৬০ বর্ষ ৪১ সংখ্যা / ২৬ মে, ২০২৩ / ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
মণিপুর
হিন্দুত্বের নতুন পরীক্ষাগার
পারভেজ রহমান
মণিপুর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির মধ্যে একটি, যার জনসংখ্যা ২৩ লক্ষ এবং ভৌগোলিক আয়তন ২২,৩২৭ বর্গ কিলোমিটার। এর উত্তরে নাগাল্যান্ড, পশ্চিমে আসাম এবং দক্ষিণে মিজোরাম রাজ্যের সাথে এর সীমানা রয়েছে। মণিপুরের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তার আন্তর্জাতিক প্রতিবেশী মায়ানমার, যার সাথে মণিপুর ৩৫২ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমানা ভাগ করে নেয়।
মণিপুরের জনগণ উপত্যকা এবং পাহাড়ের উপর ভিত্তি করে তিনটি প্রধান জাতিগত সম্প্রদায়ে বিভক্ত - মেইতেই, নাগা এবং কুকি-চিন। মণিপুর রাজ্যের জনসংখ্যার বেশিরভাগই মেইতেই জনগোষ্ঠী - ৫৩ শতাংশ, তারপরে বিভিন্ন নাগা জাতিগত গোষ্ঠী ২৪ শতাংশ এবং কুকি/জোমি উপজাতি ১৬ শতাংশ। নাগা এবং কুকিরা পার্বত্য অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত, অন্যরা সমতল অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত। বেশিরভাগ নাগা এবং কুকিরা আনুষ্ঠানিকভাবে ২৯টি তফসিলি উপজাতিতে স্বীকৃত। ভারতের ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, প্রায় ৪১.৩৯ শতাংশ মণিপুরি মানুষ হিন্দু ধর্ম পালন করে। মণিপুর উপত্যকার (ইম্ফল উপত্যকা) মেইতেই প্রভাবশালী অঞ্চলে হিন্দু জনগোষ্ঠী কেন্দ্রীভূত। ২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য অনুসারে বিষ্ণুপুর, থাউবাল, ইম্ফল পূর্ব এবং ইম্ফল পশ্চিম জেলাগুলিতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, গড় ৬৭.৬২ শতাংশ। খ্রিস্টান ধর্ম রাজ্যের ৪১ শতাংশ লোকের ধর্ম, তবে গ্রামাঞ্চলে এই অংশ প্রায় ৫৩ শতাংশ এবং পাহাড়ে এটি প্রাধান্য পায়। মণিপুরে মুসলিম জনসংখ্যা হলো মোট জনসংখ্যার ৮.০৪ শতাংশ।
বর্তমানে মণিপুর বিধানসভা তফশিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত ১৯ জন সহ ৬০ জন নির্বাচিত সদস্য নিয়ে রাজ্য পরিচালনা করে। এই রাজ্য লোকসভায় ২ জন নির্বাচিত সদস্য এবং রাজ্যসভায় ১ জন সদস্য নিয়ে প্রতিনিধিত্ব করে।
মণিপুর একসময় একটি স্বাধীন দেশীয় রাজ্য ছিল, যা ১৮৯১ সাল থেকে ব্রিটিশদের দখলে ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট এই উপমহাদেশের অন্যান্য অংশের সাথে মণিপুরও ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন হয়। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ভারতীয় উপমহাদেশে বিদ্যমান ৫০০ টিরও বেশি দেশীয় রাজ্যকে নবগঠিত ভারতীয় ইউনিয়নের সাথে যুক্ত করার কাজ শুরু করেছিলেন। মণিপুর ১৯৪৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ভারতের সাথে যুক্ত হয়েছিল। শিলংয়ে ভারতের গভর্নর জেনারেল এবং মণিপুরের মহারাজা বোধচন্দ্রর মধ্যে সম্পাদিত একীভূতকরণ চুক্তি (Manipur Merger Agreement, 1949) হয়। চুক্তির মূল কথাটা ছিল ‘ভারত ডোমিনিয়ন সরকারের কর্তৃত্বের অধীনে রাজ্যের প্রশাসনের ব্যবস্থা করা’। চুক্তিটি মণিপুর রাজ্য নামে পরিচিত অঞ্চলের উপর ‘‘শাসন’’ এবং ‘‘প্রশাসন’’ এর সম্পূর্ণ এবং একচেটিয়া কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা ভারত সরকারের কাছে হস্তান্তর করে। এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন