৫৯ বর্ষ ১৫ সংখ্যা / ২৬ নভেম্বর, ২০২১ / ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮
দিকে দিকে ভেঙেছে যে শৃঙ্খল
নন্দিনী মুখার্জি
অমৃতসরে কৃষক আন্দোলনের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন মহিলা সহ অন্যান্যদের।
করোনার তৃতীয় ঢেউ আসবে কী না, দু’টি রাজনৈতিক দলের নেতা, কর্মীরা কতবার এক দল থেকে অন্য দলে যাওয়া আসা চালাবেন, বলিউড ও টলিউডের তারকাদের জীবনের নানারকম রঙিন গল্প - এই সবকিছু নিয়ে যখন সংবাদ মাধ্যম শহুরে মানুষকে ব্যস্ত রেখেছে - ঠিক তখনই এক বছর ধরে চলে আসা কৃষক আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলো দেশের প্রতাপশালী মোদি সরকার। ১১ মাস আগে, এই কৃষক আন্দোলন শুরু হওয়ার মাসখানেকের মধ্যে মনে হয়েছিল এইরকম একটি আন্দোলনের সাক্ষী থাকার সুযোগ আর জীবনে ঘটবে না। তাই সোজা পৌঁছে গিয়েছিলাম দিল্লি, এক অনবদ্য অভিজ্ঞতার আস্বাদ নিতে। প্রথমদিন পরিচিতহীন সেই জমায়েতের অংশীদার হয়ে শিহরিত বোধ করেছিলাম। মাইলের পর মাইল অসংখ্য ট্র্যাক্টর লাইন দিয়ে দাঁড় করানো। তার ফাঁকে ফাঁকে কোথাও তাঁবু, কোথাও মঞ্চ, কোথাও রান্না হচ্ছে, কোথাও খাবার বিতরণ চলছে। আর এর মধ্যে দিয়েই চলাফেরা করছেন অসংখ্য মানুষ। চতুর্দিকে তাকালেই পতাকা, পোস্টার, ব্যানারের ছড়াছড়ি। তার মধ্যে একটা পোস্টার চোখ টানে - “হম কিষান হ্যায় আতঙ্কবাদী নহি, We are Farmers not Terrorists”।
চলতে চলতে মনে হচ্ছিল “সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ”। এখানে অন্নদাতা কৃষককে ঘোষণা করতে হয় যে, সে কৃষক, দেশের অন্নদাতা, আতঙ্কবাদী নয়। সেই সুবিশাল জনসমুদ্রে চলতে চলতে আমরা ভাবছিলাম - সম্ভব হবে কি? একদিকে একটা ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল পরিচালিত সরকার আর তার পেছনে সম্মিলিত কর্পোরেট শক্তি, আর অপর দিকে সাধারণ কৃষকের দল যার মধ্যে বড়ো, মাঝারি কৃষক ছাড়াও বহু ক্ষুদ্র কৃষক, গরিব খেতমজুর, ভাগচাষি আছে। একদিকে অর্থ ও পেশি শক্তির হুঙ্কার আর অন্যদিকে খেটে খাওয়া মানুষের চোয়ালচাপা অঙ্গীকার। এই অসম লড়াই কতদিন চলতে পারে? এই প্রশ্ন করেই ফেললাম সদ্য আলাপ হওয়া সুখবিন্দর সিংজিকে - “আপনারা কতদিন এইরকম বসে থাকবেন? সরকার যদি না মানে?” সুখবিন্দর সিংজির সোজাসাপটা জবাব - “যতদিন না কালা কানুন প্রত্যাহার হয়। প্রয়োজন হলে দু’বছর আমরা এইভাবেই দিল্লির রাস্তায় বসে থাকব”। মনে সংশয় নিয়েই সেদিন নিজের শহরে ফিরেছিলাম। কিন্তু আজ, ১১ মাস পরে বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে, মানুষ যখন সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে তার অধিকার রক্ষায় রুখে দাঁড়ায়, তখন প্রবল প্রতাপশালী শাসকেরও পরাজয় ঘটা শুধু সময়ের অপেক্ষা।
