৬০ বর্ষ ৪১ সংখ্যা / ২৬ মে, ২০২৩ / ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
ঐক্য ও সংগ্রাম - সর্বহারা শ্রেণির জয়ের পথ
দীপক দাশগুপ্ত
৩০শে মে - আজ থেকে ৫৩ বছর আগে সেন্টার অফ ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নস-এর প্রতিষ্ঠা হয়। স্বাধীনোত্তরকালে কংগ্রেসের পরিচালনায় বৃহৎ বুর্জোয়া শ্রেণির নেতৃত্বে বুর্জোয়া ভূস্বামী শ্রেণির রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ সময়ে উপরোক্ত শাসক ও শোষকশ্রেণিগুলি সমগ্র শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষের ওপর শোষণের স্টিম রোলার চালিয়েছিল।
এই শোষণ প্রতিহত করার জন্য প্রয়োজন ছিল শ্রমিকশ্রেণি ও সাধারণ মানুষের তীব্র ও ব্যাপক সংগ্রাম। কিন্তু এক্ষেত্রে শ্রমিকশ্রেণিকে টেনে নিয়ে আসার জন্য যা করণীয় ছিল আমাদের দেশে বড়ো ট্রেড ইউনিয়নগুলির পক্ষ থেকে তা করা হচ্ছিল না। নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের (এআইটিইউসি) নেতৃত্বের একাংশের শ্রেণি সংগ্রামের পথ বর্জন করে শ্রেণি সহযোগিতার রাস্তায় এগিয়ে চলা; এটা আরও স্পষ্টভাবে দেখা যায় ১৯৫৭ সালে এর্নাকুলাম সম্মেলনে এস এ ডাঙ্গের নেতৃত্বে Two pillar policy-র প্রয়োগের জন্য তদ্বির থেকে। এ লাইনই ছিল নেহরু সরকারের সঙ্গে শ্রেণি সহযোগিতার লাইন। এরকম আরও অনেক ক্ষেত্রেই শ্রেণি সহযোগিতার পথে এস এ ডাঙ্গে এবং তার সহযোগীরা এগিয়ে যাচ্ছিলেন।
শ্রেণিসংগ্রামের লাইনকে বর্জন করে শ্রেণি সহযোগিতার এই লাইনে নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছিল। শ্রেণি সহযোগিতার লাইনের বিরুদ্ধেই শ্রেণি সংগ্রামে বিশ্বাসী শ্রমিকরা ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন এবং তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৭০ সালে এপ্রিল মাসে গোয়াতে আলাদাভাবে ট্রেড ইউনিয়ন কনভেনশন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল যে শ্রেণি সংগ্রামে বিশ্বাসী নতুন ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার। সেই অনুসারে ২৭-৩০ মে ১৯৭০-এ কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন সম্মেলন - গঠিত হয় সিআইটিইউ।
শ্রেণিসংগ্রাম বাড়াও
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ১৯২০ সালে এদেশের জাতীয় আন্দোলনের বুর্জোয়া নেতৃত্ব গড়ে তুলেছিলেন এআইটিইউসি। প্রথম থেকেই এআইটিইউসি-র মধ্যে শ্রেণিসংগ্রাম ও শ্রেণি সহযোগিতার লাইনের মধ্যে সঙ্ঘাত চলতে থাকে। শ্রেণি সংগ্রাম ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম গড়ে তোলার প্রশ্নে বার বার এআইটিইউসি-র মধ্যে বিরোধ ও বিভাজন দেখা দেয়।
স্বাধীনতার প্রাপ্তির ঠিক প্রাক্কালে এআইটিইউসি-র মধ্যেকার কংগ্রেস অনুগামীদের বের করে নিয়ে আলাদা ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করলেন জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে। ১৯৪৬ সালে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা সম্মেলন করে কংগ্রেস অনুগামীরা গঠন করলেন আইএনটিইউসি (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস)। এই সংগঠন মূলত শাসকদল এবং বুর্জোয়া মালিকদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য কাজ করেছে। বর্তমানে মোদি সরকারের শাসনের সময়ে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সিআইটিইউ এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি বিজেপি এবং আরএসএস-এর শ্রমিক বিরোধী ও দেশবিরোধী নীতিগুলির বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে গণসংগ্রামের সাথে যুক্ত থাকছে ও কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এবং শিল্পভিত্তিক ফেডারেশনগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে মোদি সরকারের দেশ ও দেশের সম্পদ বিক্রির ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করতে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
