E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩২ সংখ্যা / ২৬ মার্চ, ২০২১ / ১২ চৈত্র, ১৪২৭

দশ বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতাই বানভাসি ঘাটালের মানুষকে আবার বামমুখী করেছে


ঘাটালে খাসবার হাটে প্রচারে সিপিআই(এম) প্রার্থী কমল দলুই।

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ কেউ কথা রাখেনি। গত ১০ বছরে লোকসভা বিধানসভা মিলিয়ে চার চারটে নির্বাচন চলে গেছে। চলে গেছে প্রবল সন্ত্রাস কবলিত পঞ্চায়েত নির্বাচন। কিন্তু ঘাটাল যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। ঘাটাল শহর সংলগ্ন স্কুল মাঠে ২০১১ সালে শ’য়ে শ’য়ে মাইক লাগানো জনসভা থেকে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রান্তিক এই মহকুমা শহরকে শুনিয়ে বলেছিলেন, তৃণমূল ক্ষমতায় এলে মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে ফি-বছর বানভাসি ঘাটাল শহরের আশপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীগুলিকে নিয়ে বন্যা রুখতে পরিকল্পনা রূপায়িত হবে। ড্রেজিং থেকে পলি তোলা, বাঁধ থেকে জল ছাড়া নিয়ন্ত্রণ এবং সেচ সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়কে পর্যালোচনা করে তৈরি হবে মাস্টারপ্ল্যান। কিন্তু তারপর ঘাটাল শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝুমি নদীর নাব্যতা ভীষণভাবে কমেছে, পলি বেড়েছে, বর্ষা ছাড়া অন্য সময়ে জলের ধারা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে, প্রতি বছর বেড়েছে বন্যার প্রকোপ। কিন্তু কোনো ‘মাস্টারপ্ল্যান’ বাস্তবায়িত হয়নি। এমন সব উলট-পুরাণের সাক্ষী থাকতে থাকতে ঘাটালের দু’টি ব্লকের মানুষ বিরক্ত হয়ে ব্যঙ্গ করে বলছেন, ২০১১-র পর থেকে প্রতিটি বন্যাই ‘ম্যান মেড’। এর পাশাপাশি বিধানসভা ভোটের পর ২০১৭ সালের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে বামপন্থীরা তাদের সীমিত ক্ষমতা নিয়ে যেভাবে দাঁড়িয়েছিলেন তা ভুক্তভোগী মানুষ স্মরণ করছেন অত্যন্ত আগ্রহ এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই। না, তৃণমূল-বিজেপি’র দেখা মেলেনি তখন। যেমন দেখা মেলেনি অসহায় পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে। সেখানেও বামপন্থীরা থেকেছেন পাশে, সাধ্যমতো সহায়তা নিয়ে।

তৃণমূলী বিধায়ক শঙ্কর দলুইকে পরপর দু’বার জিতিয়েও সংরক্ষিত এই কেন্দ্রের সমস্যা গত এক দশকে বেড়েছে বৈ কমেনি। মূলত কৃষিজীবী এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের বাস এখানে। সার, বীজ আর চাষের আনুষঙ্গিক খরচ ডিজেল পেট্রোলের সঙ্গে তাল রেখে দ্বিগুণ-তিনগুণ হয়েছে। সেসব নিয়ে হতাশা গোপন করছেন না কেউই। যেমন খাসবারের বাজার সংলগ্ন কলের হাটে চাষিরা ফসল বেচতে এসে বলছিলেন সেসব। বলছিলেন আলু চাষে তাদের লোকসানের অভিজ্ঞতার কথা। জ্যোতি আলু বীজের দাম বেশি হওয়ায় চাষ কম হচ্ছে এবার। তুলনায় কম দামি দেশি গোত্রের পোখরাজ, হেমাঙ্গিনী আলু চাষ পশ্চিম মেদিনীপুরের এই অংশে বেশি। সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী কমল দলুইয়ের সমর্থনে মিছিল ঝুমি নদীকে ডান দিকে রেখে যত সামনে এগিয়েছে, ততই দূরের মাঠে বিক্রি না হওয়া স্তূপাকার বা না তোলা আলুর ভরা খেত দেখা গেছে কম-বেশি সবদিকেই। সংযুক্ত মোর্চার পক্ষ থেকে আগামী কর্মসূচি হিসেবে বন্যা প্রতিরোধ ও অসমাপ্ত সেচ প্রকল্পগুলি কার্যকর করতে যে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং পাট ও আলুবীজের স্বাবলম্বী হওয়ার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার কথা সমবায় প্রথার মাধ্যমে বীজ সার সেচ ও ফসলকে বাজারজাত করার উদ্যোগ এবং ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবার মতো বিষয়গুলি মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখছেন এবং উৎসাহিত বোধ করছেন। প্রার্থীকে জড়িয়ে ধরে কুশল বিনিময়ের ভঙ্গিতে সেটা আরও ধরা পড়ে।