মণিপুরের মহারাজা বোধচন্দ্র সিং এবং ভারত সরকারের পক্ষে ভিপি মেনন এবং শ্রী প্রকাশ। এই চুক্তিতে মহারাজাকে পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা, প্রথাগত অধিকার, ব্যক্তিগত সম্পত্তির ব্যবহারের অধিকার এবং ব্যক্তিগত সাহায্য (PRIVY PURSE) হিসাবে তিন লক্ষ টাকা নিশ্চিত করা হয়েছিল। ভারত সরকার মণিপুরি জনগণকে আশ্বস্ত করেছিল যে, তাদের অধিকার সুরক্ষিত করা হবে এবং তাদের প্রথাগত আইন ও সাংস্কৃতিক অনুশীলনগুলি কোনো বাধা ছাড়াই অনুসরণ করা যেতে পারবে। মণিপুর রাজ্য বিধানসভা ভেঙে দেওয়া হয় এবং মণিপুরের প্রথম ভারতীয় প্রধান কমিশনার রাওয়াল অমর সিং দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে সংবিধান সংশোধনের (THE CONSTITUTION (SEVENTH AMENDMENT) ACT, 1956) মধ্য দিয়ে মণিপুরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়। ১৯৭২ সালের ২১ শে জানুয়ারি সংসদে North-Eastern Areas (Reorganization) Act, 1971 (NEA)-এর মাধ্যমে মণিপুরকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের ১৯তম রাজ্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
রাজ্যের মধ্যে অনেকেই এই সংযুক্তির পক্ষে ছিলেন না। এই অঞ্চলটি তখন থেকেই হিংসাশ্রয়ী বিদ্রোহের পাশাপাশি জাতিগত সংঘাতের সম্মুখীন হয়েছে, যার ফলে কয়েক দশক ধরে শত শত মানুষ মারা গেছে এবং আহত হয়েছে। হিংসার বর্তমান অবস্থা সাম্প্রতিক দশকগুলির মধ্যে সবচেয়ে খারাপ।
বর্তমানে অহিংস সহ ৩৪টি গোষ্ঠী ভারতের কাছ থেকে স্বাধীনতা দাবি করে আন্দোলন করছে। ১৯৯৯ সালে, এই দলগুলির মধ্যে কয়েকটি মিলে মণিপুর পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট নামে একটি জোট গঠন করে । এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তিনটি হলো ইউনাইটেড ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (UNLF), পিপলস রেভেলিউশনারি পার্টি অফ কাংলেইপাক (PREPAC) এবং পিপল’স লিবারেশন আর্মি অফ মণিপুর (PLAM)। UNLF-এর ২,৫০০ সক্রিয় সদস্য রয়েছে বলে অনুমান করা হয়, PREPAK সক্রিয় সদস্য ১,৫০০ এবং PLAM-র সক্রিয় সদস্য সংখ্যা ৩,০০০।
মণিপুরে তিনটি প্রধান জাতিগত গোষ্ঠী আছে মেইতেই, নাগা এবং কুকি। এদের প্রত্যেকের একটা আলাদা বিদ্রোহী গোষ্ঠী আছে। মেইতেই বিদ্রোহীদের প্রধান লক্ষ্য তাদের প্রাক্-ব্রিটিশ আঞ্চলিক সীমানাকে ‘ভারতীয় দখল’ থেকে মুক্ত করা। মণিপুরের নাগা বিদ্রোহীরা নাগাল্যান্ডের পাশাপাশি মণিপুর, আসাম, অরুণাচল প্রদেশ এবং বার্মা (মায়ানমার) এর নাগা সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলির সমন্বয়ে সার্বভৌম ‘নাগালিম’ (বৃহত্তর নাগাল্যান্ড) এর দাবিকে সমর্থন করে। অন্যদিকে কুকিরা পৃথক ‘কুকিল্যান্ডে’র দাবিকে সমর্থন করে যার জন্য বার্মার কুকিরাও লড়াই করছে।
দেশের ‘অশান্ত অঞ্চল’ হিসাবে চিহ্নিত অঞ্চলে সশস্ত্র বাহিনীকে বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করার অধিকার দিয়ে দেশের সংসদে ১৯৫৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা) আইন, ১৯৫৮ পাশ করা হয়। আইনটি সশস্ত্র বাহিনীকে সীমাহীন ক্ষমতা দেয়, যার মধ্যে রয়েছে আইনি পদক্ষেপ থেকে অনাক্রম্যতা এবং ওয়ারেন্ট ছাড়াই মানুষকে গ্রেফতার ও হত্যা করার জন্য গুলি করার লাইসেন্স। ১৯৮০ সালে ভারত সরকার