৬০ বর্ষ ৪১ সংখ্যা / ২৬ মে, ২০২৩ / ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
‘কোরাস’ - এক বোধের ছবি
সঞ্চিতা সান্যাল
‘কোরাস’ ছবির একটি দৃশ্য।
আমরা যারা সত্তরের দশকে জন্মালাম, তাদের বড়ো হওয়ার সময়জুড়ে দেখছিলাম সামাজিক ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলা আনার জন্য সরকারি ও নাগরিক স্তরের তদবির। অভুক্ত মানুষের মিছিল, রাষ্ট্রের কানায় পড়া মানুষের দৌড় তখন কমে আসছে ক্রমশ। কিন্তু এই পরিবর্তনের কথা আজ আর খুব লেখা হয় না কোথাও। কারা এনেছিলেন সেই পরিবর্তন? অগণিত মানুষ। মনে পড়ে ‘কোরাস’-এর ত্রিশ হাজার হানাদারের সেই চিঠি, যেখানে তারা ঘোষণা করে “আমরা ত্রিশ হাজার অ্যাপ্লিক্যান্ট নতুন সাজে, নতুন রূপে উপস্থিত হইব... হানাদারে রূপান্তরিত হইয়া আপনাদের ধ্বংস করিব... এবং নতুন ধাঁচে সংসার পাতিব। “মৃণাল সেনের ‘কোরাস’ ছবির দুনিয়ায় এক অবাক সৃষ্টি। তাঁর ন্যারেটিভ, তাঁর প্রেজেন্টেশন তছনছ করে দেয় সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে যাবতীয় সরল ও জটিল ভাবনাগুলোকে।
মৃণাল সেন মনে করতেন ফিল্ম যতখানি visual, ততখানিই aural... শব্দ, সংলাপ এসবের মধ্যে দিয়ে ফিল্ম আসলে একটি Literary Exercise...। তিনি বলেছিলেন, “কোরাস আমাদের ছবির জীবনে একটি বিশেষ ঘটনা”। কোরাস কি বাস্তব না ফ্যান্টাসি? কোরাসে দুই-ই আছে। ফ্যান্টাসি আর বাস্তবতা প্রয়োজনমতো একে অপরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এই ছবিটি শুধুমাত্র একটি সিনেমা নয়... আসলে একটা দেখানো যা মৃণাল নিজেও দেখতে চেয়েছিলেন। সেই দেখা কী? অগণিত মানুষের, অসংগঠিত মানুষের, নেতৃত্বহীন মানুষের এক দৌড় যা তাড়া করবে, ভেঙে ফেলবে, তছনছ করবে বিত্তের সাজানো সংসার। অথচ, তাদের যেহেতু কোনো পরিচিতি নেই, সেহেতু তাদের সম্পর্কে রাষ্ট্রের কাছে কোনো হদিশ থাকে না। এই পরিচয়হীন, মুণ্ডুহীন জনগণের তালটিকে সংখ্যা দিয়ে, নাম দিয়ে, ধাম দিয়ে, কাম দিয়ে রাষ্ট্র বুঝতে চায়। বুঝলে তাদের ধ্বংস করা যায়। কিন্তু সত্যি কী সে বোঝে? ‘ত্রিশ হাজার’ শব্দটিই কোরাসে প্রোটাগনিস্ট অথচ ফর্মলেস, সাইনলেস...
তাইই আতঙ্ক। তাইই শঙ্কা। তাই এ ছবিকে এড়িয়ে যাওয়া। আর তাই বিশেষ ছবি হওয়া সত্ত্বেও, কোরাসের দর্শক আসন ফাঁকা থাকা।
দর্শকের অবস্থান কী ছিল? কলকাতায় এই ছবির বাজার মোটে ছিল না। ভেবে দেখুন এই ছবির নির্মাণকাল ১৯৭৪... এই ছবি বলছে মানুষের জোট বাঁধার কথা, তবুও এই ছবি দেখতে মানুষের ভিড় নেই। কেন? তাহলে কী দর্শক তাই দেখেন যা তিনি দেখতে চাইছেন? তবে কি এই সত্য যে, এই ছবি প্রমাণ করে দিয়েছিল আমাদের দৃষ্টি আর মেধার সীমাবদ্ধতা? অথবা দর্শক হিসেবে বাঙালির ক্লীবতা? টিকিট কেটে ছবি সাধারণত দেখতেন সেকালে উচ্চবিত্ত অথবা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক সম্প্রদায়। তাঁরা কী ভয় পেলেন এ ছবি দেখতে! নচিকেতা ঘোষ ১৯৭৪ এই তৈরি করলেন মৌচাক। রোমাণ্টিক কমেডি ফিল্ম। এবার মলে সুতো হবো, পাছাপেড়ে শাড়ি হয়ে দুলবো তোমার কোমরে... এ গান তখন মানুষের মুখে মুখে! মধ্য ও উচ্চবিত্ত বাঙালি তখন রোমান্টিক। অথচ পথে তখন মানুষের লাইন... মৃণাল সেই অসংখ্য চাকরি প্রার্থীর লাইনটিকেই তাঁর ছবির নায়ক করে তুললেন। বার্নার্ড শ’ এর নাটক Androocles and the Lion, তার প্রেক্ষাপট অতি প্রাচীন, তা দেখতে দেখতে বর্তমানকালের এক রাজপুরুষ চিৎকার করে উঠেছিলেন, প্রেক্ষাগৃহ ছেড়ে বেড়িয়েও গেছিলেন। এ শুনে, বার্নার্ড শ’ আশ্বস্ত হয়েছিলেন, বলেছিলেন, যাক, ভদ্রলোকটি তবে আমাকে বুঝতে পেরেছেন। তাহলে, আমাদেরও বুঝে নিতে সুবিধা হয়, সেকালের বেশিরভাগ বাঙালি বিত্তধারী, মেধাধারী বুঝতে পেরেই কোরাস দেখতে যাননি...
