৬০ বর্ষ ৪১ সংখ্যা / ২৬ মে, ২০২৩ / ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
হাতিয়ার সাম্প্রদায়িকতা
কাজী রেজাউল করিম
এই প্রথম শুনছি রাম নবমী ও নবি দিবসের পূর্বে ১২ মাসে ১৩ পার্বণের মধ্যে এরা থাকতে পারে, তবে বাঙালির পার্বণে এরা ততটা গুরুত্ব পায়নি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং আরও মহৎ কবি সাহিত্যিক এ দেশে জন্মেছেন। নানাভাবে তাঁরা দেশবাসীকে নিত্য নূতনের ডাক দিয়েছেন, গান শুনিয়েছেন। আমরা কৃতার্থ হয়েছি। কিন্তু ওই দিবস দু’টিকে নিয়ে সম্প্রতি যে উন্মাদনা, ধর্মীয় জিগির শোনা যাচ্ছে তা পূর্বে শুনিনি। একদিন পাড়ার মোড়ে দেখলাম সারি সারি মেয়েরা পূজার থালা হাতে লাল পেড়ে শাড়ি পরে হেঁটে চলেছে। আমার অভ্যাস মতো মেয়েদের হেঁকে কথা বললাম, কোথায় চললে গো এত জাঁকজমক করে। একজন বললে, দাদু তুমি জানো না আজ যে রাম নবমী, আমি বললাম তা বেশ বেশ তাহলে তো খাওয়া দাওয়াটা বেশ ভালোই হবে। আর সুন্দর সুন্দর শাড়িগুলো কিনলে বুঝি? না দাদু এই শাড়ি হচ্ছে আমার মায়ের। একজন ঠাট্টা করে বললে, কেন তোমার মনে ধরেছে বুঝি? আমি মুচকি হাসলাম। ১৯২৬ সালের কিছু কথা মনে পড়ে, ইতিহাসে পড়েছি নজরুল তখন শ্যামবাজারে সপরিবারে বাস করছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, কলকাতার সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে স্মরণ করে নজরুল লিখেছিলেন -
‘‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি-পণ।
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বলো, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।’’
এমনকী স্বয়ং কাজী নজরুল তখন তাঁর নেমপ্লেট খুলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তারপর কবি তখন নানা সংকটে ভুগছেন তার থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য। রাজনৈতিক নেতা হেমন্ত কুমার সরকারের আহ্বানে কবি সপরিবারে চলে যান কৃষ্ণনগরে। সেখানে ছিলেন ৩ বছর (১৯২৬ থেকে ১৯২৮)। কিছু কিছু মানুষ আছেন যাঁরা খুব সহজেই সমাজটাকে গড়ার স্বপ্ন দেখেন, আবার কেউবা ভেঙে মুচড়ে সমাজের মানুষের ক্ষতি করে হাসতে হাসতে চলে যান। এখন যেটা প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে। এমনকী যাদের আমরা প্রোগ্রেসিভ বলে জানতাম তাদেরও অনেকে গোপনে গোপনে সাম্প্রদায়িকতার ঝান্ডা বহন করে চলেছেন। আমার এক বন্ধুস্থানীয়ের পাড়ায় বেড়াতে গিয়ে দেখলাম পাড়াটা রাম নবমীর পতাকায় পতাকায় ছেয়ে গেছে। আর তিনি কপালে লম্বা তিলক লাগিয়ে সং সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমি ঠাট্টা করে বললাম, তিলক কাটো আর যাই কাটো ওপারে একদিন যেতেই হবে। কিন্তু যাওয়ার সময় আগামী প্রজন্মের ক্ষতি করে দিয়ে গেলে তো? এই সময় আমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাঁশি’ কবিতার কয়েকটা লাইন মনে পড়ে গেল -
‘‘আকবর বাদশার সঙ্গে
হরিপদ কেরানির ভেদ নেই।
বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে
ছেঁড়া ছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে
এক বৈকুণ্ঠের দিকে।’’
বললাম, কী চা খাওয়াবে না চলে যাব? ওর স্ত্রী কথাটা শুনতে পেয়ে ঘরের ভিতর থেকে বললে, না না বসুন এক্ষুনি আমি চা করে আনছি। মনে মনে আশ্বস্ত হলাম, যাক সমাজটার এখনো মূল্যবোধ বেঁচে আছে। চা দিয়ে বললেন, কী এবছর মেলা হবে না, জ্যৈষ্ঠ মাস তো এসে গেল? আগাম বলবেন, মেয়েরা শ্বশুর বাড়ি থেকে মেলাতে আসার জন্য মুখিয়ে আছে। কোনদিন কী হবে একটা হ্যান্ডবিল দেবেন।
