৬০ বর্ষ ৪১ সংখ্যা / ২৬ মে, ২০২৩ / ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
কাজী নজরুল ইসলাম ও কাকাবাবু
সুপ্রতীপ রায়
নজরুল ইসলাম কবি, স্বাধীনতা সংগ্রামী, সাংবাদিক, শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কাব্যকার, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা বাহক ছিলেন। যদিও নজরুল ইসলাম সম্পর্কে চর্চার অভাব আছে। নজরুল ইসলামের প্রতিভা বিকাশে মুজফ্ফর আহ্মদের বিশাল অবদান ছিল। একটি চারাগাছকে মালি যেমন যত্ন করে, পরিচর্যা করে, নজরুল ইসলামকে সেইভাবে যত্ন পরিচর্যা করেছিলেন ‘কাকাবাবু’। বিদ্রোহী কবির সঙ্গে মুজফ্ফর আহ্মদের সম্পর্ক ছিল গভীর। মৃত্যুশয্যায় শুয়েও তিনি নজরুলের জীবনের সঠিক তথ্য লিপিবদ্ধ করার কথা ভেবেছেন। ‘কাজী নজরুল ইসলামঃ স্মৃতিকথা’র চতুর্থ সংস্করণ ছাপা হচ্ছে শুনে সেই অসুস্থতার মধ্যেও নির্ভুল তথ্যের কথা ভেবেছেন এবং যখনই কথা বলার সামান্যতম শক্তি ফিরে আসে তখনই তার সংগৃহীত তথ্য লিপিবদ্ধ করার জন্য ব্যস্ত হন।” (পৃঃ ১৩৪ - গণশক্তি - কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ জন্মশতবর্ষ সংখ্যা)
কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা-তে কাকাবাবু লিখেছেন, “১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে নজরুল আর আমি ঠিক করি যে আমরা কমিউনিষ্ট পার্টি গড়ার কাজে এগিয়ে যাব। পড়াশুনা করব বলে সামান্য কিছু পুঁথি-পুস্তকও কিনেছিলাম”। কাকাবাবুর সান্নিধ্যে থেকেই তিনি সাম্যবাদের তত্ত্ব সম্পর্কে পড়াশোনা করেছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের প্রথম পরিকল্পনায় (১৯২১) যদিও কাকাবাবুদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টিতে তিনি কোনোদিন যোগ দেননি।
১৯২০ সালে কাকাবাবুর সঙ্গে নজরুলের প্রথম সাক্ষাৎ হলেও যোগাযোগ ছিল আরও আগে থেকে। ১৯১৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই ৪৯ নম্বর বেঙ্গলি রেজিমেন্টের কয়েকজন সৈনিক ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’র গ্রাহক হয়েছিলেন। এই গ্রাহকদের মধ্যে নজরুল ইসলাম ছিলেন এবং তিনি নিয়মিত পত্রালাপ করতেন। কাকাবাবুর কথায়, “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার পরিচালনার সময় কাজী নজরুল ইসলামের সহিত পত্র লেখালেখির মারফতে আমার প্রথম পরিচয় হয়। পরে পরে নজরুলের একটি কবিতা ও দুটি ছোট গল্প আমরা কাগজে ছেপেছিলাম। সে তখন ৪৯ নং বেঙ্গলি রেজিমেন্টের কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার ছিল। ১৯২০ সালের শুরুর দিকে এই পল্টন যখন ভেঙে দেওয়া হ’ল তখন কলকাতায় এসে সাহিত্য সমিতির বাড়িতে আমার সঙ্গেই থাকতে লাগল। সাহিত্য সমিতিতে কাজ করতে গিয়ে নজরুল ইসলামকে বন্ধুরূপে পাওয়া আমার একটি বড় লাভ হয়েছিল।” (‘সমকালের কথা’,পৃঃ ২৩, মুজফ্ফর আহ্মদ)। ১৯১৯ সালের জুলাই-আগস্ট মাস সংখ্যার ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় নজরুল ইসলামের “মুক্তি” শিরোনামে একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, ৪৯ নম্বর বেঙ্গলি রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়ার কিছু দিন আগে নজরুল সাত দিনের ছুটি পেয়েছিলেন। এই সাতদিনের ছুটির সময়ই কবির সঙ্গে কাকাবাবুর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল। কাকাবাবু তাঁর থেকে বয়সে ছোটোদেরও ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। কিন্তু নজরুলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এতটাই অন্তরঙ্গ ছিল যে, কাকাবাবু নজরুলকে ‘তুমি’ বলেই ডাকতেন। ৩২, কলেজ স্ট্রিটের বাড়িতে অবস্থানকালে কবির একটি সরকারি চাকুরির ইন্টারভিউ এসেছিল। কিন্তু কাকাবাবু সহ অনেকেই নজরুলকে ওই ইন্টারভিউ দিতে দেননি তাঁর সাহিত্য কর্মের ক্ষতি হবে বলে।