২০২০ সালের ৫ জুন কেন্দ্রীয় সরকার তিনটি কৃষি আইন জারি করার কথা ঘোষণা করে। বলা হয় এই তিনটি আইন দেশের কৃষি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসতে চলেছে। একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন অবশ্যই উঠে আসে যে, যে সময়ে দেশে লক ডাউন পরিস্থিতি ৯০ দিন অতিক্রম করেছে, দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়তে বাড়তে পাঁচ লক্ষ অতিক্রম করেছে, পরিযায়ী শ্রমিকরা তখনো একটা নিরাপদ জীবনে ফিরতে পারে নি, কর্মহীন হয়ে পড়া বহু মানুষ তখনো পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাচ্ছে না, ঠিক এইরকম একটা সময়ে কৃষক সমাজের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই কেন নতুন আইন জারি করা প্রয়োজন হয়ে পড়ল। ১৭ সেপ্টেম্বর প্রথমে লোকসভা এবং ২০ সেপ্টেম্বর রাজ্যসভায় এই সম্পর্কিত অর্ডিন্যান্স গৃহীত হওয়ার পর পাঞ্জাবের কৃষকরা এই অভূতপূর্ব কৃষক আন্দোলনের সূচনা ঘটান তিন দিন ব্যাপী রেল রোকো-র মাধ্যমে। ২৫ সেপ্টেম্বর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকরা এই তিনটি বিলের প্রতিবাদে পথে নামেন। ৩রা নভেম্বর, ২০২০ সারা দেশ জুড়ে রাস্তা রোকো প্রতিবাদ আন্দোলনের পর ২৫ নভেম্বর ২০২০ পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা দিল্লি চলো ডাক দেন। দিল্লি পুলিশ তাঁদের দিল্লি প্রবেশের অনুমতি না দিলে তাঁরা সেই জাতীয় সড়কেই বসে পড়েন। এখানেই গড়ে ওঠে তাঁদের অস্থায়ী আস্তানা, আর তাকে ঘিরে প্রতিবাদ কর্মসূচি। ক্রমশ তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও আরও অন্যান্য রাজ্যের অসংখ্য কৃষক। দিল্লি প্রবেশের মুখে বিভিন্ন জাতীয় সড়কগুলিতে তাঁরা কাতারে কাতারে এসে অসংখ্য জমায়েত তৈরি করেন। সিঙ্ঘু বর্ডার, টিকরি বর্ডার, গাজিপুর বর্ডার - এইভাবে চিহ্নিত হয় তাঁদের জমায়েতগুলি। যেন দেশের মধ্যেই দেশের রাজধানী ঘিরে তৈরি হলো অনেকগুলি সীমানা - যে সীমানা পেরনোর অধিকার নেই সাধারণ কৃষকের। তাই সীমানায় বসেই শাসকের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে তাঁরা অবস্থান চালিয়ে যান তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবি নিয়ে। কৃষক নেতারা এর মধ্যে বহুবার সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন, কিন্তু সবসময়েই তাঁদের ফিরতে হয়েছে শূন্য হাতে। ২৬ জানুয়ারি প্রতিবাদী কৃষকরা একযোগে দিল্লি প্রবেশ করলে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ বাঁধে এবং আবার তাঁদের সন্ত্রাসবাদী হিসাবে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে।
জাতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলির অবিরত প্রচারে একটা সময় বহু শিক্ষিত মানুষ এটাই বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, “প্রকৃতপক্ষে সরকার কৃষকদের ভালোই চাইছেন। কৃষক ও ক্রেতাদের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হলে আখেরে কৃষকের লাভই হবে। লাভবান হবেন ক্রেতারাও”। এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে এবং বিলগুলি