E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪১ সংখ্যা / ২৬ মে, ২০২৩ / ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০

বাংলাদেশে নজরুল

মাসুদুল হক


কাজী অনির্বাণের আঁকা নজরুলের ছবি।

ব্রিটিশশাসিত ভারতের অখণ্ড বঙ্গভূমির বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নিলেও কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। রাজনৈতিক উত্থান-পতন, ভৌগোলিক বিভাজনের সূত্রে পশ্চিমবঙ্গের হয়েও যে-কারণে তিনি আজ বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত - এর পেছনে রয়েছে তাঁর ও তাঁর সৃষ্টিকর্মের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং একই সঙ্গে এদেশের মানুষের সঙ্গে তাঁর পূর্ব-সম্পৃক্ততা, সম্প্রীতি ও প্রেমের বন্ধন। তাঁর রচনাকর্মের বেশকিছু অংশ পূর্ব বাংলায় বসে লেখা;পূর্ব বাংলা ও পূর্ব বাংলার মানুষকে নিয়ে লেখা।

নজরুল তাঁর কৈশোরেই এদেশের ভূখণ্ডে পা রাখেন। দারিদ্র্যকবলিত অথচ সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম-নেওয়া এই কবি-কিশোর আসানসোলের মাথরুন স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ চুকিয়ে প্রসাদপুরের এক বাঙালি খ্রিস্টান-পরিবারে কিছুদিন বাবুর্চির কাজ করেন। আবারও আসানসোলে এসে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে যখন একটি রুটির দোকানে কাজ করছিলেন তখন ঘটনাচক্রে তাঁর সাহিত্য-প্রতিভার পরিচয় পেয়ে কাজী রফিজউল্লাহ নামে এক পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেন। তিনি ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানায় দারোগা হিসেবে বদলি হলে নজরুলকেও সঙ্গে নিয়ে আসেন কাজীর সিমলা গ্রামে। ১৯১৪ সালের জানুয়ারি মাসে নজরুলকে দরিরামপুর হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে ভরতি করে দেন। নিজগুণেই নজরুল বিনাবেতনে লেখাপড়ার সুযোগ পান। বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান পেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। কিন্তু অজানা কারণে চঞ্চলমতি নজরুল কাউকে না জানিয়ে নিজ গ্রাম চুরুলিয়ায় ফিরে যান। ১৯২৬ সালের ১৭-১৮ জানুয়ারি ময়মনসিংহে এক কৃষক-শ্রমিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আমন্ত্রণ পেয়ে সম্মেলনে যোগ দিতে না পারলেও কৃষ্ণনগর থেকে পাঠানো এক বাণীতে কবি লেখেনঃ “ময়মনসিংহ জেলার কাছে আমি অশেষ ঋণে ঋণী। আমার বাল্যকালের অনেকগুলি দিন ইহারই বুকে কাটিয়া গিয়াছে... আজও আমার মনে সেইসব প্রিয় স্মৃতি উজ্জ্বল ভাস্বর হইয়া জ্বলিতেছে।” পরিণত বয়সে নজরুল ময়মনসিংহ অঞ্চলে অনেক ঘুরেছেন। ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হিসেবে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ঢাকা, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ জেলার বিস্তৃত অঞ্চল ছিল তাঁর নির্বাচনী এলাকা। জয়লাভ তো দূরের কথা, নির্বাচনে তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। ভোটপ্রার্থী হিসেবে প্রত্যাখ্যাত হলেও কবি হিসেবে তিনি সর্বত্রই সমাদৃত। নজরুলের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার ময়মনসিংহের ত্রিশালে ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপন করেছে।

কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম ঢাকায় আসেন ১৯২৬ সালের ২৪ জুন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ২৭-২৮ জুনে অনুষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য সমাজের একটি অধিবেশনে যোগ দিতে। এখানে এসে আবদুল কাদির, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ,কাজী আবদুল ওদুদ, আবদুল মজিদ সাহিত্যরত্ন-সহ অন্যান্যদের সঙ্গে প্রথমবারের মতো পরিচয় ঘটে। নজরুল সেই সম্মেলনে ইসলামি পুনর্জাগরণ বিষয়ে বক্তব্য দেন, ‘খালেদ’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন, গজল ছাড়াও ‘খোশ আমদেদ’ নামে একটি নতুন গান পরিবেশন করেন। এই সময়ে দিদারুল আলমের অনুরোধে নজরুল আট পঙ্‌ক্তির প্রশস্তি লিখে দেন, যা যুগের আলোর একটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নজরুল আবারও ঢাকায় আসেন; ওঠেন ডঃ কাজী মোতাহার হোসেনের বর্ধমান হাউসের বাসায়। এখানে বসে তিনি ‘এ বাসী আসরে আসিলে কে ছলিতে’ এবং ‘চল চল চল’ গানটি রচনা করেন, যা এখন আমাদের রণসংগীতের মর্যাদা পেয়েছে। এ-সফরে তিনি পরিচিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক প্রখ্যাত কবি ও প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসু এবং কাজী মোতাহার হোসেনের দূরসম্পর্কের বোন ফজিলতুননেসার সঙ্গে। ফজিলতুননেসার রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়ে নজরুল তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং এ-বিষয়ে কাজী মোতাহার হোসেন ও ফজিলতুননেসাকে অনেক চিঠি লেখেন ও বই পাঠান। কাজী মোতাহার হোসেন একটি চিঠিতে ফজিলতুননেসার অনাগ্রহের কথা জানালে নজরুল অনুশোচনা করে এ-বিষয়ে বিরত হন। এরপর হঠাৎ করেই তিনি একই বছরের জুন মাসে আবারো ঢাকায় এলে ঘনিষ্ঠতা জন্মে রানু সোম নামে এক সুকণ্ঠী তরুণীর সঙ্গে, যিনি পরে বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী হওয়ার পর প্রতিভা বসু নামে খ্যাতি অর্জন করেন। ঢাকা সফরকালে নজরুল রানু সোমকে তাঁদের বনগ্রামের বাসায় গানের তালিম দিতে শুরু করেন এবং পরবর্তীতে রানু সোম কলকাতায় গিয়ে নজরুলের কাছে গান শেখেন এবং নজরুলের প্রচেষ্টায় তিনি গ্রামোফোনে ও বেতারে গান গাওয়ার সুযোগ পান। নজরুলের সঙ্গে রানু সোম ওরফে প্রতিভা বসুর সম্পর্ককে ব্যঙ্গ করে শনিবারের চিঠি পত্রিকায় নজরুলের ‘কে বিদেশী মন উদাসী’ গানটির প্যারোডি ‘কে উদাসী বনগাঁবাসী’ ছাপা হয়। কবি আবদুল কাদিরের বিয়ে উপলক্ষে ১৯৩৪ সালের ২১ অক্টোবর কবি ঢাকায় আসেন এবং ‘বন্ধন’ শীর্ষক ‘অনন্তকাল এ অনন্তলোকে’ আশীর্বাণী রচনা করেন। নারায়ণগঞ্জ সংগীত সংসদের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নজরুল ঢাকা হয়ে নারায়ণগঞ্জে আসেন ১৯৩৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর।

ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রথম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান উপলক্ষে নজরুল, বুদ্ধদেব বসু ও একদল শিল্পী নিয়ে ঢাকায় আসেন ১৯৪০ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৪০ সালের ২৬ মার্চ, ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত শচীন সেনগুপ্তের ‘ঝড়ের রাতে’ নাটকের সংগীত পরিচালনায় ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।

