৫৮ বর্ষ ৩২ সংখ্যা / ২৬ মার্চ, ২০২১ / ১২ চৈত্র, ১৪২৭
বুখেনওয়াল্ড থেকে গোয়ালপাড়া হয়ে বনগাঁ
তপন মিশ্র
এক বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষকে সন্ত্রস্ত করতে নাগরিকত্ব প্রমাণের কৌশল অতিদক্ষিণপন্থীদের চিরদিনের কৌশল। আমাদের দেশে এই কৌশল প্রয়োগের সমস্ত চেষ্টা করে চলেছে মোদী সরকার। মুখে বিরোধিতা করলেও এই রাজ্যের সরকার কিছু কম যায় না। বিগত শতাব্দীর প্রথমার্ধে জার্মানির নাজি সরকার যে পদ্ধতি অবলম্বন করে, ঠিক একই পদ্ধতির পুনরাবৃত্তি হচ্ছে এদেশেও। জার্মানিতে এখন উলট পুরাণ। সিরিয়া, ইরান, ইরাক এমনকি আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশ থেকে চলে আসা মানুষদের সানন্দে স্থান দিচ্ছে জার্মানি। অবশ্য আমাদের দেশে এই পথ কেউ সমর্থন করেনা। দেশের সীমানা রক্ষার দায়িত্ব যে সরকারের উপর সেই দায়িত্ব পালনের অপারগতার কারণে জাতীয় নাগরিকত্ব আইন বা এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস)-র ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন লক্ষ লক্ষ পরিবার।
১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৩৫ নুরেমবার্গ আইন হিটলারের নেতৃত্বে নাজি পার্টি পাস করে। জার্মান রক্ত এবং স্বাভিমান রক্ষার জন্য দু’টি আইন পাস হয়। একটি ছিল জার্মানরা ইহুদীদের বিয়ে করতে পারবেনা এবং প্রেমের কোনো সম্পর্কও রাখতে পারবেনা (অনেকটা লাভ জেহাদের মতো)। অন্য আইনটি ছিল জার্মান নাগরিকত্ব আইন (Reich Citizenship Law) অর্থাৎ কেবল জার্মান রক্তের বা তাদের সঙ্গে নিকট সম্পর্কযুক্তরাই জার্মান নাগরিক হতে পারবেন। এখানে বলে রাখা ভাল যে, হিটলারের ‘এসএস’ (Schutzstaffel) বাহিনী নিযুক্ত করার সময় কেবল বিশুদ্ধ জার্মান বংশোদ্ভূত ব্যতিরেকে কাউকে বিবেচনা করা হতো না। অনেকটা আর এসএস-র মতো।
২০১৯ সালে আসামের গোয়ালপাড়ার মাটিয়া থেকে রয়টার-এর জেবা সিদ্দিকি জানাচ্ছেন যে, যারা ওখানে ৩০০০ মানুষের আটক শিবির (detention camp) বানাচ্ছেন তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন এই শিবিরের সম্ভাব্য বাসিন্দা। কাজে যুক্ত আছেন এমন শ্রমিকদের মধ্যে একজন হলেন শেফালি হাজং। তিনি মুসলমান নন বা হিন্দুও নন, এদেশের একজন আদিবাসী। এনআরসি’র সর্বশেষ তালিকায় তাঁর নাম নেই। অর্থাৎ তিনি অনেকদিনের বাসিন্দা হলেও, অনুপ্রবেশকারী। শুদ্ধ অহমিয়াতে শেফালি বলেছেন যে, দিনে ২৫০ টাকা তাঁর বেচে থাকার জন্য এখন জরুরি। এর অর্থ হলো নিজের হাতেই শেফালি নিজের বন্দিশিবির তৈরি করছেন, যদিও মন্ত্রী জি কৃষ্ণান রেড্ডির কথায় এগুলো আটক রাখার জায়গা নয়। তবে লোকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে এই মন্ত্রী বলেন যে, কয়েকদিনের মধ্যে আটক শিবিরে বিদেশি নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
মধ্য জার্মানির অরণ্যপ্রধান রাজ্য থুরিঙ্গেনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ওয়াইমারের মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে বুখেনওয়াল্ড। ডয়েচ ভাষায় (জার্মানির ভাষা) ‘ওয়াল্ড (wald)’ কথাটির অর্থ জঙ্গল। ডয়েচ ভাষায় ইংরেজি অক্ষর ব্যবহার হলেও উচ্চারণ একটু ভিন্ন ধরনের। ওয়াইমার শহর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার যাওয়ার পর যে ৭ কিলোমিটার পথ ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বুখেনওয়াল্ড কনসেনট্রেশন ক্যাম্প (আটক শিবির)-কে যুক্ত করছে তার নাম ব্লুটস্ট্রাসে (blutstrasse) বা ব্লাড স্ট্রিট, বাংলায় বললে দাঁড়ায় রক্তেরাঙা পথ। পুরো রাস্তাটাই তৈরি করেন এই আটক শিবিরের বাসিন্দারা।