।। দুই ।।
১৯৭৪, মৃণাল সেন অগণন জনতার এলোমেলো দৌড় আর পদ্যের কথা বলে উঠলেন কোরাস-এ। মৃণাল বলেন, ‘‘আমার সিনেমার জীবনে কোরাস বাস্তবিকই একটি মসৃণ সিনেমাটিক অভিজ্ঞতা।’’ কোরাস শব্দের অর্থ, অবশ্যই যদি গ্রিক অর্থে বলি, তা হলো এক সমবেত জনতা যারা কোনো ধর্মীয় উৎসব পালন করতে মিলিত হয়েছে। মৃণাল বলেন, কোরাস হলো গ্রিক নাটকের একটা চরিত্র, যে বা যারা বিশেষ মুহূর্তে এসে দাঁড়ায় মঞ্চের ওপর এবং ভাষ্যকারের ভূমিকা পালন করে চলে যায়। যদিও এই ছবিতে কোরাস হলো এক নামহীন জাতহীন পরিচয়হীন একতাল মানুষ...যাদের বহু লড়াই, বহু ব্যর্থতা, বহু অসহায়তা রয়েছে আবার একটা বল্গাহীন ছুট আছে, দৌড় আছে, একসঙ্গে বলে ওঠার মতো একটাই কথা আছে, যা অনেকটা পদ্যের মতো, সংগীতের মতো শোর ও সুর... collective voice... কোরাস।
এই ছবিটি প্রসঙ্গে মৃণাল সেন বলেছিলেন, প্রতিটি আর্ট ফর্মেরই একমাত্র সামাজিক ও শিল্পগত ব্যাখ্যা হলো বক্তব্য প্রকাশ করা, কমিউনিকেট করা। হাতিয়ারের ওপর নির্ভর করে এবং প্রয়োজন হলে বাইরে থেকে আরও একাধিক হাতিয়ার আমদানি করে কমিউনিকেটরের ভূমিকা যথাযথ পালন করাটাই আপনার দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি বিশুদ্ধবাদীদের চোখে জাতিচ্যুত হয়ে যান তো জাত খোয়ানোটাই আপনার দায়িত্ব বলে মনে করবেন। ...এটা আমি একটি পবিত্র সামাজিক দায়িত্ব বলে মনে করি।’’ আসলে এই ছবিতে মৃণাল সেই দায় পালন করতে ফিল্ম এবং থিয়েটারের ফর্মকে একসাথে উপস্থাপন করেন। যাত্রার সূত্রধরের বা বিবেকের চরিত্র এখানে এনে তিনি আসলে দর্শককে শুধু দেখতে নয়, শুনতে বাধ্য করেছেন।
ছবি শুরু হচ্ছে এক নারদরূপী সূত্রধরকে দিয়ে।
বলছেন তিনি,
অভাব না থাকে যদি
থাকে না ঈশ্বর।।
অভাব সৃজিয়া বিধি ধর্মে রাখে মন।।
করো অভাব বরণ
পাবে দেবের চরণ।।
লীলাচ্ছলে ভগবান
মর্তে নেমে আসে।
আর দেশের কাণ্ডারি রূপে মহিমা প্রকাশে।।
মৃণাল দেখালেন, এই কলিকালের দেবতারা কোর্টপ্যান্ট হ্যাট পরে যে স্থল থেকে বিধি বিধান দেন তা দুর্গের মতো, তা কেল্লার মতো। নিরাপত্তার বলয়ে ঘেরা। ছবি শুরু হচ্ছে সেই বিশাল কেল্লার ভেতর থেকে চাকরির ফর্ম দেওয়ার ঘোষণার ঘটনা দিয়ে। কেল্লার বাইরে অগণন জনতা আবালবৃদ্ধবনিতা। গাঁ শহর ঝেঁটিয়ে এসেছে চাকরি না শুধু ফর্ম পেতে। পদ একশোটি। প্রতিটি ফর্মের মূল্য দুই টাকা। ফর্ম বিক্রি হয়েছে ত্রিশ হাজার। এ ছবিতে কোনো নায়ক নেই, নেই কোনো নায়িকা। কোনো একটি গল্প নেই। আছে অনেক উপগল্প । ত্রিশ হাজার... এই সংখ্যাই নায়ক, এই সংখ্যাটিকে ঘিরেই ঘটনা এগিয়ে চলে। আতঙ্ক বিপন্নতা, অসহায়তা, এমনকী সাহস, স্পর্ধা, ইচ্ছে, আবেগ সব কিছুই এই ত্রিশ হাজার শব্দটিকে ঘিরে আবর্তিত হতে থাকে।