মণিপুরকে একটি অশান্ত অঞ্চল হিসাবে ঘোষণা করে এই আইনটি সেখানে কার্যকর করে। ২০১৪ সালে রাজ্যের সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে এই আইন প্রত্যাহার করা হয়েছিল, কিন্তু এখনও রাজ্যের অন্য সব জায়গায় কার্যকর রয়েছে। এই আইনের যথেচ্ছ অপব্যবহারের বিরুদ্ধে মণিপুরেও দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন চলছে। আসাম রাইফেলসের আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা থাংজাম মনোরমা দেবী নামে এক মণিপুরি মহিলাকে ধর্ষণের ঘটনায় ‘মীরা পাইবিস’ নামক মহিলা সংগঠনের নেতৃত্বে মণিপুরের মহিলারা নগ্ন হয় প্রতিবাদ সংগঠিত করেছিলেন। যা সারা দেশ সহ পৃথিবীর মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ইরম চানু শর্মিলা এই আইনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১৬ বছর অনশন প্রতিবাদ চালিয়ে গেছেন। বিজেপি বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই আইনকে তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু শাসনক্ষমতা দখল করার পর তার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। বরং এই আইনকে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে থাকে।
১৯৯১ সাল থেকে মেইতেইরা অন্যান্য অনগ্রসর জাতির অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে আদিবাসীরা উপজাতির অন্তর্ভুক্ত। রাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ হিন্দু মেইতেই সম্প্রদায় বহু বছর ধরে তফশিলি উপজাতি হিসাবে স্বীকৃত হওয়ার জন্য প্রচার চালাচ্ছেন, যা তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সরকারি চাকরিতে বিশেষ সুবিধা দেবে।
২৭ মার্চ, ২০২৩ মণিপুর হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এম. ভি. মুরলিধরণ এক মামলার রায়ে মেইতেইদের উপজাতিভুক্ত করার জন্য রাজ্য সরকারকে কেন্দ্রের কাছে ৪ মাসের মধ্যে আবেদন করতে নির্দেশ দেন। এন বীরেন সিংয়ের বিজেপি সরকার তৎক্ষণাৎ বিধানসভায় সেই প্রস্তাব পাশের জন্য বিল আনতে সচেষ্ট হয়। যদি মেইতেই সম্প্রদায়কে তফশিলি উপজাতির মর্যাদা দেওয়া হয়, তবে অন্যান্য যারা তফশিলি উপজাতি ভুক্ত জাতিগত গোষ্ঠীগুলি (যাদের মধ্যে বেশিরভাগটাই খ্রিস্টান) চাকরি এবং অন্যান্য সুবিধার ন্যায্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে বলে আশংকিত হয়ে ওঠে।
একদল এই সংরক্ষণের পক্ষে, অপরদল সংরক্ষণের বিপক্ষে পথে নামে। ২০২৩ সালের ৩ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ ফলে পার্বত্য অঞ্চলের নাগা এবং কুকি সম্প্রদায়ের মানুষদের মনে বিজেপি সরকার এবং তার পাশাপাশি মেইতেই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ তৈরী করে। সংরক্ষণ প্রদানের প্রতিবাদে অল ট্রাইবাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন মণিপুর (ATSUM) কর্তৃক ডাকা ‘উপজাতীয় সংহতি পদযাত্রা’ চলাকালীন চুড়াচাঁদপুর জেলায় অ-উপজাতীয় মেইতেই এবং উপজাতি কুকি জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতিগত সংঘর্ষ শুরু হয়। কমপক্ষে ৬০ জন নিহত, কমপক্ষে ২৩০ জন আহত এবং প্রায় ৯০০০ জন ঘরছাড়া হয়।