নজরুল প্রথমবারের মতো কুমিল্লায় আসেন ১৯২১ সালের ৪ এপ্রিল। আসার পথে ট্রেনে বসে লেখেন ‘নীলপরী’ কবিতাটি। দৌলতপুর যাওয়ার পথে তাঁদের যাত্রাবিরতি ঘটে কান্দিরপাড়ে, সফরসঙ্গী আলি আকবর খানের পরিচিত ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে। ইন্দ্রকুমারের স্ত্রী বিরজাসুন্দরীর স্নেহে আপ্লুত হয়ে নজরুল তাঁকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেন; পরে তাঁকে নিয়ে কবিতা লেখেন ও তাঁর নামে বই উৎসর্গ করেন; সে-বাড়িতেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা জন্মে বিরজাসুন্দরীর দেবর বসন্তকুমার সেনগুপ্ত ও গিরিবালা দেবীর মেয়ে আশালতার সঙ্গে, যাঁর ডাকনাম ছিল দোলন বা দুলি– নজরুল নিজে যাঁর নাম দিয়েছিলেন প্রমীলা। একই যাত্রায় একদিন পর দৌলতপুর গিয়ে ঘটে আরও এক নাটকীয় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এক বিয়ের অনুষ্ঠানে নজরুল পরিচিত হন আলী আকবর খানের পিতৃহীন ভাগ্নি সৈয়দা খাতুনের সঙ্গে, নজরুল যার নাম দিয়েছিলেন নার্গিস। সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে নার্গিসের গান শুনে ও রূপ দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে তাঁর প্রেমে পড়েন। অল্পদিনের মধ্যেই দৌলতপুরে বসে অনেক কবিতা ও গান লিখে ফেলেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ ‘অ-বেলায়’, ‘হার-মানা হার’, ‘পাপড়ি খোলা’, ‘অনাদৃতা’। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেন নার্গিসকে তিনি বিয়ে করবেন। খবর পেয়ে কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ-সহ কবির বহু সুহৃদ বিয়ের ব্যাপারে তাঁকে সাবধানে এগোতে পরামর্শ দেন। তাঁর ও নার্গিসের একান্ত আগ্রহে ১৯২১ সালের ১৭ জুন নজরুল-নার্গিসের ‘আক্ত’ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। অজ্ঞাত কারণে কনের মামা আলী আকবর খান কাবিননামায় শর্ত জুড়ে দেন, নজরুল নার্গিসকে নিয়ে কখনো দৌলতপুর ছেড়ে যেতে পারবেন না। এই অন্যায় আচরণ ও শর্তে মর্মাহত কবি পরের দিনই নার্গিসকে ফেলে রেখে হেঁটে কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে পৌঁছেন। এরই মধ্যে দৌলতপুরে বসেই তিনি লিখে ফেলেন ‘বিদায়-বেলায়’, ‘বেদনা-অভিমান’, ‘বিধুরা পথিক-প্রিয়া’, ‘মুকুলের উদ্বোধন’, ‘লাল সালাম’, ‘হারা-মণি’, ‘মানস বধূ’ ও ‘মনের মানুষ’ কবিতাগুলো। ১৯২১ সালের ১৮ নভেম্বর নজরুল আবারও কুমিল্লায় আসেন এবং যথারীতি ওঠেন প্রমীলাদের বাসায়। সেখানে পৌঁছেই ‘বন্দনা গান’ নামে একটি গান লেখেন, যা পরে ‘বিজয় গান’ নামে সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একই সময়ে তিনি ‘নিশীথ-প্রীতম’ ও ‘বিজয়িনী’ নামে দুটি কবিতা লেখেন।

ব্রিটিশ যুবরাজ প্রিন্স অব ওয়েলসের ভারত সফর উপলক্ষে দেশব্যাপী যখন হরতাল চলছে, তখন তিনি কুমিল্লায় একটি মিছিলে কাঁধে হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে সরকারবিরোধী গান গেয়েছেন, মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তরুণদের জন্য ‘জাগরণী’ নামে নতুন কোরাস গান লিখে দিয়েছেন। সেই গান রচনা ও প্রচারের দায়ে একরাত তাঁকে থানায় আটকে রাখা হয়।

নজরুল তৃতীয়বারের মতো কুমিল্লায় আসেন ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এ-সময়ে তিনি প্রায় চার মাস প্রমীলার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে কাটান। এই সময় নজরুল তাঁর ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘প্রিয়ার রূপ’ কবিতাগুলো এবং ‘শায়ক-বেঁধা পাখি’ ও ‘চিরচেনা’ গান দুটি রচনা করেন। প্রমীলার সঙ্গে তাঁর মেলামেশা নিয়ে এলাকাবাসীর উত্তেজনার কারণে জুন মাসের কোনো একসময়ে নজরুল কলকাতায় ফিরে যান। এরপর ২২ নভেম্বর প্রমীলা ও তাঁর মা গিরিবালা দেবীর সঙ্গে তিনি আবারও কুমিল্লায় আসেন এবং আসার পরদিনই পুলিশ তাঁকে আটক করে। প্রমীলার সঙ্গে সম্পর্কজনিত উত্তেজনার কারণে নয়, ধূমকেতু পত্রিকার সরকারবিরোধী ভূমিকার দায়ে তাঁকে আটক করা হয়। ট্রেনে করে পুলিশ তাঁকে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে যায়। এক বছরের কারাদণ্ড শেষে নজরুল ১৯২৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর কুমিল্লায় আসেন। কিন্তু প্রমীলার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে এলাকাবাসী বাড়াবাড়ি শুরু করলে তিনি গোপনে কুমিল্লা ছাড়তে বাধ্য হন। ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল কলকাতার একটি বাড়িতে প্রমীলার সঙ্গে তাঁর বিয়ের কাজটি সুসম্পন্ন হয়।