শোনা যাচ্ছে গত রাত থেকে লাইন পড়েছে। কেউ বলে উঠলেন লাইনটা এতো বড়ো যে মনে হয় দেশ ছাড়িয়ে চলে যাবে। যাঁরা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা কারা? এই বাংলার বিএ পরীক্ষা দেওয়া মেয়েটি যার পরীক্ষার আট মাস পরেও ফল প্রকাশ হয় না। বাদলা, যে তার মহাজন পিসেমশাইয়ের কাছে একটুকরো জমি বেচতে বাধ্য হলো, বাধ্য হলো মাটির তলায় সেঁধিয়ে যেতে কারণ, মাটির ওপর তখন আর কিছু মেলার সম্ভাবনাগুলোকে নস্যাৎ করা হয়ে গেছে। কোরাস এর শুরুতেই সূত্রধর সে কথা জানিয়ে দিয়েছেন, অভাব রচেন যিনি তিনি শক্তিমান। আর ছবি শেষ হয় যে শোর দিয়ে... ত্রিশ হাজার /করে পুকার /জোট বাঁধো তৈরি হও।
‘কোরাস’-এর পোস্টার।
এ ছবি দেখায় মুষ্টিমেয় ক্ষমতার অলিন্দে বসে থাকা কোর্টপ্যান্ট পরিহিত মানুষ যারা আসলেই বিপন্ন, বলে উঠছেন,আমাদের বাঁচতে হবে... We have to survive... কিন্তু না... তাঁরা বাঁচতে পারেন না শেষ অবধি। অগণিত জনতা যাঁদের মৃণাল ত্রিশ হাজার বলেন, তাদের গল্প বলতে গিয়ে আসলে তিনি একটা রাজনীতির কথা বলেন, যার কোনো ছাঁচ হয় না। বলা হলো তাদের নাম ধাম নিয়ে স্টাডি করতে। তারপর গ্রেপ্তার করতে, ভয় দেখাতে, হ্যারাস করতে, সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে। উৎপল দত্ত বাইনোকুলার দিয়ে দেখেন রাজনৈতিক নেতাদের, বলেন এদের চিনি, এরা শুধু চায়, তবে, বৈঠক, আপস, মেমোরেন্ডামের মধ্যে দিয়ে এদের ঠান্ডা করাও যায়। কিন্তু ওই ত্রিশ হাজার! মৃণাল প্রাইভেট মার্কসিস্ট। ওই ত্রিশ হাজারের রাজনীতির তাই কোনো আদল দেন না। তাদের অস্তিত্ব নিয়ে অনেক প্রশ্ন রেখে যান। কেউ মনে করলেন, ওই ত্রিশ হাজার মস্ত ধোঁকা। কিন্তু সব জল্পনা নস্যাৎ করে ত্রিশ হাজার পথে নেমে এলে শঙ্খ বেজে উঠল। আসলে এই ছবি এক বিপন্নতার গল্প বলে। বিপন্নতা কার? এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর, ক্ষমতার।
মৃণাল মনে করতেন, সিনেমা শুধুমাত্র বিজ্ঞান নয়, শুধুমাত্র প্রযুক্তি নয়, শুধুমাত্র দৃশ্যময়তাও নয়, সিনেমা একটি বোধ ও অনুভব এবং সেই সিনেমাই স্বার্থক, যা সময়কে রূপান্তরিত করে ধরনায়। গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজের দেশ ও কালকে বোঝা এবং তার ভিত্তিতে তাকে বিশেষ পটভূমিকার সাহায্যে প্রতিষ্ঠা করা। সিনেমার কাজ সমকালীন সংকটকে দৃশ্যকাব্যে পরিণত করা। কোরাস সেই অর্থেই বিশেষ সিনেমা যা দর্শককে তার দৃষ্টির সীমানা চিনতে বাধ্য করেছিল।