E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১৫ সংখ্যা / ২৬ নভেম্বর, ২০২১ / ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

সিআইটিইউ সারা ভারত জেনারেল কাউন্সিল সভার আহ্বান

কেন্দ্রীয় সরকারের মানুষমারা নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলো

দেবাঞ্জন চক্রবর্তী


সিআইটিইউ’র জেনারেল কাউন্সিল সভায় রিপোর্ট পেশ করছেন তপন সেন।

গত ১৬-১৮ নভেম্বর ২০২১ হায়দরাবাদে (তেলেঙ্গানা) ‘সুন্দরাইয়া বিজ্ঞান কেন্দ্রে’ অনুষ্ঠিত হলো সিআইটিইউ’র সারা ভারত জেনারেল কাউন্সিল সভা। ৩৫২ জন কাউন্সিল সদস্য এই সভায় যোগদান করেছেন। এই সভায় ১৬ রাজ্য থেকে ২৪৫টি ইউনিয়ন সিআইটিইউ’র অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছিল। এদের মোট সদস্য সংখ্যা ১,১৮,৩৩৬। এই আবেদনগুলি মঞ্জুর হয়।

এই সভার সূচনা হয় সিআইটিইউ’র পতাকা উত্তোলনের মধ্য ‍‌নিয়ে। এই রক্তপতাকা উত্তোলন করেন সিআইটিইউ’র সভাপতি কে হেমলতা। শহিদ বেদিতে নেতৃবৃন্দ মাল্যদান করেন।

সভায় হেমলতা বলেনঃ কোভিড অতিমারী আমাদের আবারও প্রমাণ করলো সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার থেকে অনেক উন্নততর। মানুষের জীবনের মূল্য ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় কতটা তা বোঝা গেল স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থার সংকটপূর্ণ চেহারায়। যা চলছে একমাত্র মুনাফার উপর ভিত্তি করে। এই সময়কালে মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় চাহিদাও পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে ধনতান্ত্রিক দেশগুলি।

এই অতিমারীর সময়কালে বিশ্বের ১% ধনী ব্যক্তি তাদের সম্পত্তি বাড়িয়েছে ৩২% এবং ভারতে ১% ধনী ব্যক্তি তাদের সম্পত্তি বাড়িয়েছে ৩৫%। রাষ্ট্রসঙ্ঘের রিপোর্ট বলছে মার্চ-ডিসেম্বর ২০২০ মধ্যে অত্যন্ত গরিব মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১১৯ মিলিয়ন-২২৪ মিলিয়নে। এই সংখ্যা বৃদ্ধিটা হলো বিগত ২১ বছরে সবচেয়ে বেশি।

আইএলও বলেছে - অক্টোবর ২০২১, বিশ্বব্যাপী পূর্ণ সময়ের কাজ কমেছে ১২৫ মিলিয়ন - অতিমারীর আগে যা ছিল তার থেকে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ বলেছে ২০২০’তে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ৭২০ থেকে ৮১১ মিলিয়ন হয়েছে। যা ২০১৯’র তুলনায় ১৬১ মিলিয়ন বেশি।

।। দুই ।।

৭৫% ভ্যাকসিন ব্যবহৃত হয়েছে ১০টি ধনী দেশে। ব্রিটেন তার দেশের ৬৮% নাগরিককে দুটি ডোজ দিয়েছে। আমেরিকা তার দেশের ৫৮% নাগরিককে দুটি ডোজ দিয়েছে। কিন্তু আফ্রিকা মহাদেশে ৫৪টি দেশের মোট নাগরিকের মাত্র ১০% কে দুটি ডোজ দেওয়া গেছে।

এই অতিমারীর সময়কালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছাঁটাই, বেতন না দেওয়া, বেতন কাটা, পেনশন কমিয়ে দেওয়া এবং অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা কমিয়ে দেওয়া, কাজের ঘণ্টা বাড়িয়ে দেওয়া, শ্রম আইন লাগু না করা ইত্যাদি সবই চলেছে মালিকদের পক্ষ থেকে। এই আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, আন্দোলন, বিক্ষোভ, ধর্মঘটও সংগঠিত হচ্ছে - ফ্রান্স, ডেনমার্ক, গ্রিস, ইতালি, পর্তুগাল, স্পেন এবং অন্যান্য ইয়োরোপীয় দেশগুলিতে ও আমেরিকা এবং দক্ষিণ আফ্রিকায়।

সাধারণ সম্পাদক কমরেড তপন সেন তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে - ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে সিআইটিইউ’র ১৬তম সারা ভারত সম্মেলনের পরে আমরা এখানে মিলিত হয়েছি। এই মধ্যবর্তী সময়ে মানুষের জীবন-জীবিকাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে - (ক) কোভিড অতিমারী, (২) কোভিড অতিমারী নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক ক্রমবর্ধমান আক্রমণ সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার উপর, (৩) ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন সহ শ্রমিকশ্রেণি ও কৃষকদের যৌথ আন্দোলন-সংগ্রাম।