করাচি সেনানিবাসে থাকার সময় ১৯১৭-তে রুশবিপ্লবের খবর পান নজরুল ইসলাম। ওই সময় রুশ বিপ্লব বিষয়ক বিভিন্ন লেখা পড়ার সুযোগও হয়েছিল। সেনা শিবিরে থাকার সময় নজরুলের আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল। ১৯১৮ সালে সেনা শিবিরে ‘ব্যথার দান’, ‘হেনা’ নামে দুটি গল্প লেখেন। ‘ব্যথার দান’ গল্পের দুই মুখ্য চরিত্র সয়ফুল ও দারা রাশিয়ার লাল ফৌজে যোগ দিচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেছিলেন। ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র পত্রিকায় এই গল্প প্রকাশিত হয়েছিল (বাংলায় ১৩২৬-র মাঘ সংখ্যাতে)। এই পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্বভার ছিল মুজফ্ফর আহ্মদের উপর। নজরুলের লেখা মূল পাণ্ডুলিপিতে যে ‘লালফৌজ’ শব্দ ছিল তা পরিবর্তন করেন কাকাবাবু। কারণ তিনি মনে করেছিলেন মুদ্রিত গল্পে ‘লালফৌজ’ শব্দটি থাকলে ব্রিটিশ সরকার দমনমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। তাই তিনি ‘লালফৌজ’র পরিবর্তে ‘মুক্তি সেবক সৈন্যদের দল’ শব্দগুলি বসিয়ে দেন। এই বদলের জন্য করাচি থেকেই নজরুল কাকাবাবুকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।
১৯২০ সালের ১২ জুলাই সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’ প্রকাশিত হয়। যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন মুজফ্ফর আহ্মদ ও নজরুল ইসলাম। মূল্য ছিল এক পয়সা। এই সময়ে অসহযোগ আন্দোলন এবং খিলাফত আন্দোলনে দেশ উত্তাল ছিল। এই পরিস্থিতিতে ‘নবযুগ’এর আত্মপ্রকাশ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ‘নবযুগ’ দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই জনপ্রিয়তার পিছনে নজরুলকেই কৃতিত্ব দিয়েছেন মুজফ্ফর আহ্মদ। ‘নবযুগ’র উপর ব্রিটিশের আক্রমণ নেমে আসে। নজরুলের লেখা ‘মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে’ প্রবন্ধটির জন্য ‘নবযুগ’ নিষিদ্ধ হয়। ১৯২০ সালের ৪-৯ সেপ্টেম্বর কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে কাকাবাবু ও নজরুল ইসলাম ‘নবযুগ’ পত্রিকার প্রতিনিধিরূপে যোগদান করেছিলেন।
কবি নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় ১৯২২ সালে ‘ধূমকেতু’ নামক একটি কাগজ প্রকাশিত হয়েছিল। ‘ধূমকেতু’ কমিউনিস্ট পার্টির কাগজ ছিল না। কাকাবাবু দ্বৈপায়ন ছদ্মনামে এ কাগজে লিখতেন ও ‘তাঁর লেখার আবেদন ছিল গণ আন্দোলনের দিকে’।
‘লাঙল’ পত্রিকায় শ্রমিক-কৃষকের কথা এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব তুলে ধরা হতো। “বাংলাদেশ হতে প্রকাশিত আমাদের দ্বিতীয় কাগজ ছিল বাংলা ভাষায় সাপ্তাহিক ‘লাঙল’। এই কাগজের নাম বদলে পরে ‘গণবাণী’ হয়েছিল। ‘গণবাণী’ও সাপ্তাহিক কাগজ ছিল। ‘লাঙল’ কিংবা ‘গণবাণী’ ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির মুখপত্র ছিল না। সে যুগে কমিউনিষ্ট পার্টির মুখপত্র নাম দিয়ে কোনো কাগজ বার করা সম্ভবও ছিল না। তবে দু’খানা কাগজের পরিচালনাতেই কমিউনিষ্টদের হাত ছিল। ‘লাঙল’ পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। কাগজখানা শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দলের সাপ্তাহিক মুখপত্র ছিল। পরে এই দলের নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘কৃষক ও শ্রমিক দল’ (workers’ and peasants’ party) হয়েছিল। ‘লাঙল’ পত্রিকায় প্রধান পরিচালক হিসাবে নাম