৬০ বর্ষ ৪১ সংখ্যা / ২৬ মে, ২০২৩ / ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
ভারতীয় দর্শন প্রসঙ্গে (বারো)
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
[‘‘ভারতীয় দর্শনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য’’ ৭টি আগের সংখ্যায় বলা হয়েছিল। এ সংখ্যায় তারপর থেকে বিবৃত হলো।]
(৮) বিভিন্ন দর্শনের এই মতবাদই ভারতীয় দর্শনে সাধারণভাবে কর্মবাদ নামে পরিচিত। কর্মবাদ অনুসারে আমাদের কৃতকর্মের ফল আমাদের ভোগ করতেই হবে। পুণ্য কর্মের ফল সুখভোগ এবং পাপ কর্মের ফল দুঃখভোগ। কর্মের দুইটি ভাগ বা প্রকার - অনারব্ধ কর্ম অর্থাৎ যা এখনও ফল দিতে আরম্ভ করেনি এবং প্রারব্ধ কর্ম অর্থাৎ, যে কর্ম তার ফল দিতে আরম্ভ করেছে। কর্মবাদের উপরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভারতীয় জন্মান্তরবাদ। কর্ম এবং কর্মফলের ভোগ - এই দুইয়ের মধ্যে রয়েছে কার্যকারণ সম্পর্ক। কৃতকর্মের ফল যদি এক জীবনে শেষ না হয় তবে জীবকে নতুন জন্ম পরিগ্রহ করে তার কর্মফল ভোগ করার জন্য এই সংসারে আসতে হয় - এই মতবাদই তো হলো জন্মান্তরবাদ। অর্থাৎ এক কাল্পনিক শাশ্বত নিয়মের উপর ভারতীয় কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদ প্রতিষ্ঠিত।
(৯) চার্বাক ব্যতীত অন্যান্য ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়ের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, ভোগ ও ত্যাগের মধ্যে অদ্ভুতভাবে এক সমন্বয় সাধন করা হয়েছে। চতুরাশ্রম প্রথা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। চারটি আশ্রম হলো যথাক্রমে ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ, সন্ন্যাস।
ভোগ না হলে কখনোই ত্যাগ-ধর্মে মানুষ দীক্ষিত হতে পারে না বলে চতুরাশ্রম প্রথায় ভোগবাদী গার্হস্থ্য জীবনের প্রতি সমান গুরুত্ব দেওয়ার পরই সমাজসংসার ত্যাগ করে বানপ্রস্থে অনাসক্ত জীবনের কথা বলা হয়েছে। ভোগ ও ত্যাগের প্রতি একইভাবে এই গুরুত্ব প্রদান ভারতীয় দর্শনের এক অভূতপূর্ব বৈশিষ্ট্য। কেবল চার্বাক ছাড়া বাদবাকি ভারতীয় দর্শনে মনে করা হয় অবিদ্যা বা অজ্ঞতাই হলো সকল দুঃখের কারণ। তাদের মতে মানুষ দুঃখ পায় কারণ সে তার আত্মার প্রকৃত স্বরূপ জানে না। আত্মার সংকীর্ণ চেতনা থেকে উদ্ভূত হয় মানুষের ঘৃণা ও আসক্তি। আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি করলে প্রিয় ও অপ্রিয়র পার্থক্য দূরীভূত হয় এবং সব মানুষই এক পরম সত্তার প্রকাশ বলে মানুষ জানতে পারে। সুতরাং তখন দুঃখও দূরীভূত হয়। অনাত্মবাদী বৌদ্ধ দর্শনে এই আত্মার স্থলে প্রতীত্য-সম্যুপাদ নীতিকে প্রয়োগ করা হয়েছে।
