E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১৫ সংখ্যা / ২৬ নভেম্বর, ২০২১ / ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

তিন বছর ব্যাপী সংগ্রামের পর ব্যাঘ্র অভয়ারণ্যে পাট্টা পেলেন তামিলনাডুর কাদার আদিবাসীরা


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ তামিলনাড়ুর ইতিহাসে প্রথমবার এই ঘটনা ঘটল। রাজ্যের কোনো সংরক্ষিত অভয়ারণ্য থেকে আদিবাসী মানুষ উচ্ছেদ হবার পর ফিরে পেলেন তাঁদের বাসস্থান। ঘটনাটি ঘটেছে কোয়েম্বাটুর জেলায়। সিপিআই(এম)’র প্রত্যক্ষ সহায়তায় আদিবাসী-মানুষের তিন বছর ব্যাপী সংগ্রামের ফল মিলল। আদিবাসী কাদার গোষ্ঠী ওই জেলার সংরক্ষিত আন্নামালাই ব্যাঘ্র অভয়ারণ্যে তাদের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যবাহী বন ভূমিতে বসবাসের আইনি অধিকার পুনরায় ফিরে পেলেন, পেলেন বসবাসের জন্য বাড়ির পাট্টা।

২০১৯ সালে ওই অভয়ারণ্যের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কাদার আদিবাসী গোষ্ঠীর ২৩ টি পরিবারের বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। যদিও ওই ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি, তা হলেও ওই আদিবাসীরা তাদের আশ্রয় স্থল, বসবাসের জায়গা এবং জীবন-জীবিকা সবই খোয়ায়। তারপর থেকেই প্রশাসন তাঁদের ওই জায়গায় বসবাসের অনুমতি দিচ্ছিল না। ছিন্নমূল আদিবাসী মানুষ জেলা প্রশাসনের কাছে তাঁদের বাড়ি গড়ে তোলার অনুমতির জন্য আবেদন জানাতে থাকে। কিন্তু তাঁদের আর্তি বারবার অগ্রাহ্য করে প্রশাসন।

বনদপ্তর তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে জানায় যে বনের গভীরে ‘কোর এরিয়া’য় তাদের জন্য বসবাসের জায়গা দেওয়া যাবে না। এর পরিবর্তে তারা তামিলনাডু টি বোর্ড’র অনুর্বর জমি যা খালি করে দিয়েছিল টি বোর্ড কর্তৃপক্ষ, সেটি বরাদ্দ করতে রাজি হয়। কিন্তু গভীর জঙ্গলে থাকতে অভ্যস্ত আদিবাসীরা আন্নামালাই ব্যাঘ্র অভয়ারণ্য-যা তাদের পূর্বপুরুষদের বসবাসের ঐতিহ্যবাহী সেই থেপাক্কালুডুতে তাদের জমি ফেরত দিতে বলে।

প্রসঙ্গত, ২০০৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর সংসদে বন অধিকার বিল, যে বিলে বনভূমির ওপর নির্ভরশীল আদিবাসী সহ অন্যান্য অংশের মানুষের বনভূমির অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে, তা পেশ করা হয়। সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর সদস্য বৃন্দা কারাত এবং আদিবাসী নেতা সাংসদ বাজুবন রিয়াঙ-এই দুজনের ঐকান্তিক ভূমিকায় এই বিলটিকে আইনে পরিণত করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং তা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সমর্থ হয়। সিপিআই(এম) সহ বামপন্থীদের প্রচেষ্টায় এই বিলটিতে আদিবাসী-মানুষের অধিকারের স্বীকৃতি সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বামপন্থী দলগুলির সংসদের ভেতরে এবং বাইরে তীব্র আন্দোলনের জেরে এই বিলটি আইনে পরিণত হবার দাবি ওঠে দেশজুড়ে। ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স-১ (ইউপিএ) সরকারের গড়িমসি এবং একাধিকবার বিলটিকে আইনে পরিণত করার ক্ষেত্রে নানা বিরোধিতা সত্ত্বেও ২০০৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিলটি আইনি স্বীকৃতি পায়। এরপর বামপন্থী দলগুলি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই আইনটিকে চালু করার ক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানালে ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে আইনটি কার্যকর হয়।

বন অধিকার আইন বা এফআরএ-তে ঐতিহ্যগতভাবে যে সমস্ত অধিকার আদিবাসী মানুষ ভোগ করে থাকেন যেমন বনভূমিতে থাকার জায়গা, চাষাবাদ, পশুচারণ এবং বনের বিভিন্ন গৌণ বনজ দ্রব্য আহরণ করা, সংগ্রহ করা ইত্যাদি বিষয়ের স্বীকৃতি রয়েছে। শুধুমাত্র শিকার এবং অন্যান্য বিধিভুক্ত নয় এমন বিষয়গুলির কোনও স্বীকৃতি নেই ওই আইনে।

কিন্তু আন্নামালাই ব্যাঘ্র অভয়ারণ্য প্রকল্পে এই নয়া আইন মোতাবেক আদিবাসীদের অধিকার এর সপক্ষে বসবাস কৃষিকাজ ইত্যাদি করতে দেওয়া হচ্ছিল না। তামিলনাড়ুর বনদপ্তর এ প্রসঙ্গে দিল্লির অভয়ারণ্য সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় বনদপ্তরের থেকে সবুজ সঙ্কেত চাইছিল। এর মধ্যেই তামিলনাডুর রাজস্ব দপ্তর একটি বিকল্প জায়গা দেখিয়ে আদিবাসীদের সেই জমিটি ব্যবহার করতে বলছিল বসবাস করার জন্য।