ছাপা হতো কাজী নজরুল ইসলামের আর সম্পাদক হিসাবে নাম থাকত মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের। গোড়ায় কাজী নজরুল ইসলাম সত্যই কাগজের প্রধান পরিচালক ছিলেন। বিভিন্ন উপ-শিরোনামে বিভক্ত তাঁর সাম্যবাদী নামক বিরাট কবিতা বুকে নিয়েই ‘লাঙল’ প্রথম বার হয়েছিল। তাঁর বিখ্যাত ‘সব্যসাচী’ নামক কবিতা ছাপা হয়েছিল ‘লাঙল’-এর তৃতীয় সংখ্যায় (৭ জানুয়ারি, ১৯২৬ সাল)। কানপুর কমিউনিষ্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার সাজা হতে মুক্তি পেয়ে ওই জানুয়ারি মাসেই মুজফ্ফর আহ্মদ কলকাতায় ফিরে আসেন। তারপরে ধীরে ধীরে ‘লাঙল’ এর সম্পাদনার ভার তাঁর হাতে এসে যায় এবং অন্য সব ব্যবস্থার দিকটা দেখতে লাগলেন আবদুল হালীম।...” (সমকালের কথা - মুজফ্ফর আহ্মদ পৃঃ ৫৬-৫৭)। কার্ল মার্কসের কথা, রুশ বিপ্লব, লেনিন, ম্যাকসিম গোর্কির রচনা এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নানা তত্ত্ব ‘লাঙল’ই প্রথম প্রকাশ করে।
১৯২৬ সালের ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ‘লাঙল’ প্রকাশিত হওয়ার পর ১২ আগস্ট থেকে নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘গণবাণী’ নামে প্রকাশিত হতে থাকে। সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন কাকাবাবু। ‘গণবাণী’ পত্রিকায় নজরুল ইসলাম ‘মন্দির ও মসজিদ’ ও ‘হিন্দু মুসলমান’ নামে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লেখেন।
নজরুলের বিপদের দিনগুলিতে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন কাকাবাবু। ‘নবযুগ’ পত্রিকা বন্ধ হওয়ার কিছুদিন পূর্বে নজরুল দেওঘরে চলে গিয়েছিলেন। দেওঘরে নজরুলকে প্রচণ্ড আর্থিক সংকটে পড়তে হয়। পাশে দাঁড়ান মুজফ্ফর আহ্মদ। কাকাবাবু নজরুলকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনেন। কুমিল্লায় গিয়ে কবি আর্থিকভাবে রিক্ত হয়ে পড়েন। নজরুলকে কলকাতায় নিয়ে আসেন কাকাবাবু। তিনি মাত্র ত্রিশ টাকা সম্বল করে অনেক কষ্ট করে কুমিল্লার দৌলতপুর থেকে নজরুলকে কলকাতায় এনেছিলেন (৮ জুলাই, ১৯১৯)।
কুমিল্লা থেকে কলকাতায় ফিরে এসে নজরুল মুজফ্ফর আহ্মদের সঙ্গে ৩/৪ সি তালতলা লেন বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। কাকাবাবুর সঙ্গে কবির একত্রে এটাই শেষ বসবাস। এখানে থাকাকালীন নজরুল তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ রচনা করেন। নজরুলের কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’র প্রথম শ্রোতা ছিলেন মুজফ্ফর আহ্মদ। ১৯২২ সালে নজরুল আবার কুমিল্লা চলে যান। কাকাবাবু ও নজরুল এরপর আর একসঙ্গে বসবাস করেননি।
ধুমকেতুতে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা লেখার অভিযোগে নজরুলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। নজরুলের সাজা হওয়ার কিছু দিন পর কাকাবাবুও কানপুর ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী হয়ে জেলবন্দি হন। উভয়ের যোগসূত্র ছিন্ন হয়। প্রায় তিন বছর পর (১৯২৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি) কৃষ্ণনগরে নজরুলের সঙ্গে কাকাবাবুর দেখা হয়। কৃষ্ণনগরেই গঠিত হয়েছিল ‘বঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক দল’। মুজফ্ফর আহ্মদের অনুরোধেই ১৯২৬ সালে নজরুল কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের বাংলা অনুবাদ (‘অন্তর ন্যাশনাল সংগীত’) করেন। ১৯২৮ সাল পর্যন্ত নজরুল কৃষ্ণনগরে ছিলেন। এরপর কলকাতায় আসেন। এই সময় কাকাবাবুর সঙ্গে পরিবারের যোগাযোগ বেড়েছিল।