(১০) ভারতীয় দর্শনে একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো, যুক্তিনিষ্ঠ চার্বাক দর্শন ছাড়া বাকি দর্শনগুলিতে যুক্তি ও বিশ্বাসের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। জ্ঞানবিদ্যা, তত্ত্ববিদ্যা, যুক্তিবিদ্যা প্রভৃতির চুলচেরা আলোচনায় যুক্তি-তর্কের উৎকর্ষে খুবই সম্মানজনক উচ্চতায় আসীন হলেও শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় উদ্দেশ্য সিদ্ধিই ভারতীয় দর্শনের মূল লক্ষ্য হিসাবেই চিহ্নিত হয়।
● ষড়দর্শন অর্থাৎ ছয়টি দর্শন প্রসঙ্গে আলোচনার পর চার্বাক দর্শনের আলোচনায় পুনরায় প্রবেশ করা প্রয়োজন, এই বিবেচনায় চার্বাক দর্শন প্রসঙ্গে কিছু বিষয়ের অবতারণা করছি। প্রখ্যাত দর্শন গবেষক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হলোঃ ‘‘এ হেন মহানরকেই নাস্তিক চার্বাকের স্থান। অবশ্য সাধারণত মরবার পর নরকে যাবার কথা। কিন্তু চার্বাকের অবস্থা তা নয়। মহানরকবাসের জন্য তার মরবারও দরকার পড়ে না, জীবদ্দশাতেই ঐ নরকবাস। কেননা, চার্বাকের এমনই মত যে তা মানলে মহানরকের যন্ত্রণা ছাড়া গত্যন্তর নেই।’’ এটা প্রসিদ্ধ ভারতীয় অধ্যাত্মবাদী দার্শনিক বাচস্পতি মিশ্রর বক্তব্য। ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে বাচস্পতি মিশ্র সাধারণ কোনো দার্শনিক নন, দার্শনিক হিসাবে তিনি ছিলেন দিকপাল, নানা প্রসিদ্ধ দার্শনিক সম্প্রদায়ের ব্যাখ্যায় তাঁর গ্রন্থ প্রামাণ্য বলে স্বীকৃত। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়-কৃত উদ্ধৃতিতে বাচস্পতি মিশ্র আরও বলছেনঃ ‘‘চার্বাক প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া আর কোনো প্রমাণই মানে না। তাই অবস্থা জানোয়ারেরও বেহদ্দ...।’’ চার্বাক দর্শন সম্পর্কে এই অতিরঞ্জিত অভিযোগগুলির সম্পর্কে সঠিক ধারণা গড়ে তোলার জন্য চার্বাক দর্শন সম্পর্কে আরও কিছু আলোচনা প্রয়োজন।
চার্বাক দর্শন - আরও কিছু কথা
ভারতের মতো সুপ্রাচীন সভ্যতার দেশে চার্বাক দর্শনের মতো একটি আপসহীন অধর্মীয় ইহলোক সর্বস্ব দর্শন যে গড়ে উঠেছিল এটাই এক বিরাট ঘটনা। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর আলোচনায় বলেছেন যে, চার্বাকরা হয় তো একেবারে নিঃসঙ্গ ছিলেন না। সাংখ্যদর্শনের প্রকৃতি আর ন্যায় দর্শনের স্বভাব-এর ধারণায় চার্বাক দর্শনের বক্তব্যের রেশ রয়ে গেছে। তবে সাংখ্য ও ন্যায় দর্শন বেদপ্রামাণ্য স্বীকার করে ধর্মশাস্ত্রীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল।