বেশ বেশ শিগগিরই জানতে পারবে। মেলা হবে বই কী, নিশ্চয়ই হবে। রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। কানের পাশ দিয়ে ভোঁ করে একটা পুলিশের গাড়ি পেরিয়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম নিশ্চয় কোথাও কিছু বাধিয়ে দিয়েছে, না হলে পুলিশের এত তৎপরতা আগে তো দেখিনি। আগে সমস্ত ঝঞ্ঝাট তো পাড়ার ছেলেরাই মিটিয়ে ফেলত। দেশের হাল শেষকালে পুলিশের হাতে চলে গেল! এখনো সময় আছে সাম্প্রদায়িক দুষ্কৃতীরা ভারতের বহু স্থানে থাবা মেলে ধরলেও সর্বত্র পারেনি - এটা কেউ একা দাবি করতে পারে না। এটার একমাত্র দাবিদার বাংলার জাগ্রত জনগণ।
কাজী নজরুল তাঁর ‘হিন্দু মুসলমান’ প্রবন্ধে চমৎকার ও সহজ ব্যাখ্যা করেছেন।
“নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে দেখি একটা লোক ডুবে মরছে। মনের চিরন্তন মানুষটি এখন এ প্রশ্ন করবার অবসর দেয় না যে মানুষটি হিন্দু না মুসলমান! এক জন মানুষ ডুবছে, এইটেই হয়ে ওঠে তার কাছে সবচেয়ে বড়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদী হোক বা পুকুর থেকে হোক, তাকে বাঁচাবার জন্য। উদ্ধার করে দেখে লোকটা হিন্দু কিংবা মুসলমান, তাতে তার আত্মপ্রসাদ এতটুকু কমে না। তার মন বলে আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি। আমার মতো একজন মানুষকে।’’
এ চিরন্তন মানবতার পরিচয়টা তুলে ধরেছেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে যা ঘটেছে বা মানবতা কীভাবে সাম্প্রদায়িকতার কঠোর জঠরে পড়ে দিনের পর দিন হারিয়ে যাচ্ছে, এর চিত্রকল্প ভারতবর্ষের ইতিহাসে বহুভাবে কবি সাহিত্যিকগণ এঁকেছেন, আমাদের সেই চেতনাকে আস্তে আস্তে খর্ব করে দেওয়া হচ্ছে। আর মূলে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। মহাভারতের ভীষ্ম অন্যায় যুদ্ধকে কোনোদিন সমর্থন করেননি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আজকের ভীষ্ম মানুষের কত বড়ো ক্ষতি হবে জেনেও অন্যায় যুদ্ধকে সমর্থন করেই চলেছেন, আমাদের পক্ষে এটাই হচ্ছে পীড়াদায়ক। তাই একদিন নজরুল যখন তাঁর গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছিলেন, সেই দিন রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘দেখ যে ন্যাজ বাইরের তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভিতরের ন্যাজকে কাটবে কে?’’ নজরুল সেই দিন গুরুদেবের পায়ের ধুলো নিয়ে বলেছিলেন, আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি।
দুঃখের বিষয় আজকের সেই ভেতরের ন্যাজটা রাষ্ট্র ক্ষমতার আশকারাতে লালন পালনে এতই বাড়বাড়ন্ত হয়েছে যে, মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা চলেছে এটাই ভারতের রাজনীতি। তাই এখন রাম নবমীর দিনে হোক কিংবা নবি দিবসে হোক দাঙ্গা ফ্যাসাদ লেগেই আছে এবং কোনো সুচিন্তিত উপশম দেখতে পারছি না, বরং সাম্প্রদায়িকতার সলতেটা উস্কে দেওয়া হচ্ছে। রবীন্দ্র-নজরুলের এর বিরুদ্ধে লড়াইটা এখনও জারি রয়েছে। সচেতন মানুষ যেভাবে এগিয়ে আসছেন, সেভাবে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে যুবক-যুবতী সহ সমস্ত স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। না হলে এই বিষাক্ত আবহাওয়া থেকে মুক্তি নেই। বাংলার-বাঙালির যে ঐতিহ্যর সুখস্মৃতি তাকে এই হিংস্র বিভেদ ভুলিয়ে দিতে চাইছে নানারকম উস্কানিমূলক স্বার্থপরতার বাতাবরণ তৈরি করে। গরিবের দেশ এই ভারত এবং তার এক কোণে হাতজোড় করে উচ্ছিষ্ট ভক্ষণের জন্য বাংলার মানুষ আর কতকাল অপেক্ষা করবে? পরিশেষে নজরুলের বাণীতেই বলি -
‘‘যে লাঠিতে আজ টুটে গুম্বুজ, পড়ে মন্দির চূড়া,
সেই লাঠি কালি প্রভাতে করিবে শত্রু দুর্গ গুঁড়া।
প্রভাতে হবে না ভায়ে ভায়ে রণ
চিনিবে শত্রু চিনিবে স্বজন।
করুক কলহ - জেগেছে তো তবু - বিজয়-কেতন উড়া।
ল্যাজে তোর যদি লেগেছে আগুন, স্বর্ণলঙ্কা পুড়া।’’
(‘হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ’)
______________________________
লেখকঃ কবি নজরুল ইসলামের ভ্রাতুষ্পুত্র।