সন্ত্রাস কবলিত ঘাটাল গত ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে আর বিধানসভা নির্বাচনে সাক্ষী থেকেছে ব্যাপকতর সন্ত্রাসের। মনোনয়ন দাখিল করতে দেওয়া হয়নি মূলত বামপন্থীদের। তারপরেও চলেছে আমফানের ত্রাণ চুরি আর দলবাজি। প্রতিবাদ করলেই নেমে এসেছে সীমাহীন অত্যাচার। তাই এলাকায় রয়েছে চাপা সন্ত্রাস। এর আগে ২০১৪ সা‍‌লের লোকসভা নির্বাচনে সূর্য মিশ্রের জনসভা থেকে ফেরার পথে কমরেড প্রহ্লাদ রাই শহিদ হন। তাঁকে পিটিয়ে খুন করে তৃণমূলীরা। তবু মানুষ মুখ খুলছেন। হাসিমুখে অনেকেই কুশল বিনিময় করছেন সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থীর সঙ্গে।

তবে আছে। প্রতিরোধের উদাহরণের সন্ত্রাসের মুখেও বুক টান করে কেমন করে বুথ রক্ষা করতে হয় তা দেখিয়েছেন কোমরা গ্রামের কুশধ্বজ মল্লিক। গ্রামবাসীদের আদরের ‘কুশো’। ২০১৬ সালের কথা। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর প্রসবের দিন বিধানসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণের দিন পড়ায় ডাক্তারবাবুকে বলে দু'দিন আগেই প্রসবের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করেন কুশো। কিন্তু ভোট লুট রুখতে তার ভূমিকার কথা বিলক্ষণ জানতো তৃণমূলীরা। তাই ভোটের দু’দিন আগেই তারা চড়াও হয় কুশধ্বজের বাড়িতে। অকুতোভয় কুশো রুখে দাঁড়ালে বীরপুঙ্গবরা পিছু হটে। আর ভোটের দিন পাশাপাশি দু’টো বুথে বসেছিলেন কুশধ্বজ এবং আরেক অল্প বয়সি কমরেড। দু’দিন আগে প্রসবের পর তার স্ত্রী এবং সন্তান দুজনেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। অসুস্থতা বাড়ার খবর জেনেও বুথ ছাড়েননি পেশায় গৃহ শিক্ষক কুশধ্বজ মল্লিক। হাসপাতাল থেকে ফোনে বারবার খবর আসছিল তার কাছে। তবু বুথের মাটি কামড়ে পড়ে থেকে ভোট লুট রুখেছিলেন। কিছুতেই না পেরে তৃণমূলীরা অন্য পথ ধরে। ভোট সময়সীমা পেরোনোর অল্প আগে সেই তরুণ কমরেডের বাড়িতে বন্দুকধারীরা চড়াও হয়ে হুমকি দিলো মাঠের ধান কেটে নেওয়ার। সেই কমরেডের বিপদের কথা ভেবে তাকে নিয়ে কুশো যখন বুথ ছাড়েন তখন ৮০ শতাংশ ভোট পড়ে গিয়েছিল। দু’দিন পরে ফল বেরোলে দেখা যায় সিপিআই(এম) জিতেছে ওই দু’টি বুথেই। তৃণমূলীরা খাপ্পা হয়ে চড়াও হয় কুশধ্বজের বাড়িতে। তখনই গোটা গ্রাম এক কাট্টা হয়ে রুখে দেয় তৃণমূলীদের। ‘কুশো’র মতো কমরেডরা এবারও তৈরি।