● চার্বাক লোকায়ত দর্শন সম্পর্কে জানার সবচেয়ে পরিচিত উৎস সায়ন-মাধব-এর সর্বদর্শনসংগ্রহ। তার প্রথম অধ্যায়েই চার্বাক মতের সারসংকলন করা হয়েছে। বইটি নিজের উদ্যোগে সম্পাদনা করে বিদ্যাসাগর। বলা যেতে পারে এই সম্পাদিত সর্বদর্শনসংগ্রহ থেকে, এদেশে ও বিদেশে, সাধারণ মানুষ প্রাচীন ভারতের আপসহীন নিরীশ্বরবাদী বেদবিরোধী বস্তুবাদী এই দর্শনের কথা জানতে পারলেন। তার আগে এই বিষয়ে পণ্ডিতদেরও জ্ঞান ছিল নামমাত্র। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকার সময়ে (১৮৫১-৫৮), নানা কাজের মধ্যে বিদ্যাসাগর এই মূল্যবান কাজটিও করেছিলেন। শুধু সম্পাদনাই নয়, বইটির বাংলা তর্জমার ব্যবস্থাও করলেন বিদ্যাসাগর।
চার্বাক দর্শন প্রসঙ্গে দুই বিজ্ঞানী
● প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায় ১৯০৯ সালে লেখেনঃ ‘‘ভারত যে শাস্ত্রবাদগ্রস্ত হইয়া চিরকাল কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল এমন নহে। প্রাচীন ভারতে অনুসন্ধিৎসা-বৃত্তি যথেষ্টই বলবতী ছিল এবং স্বাধীন চিন্তার স্রোত অপ্রতিহতভাবে প্রবাহিত হইয়াছিল।... চার্বাক মুনি শ্রুতিও অগ্রাহ্য করিয়া ঘোষণা করিলেন ...।’’
● আর একজন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। ১৯৩৯-এ তিনি লেখেনঃ ‘‘[অনিলবরণ রায়] কী জানেন না যে লোকায়ত মতে অর্থাৎ খ্রিস্টের কিছু পূর্বে ভারতের একদল যুক্তিবাদী ছিলেন, যাঁহারা মনে করিতেন যে বেদের প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করা দুরূহ, শুধু কতগুলি ভণ্ড লোকে বেদের দোহাই দিয়া ভ্রান্তমত প্রচার করে। এখনও এই শ্রেণির লোকের অভাব নাই ...।’’
চার্বাকী সিদ্ধান্তের আলোচনা
● প্রত্যক্ষই প্রমাণশ্রেষ্ঠ - চার্বাক দর্শন সম্বন্ধীয় বিভিন্ন গ্রন্থে চার্বাক নামের সঙ্গে প্রত্যক্ষ প্রমাণবাদিতা অঙ্গাঙ্গীভাবে বিজড়িত। এভাবে বলাও হয়েছে, ‘‘লোকায়তশাস্ত্র মতে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। ...বাচস্পতি বা বৃহস্পতি প্রণীত এই লোকায়ত শাস্ত্রমতটিকে চার্বাক শিষ্য-প্রশিষ্যের মাধ্যমে চতুর্দিকে প্রচার করেন।’’ বেদান্ত অনুসারী সায়ন মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থের চার্বাক দর্শনের বর্ণনায় বলা হয়েছে - ‘‘একমাত্র প্রত্যক্ষকে প্রমাণ বলেন বলে, অনুমান প্রভৃতি প্রমাণ অস্বীকার করেন বলে দেহাতিরিত্ত আত্মাতে অনুমান প্রভৃতি প্রমাণ নয়।’’
‘অদৃষ্ট’ স্বীকারে চার্বাকদের আপত্তি; কারণ দৃষ্টিসীমার বহির্ভূত হওয়ার ফলে প্রত্যক্ষের মাপকাঠিতে ‘অদৃষ্ট’ বিচারযোগ্য নয়। অদ্বৈত বেদান্তের প্রবর্তক শংকরাচার্যের ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে -
‘‘লোকায়তিকেরা বলেন, যা কিছু প্রত্যক্ষসিদ্ধ তা-ই আছে। অদৃষ্ট যেহেতু দেখা যায় না সেহেতু অদৃষ্ট বলে কিছু নেই।....’’