এই ঘটনা শুধুমাত্র এই একটি ঘটনার বহিঃপ্রকাশ - এমনটা না। বহু দিন ধরে চলে আসা কর্মহীনতা, অর্থনৈতিক বঞ্চনা, রাষ্ট্রের অত্যাচার এবং তার সাথে চলা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (বিজেপি সরকার বিভিন্নভাবে আইনকে কাজে লাগিয়ে একে আরও সুদৃঢ় করে তুলেছে) মণিপুরের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষকে একে ওপরের বিরুদ্ধে সন্দেহপ্রবণ করে তুলেছে।
মণিপুর বিধানসভার ৬০টি আসনের মধ্যে ৪০টি আসনই মেইতেই সংখ্যাধিক্য। তাই সঙ্কীর্ণ ভোট কৌশল থেকেই পরোক্ষে বিধানসভার ভোটের আগে বিজেপি মেইতেইদের দাবিতে ইন্ধন জুগিয়েছে। বিজেপি সরকারের এই ভূমিকায় রাজ্যের মানুষ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে।
মণিপুরের কুকিদের দীর্ঘ সময় ধরে জ্বলন্ত অন্তর্নিহিত রাগ কেবল রাজ্যের পার্বত্য অঞ্চলে সংরক্ষিত এবং সংরক্ষিত বনের উপর সরকারের দমন-পীড়নের সাথেই যুক্ত নয়, এদের নির্যাতিত হওয়াও এর সাথে যুক্ত। মায়ানমারের সীমান্তের ওপার থেকে একই জাতিগোষ্ঠীর (একটা বড়ো অংশ আত্মীয়) বেশ কয়েকজন মানুষ হিংসা ও নিপীড়ন থেকে পালিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে এবং এই তথাকথিত অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে সরকারের অনমনীয় অবস্থান কুকিদের ক্ষুব্ধ করে।
২০১৭ সালে মণিপুর জয়ের লক্ষ্যকে সামনে রেখে মণিপুরের বিভিন্ন কুকি-জোমি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে বিজেপি মধ্যস্থতা শুরু করে। নির্বাচনের পর দল ভাঙানোর মাধ্যমে বিজেপি সরকার গঠিত হলে কেন্দ্র-রাজ্য ও গোষ্ঠীগুলির মধ্যে ত্রিপাক্ষিক শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এবছর ১০ মার্চ বিধানসভায় রাজ্য সরকার এই চুক্তি প্রত্যাহার করে নেয়। এই ঘটনায় কুকি সম্প্রদায়ের ক্ষোভ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।
সরকারে আসার পর থেকেই বিজেপি প্রচার চালিয়েছে যে, মণিপুরের ইতিহাসে মণিপুরের অতীতকে সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি। এখানে ক্রিস্টিয়ান মিশনারিরা তাদের মতো করে ইতিহাসকে রচনা করেছেন। তাই এর বদল দরকার। ২০২২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর, মণিপুর সরকার মণিপুরের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ভূগোল সম্পর্কে লিখিত বইয়ের যথার্থতা যাচাই করার জন্য ১৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে, যাতে তথাকথিত তথ্যবিকৃতি এড়ানো যায়। উল্লিখিত বিষয়গুলির প্রতিটি লেখককে তাদের পাণ্ডুলিপিগুলি (প্রকাশের আগে) যাচাই ও অনুমোদনের জন্য উচ্চশিক্ষা পরিচালক এবং মণিপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জমা দিতে হবে, তা না হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যা প্রধানত উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে তাদের অতীতের ইতিহাসকে বদলে দেওয়ার ভয়কে গড়ে তুলেছে। তারা সন্দিহান হয়ে উঠেছে।
এ বছরের মার্চ মাসের শেষের দিকে চুড়াচাঁদপুর জেলার চুড়াচাঁদপুর-খুপুম সংরক্ষিত বনাঞ্চলে আকস্মিক রাজস্ব ও বন দপ্তর জরিপের কাজ শুরু করে। সরকার ঘোষণা করে একাজে স্যাটেলাইট ম্যাপিং ব্যবহার করা হবে। এর প্রায় সাথে সাথেই ওই বনাঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ৬৯টি গ্রামকে প্রস্তাবিত সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে বাদ দেওয়ার জন্য আদেশনামা জারি হয়। যা পার্বত্য উপজাতিদের মনে ভয়ের উদ্রেক করে। রাজ্যের বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন যে, যে বা যারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে, তারা সাংবিধানিক বিধানের বিরুদ্ধে বলে চিহ্নিত হবেন (বলা যায় দেশদ্রোহী হিসাবে চিহ্নিত হবেন)। ২০২৩ সালের ১১ এপ্রিল ল্যাঙ্গোল সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অভ্যন্তরে ৩২ টি বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়। ২০২৩ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি, চুড়াচাঁদপুরের কে সংজং গ্রামের বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করা হয়েছিল। কারণ হিসাবে বলা হয়েছে যে,গুগল ম্যাপের ছবিতে নাকি দেখা গেছে যে, ২০২০ সালে এই অঞ্চলে কোনো বসতি ছিল না। এর আগে ২০২২ সালের নভেম্বরে বন বিভাগ চুড়াচাঁদপুর ও নোনি জেলার ৩৮টি গ্রামের স্বীকৃতি বাতিল করে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলা হয় যে, চুড়াচাঁদপুর-খুপুম সংরক্ষিত বনের এই গ্রামগুলিকে স্বীকৃতি এমন একজন কর্মকর্তা দিয়েছিলেন যিনি এটি করার যোগ্য নন। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারও রাজ্যের এই পদক্ষেপকে সমর্থন করে। কুকিদের দাবি অনুযায়ী ১০০০-র বেশি জনসংখ্যার এই ৩৮টি গ্রাম গত ৫০-৬০ বছর ধরেই আছে।
১১ এপ্রিল ২০২৩ মঙ্গলবার ভোরে আদিবাসী কলোনিতে ৩টি গির্জাকে বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তা কর্মীর উপস্থিতিতে ভেঙে ফেলা হয় এই কারণ দেখিয়ে যে, গির্জাগুলি অবৈধ, এগুলি সরকারি জমি দখল করে বেআইনিভাবে নির্মিত। একটি স্থানীয় সংগঠন মণিপুর হাইকোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার পরে বিষয়টি আদালতে পৌঁছেছিল। প্রায় ৫০ বছর আগে গির্জাগুলি তৈরি হয়েছিল। ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বর সরকারি উচ্ছেদের নোটিশ দেওয়া হয় এবং হাইকোর্ট প্রায় ৩ বছর ধরে স্থিতাবস্থা রক্ষা করে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে হাইকোর্ট স্থিতাবস্থা তুলে নেয় এবং সরকার তৎক্ষণাৎ গির্জাগুলিকে ভেঙে দেয়।
২০২৩ এর ২ মে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেন যে, মণিপুর মায়ানমার থেকে আসা বিপুল পরিমাণ অবৈধ অভিবাসনের হুমকির মুখে রয়েছে। এটা তথ্য হিসাবে সঠিক। মায়ানমারের সামরিক শাসনের কারণে সেদেশের বেশ কিছু নাগরিক এদেশে প্রবেশ করছে। কিন্তু একে অর্থনৈতিক সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত না করে একে সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যায় মুড়ে তিনি বলেন যে, এই অবৈধ অভিবাসন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সৃষ্টি করবে। যা হিন্দু মেইতেই জনগোষ্ঠীর মানুষদের মনে নাগা এবং কুকি সম্প্রদায়ের মানুষদের সম্পর্কে সন্দেহ এবং ঘৃণার সঞ্চার করে।
মণিপুরে বিজেপি নেতৃত্বধীন সরকারের শাসনকালে অনুন্নয়ন, বেকার বৃদ্ধির পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ এবং রাজনৈতিক মেরুকরণের নির্দিষ্ট লক্ষ্যেই ৫৩ শতাংশ হিন্দু মেইতেই জনগোষ্ঠীর ভোটকে নিজেদের পক্ষে আনতে কেবলমাত্র মেইতেই অধ্যুষিত সমতলে উন্নয়নের কাজ পরিচালিত করেছেন।