২০১১ থেকেই এই এলাকার কোমরা গ্রাম, সীমন্তপুর সহ অধিকাংশ পার্টি অফিস ভেঙে দেওয়া এবং বেশকিছু দখল হয়ে যায়। তবে তা দখলমুক্ত করা হয়েছে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে। যা এই ভোটে মানুষের মন পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় সূচক।

গোটা রাজ্যের মতো কৃষি কেন্দ্রিক জীবিকা বিপন্ন এখানেও। ধান আর আলু চাষের ওপর ভিত্তি করে খেতমজুররা দিন গুজরান করেন এখানে। তবে ঘাটাল ছেড়ে বাইরে বেরোতেও তাঁরা বাধ্য হন। কারণ রাজ্য সরকার ব্যাপক প্রচারের ঢক্কা নিনাদ করলেও বছরে ৪০ দিনের বেশি তাঁদের রেগার কাজ নেই। কুইন্টাল পিছু ধানের দাম ১৩ থেকে ১৪শো টাকা দিচ্ছে ফড়েরা। মান্ডি নেই। বুঝতে অসুবিধে হয় না পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। সারা ভারত কৃষক সভা এবং খেতমজুর ইউনিয়নের আন্দোলনের জেরে মজুরি অনেকটাই নিয়মিত হয়েছে। সুবল মাইতি, বিদ্যুৎ জানা-রা বলছিলেনও সেসব। তবে ভূয়ো জব কার্ডধারীদের নাম রয়েছে মাস্টার রোলে। তৃণমূলের তোলাবাজির বেশিরভাগ টাকাই আসে এখান থেকে। যখন কাজ থাকেনা তখন তাঁরা বেরিয়ে পড়েন। স্থানীয়ভাবে তামার কাজ এবং আলোর নকশার কাজ থেকে অন্যত্র শহরে রাজমিস্ত্রির কাজ-কোনো কিছুতেই তাঁরা পিছপা হন না। প্রায় ২৪ হাজার মানুষ বেরিয়ে পড়েন ভিন রাজ্যে কাজের খোঁজে। তাই সংযুক্ত মোর্চার ক্ষমতায় এলে রেগার কাজের দিন ১০০ থেকে বাড়িয়ে ১৫০ দিন করার এবং ‍পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য আলাদা দপ্তর খোলার প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রাখতে চাইছেন গরিব অংশের মানুষ। সিপিআই(এম) প্রার্থী যখন বলছিলেন সংযুক্ত মোর্চার পক্ষ থেকে আগামী কর্মসূচি হিসেবে বন্যা প্রতিরোধ ও অসমাপ্ত সেচ প্রকল্পগুলি কার্যকর করতে এবং পাট ও আলুবীজে স্বাবলম্বী হওয়ার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার কথা, সমবায় ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং তার মাধ্যমে বীজ সার সেচ ও ফসলকে বাজারজাত করার উদ্যোগ এবং ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবার মতো বিষয়গুলি, তখন মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখছেন এবং উৎসাহিত বোধ করছেন, সেটা তাঁদের বিশদে জেনে নেওয়ার আকুতি থেকেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। সওয়াই পর্যন্ত প্রচারের পথের দু’ধারে বামপন্থী প্রার্থীকে কেন্দ্র করে মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ততা ফুটে উঠছিল তা অত্যন্ত ইঙ্গিতবাহী। ভোট আসে ভোট যায়। গোটা দেশের সাথে সাথে এরাজ্যেও বাড়ে বেকারের সংখ্যা। আর ভোট এলে পাল্লা দিয়ে বাড়ে তৃণমূল বিজেপি’র চাকরির প্রতিশ্রুতি। কৃষিতেও তাই কর্মপ্রার্থী যুবক বিশ্বম্ভর মাইতি বামফ্রন্ট প্রার্থীর মিছিলের দিকে তাকিয়ে বলছিলেন ভিক্ষা নয় চাকরি চাই। আমার দু’টো সবল হাত আছে। কাজ করে আমি খাব। আমি যদি ১৮ হাজার টাকা বেতন পাই, তাহলে ৩৫ টাকা কিলো দরে চাল কিনে খেতে পারব। দু’টাকা কিলো চালের দরকার নেই। শহরের যুবকদের ক্ষোভের আঁচ ইতিমধ্যেই টের পেয়ে গেছে দুই ফুলতুতো পার্টি।