সিআইটিইউ’র কাছে এটা অত্যন্ত গর্বের বিষয় যে, আমাদের সংগঠনের সমস্ত কমিটি স্তরেই আমাদের কমরেডরা পরিযায়ী শ্রমিকদের, যাঁরা কাজ হারিয়েছেন এরকম শ্রমিকদের যতটা সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করেছে।

।। তিন ।।

২৩/৩/২০২০ প্রধানমন্ত্রী আচমকা দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করেছিলেন দেশের জনগণকে প্রস্তুত হবার সময় না দিয়ে। কোভিড অতিমারীকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে দেশের জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে শক্তিশালী না করে জনগণের জীবন-জীবিকার উপর আক্রমণ হেনেছে সরকার। ফলে শ্রমিকরা, বিশেষ করে পরিযায়ী শ্রমিকরা, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক সহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পসমূহকে হঠাৎই ঠেলে দেওয়া হলো এক ভয়ংকর পরিস্থিতিতে।

‘সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি’-র রিপোর্ট অনুযায়ী কয়েক কোটি মানুষ অতিমারীর কারণে তাদের কাজ / চাকরি হারিয়েছে। নির্মাণ, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, পরিবহণ, ছোটো ব্যবসা ইত্যাদি সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী লকডাউনের প্রথম ধাপে ১৪ কোটি মানুষ তাদের জীবিকা হারিয়েছেন। করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গে ২০২১-এর এপ্রিল-মে মাসে ২.২০ কোটির বেশি লোক তাদের জীবিকা হারিয়েছেন। সাম্প্রতিক আইএলও’র এক সমীক্ষা অনুযায়ী আমাদের দেশে সংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের মজুরি গড়ে ৩.৬% কমেছে এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের মজুরি কমেছে ২২.৬%।

ভারতে এখন বেকারের হার ৯%, যুবকদের মধ্যে এই হার ২০%। গত বছর ২১.৮ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

এফআইসিসিআই (মালিকদের সংগঠন)-এর একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে - প্রায় ৫৮% ব্যবসার উপর ২০২১ সালের এপ্রিল-মে মাসের রাজ্যস্তরের লকডাউনের প্রভাব পড়েছে খুব বেশি এবং ৩৮% ক্ষেত্রে এই প্রভাব মাঝারি। গ্রামীণ ব্যবসায় বাজারে বিক্রি কমেছে ৭১%।

।। চার।।

এই সময়কালে কেন্দ্রীয় সরকার ৪টি শ্রম কোড সংসদে পাশ করিয়েছে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নসমূহের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও। এই কোডের ফলে মালিক যখন খুশি ছাঁটাই, লে-অফ, লকডাউন করতে পারবে সরকারের অনুমোদন ছাড়াই। ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ১২ ঘণ্টা কাজ চালু করার কথাও বলা রয়েছে এই শ্রম কোডে। বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রের সামাজিক সুরক্ষা স্কিম বাতিল করে সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা স্কিম চালু করার নাম করে শ্রমিকদের ভাঁওতা দেওয়া হচ্ছে।

এই লকডাউন সময়কালে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি-শাসিত রাজ্য - উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, আসাম, কর্ণাটক, ত্রিপুরায় এবং কংগ্রেস-শাসিত রাজ্য - রাজস্থান ও পাঞ্জাব এই আইন (কোড) লাগু করেছে। সাথে বিজেডি পরিচালিত ওডিশা সরকারও আছে।

কেন্দ্রীয় সরকার ‘ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপ লাইন’-এর মাধ্যমে কর্পোরেট পুঁজির কাছে জনগণের সম্পত্তি পাচার করার আগ্রাসী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। উদাহরণ - (ক) ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার অধীনে বর্তমানে জাতীয় সড়ক রয়েছে ১,৩২,৪৯৯ কিমি রাস্তা। যার মধ্য থেকে ২০২২-২০২৫ সালের মধ্যে ২৬,৫০০ কিমি রাস্তা অর্থাৎ ২২% জাতীয় সড়ক মাত্র ১ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকায় কর্পোরেট পুঁজির হাতে তুলে দেওয়া হবে।

২০২২-২০২৫ - এই ৪ বছরে ৪০০টি রেল স্টেশন এবং ৯০টি যাত্রী পরিবাহী ট্রেন, ১টি রুটের ১৪০০ কিমি রেলপথ, কোঙ্কন রেলওয়ের ৭৪১ কিমি রেলপথ, ১৫টি রেলওয়ে স্টেডিয়াম, কয়েকটি নির্দিষ্ট রেল কলোনি, ২৬৫টি রেলওয়ে গুডস সেড, ৪টি হিল রেলওয়েজ ১,৫২,৪৯৬ কোটি টাকায় বিক্রি করা হবে।