চার্বাক দর্শনঃ পাঁচটি লক্ষণ
১। ভূতবাদ - মাটি, জল, আগুন আর বাতাস এই চারটি উপাদানই একমাত্র বাস্তব। সমস্ত জড় ও জীবের দেহই এগুলির এক বা একাধিক উপাদান দিয়ে তৈরি। এই চারটি উপাদানের এক বিশেষ সমবায়েই দেখা দেয় চেতনা বা চৈতন্য। এই চেতনা দেহ ছাড়া থাকতে পারে না।
২। স্বভাববাদ - উপনিষদের যুগে, আরও কয়েকটি মতবাদের সঙ্গে এটিও একটি আলাদা দার্শনিক মত ছিল। ঈশ্বর, নিয়তি, কাল ইত্যাদির বদলে বস্তুর নিজের স্বভাবকেই জগতের বৈচিত্র্যের কারণ বলে ধরা হতো। কালক্রমে আংশিকভাবে এটি চার্বাক দর্শনের অঙ্গ হয়ে যায়।
৩। প্রত্যক্ষ-প্রাধান্যবাদ - জ্ঞানের উৎস হিসাবে প্রাণী দেহের বাইরের কোনো বস্তুর সঙ্গে কোনো প্রাণীর ইন্দ্রিয়র সংযোগকেই নিশ্চিত জ্ঞান বলে ধরা হয়। যে জানার ক্ষেত্রে এমন কোনো প্রত্যক্ষ সংযোগ নেই তাকে প্রমাণ বলে স্বীকার করা হয় না। এই কারণেই ঈশ্বর, পরলোক, আত্মা, পুনঃজন্ম, সর্বজ্ঞ পুরুষ - এইসব ধারণা চার্বাক দর্শনে খারিজ, যেহেতু ইন্দ্রিয় দিয়ে এগুলি প্রত্যক্ষ করা যায় না। কোনো অনুমান বা আপ্তবাক্য (কোনো শাস্ত্রে লেখা আছে বা জ্ঞানী লোকেরা বলেছেন এমন কথা) যদি প্রত্যক্ষমূলক বা প্রত্যক্ষ নির্ভর হয়, চার্বাকদের তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু অ-লৌকিক বিষয়ে স্রেফ অনুমানের ভিত্তিতে বা বেদ-পুরাণ, অমুক ঋষি, তমুক মুনির বচন বলে কোনো কথা গ্রাহ্য হতে পারে না। চার্বাক বিরোধীরা এই বক্তব্যটিকে বিকৃতভাবে প্রচার করেন।
৪। পুনঃজন্ম ও পরলোক বিলোপবাদ - দেহ ছাড়া কোনো ক্ষণিক বা অমর আত্মাকে চার্বাক দর্শনে স্বীকার করা হয় না। আগের তিনটি ধারণা থেকে এটা অনিবার্যভাবেই আসে। ফলে জন্মান্তর, কর্মফল, স্বর্গ-নরক, অদৃষ্ট সবই বাতিল।
৫। বেদপ্রামাণ্য-নিষেধবাদ - ঈশ্বর বলে কেউ আছেন - কয়েকটি দর্শনে একথা মানা হয়নি। (সাংখ্য, মীমাংসা তো বটেই, ন্যায়সূত্রর কোথাও ঈশ্বরের নাম গন্ধ নেই।) বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনেও ঈশ্বরকে স্বীকার করা হয় না। কিন্তু নিরীশ্বরবাদী হলেও সাংখ্য ও মীমাংসাকে ‘আস্তিক’ বলে ধরা হয়। তার কারণ দুইটিঃ
(১) এ দুইটি দর্শনে পরলোককে স্বীকার করা হয়েছে, আর
(২) বেদকে অভ্রান্ত বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। বেদ কার রচনা, মানুষের নাকি সাক্ষাৎ ঈশ্বরের - এই প্রশ্ন নিয়ে আস্তিক দর্শনগুলির মধ্যেও বিস্তর তর্কাতর্কি চলত। তবে সব আস্তিকই একটি ব্যাপারে একমত, তা হলো বেদবাক্যে কোনো ভুল থাকতে পারে না। ইতিমধ্যেই আলোচনা করা হয়েছে যে, চার্বাক (লোকায়ত), জৈন ও বৌদ্ধ এই তিনটি দর্শনই নাস্তিক; পরলোক না মানার কারণে নয় (বৌদ্ধ ও জৈনরা তা অবশ্যই মানেন), বেদপ্রামাণ্য না মানার কারণে।
(ক্রমশ)