নজরুল পরিবারের সঙ্গে কাকাবাবুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কৃষ্ণনগরে থাকার সময় ১৯২৭ সালের ১৩ মার্চ নজরুল-পুত্র বুলবুলের মুখেভাত হয়েছিল। কাকাবাবু নিমন্ত্রিত ছিলেন। কিন্তু ১৪ মার্চ দিল্লীতে মুজফ্ফর আহ্মদের সভা ছিল বলে তিনি নিমন্ত্রণে যেতে পারেননি।
১৯২৯ সালের ২০ মার্চ কাকাবাবু মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যান। নজরুল মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের সাহায্যে সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন ও অর্থ সংগ্রহও করেছিলেন। কাকাবাবুর সঙ্গে কবি ১৯২৯ সালের মার্চে কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত কৃষক সম্মেলনে একসঙ্গে রাজনৈতিক মঞ্চে দাঁড়িয়েছিলেন। মুজফ্ফর আহ্মদের সঙ্গে এটিই শেষবারের মতো কবির একসঙ্গে রাজনৈতিক মঞ্চে দাঁড়ানো।
১৯৪২ সালের ৯ জুলাই নজরুলের অসুখ সবাই জানতে পারেন। “নজরুল ইসলাম জীবনীশক্তিতে পরিপূর্ণ ছিলেন। একদিন তাঁরও ভিতরে প্রবেশ করল ব্যাধি। এই ব্যাধি তাঁকে কুরে কুরে খেতে লাগল। অবশেষে ১৯৪২ সালের ৯ জুলাই তারিখের রাত্রিতে তাঁর ব্যাধি প্রকট হয়ে পড়ল - অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা স্টেশনে। তারপরে আমাদের সুপরিচিত নজরুল ইসলামকে আমরা ধীরে ধীরে হারিয়েছি। তাঁর সম্বিত নেই, তিনি কথা বলতে পারেন না, তিনি আমাদের চিনতে পারেন না। কবি আজ জীবিত থাকলেও তাঁর অবস্থা মৃতের মতো।” (মুজফ্ফর আহ্মদ নির্বাচিত প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা-৩০৩)।
কাকাবাবু আক্ষেপ করে লিখেছেন, “নজরুলের রোগের প্রথম সূচনা কখন হয়েছিল তা বলা কঠিন। সে নিজে নিশ্চয় তার ভিতরে এই রোগের আবির্ভাবটা অনেক আগে টের পেয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সে যদি কোনো বিশিষ্ট চিকিৎসকের নিকট যেত তা হলে আজ আমাদের দেশ তাকে এইভাবে হারাত না। তা হলে আমাদের চোখের সামনে আজ এক জীবনমৃত নজরুলকে দেখতে হ’ত না। দেশের কত দুর্ভাগ্য যে নজরুলের যখন বিজ্ঞানের আশ্রয় গ্রহণ করা উচিত ছিল তখন সে আশ্রয় নিয়েছিল আধ্যাত্মিকতার কোটরে। এই আধ্যাত্মিকতা যে কি তা আমি জানিনে, তবে তা রোগের ঔষধ নয়। রোগের ঔষধ হচ্ছে বড়ি, মিকচার কিংবা সূচের ভিতর দিয়ে শরীরের তরল পদার্থ ঢোকানো। নজরুল গোড়াতেই তা না করে রোগকে বাড়তে দিল।” (কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথাঃ মুজফ্ফর আহ্মদ, পৃষ্ঠা-২৫০)
মুজফ্ফর আহ্মদ নজরুলের প্রতি আন্তরিক ছিলেন বলেই কাজী নজরুল ইসলামের ৭০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক রবীন্দ্র সদনে (কলকাতা) ২৫ মে, ১৯৬৯ তারিখে অনুষ্ঠিত জয়ন্তী উৎসবে পঠিত ভাষণে রাজ্য সরকারের কাছে কাকাবাবু কবির বাসস্থান সমস্যা ও চিকিৎসা বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।
নজরুল ইসলামের অবদান স্মরণ করে মুজফ্ফর আহ্মদ বলেছেন, “কবি নজরুল ইসলাম গত সাতাশ বছর যাবৎ অসুস্থ ও সম্বিতহারা। এই সাতাশ বছরে তিনি আমাদের কিছুই দিতে পারেননি। কিন্তু সাহিত্য ও সংগীতের আসরে তিনি একসঙ্গে বাইশ বৎসর কর্মব্যস্ত জীবন কাটিয়েছিল। এই বাইশ বছরে তিনি আমাদের যে অবদান দিয়েছেন তার কোনো তুলনা হয় না। তাঁর অবদান সমস্ত দেশের নিকট হতে স্বীকৃতি লাভ করেছে। নজরুল ইসলাম দেশকে স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের প্রেরণা জুগিয়েছেন। তিনি নিজেও ছিলেন দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন সৈনিক। এই জন্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি কবির এই সুদীর্ঘ নীরবতা সত্ত্বেও তাঁর জনপ্রিয়তা প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে।”