৬০ বর্ষ ৪১ সংখ্যা / ২৬ মে, ২০২৩ / ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ, পশ্চিমবঙ্গ
৮১-তে পা
হিরণ্ময় ঘোষাল
প্রতিটি প্রতিষ্ঠা দিবসই ফেলে আসা পথে আলো ফেলে ফিরে দেখা, সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমানকে বুঝে নেওয়া আর ঐতিহ্যের আলোকবর্তিকাকে ভবিষ্যতের লক্ষ্যে প্রসারিত করার শপথ গ্রহণের দিন।
১৯৪৩-র ২৫মে বোম্বাই শহরে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রতিষ্ঠা হয়। ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আন্দোলন তখন শ্রমিক-কৃষকদের আন্দোলনে নতুন মাত্রা পেয়েছে। কিন্তু গণনাট্য শুধু স্বাদেশিকতার পুনরুজ্জীবন নয়, গভীর দেশপ্রেমের সঙ্গে ফ্যাসিজমকে রুখবার দুর্জয় সংকল্পও গ্রহণ করেছিল। বিশ্বজুড়ে তীব্র ঔপনিবেশিকতা বিরোধী আন্দোলন, ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে তখন প্রোজ্জ্বল বিশ্বমানবতার মুখ। সেই অভিঘাতে এদেশে গড়ে ওঠা নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ, ফ্যাসি বিরোধী লেখকশিল্পী সংঘে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মুলকরাজ আনন্দ, মুন্সি প্রেমচাঁদ, সাজ্জাদ জহির, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সহ আরও অনেক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। সেই গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যেরই উওরাধিকার বহন করছে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ। ‘‘Peoples' theatre stars the people’’ - রমাঁ রলাঁ-র এই ঘোষণাকে পাথেয় করে শুরুতেই গণনাট্যের লক্ষ্য ও পক্ষপাত নির্ধারিত হয়ে গেছে। তাই জন্মলগ্নেই, বিশেষত বাংলায়, নিদারুণ দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মোকাবিলা আর তেভাগা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন গণনাট্যের শিল্পীরা তাদের গান নাটক নিয়ে।
স্বাধীনতা এলো। কিন্তু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নেমে এলো রাষ্ট্রীয় আক্রমণ। আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও কাজ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ল। ১৮৭৬-র নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইনকে কাজে লাগিয়ে পুলিশের কাছে অনুমোদন নেবার জন্য যে সমস্ত নাটকের স্ক্রিপ্ট জমা দেবার নির্দেশ আসে সেই তালিকায় ছিল দীনবন্ধু মিত্র-র ‘নীলদর্পণ’, শরৎ চন্দ্রের ‘মহেশ’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চার অধ্যায়’ এবং ‘গোরা’ও। অন্যদিকে সরকারি আনুকূল্যে অনেক প্রতিভাবান শিল্পী নানান একাডেমির সদস্য হয়ে শিল্পকলার চর্চায় মনোনিবেশ করেন এবং অবশ্যই তা গণনাট্য সংঘের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার শর্তে। আবার গণনাট্য সংঘের বিশিষ্ট নেতা চারু প্রকাশ ঘোষের ডিকসন লেনের বাড়িতে একটি অনুষ্ঠানে স্টেনগানের গুলিতে খুন হয়ে যান সংঘের দুই শিল্পী সুশীল মুখার্জি ও ভবমাধব ঘোষ। নতুন এক তত্ত্ব সামনে চলে আসে ‘যা কিছু প্রতিক্রিয়াশীল নয় তাই প্রগতিশীল’। ভারত সরকার ও মিউজিক ইন্ডাষ্ট্রি উৎসাহিত করে এই সব বিপথগামী প্রবণতাকে। লক্ষ্যভ্রষ্ট এবং দিশাহীনতার চূড়ান্ত পরিণতিতে গণনাট্য সংঘের সর্বভারতীয় সংগঠনটি ভেঙে পড়ে।
১৯৬৭-তে বাগবাজার রিডিং রুম লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত তৃতীয় রাজ্য সম্মেলনে নতুন ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে পুনর্গঠিত হয় ভারতীয় গণনাট্য সংঘ, পশ্চিমবঙ্গ। এই সংগঠনটি আজও লক্ষ্য ও মতাদর্শে অবিচল এবং ক্রিয়াশীল; মানুষের সুখ-দুঃখ-ব্যথা-বেদনার পাশে এবং শ্রমজীবী মানুষের প্রতিটি আন্দোলনের ময়দানে তাদের সুস্পষ্ট উপস্থিতি।
পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ অতিক্রম করেছে গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস ও জরুরি অবস্থার ভয়ংকর দিনগুলি। আক্রান্ত হয়েছে, তবু গান থামেনি। নানা কৌশলে শিল্প সম্ভার নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছবার প্রচেষ্টা জারি রেখেছে। সৃষ্টি করেছে প্রচুর গান, নাটক। সব ক্ষেত্রে সব প্রযোজনাই মানোত্তীর্ণ হয়েছে এ কথা বলা যাবে না, কিন্তু প্রতিকূল পরিস্হিতিতে লক্ষ্য ও আদর্শে অবিচল থাকা, সামান্য সুযোগকে ব্যবহার করেই শিল্প প্রযোজনাকে নানা কৌশলে মানুষের সামনে তুলে ধরার প্রচেষ্টাকে জারি রাখার কৃতিত্ব তাদের দিতেই হবে।
১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পর স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ ঘটে। জনদরদি সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সাক্ষরতার আন্দোলন, বিজ্ঞান আন্দোলন ও অনান্য নানাক্ষেত্রে নানা বিষয় গণনাট্যের সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বহু শিল্পী ও দলকে সাদর আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই তাঁদের সসম্মানে জায়গা ছেড়ে দেবার মতো ঔদার্য দেখিয়েছে গণনাট্য সংঘ ‘অনেক নতুন বন্ধু হোক’ এই বার্তাকে সামনে রেখে।
২০১১ সালে বামফ্রন্ট সরকারের পরাজয়ের পর পশ্চিমবঙ্গের আকাশে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। রাজ্য জুড়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসের মূল লক্ষ্য বামশক্তিকে নির্মূল করা। স্বাভাবিকভাবেই গণনাট্য সংঘকেও তারা রেয়াত করেনি। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল গণনাট্য সংঘ, কিন্তু কোনো শিল্পীসদস্যকেই আদর্শচ্যুত করতে পারেনি।
গণনাট্য সংঘের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে ঢোঁক গিলে স্বীকার করলেও গণনাট্যের বর্তমানকে সচেতনভাবে অস্বীকার করার একটা পরিকল্পিত প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যাঁরা গণনাট্যকে খুঁজেই পান না তাঁদের উদ্দেশে সবিনয়ে জানাতে চাই - গণনাট্য আছে গণনাট্যেই। গণনাট্য আছে বাজারি প্রচারের আলোর বাইরে গ্রামে গঞ্জে শহরতলিতে শ্রমজীবী মানুষের নিবিড় সান্নিধ্যে, তাদের শিল্প হাতিয়ার নিয়ে। এই বছর রাজ্য জুড়ে সংঘের ৮১তম প্রতিষ্ঠা দিবস উদ্যাপন করছে ১৯৯টি শাখার ৩৩৭১ জন দায়বদ্ধ সদস্য। এই মুহূর্তে ভীত সন্তস্ত্র মানুষ রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদে সোচ্চার। প্রশাসনিক সমস্ত বাধাকে উড়িয়ে দিয়ে গণ-আন্দোলন ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে গণনাট্য কর্মীরাও পূর্ণ উদ্যমে ময়দানে হাজির তাদের সৃষ্টি নিয়ে।
বর্তমানে এই বাজার অথনীতির যুগে বাজারই মানুষের পছন্দ রুচি এমনকী চাহিদাও নির্মাণ করে। বিশ্বজুড়ে লোভের পসরা সাজিয়ে মানুষকে বিশ্বায়নের ছাঁচে-ঢালা খরিদ্দার হিসাবেই তারা দেখতে চায়। তারা কিনে নিতে চায় মানুষের মন, চিন্তা, বোধ - এককথায় সংস্কৃতি। প্রত্যেক দেশের, প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। তারা সেগুলিকে সংগ্রহ করে বিশ্বায়নের শিলে বেটে সংস্কৃতির এমন মণ্ড বানিয়ে ফেলে যাতে সারা পৃথিবীর কোমর একই ছন্দে দুলতে পারে। শিল্পে আধুনিকীকরণের নামে তারা স্বাভাবিক রূপ-রস-গন্ধকে বিকৃত করে বাজারি ককটেলের সুদৃশ্য পেয়ালায় পরিবেশন করে এবং বিপুল প্রচারে তাকে জনপ্রিয় করে তুলতে চায়।
ভারতীয় গণনাট্য সংঘ, পশ্চিমবঙ্গ মনে করে, আমাদের দেশে সংস্কৃতি আন্দোলন যে ধারায় বিকশিত হয়েছে সেই ধারাতেই তার ক্রমবিকাশে আরও যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলে, বহিরঙ্গে যত জৌলুসই থাকুক, সে তার দেশীয় এবং জাতীয় চরিত্র হারিয়ে ফেলে। আমাদের দেশে গণসংস্কৃতি আন্দোলনকে মাটির সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থেকে বিষয়গত দিকে সর্বাধুনিক আন্তর্জাতিক চেতনার প্রকাশ ঘটাতে হবে, সেই সঙ্গে শিল্পমানও উন্নত ও শাণিত করতে হবে। আঙ্গিক বা উপস্থাপনাগত দিক দিয়ে আমাদের প্রযোজনাগুলি যেন আগন্তুক বলে মনে না হয়। মনে রাখতে হবে content International হলেও Form যেন National হয়। দেশীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যের পরম্পরা থেকে তা যেন বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়।