আরএসএস-এর নেতৃত্বে তাদের শারীরিক বাহিনী, মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে মণিপুরের মানুষের কাছে এই মিথ্যা প্রচারকে নিবিড়ভাবে প্রচার করেছে যে, মণিপুরকে খ্রিস্টান রাজ্যে পরিণত করার চক্রান্ত চলছে মিশনারিদের নেতৃত্বে। তাই হিন্দু মেইতেইদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করার লক্ষ্যে অবিলম্বে ঐক্যবদ্ধ হাওয়া এবং প্রয়োজনে অস্ত্রের ব্যবহার করার প্রস্তুতি নেওয়া অতি প্রয়োজন। (সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ধরনের অসংখ্য ভিডিয়ো পাওয়া যাচ্ছে) এই উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রচার একদিকে যেমন মেইতেই জনগোষ্ঠীকে একদিকে নিয়ে যাচ্ছে।পাশাপাশি মনে অনুন্নয়নের ক্ষোভ, হিন্দুত্ববাদীদের উগ্র প্রচারকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আদিবাসী মানুষকে সঙ্গবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। আড়াআড়ি ভাগ হওয়ার পথে আজ মণিপুরের সমাজ।
আসামেও একই রকম বিভাজনের উদ্দেশ্যে তাদের পদ্ধতিকে প্রয়োগ করে চলেছে বিজেপি।
আমাদের রাজ্যের উত্তরবঙ্গে বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, সাংসদ এবং বিধায়করা জোর দিয়ে বলে চলেছেন যে পৃথক উত্তরবঙ্গ রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের দাবি খুবই যুক্তিসঙ্গত। বিজেপি’র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বক্তব্যেও বিপজ্জনক ইঙ্গিত রয়েছে। বিজেপির প্রধান নিয়ন্ত্রক আরএসএস’র পৃথক উত্তরবঙ্গকেন্দ্রিক রাজ্য কমিটি গঠন আসলে তাদের একটি পৃথক উত্তরবঙ্গ রাজ্য গঠনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।বিজেপি দেশে একটি একক ব্যবস্থা চায় যেখানে রাজ্যগুলি ছোটো এবং আর্থিক ও প্রশাসনিকভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভরশীল হবে। বিশেষ করে দেশের সীমান্ত এলাকায় বিজেপি সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসন চায়। উত্তরবঙ্গের ভৌগোলিক অবস্থান এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, ছোটো রাজ্য গঠনের সমর্থনকারী বিজেপি নীতি রাজ্যের বিভাজনের লক্ষ্যে প্রচারকারী উপাদান হিসাবে কাজ করে। এখানেই বিপদ।
সিএএ এবং এনআরসি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রচার এবং এর প্রভাব এবং আসাম সহ উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বিভিন্ন ঘটনা উত্তরবঙ্গের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। এর সুযোগ নিয়ে উত্তরবঙ্গেও রাজনৈতিক লক্ষ্যকে পূরণের জন্য ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে চলেছে বিজেপি-কে সামনে রেখে আরএসএস।
বামপন্থীদের এ বিষয়ে সর্বদা সজাগ থেকে এর বিরুদ্ধে জনগণের জীবিকার প্রশ্নে শ্রেণী আন্দোলন এবং গণআন্দোলন গড়ে তোলাকে বামপন্থীদের অগ্রাধিকার, উত্তরবঙ্গের বর্তমান রাজনীতিতে এই বিভাজনের প্রবণতাগুলি সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। বিজেপির গোপন অ্যাজেন্ডাকে প্রতিষ্ঠিত করতে উত্তরবঙ্গের কিছু বুদ্ধিজীবী দ্বারা পরিচালিত “পোস্ট-ট্রুথ” ভিত্তিক প্রচার এবং জনবিরোধী, দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি’র মধ্যে দ্বন্দ্বকে মানুষের সামনে উন্মুক্ত করে বামপন্থীদের প্রাথমিক কাজ। এ কথাকে প্রতিষ্ঠিত করাই বর্তমানে আমাদের লক্ষ্য, যে বিভাজন কখনও মানুষের সমস্যা বা অভিযোগ সমাধানের উপায় নয়। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই আসল পথ।