এই পরিস্থিতিতে কাদার আদিবাসীরা প্রতিবাদের পথ বেছে নেন। এবছর অক্টোবর মাসের ২ তারিখ থেকে তারা আন্দোলনে নেমে পড়েন। তাদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে তামিলনাডু ট্রাইবালস অ্যাসোসিয়েশন (টিটিএনএ) তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। অ্যাসোসিয়েশন এবং পার্টিকর্মীরা তাদের থেপাক্কালুডুতেই তাদের পুনরায় থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। আদিবাসীদের ওই সংগঠনের পক্ষ থেকে বিস্তারিত ভাবে বুঝিয়ে বলা হয় যে তাদের সেখানে আইন মোতাবেক বসবাস করার অধিকার রয়েছে।

ওই বনে তাদের বসবাসের ব্যবস্থা করে ফিরে আসার পথে বনকর্মীদের প্রশ্নের মুখে পড়েন ট্রাইবালস অ্যাসোসিয়েশন এবং সিপিআই(এম) কর্মীরা। তাঁদের বনকর্মীরা বলেন, গভীর বনভূমিতে হিংস্র জানোয়ার সহ অন্যান্য সমস্যা রয়েছে যা জীবন জীবিকা নির্বাহের পক্ষে সহজ হবে না। তাই তারা আদিবাসীদের বিকল্প জমিতে যেতে বলে আবার। এ প্রসঙ্গে আদিবাসীদের সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয় যে আদিবাসী মানুষ জঙ্গলের সম্ভাবনা এবং আশঙ্কার যাবতীয় বিষয়গুলি মাথায় রেখেই সেখানে থাকতে পছন্দ করেন এবং ভালোবাসেন। আদিবাসীরা এভাবেই বনে থাকতে অভ্যস্ত। তাই তারা সেখানেই থাকতে চান এবং তাদের সে অধিকার রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে তারা আরও উল্লেখ করেন বন অধিকার আইনে উল্লিখিত ধারায় রয়েছে ২০০৫ সালের ১৩ ডিসেম্বরের আগে যারা বনে, গভীর জঙ্গলে এবং পর্বতের উপরে প্রকৃত বসবাস করতেন, তাদের বনে নির্দিষ্ট জায়গায় বসবাসের অধিকার রয়েছে এবং তাদের আইনি পুনর্বাসন না দিয়ে বেআইনিভাবে উচ্ছেদ করা বা অন্যত্র বসবাসে বাধ্য করা আইনত দণ্ডনীয়। প্রাথমিকভাবে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নিজভূমে ফেরার পরেই বসবাসের পাট্টার জন্য আদিবাসীরা আবেদন করেন।

৪ অক্টোবর টিটিএনএ’র পক্ষ থেকে এক বৈঠকে রাজস্ব দপ্তর, বনদপ্তর এবং অভয়ারণ্যের আধিকারিকদের সামনে যখন পাট্টা দেবার জন্য আদিবাসীদের দাবি তুলে ধরা হয় তখন সবকটি প্রশাসনিক দপ্তর এ ব্যাপারে সম্মত হয়।

কিন্তু তা সত্ত্বেও গড়িমসি চলতে থাকে। দিল্লির সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে সম্মতির অপেক্ষায় তামিলনাড়ুর আধিকারিকরা বিষয়টিকে পিছোতে থাকেন এবং আদিবাসীদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যময় বাসস্থান আইনি পদ্ধতি মেনে ফেরত দিতে অনীহা দেখাতে থাকেন।

এই পরিস্থিতিতে কোয়েম্বাটুর-এর সিপিআই(এম) সাংসদ পি আর নটরাজন কাদার আদিবাসী গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের নিয়ে জেলা কালেক্টরের অফিসে যান এবং অবিলম্বে এ বিষয়ে তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে বলেন। ওই কালেক্টর তৎক্ষণাৎ দাবি মেনে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিলে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা ওই ইস্যুর সমাধান হয়।

এই পদক্ষেপে আদিবাসী মানুষদের সঙ্গে সিপিআই(এম) সাংসদ সহ টিএনটিএ শুধু নয়, যুক্ত ছিল একতা পরিষদ। সম্মিলিত ঐক্যের ভিত্তিতে আন্দোলনের জেরে এই সাফল্য আসে। কাদার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে এই সাফল্যে খুশির ঢেউ ওঠে। আইনগতভাবে অধিকার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা মেতে ওঠেন আনন্দে। কারণ জঙ্গলে প্রবেশের ক্ষেত্রে আর তাঁরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন, এটা বন অধিকার আইন বলে তাদের অর্জিত আইনি অধিকার।

এই পরিস্থিতে ৭ নভেম্বর এই অধিকার লাভের পর আদিবাসী মানুষ লাল ঝান্ডার তলায় জড়ো হয়ে উৎসবে মেতে ওঠেন। এই অংশের মানুষ তাদের অধিকার যে লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে ফিরে পেয়েছেন ওই দিনে, এই মহাসমাপতন রুশ বিপ্লবের বিজয় দিবসের তাৎপর্যকে মনে করিয়ে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট সকলকেই।