নজরুলের বহুশিল্পিত রচনার জন্মভূমি চট্টগ্রাম। তিনি প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামে আসেন ১৯২৬ সালের ২৬ জুলাই। সিন্ধু-হিন্দোল কাব্যগ্রন্থের বহু কবিতা সেখানে রচিত হয়। বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন হবীবুল্লাহ বাহার ও তাঁর বিদুষী ভগ্নি শামসুন নাহার মাহমুদকে। ১৯২৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রায় পুরোটা সময় তিনি চট্টগ্রামে কাটান। কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে সীতাকুণ্ড পাহাড়ে উঠে ও সাম্পানে চড়ে তিনি অত্যন্ত উল্লাসের মধ্যে সেই দিনগুলো কাটিয়েছেন। চক্রবাক কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতা এখানে বসে রচনা করেন।

কবির অকৃত্রিম সুহৃদ কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের পৈতৃক নিবাস সন্দ্বীপ। ২৮ জানুয়ারি তিনি জাহাজে ও নৌকায় চড়ে সেখানে যান। বিতর্ক থাকলেও জানা যায়ঃ তিনি তাঁর ‘খেলিছে জলদেবী সুনীল সাগরজলে’ গানটি তখন রচনা করেন। ১৯৩৩ সালের ৭ মে, নজরুল চট্টগ্রাম জেলা সাহিত্য সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। বিকেলের অধিবেশনে তিনি গান ও কবিতা আবৃত্তি করেন।

নজরুল প্রথমবারের মতো ফরিদপুরে আসেন ১৯২৫ সালের ১ মে, কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে যোগ দিতে। সেই সম্মেলনে মহাত্মা গান্ধী ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের উপস্থিতিতে অসহযোগ আন্দোলনকে নিয়ে লেখা তাঁর ‘চরকার গান’ এবং এর সঙ্গে ‘শিকল-পরা ছল’ ও ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ গানগুলো গেয়ে শোনান। সেসময় কবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা জন্মে। দ্বিতীয়বার ১৯২৬ সালের ১০ মার্চ তিনি ফরিদপুরের মাদারীপুর আসেন। মাদারীপুরে নিখিল বঙ্গীয় ও আসাম প্রদেশীয় মৎস্যজীবী সম্মিলনীর তৃতীয় অধিবেশনে ‘ধীবর’ বা ‘জেলেদের গান’ শীর্ষক ‘আমরা নিচে পড়ে রইবো না আর’ উদ্বোধনী গান হিসেবে পরিবেশন করেন। গানটি অবশ্য কৃষ্ণনগরে বসে লেখা। সেই সম্মেলনে রাজনৈতিক নেতা বসন্তকুমার মজুমদার ও তাঁর স্ত্রী হেমপ্রভার সঙ্গে পরিচিত হন। নজরুল তখন হেমপ্রভাকে নিয়ে একটি দেশাত্মবোধক গান ‘কোন অতীতের আঁধার ভেদিয়া’ রচনা করেন। নিজের নির্বাচনী প্রচারের কাজে নজরুল আবারও ফরিদপুরে আসেন একই বছরের ৩ নভেম্বর। এবার তিনি ওঠেন কবি জসীমউদ্দীনের বাড়িতে।

১৯৩৬ সালের ২৭ জানুয়ারি, জেলা মুসলিম ছাত্র সম্মিলনীতে সভাপতি হিসেবে যোগ দিতে; ১৯৩৮ সালে ফরিদপুর সংসদের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করতে এবং সবশেষে ১৯৪১ সালের ১২ আগস্ট জেলা মুসলিম ছাত্রলিগের সম্মেলনে যোগ দিতে নজরুল ফরিদপুর আসেন।

১৯২৭ সালের ১৫ থেকে ২০ জুন তিনি উষ্ণ সংবর্ধনা পান নোয়াখালিতে। আটটি ঘোড়াচালিত এক শৌখিন গাড়িতে চড়িয়ে সোনাপুর রেলস্টেশন থেকে কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় খাদেমুল ইসলাম অফিসে; পথে পথে নির্মিত হয়েছিল সুসজ্জিত বহু তোরণ। এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁকে উপহার দেওয়া হয় সোনার তৈরি দোয়াত ও কলম; লক্ষ্মীপুরের জেলেরাও তাঁকে সংবর্ধনা জানান। সেখানে তাঁকে উপহার দেওয়া হয় রূপার তৈরি মালা ও বাটি। এমন প্রাণঢালা সংবর্ধনা পেয়েছেন তিনি সিলেটেও ১৯২৮ সালের অক্টোবর মাসে। সেখানকার পর্দা প্রথার কঠিন নিয়ম ভঙ্গ করে বহু মুসলমান নারী তাঁর অনুষ্ঠানে যোগ দেয়।

বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের এবং পশ্চিম সীমান্তের জেলাগুলোতে নজরুল প্রায়ই আসতেন। ১৯২৪ থেকে ১৯৩২ সালের বিভিন্ন সময়ে তিনি দিনাজপুর, রংপুর, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর ও বাকেরগঞ্জে এসেছেন একাধিকবার। বিভিন্ন সম্মেলনে অতিথি হিসেবে যোগদান কিংবা তাঁকে দেওয়া সংবর্ধনা উপলক্ষে এসব সফরে এসেছেন। এসব সফরের সময় রচিত কোনো কবিতা বা গানের কথা আমাদের জানা নেই। তবে ১৯২৮ সালের ২৮ নভেম্বর তিনি রংপুরের হরগাছায় বসে ‘ভোরের পাখী’ কবিতাটি লিখেছেন।

কবি নজরুল দিনাজপুরে আসেন ১৯২৮ সালে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কৃষক-প্রজাপার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও বামপন্থী নেতা হেমন্তকুমার সরকার। সেবার তিনি ড্রামাটিক ক্লাব সংলগ্ন গোলকুঠি মাঠে তাঁর রচিত বেশ কয়েকটি গান গেয়ে শোনান।

এক অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪২ সাল থেকেই তিনি বোধশক্তি ও বাক্‌শক্তি হারিয়ে ফেলেন। তবে, বলতে গেলে এরপরই বাংলাদেশে নজরুল-চর্চা আরও বেগবান হয়ে ওঠে। বাংলা একাডেমি-সহ বহু প্রকাশনা সংস্থা থেকে নজরুলের বইগুলোর নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হতে থাকে এবং বিভিন্ন জায়গায় তাঁর জন্মজয়ন্তী উদ্‌যাপিত হতে শুরু করে। ১৯৬৩ সাল থেকে বেতারে তাঁর গান ‘নজরুল গীতি’ হিসেবে স্বতন্ত্র মর্যাদা পায়। ১৯৬৪ সালের ২৪ মে ঢাকায় নজরুল একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭০ সালে নজরুলের জীবন ও কর্ম নিয়ে বাংলাদেশে সরকারি উদ্যোগে বিদ্রোহী কবি নামে প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়।

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একক উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় বোধশক্তিহীন নির্বাক কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ধানমন্ডির ২৮ নম্বর সড়কের ৩৩০-বি ভবনটি এবং একটি গাড়ি কবির নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ডাক্তার-নার্স-সহ সেবা-শুশ্রূষার সবরকম ব্যবস্থা করা হয়। ভবনটির নতুন নাম রাখা হয় ‘কবিভবন’ যা এখন আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান নজরুল ইনস্টিটিউট।

১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি লিট ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৭৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। একই বছর তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় এবং ‘চল চল চল’ গানটি আমাদের রণসংগীতের মর্যাদা পায়।

নজরুল অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক। তিনি পরাধীন ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির জন্যে তাঁর সাহিত্যে যে মানবতার বীজ রোপন করেছিলেন, সে বীজ বিকশিত হয়ে আজ পল্লবিত তরু। বর্তমানে ভারত ও বাংলাদেশে মৌলবাদের যে বিষবাস্প ছড়িয়ে বাঙালির প্রগতির আকাশকে কুলষিত করছে, তা থেকে মুক্তি পেতে নজরুলের মানবতা ও সম্প্রীতির পল্লবিত তরুর ছায়ায় আমাদের আশ্রয় জরুরি।

স্থায়ীভাবে এদেশে আসার পর প্রতি বছর কবির জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে কবিকে ফুলের শুভেচ্ছায় সিক্ত করেছে এদেশের মানুষ। কিন্তু সেসব ফুলের জলসায়ও নীরব ছিলেন কবি। অবশেষে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় কবিকে ঢাকার পিজি হাসপাতালে ভরতি করা হয়। বিশেষ মেডিকেল বোর্ড গঠন করে কবির সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলেও কিছুদিন পরে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁকে সমাহিত করা হয়। আমাদের হৃদয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যু নেই; আজও তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন বহুকাল তাঁর সৃষ্টি ও রচনায়।

______________________________
লেখকঃ কবি, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক।
অধ্যক্ষ, বীরগঞ্জ সরকারি কলেজ, বীরগঞ্জ, দিনাজপুর, বাংলাদেশ।