মাটিয়া ছাড়াও আসামে তৈরি হচ্ছে এমনই আরও ৫ টি ডিটেনসন ক্যাম্প। এগুলি হলো তেজপুর (৭৯৭ জন), শিলচর (৪৭৯ জন), ডিব্রুগড় (৬৮০ জন), জোরহাট (৬৭০ জন) এবং কোকড়াঝাড় (৩৩৫ জন)। গোয়ালপাড়ার ক্যাম্পটি ২৫ বিঘা জমির উপর তৈরি এবং দেশের সর্ববৃহৎ। অতি সম্প্রতি আসামে নির্বাচন থাকায় গোদি মিডিয়ার কয়েকটি চ্যানেল ফলাও করে গোয়ালপাড়া ক্যাম্পে বন্দিদশা কত আনন্দদায়ক হতে পারে তার প্রচার চালাচ্ছে। পুরুষ ও মহিলার আলাদা থাকার ব্যবস্থা, আলাদা রান্নার ব্যবস্থা (রান্না করবেন আবাসিকরা) এবং খাওয়ার জায়গা ইত্যাদি। বুখেনওয়াল্ড-সহ জার্মানির সমস্ত কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে এই ব্যবস্থাগুলি ছিল। অন্তত বুখেনওয়াল্ড এবং বার্লিন থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দুরে সাক্সেনহাউসেন ক্যাম্প প্রত্যক্ষ করে এই ধারণা হয়েছে।
১৯৩৭ সালে হিটলারের সিদ্ধান্ত মতো এটেসবার্গ (Ettersberg)-এর ঘন জঙ্গলের মধ্যে এসএস বাহিনী এই ক্যাম্প তৈরি করার কাজ শুরু করে। এসএস অ্যাডলফ হিটলারের ও নাজি পার্টির তৈরি এক প্যারা-মিলিটারি সংস্থা। কেবল হিটলার এবং নাজি দলের নেতাদের রক্ষা করার জন্য ১৯২৫ সালে এই বাহিনী তৈরি হয়। অনেকটা আরএসএস-র মতো। ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় আসার পরে এসএস যেমন আইনি ব্যবস্থার মধ্যে চলে আসে তেমনই সমগ্র জার্মানি এবং জার্মান অধিকৃত অন্যান্য দেশেও এদের আধিপত্য ছড়িয়ে পড়ে।
পশ্চিম বাংলায় বিদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের (মূলত পূর্ববাংলা) জন্য ২টি আটক শিবিরের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পিটিআই-কে দেওয়া খবরে রাজ্য সরকারের মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস একথা স্বীকার করেন। দেশের গৃহ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী নাকি এই ব্যবস্থা। কিছু নির্দেশ অমান্য করা যায় কিন্তু নিউ টাউন এবং বনগাঁর ডিটেনশন ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা এড়ানো যায় না। এটা দ্বিচারিতা ছাড়া অন্য কি হতে পারে? বলা হচ্ছে যে, কোনো বিদেশি অবৈধভাবে দেশে অনুপ্রবেশ করলে, যতদিন না দেশে ফেরত পাঠান যাচ্ছে ততদিন তাদের জন্য এই আটকের ব্যবস্থা। প্রশ্ন হচ্ছে এই আটকের ব্যবস্থা এতদিন কোথায় হচ্ছিল? উভয় কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার কেন হঠাৎ করে মনে করল যে, ডিটেনশন ক্যাম্পের দরকার আছে। এক্ষেত্রে জাতীয় নাগরিকত্ব আইনের প্রভাব কতটা? মমতা সরকার এটা অস্বীকার করতে পারবেনা যে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে মোদী সরকারের গৃহমন্ত্রকের নির্দেশিকা মতো নিউ টাউন এবং বনগাঁতে আটক শিবিরের আয়োজন চলছে। এবং এটার সঙ্গে এনআরসি’র এক গভীর যোগাযোগ রয়েছে। বিজেপি-র দীর্ঘদিনের দাবি আসামের মতো পশ্চিম বাংলায় এনআরসি’র ব্যবস্থা চালু করা। অতীতের সমস্ত ঐতিহ্য ভুলে সেই দাবিতে সায় দিয়েছে রাজ্য সরকার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে (১৯৪৫ সালে) বুখেনওয়াল্ডে নাজিদের এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্প সোভিয়েত বাহিনীর দখলে চলে আসে। ফলে শেষ হয়ে যায় এর কলঙ্কিত যাত্রাপথ। এখনও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের বেশ কিছু অংশ সুসংরক্ষিত এবং তার ভেতরেই রয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ সংগ্রহশালা। ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পুর্ব জার্মানি বা জার্মান ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক - জিডিআর বা ডিডিআর (Deutsche Demokratische Republik) এই পরিত্যক্ত কনসেনট্রেশন ক্যাম্পকে একটি জাতীয় স্মৃতি সৌধে পরিণত করে। বুখেনওয়াল্ড ক্যাম্পের কয়েক’শ মিটার আগেই কমিউনিস্ট বন্দিদের প্রতিরোধের বিশাল স্মৃতিসৌধ। অন্য দেশের হলেও ইতিহাস দেশ, কাল, পাত্র নিরপেক্ষ। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হুবহু না ঘটলেও শোষণ ও যন্ত্রণার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাসের ভিন্ন রূপে পুনরাবৃত্তি ঘটবেই। বিদেশি নাগরিকের নামে লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেওয়ার রাজনীতি সাময়িকভাবে স্থগিত হলেও এর সমাপ্তি হয়নি। ঠিক তেমনই প্রতিবাদ ক্ষণিকের জন্য স্থগিত হলেও প্রতিবাদের ভাষা শেষ হবে না।