতিবাদে সবধর্মের মানুষদের নিয়ে সেদিন বাগনানে এক শান্তিমিছিল হয়। কোনো রাজনৈতিক দলের পতাকা না থাকলেও বামপন্থীদের উদ্যোগেই হয় সেই শান্তিমিছিল। তাতেও অংশ নেননি তৃণমূল বিধায়ক। আজ বাগনানের আনাচেকানাচে, রাস্তাঘাটে কানপাতলেই শোনা যায় - এই দুটি ঘটনাতেই নাকি তৃণমূল বিধায়কের মদত ছিল।প্রসঙ্গত, এই কেন্দ্রের সংখ্যালঘু ভোটার প্রায় ৩২ শতাংশ। সংখ্যালঘু মানুষদের বিরুদ্ধে এধরনের আচরণ আমরা বিজেপি-শাসিত রাজ্যেই দেখতে অভ্যস্ত। তৃণমূলের কল্যাণে আমাদের রাজ্যও আজ সেই তালিকাভুক্ত।
বিজেপি এই কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে অনুপম মল্লিককে। পুরনো বিজেপি কর্মী। কিন্তু তাঁর প্রার্থীপদ নিয়েও এলাকার বিজেপি কর্মীরা ব্যাপক বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। এমনকি এই বিক্ষোভ সদরদপ্তর হেস্টিংসেও পৌঁছেছিল। সেসব খবর বাজারি পত্রিকাতেও বেরিয়েছে। ভোটের দিন আর বেশি বাকি নেই। এখনও বিজেপি ঠিকভাবে প্রচার-ই শুরু করতে পারেনি। বলা যায়, গোষ্ঠীকোন্দলের দরুন নির্বাচনী লড়াইয়ে তারা অনেকটা পিছিয়েই গেছে।
এই কেন্দ্রের বহু মানুষ স্থানীয় স্তরে অ-কৃষি পেশায় যুক্ত, পরিযায়ী হয়ে অন্য রাজ্যে রয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ, আসেপাশের কলকারখানায় ও কলকাতায় বিভিন্ন কাজেও যুক্ত আছেন বেশকিছু মানুষ। তবে বেশিরভাগ মানুষ এখনও তাঁদের রুটিরুজির সংস্থান করে কৃষি ও কৃষি-অনুষঙ্গ কাজকর্ম থেকেই। সেখানে সারারাজ্যের মতোই কৃষিজ দ্রব্যের বিপণন, লাভজনকদামের সম্যসা; কিন্তু বাড়তি যা তা’হলো, সেচের অপ্রতুলতা। গভীর নলকূপ, লিভার লিফটিং ইরিগেশন, খালের মতো যে সেচ পরিকাঠামো বামফ্রন্ট সরকারের সময় গড়ে উঠেছিল, সেগুলি প্রায় সবই সংস্কারের অভাবে আজ ব্যবহার-অযোগ্য কিংবা সঠিকভাবে কর্মক্ষম নয়। এখানে ফুলচাষ কৃষিজ উৎপন্নের এক অন্যতম ক্ষেত্র। দামোদর-রূপনারায়ণের চরে প্রচুর ফুলচাষ হয়; সবজি চাষও হয় প্রচুর, হয় কিছু পান চাষও।সেচের অভাবে আজ ক্ষতির মুখে সব চাষই।
এখানকার ফুল কলকাতার মল্লিকঘাট বাজারে যায়। হাজার অসুবিধা পেরিয়ে উৎপন্ন সেই ফুল বিক্রিতে আর লাভজনক দাম পেতেও ব্যাপক ভোগান্তি পোয়াতে হচ্ছে বাগনানের ফুলচাষিদের। এই অবস্থা থেকে সুরাহা পেতে এলাকার তৃণমূল বিধায়ককে পাশে পাননা ফুলচাষিরা।
তা’হলে সারা রাজ্যে ঘুরেঘুরে মুখ্যমন্ত্রী যে উন্নয়নের ফিরিস্তি দিচ্ছেন তা সবই কী জুমলা? বাগনান কেন্দ্রে সেদিকে নজর দিলে তারই সমর্থন মেলে। খাল সংস্কারের অভাবে চাষের যেমন ক্ষতি হয়েছে, একইভাবে বাগনানবাসীকে এখন ভুগতে হচ্ছে নিকাশির সমস্যাতেও। ব্লক স্তরের হাসপাতালে ঘটা করে নতুন ব্লিডিং হয়েছে,কিন্তু ডাক্তারের দেখা মেলে না। বামফ্রন্ট সরকারের সময় সেই যা ছোটো মাঝারি বড়ো শিল্পগুলো হয়েছিল ৬ নং জাতীয় সড়কের দু’ধারে; আর এই কেন্দ্র সংলগ্ন বীরশিবপুরে গড়ে উঠেছিল শিল্পতালুক উলুবেড়িয়ায় গ্রোথ সেন্টার। এই কারখানাগুলিতে হাজার হাজার মানুষ কাজ পেয়েছিলেন। টিস্যু পেপার মিলের মতো বড়ো শিল্প, যা গড়ে উঠেছিল এই কেন্দ্রের ওরফুলি গ্রাম পঞ্চায়েতে, ৩ হাজারেরও বেশি শ্রমিক কাজ করতেন। সেই কাজ পাওয়ার দলে এই কেন্দ্রের মানুষও আছেন।