।। পাঁচ।।

এছাড়া বিমানবন্দর, পাওয়ার ট্রান্সমিশন লাইন ১৬০টি কয়লা খনি, তেল ও গ্যাস পাইপলাইন কোনো কিছুই বাদ নেই এই বিক্রির তালিকায়।

এই আক্রমণের মধ্যেও কোভিড-অতিমারীর সময়ে সিআইটিইউ এককভাবে নানাভাবে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে শামিল হয়েছে। লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ সেইসব প্রতিবাদ কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন।

২০/১১/২০২০ সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘটে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গেছে। এই ধর্মঘট শ্রমিক-কৃষক-কৃষি শ্রমিক - এই যৌথ আন্দোলনে ভারতে এক নবদিগন্তের সূচনা করেছে। ১৫ ও ১৬/৩/২০২১ - ব্যাঙ্ক কর্মীরা বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে ধর্মঘট করেছেন। ১৭/৩/২১ জেনারেল ইন্সিওরেন্স কর্মীরা ধর্মঘট করেছেন। ১৮/৩/২১ জীবনবীমার কর্মীরা ধর্মঘট পালন করেছেন। ২০/৬/২১ ইস্পাত শ্রমিকরা ধর্মঘট করেছেন। প্রতিরক্ষা কর্মীরা লাগাতার ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নিয়েও করতে পারেনি ধর্মঘট বেআইনি ঘোষণা করায়। ভাইজাগ ইস্পাত কারখানার শ্রমিকরা ২৫০ দিনের বেশি অবস্থান-বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে।

নির্মাণ শ্রমিকরা সারা ভারত নির্মাণ শ্রমিক ফেডারেশনের আহ্বানে আগামী ২ ও ৩রা ডিসেম্বর ‘নির্মাণ কল্যাণ পর্ষদ’ তুলে দেওয়ার প্রতিবাদে সারা ভারত ধর্মঘটে যাচ্ছে।

এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যুক্ত আন্দোলনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে এবং তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

।। ছয়।।

জেনারেল কাউন্সিল সভায় বলা হয়েছে -
প্রতিটি ওয়ার্ড, ব্লক, পঞ্চায়েত এলাকায় আমাদের সমন্বয় কমিটি গড়ে তুলতে হবে। শহরে এবং গ্রামে শ্রমজীবী মানুষের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। বিশেষ করে পরিযায়ী শ্রমিকদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।

রাজ্যে রাজ্যে মহিলা সমন্বয় কমিটি গড়ে তুলে শ্রমজীবী মহিলাদের সংগঠিত করে আন্দোলন করার উদ্যোগ নিতে হবে।

সিআইটিইউ’র মাসিক পত্রিকা ইংরেজি এবং হিন্দিতে প্রকাশিত হয়। তার ব্যাপক প্রচার করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে রাজ্যে রাজ্যে।

এই সভায় আগামী যেসব কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে সেগুলি হলো -
(১) ২৬/১১/২১ সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ করতে হবে।
(২) এনএমপি, শ্রমিক কোড, পরিযায়ী শ্রমিকদের দাবিসমূহ অসংগঠিত শ্রমিকদের দাবিসমূহ, ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপক প্রচার করতে হবে সারা দেশে সর্বস্তরে।
(৩) ডিসেম্বর ২০২১ - জানুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত দেশের সর্বত্র ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ দু'দিনের সাধারণ ধর্মঘটের দাবিসমূহ ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে।
(৪) সারা ভারত শ্রমজীবী মহিলা কনভেনশন অনুষ্ঠিত করতে হবে আগামী বছরে (২০২২)।
(৫) ১৯/১/২০২২ দেশের সর্বত্র উদ্‌যাপন করতে হবে ১৯/১/১৯৮২ সালে ডাকা প্রথম সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘটের ৪০ বছর।

এই সভায় নিম্নলিখিত প্রস্তাবসমূহ পাশ হয় -
(১) পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি কমানোর দাবিতে;
(২) মহারাষ্ট্রে পরিবহণ শ্রমিকদের লাগাতার ধর্মঘটের সমর্থনে;
(৩) ২০২০-র নতুন শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে প্রস্তাব;
(৪) সরকারি সম্পদ বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে প্রস্তাব;
(৫) মহিলা, দলিত এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রস্তাব।

এই সভায় বিইএফআই, প্রতিরক্ষা কর্মী ফেডারেশন, বিএসএনএল, এমএসআরইউ, বিমা কর্মী ফেডারেশন, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী ফেডারেশন-এর প্রতিনিধিরা তাদের শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রের বর্তমান অবস্থা এবং আগামী আন্দোলন কর্মসূচি সম্পর্কে বলেছেন।