শ্রেণি ঐক্য ও শ্রেণিসংগ্রাম
১৯৭০ সালের সর্বভারতীয় সম্মেলন থেকে গৃহীত ঐক্য এবং সংগ্রামের লাইনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সিআইটিইউ সারা দেশে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে মোদির নেতৃত্বে দেশে যে দেশবিরোধী এবং জনবিরোধী সর্বনাশা নীতিগুলিকে প্রয়োগ করছে স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী কায়দায়, তার বিরুদ্ধে ঐক্য এবং সংগ্রামের প্রতীক সিআইটিইউ নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন গড়ে তুলছে। মোদি সরকার দেশের করপোরেটকে বিশেষকরে আদানি-আম্বানী প্রমুখ করপোরেট ও বৃহৎ পুঁজিকে মুনাফার পাহাড় সৃষ্টি করতে সাহায্য করছে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে মোদি ও বিজেপি পার্টির পক্ষ থেকে জনগণের উদ্দেশে প্রদত্ত সস্তা প্রতিশ্রুতিগুলি ধাপ্পায় পরিণত হয়েছে।
মোদী বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় এলে দেশ থেকে বেকারি এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ করবেন, বিগত ৮ বছরে হয়েছে তার বিপরীত, যেমন মোদির বিগত ৮ বছরের শাসনে গরিব মানুষের গরিবি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। শতকরা ৫৩ শতাংশ গরিব আরও গরিব হয়েছে। অপরদিকে ধনী আরও ধনী হয়েছে; বৃহৎ পুঁজি ও করপোরেট রোজগার বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৯ শতাংশ। ৮ বছরে মোদির শাসনে বৃহৎ আকারে বেকারি বৃদ্ধি পেয়েছে, বেকারির রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি যা গত ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ। বিশ্বের বড়ো বড়ো ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ায় ভারতের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গড়ে প্রতিদিন কর্মচ্যুতি ঘটেছে ৩৩০০। ২০২৩-এর সূচনাতে কর্মী ছাঁটাই করেছে অ্যামাজন, মাইক্রোসফট, গুগল প্রভৃতি বড়ো বড়ো কোম্পানিগুলি। মোদীর ৮ বছর শাসনে লোপাট হয়েছে ১২ লক্ষ কোটি টাকা। কর্মী ছাঁটাই বিপুল সংখ্যায় হয়েছে। কোভিড ১৯-এর আক্রমণ ও লকডাউনের ফলশ্রুতিতে বহু ছোটো ব্যবসায় লাল বাতি জ্বলেছে। ঐ সমস্ত সংস্থায় কর্মরত লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। এর বিরুদ্ধেও শ্রমিকদের ছোটো বড়ো সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছে।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর রিপোর্টের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে, বিগত ৩ বছরে গোটা দেশে ১ লক্ষ ১২ হাজার মজুর অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যা করেছে। ৮৪ লক্ষ জব কার্ড বাতিল হয়েছে। মোদি সরকার ও শিল্প মালিকদের নীতি ও কাজকে পরাস্ত করতে রাজ্য ও দেশব্যাপী কারখানা ও শিল্পভিত্তিক সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছে; এর দ্বারা শ্রেণি সংগ্রামের ভিত্তির প্রসার ঘটছে ও শ্রেণি ঐক্য জোরদার হচ্ছে।
বিজেপি এবং মমতার সহযোগিতা বিজেপি এবং আরএসএস-র জনবিরোধী এবং দেশবিরোধী প্রতিটি কর্মসূচি এরাজ্যে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন তৃণমূল সরকার কার্যকর করতে অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছে। বলা বাহুল্য মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস ও সরকার আর এস এস'র দ্বারা গঠিত ও মদতপুষ্ট এক চরম প্রতিক্রীয়াশীল শক্তি।
