৫৮ বর্ষ ৩২ সংখ্যা / ২৬ মার্চ, ২০২১ / ১২ চৈত্র, ১৪২৭
বিজেপি’র ইস্তাহার নামক জুমলা
গৌতম রায়
বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে তাদের ইস্তাহার প্রকাশ করেছে। এই নির্বাচনী ইস্তাহারের বিষয়টি ঘিরে বিজেপি দলটির প্রতি সাধারণ মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নটা এতটাই তলানিতে ঠেকেছে যে, ওদের ইস্তাহার প্রকাশের দিন ভাটপাড়ার এক অটো ড্রাইভার বলে বসলেন, মমতা পাঁচ টাকায় এক বেলা খেতে দেওয়ার কথা বলছেন। আর মোদী পাঁচ টাকাতে তিন বেলা খেতে দেওয়ার কথা বলেছেন। কি বলেন দাদা? আমাদের আর খাওয়া দাওয়ার জন্যে কাজকর্ম করবার দরকার নেই। চুপচাপ বসে থাকি। দাদা-দিদিরাই খাইয়ে দেবেন।
বিজেপি’র এই জুমলাবাজি ঘিরে সাধারণ মানুষদের প্রতিক্রিয়া কি, ওই অটোচালকের কথার ভিতর দিয়েই তা পরিষ্কার হয়ে যায়।রাজ্যে ক্ষমতায় এলে বিজেপি সরকারি চাকরিতে মেয়েদের জন্যে ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই ৩৩ শতাংশের হিসেবটা বিজেপি প্রয়াত বাম সাংসদ গীতা মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন যৌথ সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন থেকে চৌর্য বৃত্তি করে উপস্থাপিত করেছে। যদি সত্যিই নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন হাতরস খ্যাত বিজেপি’র থাকত, তা হলে পর পর দু’বার একক গরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে সরকার গড়া বিজেপি সংসদে মহিলাদের জন্যে ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণের জন্যে গীতা মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন যৌথ সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন কেন আজ পর্যন্ত কার্যকর করেনি? লিঙ্গ রাজনীতির সুবিধা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও মেয়েদের জন্যে অনেক প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছড়িয়েছেন। এই প্রসঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছে একটি ইতিহাস তুলে ধরতে হয়। গীতা মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন জেপিসি’র সদস্যা মমতাও ছিলেন। কিন্তু মমতা মাত্র একদিন এই জেপিসি’র বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে প্রায় সাড়ে ছয় বছর কেন্দ্রীয় সরকারের শরিক ছিলেন মমতা। তখন বা এখন, একটি বারের জন্যেও কিন্তু তিনি সংসদে মেয়েদের জন্যে ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণের উদ্দেশে গীতা মুখোপাধ্যায় কমিটির সুপারিশ কার্যকর করবার দাবি তোলেন নি।
বিজেপি তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে মেয়েদের জন্যে প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আরএসএস স্ত্রী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। মনুবাদী সংস্কৃতির ধারক-বাহক আরএসএস’র বিশ্বাস, রান্নাঘর, আঁতুরঘর আর ঠাকুরঘরের বাইরে মেয়েদের আর কোথাও জায়গা নেই। বিজেপি আরএসএস’র-ই রাজনৈতিক সংগঠন। আরএসএস’র রাজনৈতিক শাখা বিজেপি মেয়েদের শিক্ষার জন্যে অবৈতনিক ব্যবস্থা কায়েম করবে, যে বিজেপি বাংলা তথা ভারতে নারীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম অগ্রদূত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি, তাঁরই নামাঙ্কিত কলেজের ভিতরে ঢুকে ধ্বংস করে, সেই বিজেপি মেয়েদের জন্যে কেজি টু পিজি অবৈতনিক শিক্ষাক্রম চালু করবে - এটা প্রাচীন ঢাকার কোচোয়ানদের নিয়ে প্রচলিত প্রবাদ বাক্যকেও হার মানায়।
বামফ্রন্ট সরকার ১৯৭৭ সালে ক্ষমতাসীন হয়েই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক করে।অল্প দিনের ভিতরেই বামফ্রন্ট সরকার কোনোরকম লিঙ্গ বৈষম্য না রেখে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষাকে অবৈতনিক করেছিল। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে মেয়েদের জন্যে, তপশিলি জাতি-উপজাতি, সংখ্যালঘু, অন্যান্য অনগ্রসর জাতির (ওবিসি) নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্যে প্রযুক্তিগত শিক্ষাতে আর্থিক ভার লাঘব করে, সেই ভার সরকারের মাধ্যমে বহন করার প্রথা চালু করেছিলেন। তাই বিজেপি আজ তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে এই যে প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত মেয়েদের বিনামূল্যে শিক্ষার কথা বলছে, সেটিও আজ থেকে অনেককাল আগেই বামফ্রন্ট সরকারের দ্বারা সফলভাবে রূপায়িত একটি কর্মসূচি। এক্ষেত্রেও বিজেপি বামফ্রন্টের অনেককাল আগের কর্মসূচিই টুকেছে।
সমস্ত মহিলাদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার কথা বিজেপি তাদের ইস্তাহারে জানিয়েছে। ওপিডি সহ যাবতীয় স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরিষেবা তারা মহিলাদের আলাদা করে দেওয়ার কথা বলেছে। বিজেপি’র এই প্রতিশ্রুতি দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে প্রচলিত একটি বাংলা প্রবাদ, ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই, কিল মারবার গোঁসাই। গোটা দেশের অর্থনীতিকে বিজেপি কেন্দ্রে এককভাবে ক্ষমতায় আসার কমবেশি সাত বছরের ভিতরে একদম শেষ করে দিয়েছে। রান্নার গ্যাস প্রায় হাজার টাকা সিলিন্ডার। পেট্রোল একশো টাকা ছুঁইছুঁই। এই ভয়ঙ্কর অবস্থার ভিতরে কোভিড-১৯ জনিত লক ডাউনের সময়ে আমরা দেখেছি কী ভয়াবহ অবস্থার ভিতরে আমাদের দেশের মানুষ আছেন। পরিযায়ী শ্রমিকদের কি অবর্ণনীয় অবস্থার ভিতরে দিন কাটাতে হয়েছে, আমরা দেখেছি। এই অবস্থায় স্বাস্থ্য পরিষেবাতে এতটুকু সুযোগ না কেন্দ্রের সরকার দিয়েছে, না দিয়েছে রাজ্য সরকার। রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে এই কোভিড-১৯ জনিত লক ডাউনের কালে কেন্দ্র আর রাজ্য পরস্পর তরজাতে ব্যস্ত থাকলেও সাধারণ মানুষের পরিষেবার জন্যে এতটুকু পদক্ষেপ ওই দু’টি সরকার তো নেয়ইনি, সেই সরকার পরিচালনা করে যে দু’টি রাজ্য সরকার, বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস, কেউই একফোঁটা যত্নবান হয়নি। তাই এই পরিপ্রেক্ষিতে বিজেপি তাদের ইস্তাহারে যখন মেয়েদের জন্যে আলাদাভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবার কথা বলে তখন আমাদের মমতা ব্যানার্জির নার্সিং হাসপাতালের সেই গালগপ্পের কথাই বেশি করে মনে পড়ে যায়।