তৃণমূল সরকারের আমলে নতুন শিল্প হয়নি একটাও, কিন্তু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে অনেকগুলি। নতুন প্রজন্মের কাজের সুযোগ নেই, তার ওপর কর্মচ্যুতি। অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই কর্মক্ষম অভাবীদের পরিযায়ী হতে হয়েছে। এঁদের বেশিরভাগেরই গন্তব্য-রাজ্য রাজস্থান, দিল্লি, কেরালা,তামিলনাডু। এঁরাই যখন লকডাউনের সময় ঘরে ফিরলেন তখন না সরকার, না তৃণমূল দল - কাউকে পাশে পাননি। কিন্তু বামপন্থীরা তাদের সর্বশক্তি নিয়ে এলাকার মানুষ আর অবশ্যই পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে থেকেছে। য়াঁরা কেরালায় ছিলেন, ফিরে এসে সেখানকার এলডিএফ সরকারের সংবেদনশীল মানবিক ভূমিকার কথা, তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা এলাকার মানুষের সাথে শেয়ার করেছেন। এঁরা বিভিন্ন রাজ্যে তাঁদের কর্মস্থলে আবার ফিরে গেছেন। এঁদের অনেকেই ভোট দিতে আসবেন। আবার পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার শরৎ অঞ্চলে কলেজ এবং হিজলক মাঠে স্পোর্টস কমপ্লেক্সের পরিকল্পনা নেয়। প্রশাসন স্তরের কাজকর্ম সবই প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাসত্ত্বেও তৃণমূল সরকার এই প্রকল্পগুলি রূপায়ণে কোনো আগ্রহই দেখা যায়নি।
উন্নয়ন দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হলেও, তৃণমূলের দূর্নীতি ছড়িয়ে আছে আনাচে-কানাচেতে। খালের মাটি কাটা থেকে শুরু করে একশ দিনের কাজ কিংবা আবাসন প্রকল্প-দুর্নীতি সর্বত্র। তৃণমূলের ছোটো বড়ো মাঝারি কোন্ নেতা কতো কাটমানি খেয়েছে তা এলাকার মানুষের খোরাকের বিষয় এখন। আর পঞ্চায়েত ব্যবস্থাতো উঠেই গেছে। এই নির্বাচনে উন্নয়ন, শিল্পায়ন, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন সংযুক্ত মোর্চার প্রচারের অন্যতম প্রধান বিষয়। বাগনান কেন্দ্রেও প্রার্থীকে নিয়ে প্রচার, মিছিল, পথসভা, বৈঠকি সভায় এই ইস্যুগুলিই নিয়ে যাচ্ছেন ভোটারদের কাছে সংযুক্ত মোর্চার কর্মীরা।
তৃণমূল জমানায় সারারাজ্যে যে গণতান্ত্রিক বাতাবরণ ধ্বংস হয়েছে বাগনান তার বাইরে নয়। ২০১১ সাল পরবর্তী সময় সিপিআই(এম) কর্মীরা ঘরছাড়া হয়েছেন, ভাঙচুর করা হয়েছে ৮টি পার্টি অফিস। গত বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনে বাগনান কেন্দ্রের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বুথ দখল করেছিল তৃণমূলীরা। কয়েক হাজার ভোটার গত নির্বাচনগুলিতে ধারাবাহিকভাবে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছেন না। মানুষের মনে এনিয়েও ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে। সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী, কর্মী-নেতৃত্বের কাছে সে ক্ষোভের কথা প্রকাশও করছেন সাধারণ মানুষ।
আগামী ৬ এপ্রিল বাগনান বিধানসভা কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ। মানুষ এই অত্যাচার বঞ্চনার জবাব দেবেই, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে ইভিএম মেসিনে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে এই ক্ষোভকে সঠিক পথে চালনা করে নিজেদের প্রার্থীকে জয়ী করে আনাই এখন সংযুক্ত মোর্চার কর্মীদের কাছে প্রধান চ্যালেঞ্জ।