সিআইটিইউ ও অন্যান্য বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন ও গণসংগঠনগুলির পক্ষ থেকে সংগঠিত প্রতিরোধ সংগ্রাম দমন করতে মমতা ব্যানার্জির সরকার মোদি সরকারের অত্যন্ত আস্থাভাজন হিসাবে ভূমিকা পালন করছেন। দেখা যাচ্ছে, মোদীর দেশবিরোধী নীতিগুলির বিরুদ্ধে আহুত ধর্মঘট ও আন্দোলন ভাঙতে মমতা ব্যানার্জির সরকার নিষ্ঠুর ও হিংস্রভাবে কাজ করে চলেছে। ফলে দেশরক্ষার জন্য সিআইটিইউ এবং বামপন্থীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী কর্মী ও নেতাদের অনেককেই মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হচ্ছে বা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হচ্ছে।
নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সিআইটিইউ এবং বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলি আন্দোলনের বিকাশ ঘটাচ্ছে। এর মূল কারণ আমাদের ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীরা শ্রমিকদের প্রতিরোধ-সংগ্রামে টেনে আনতে অত্যন্ত সাহসী ও সময়োপযোগী ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
সাম্প্রদায়িকতা, জাতপাত ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রাম বৃদ্ধি করো
ভারতের সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের শতবর্ষ হয়েছে ২০২০ সালে। অপরপক্ষে চরম দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিস্ত শক্তি আরএসএস’র জন্ম ১৯২৫ সালে। যেটি আগামী বছরে ১০০ বছর পূরণ করবে। এই আরএসএস জন্মলগ্ন থেকেই দেশে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প ছড়িয়ে দিচ্ছে। এবং আরএসএস জন্মলগ্ন থেকেই ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে সচেষ্ট। সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের উত্তরাধিকারী সিআইটিইউ এবং কমিউনিস্ট আন্দোলন দেশকে শোষণমুক্ত, সুখী, সমাজতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধশালী ভারত হিসাবে গড়ে তুলতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শ্রমিকশ্রেণির আদর্শ দেশকে উন্নত, আধুনিক, প্রগতিশীল ও শোষণমুক্ত দেশে পরিণত করতে সচেষ্ট হয়েছে। আরএসএস-বিজেপি দেশকে মধ্যযুগীয় পশ্চাদপদতায় ডুবিয়ে মারতে চায়। এরা দেশের করপোরেট ও পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষার্থে কাজ করে চলেছে।
দেশরক্ষা ও ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে শ্রমিক শ্রেণিকে অনেক বেশি সচেতন করার প্রয়োজন, একাজ সিআইটিইউ-কে করতে হবে নিরবচ্ছিন্ন ও আন্তরিকভাবে। তাই সিআইটিইউ বিগত ৫৩ বছরে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে ও শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হচ্ছে। আগামীদিনে ঐক্য ও সংগ্রামের রণনীতি ও রণকৌশলের লাইনে প্রতিটি শ্রমিককে নিয়ে আসতে, হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সমগ্র শ্রমিকশ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করে আমাদের দেশে শ্রেণিসংগ্রামকে গড়ে তোলা ও দেশরক্ষার কাজ চালাতে হবে। একইসঙ্গে সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখতে সিআইটিইউ-কে উদ্যোগ নিতে হবে।
৫৩ বছরে সিআইটিইউ'র অনুসৃত পথ আরও জোরালভাবে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ইতিহাস আমাদের দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দায়িত্ব দিয়েছে। এরকম গুরুত্বপূর্ণ কাজে শ্রমিকশ্রেণিকে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করতে হবে। নেতৃত্বদানকারী শ্রমিকশ্রেণিকে নেতৃত্ব দেওয়ার উপযোগী করে গড়ে তোলা অনিবার্যভাবে সিআইটিইউ-র একটি গুরুপূর্ণ কাজ।
৫৩তম বৎসর উদযাপনকালে শ্রেণি হিসাবে শ্রমিকশ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করার ইতিহাস নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে আমরা দায়বদ্ধ ও দৃঢ়বদ্ধ থাকব। এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। এপথেই সর্বহারা শ্রেণির জয়লাভ সম্ভব।