কৃষক এবং ভোক্তা উভয়ের উপর কি ধরনের বিপদ নিয়ে আসতে চলেছে সে বিষয়ে সারা ভারত কৃষক সভার নেতৃত্বের বক্তব্য শুনেছিলাম। একই সাথে প্রশ্ন রেখেছিলাম অবসরপ্রাপ্ত এক কৃষিবিদের কাছে যিনি তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে বিষয়টির পর্যালোচনা করতে পারবেন। তাঁর বক্তব্য হলো - “এই আইনে ফসলের বীজ বপনের আগে কৃষককে বৃহৎ ব্যবসায়ী সংস্থা বা তার প্রতিনিধিদের সঙ্গে লিখিত চুক্তি করতে হবে। চুক্তিতে উৎপন্ন ফসলের মূল্যের সঙ্গে তার গুণাগুণও বর্ণনা করতে হবে । ফসলের বীজ বোনবার সময় সরকার ঘোষিত কোনো মূল্যমান না থাকায় কিসের ভিত্তিতে মূল্য ঠিক হবে, গুণাগুণই বা কে ঠিক করবে? ফসল ওঠবার সময় যদি কোনো কারণে বাজারে ফসলের মূল্য কমে যায়, যা আমাদের রাজ্যে আলু পাট ও সবজির ক্ষেত্রে দুই এক বছর অন্তর হয়ে থাকে, তাহলে কি হবে? বা অন্য কোনো কারণে ওই সংস্থা কৃষককে বলতে পারে যে, তোমার ফসল উপযুক্ত মানের হয়নি, যেমন ধানে বা পাটে বেশি রস রয়েছে, গমের দানা তেমন পুষ্ট হয়নি, আলুর আকার সমমানের নয়, ফসলে প্রয়োগ করা কীট ও রোগনাশক রাসায়নিকের অবশেষের পরিমাণ বেশি ইত্যাদি। অতএব ওই সংস্থা ফসল নিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করতে পারে বা দাম কম দিতে পারে। এখনও অসৎ ব্যবসায়ীরা এই কথা বলে থাকেন, কিন্তু এখন কৃষক এক ব্যবসায়ীকে ছেড়ে অন্য ব্যবসায়ীর কাছে যেতে পারে, কিন্তু একবার চুক্তি হয়ে গেলে তার বাইরে কৃষক অন্য কোথাও ফসল বিক্রয় করতে পারবে না। তৃতীয় কোনো পক্ষকে দিয়ে গুণাগুণ বিচার করাতে গেলে তার খরচ রয়েছে, বৃহৎ সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে ও শুনানির জন্য তাকে মহকুমা কর্তৃপক্ষের কাছে কয়েকবার যেতে হবে যা সময় ও খরচ সাপেক্ষ। চুক্তির শর্তাদি ও বিচারে পরামর্শ দেওয়ার জন্য বৃহৎ ব্যবসায়ীদের পক্ষে উকিল বা অন্যান্য আমলা ইত্যাদি ব্যক্তির সাহায্য গ্রহণ সম্ভব হবে। গরিব কৃষকদের জন্য কে থাকবে? আমাদের দেশের প্রশাসন রাজশক্তি ও ধনশক্তির অধীন। অতএব কৃষক সুবিচার পাবেন কিনা সন্দেহ।’’
২৬ জানুয়ারির দু’একটি বিক্ষিপ্ত অনভিপ্রেত ঘটনার পর অধিকাংশ জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে এই অচিন্তনীয় বৃহৎ কৃষক জমায়েতের খবর প্রায় চাপা পড়ে গেল বললেই চলে। আমরা তবু মাঝে মাঝে সামাজিক মাধ্যম থেকে খবর পাচ্ছিলাম উত্তরপ্রদেশে বেশ কয়েকটি জায়গায় কীভাবে মহা পঞ্চায়েত আহ্বান করা হয়েছে। কিভাবে লোটা নুনের শপথ নেওয়া হয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টিকে সার্বিকভাবে বয়কটের সিদ্ধান্ত করে। ধীরে ধীরে আমরাও ভুলতে বসলাম দিল্লির বর্ডারে বসে থাকা লক্ষ লক্ষ অন্নদাতা মানুষগুলিকে। এর মধ্যে শীত এসেছে, শীত চলে গেছে। গ্রীষ্মের প্রখর রোদ, বর্ষার অঝোর বর্ষণ কৃষকদের ক্লান্ত করতে পারে নি। আন্দোলনের অভিমুখ বদলায় নি। মৃত্যু ছিনিয়ে নিয়ে গেছে বহু সহযোদ্ধাকে। কখনো দীর্ঘ আন্দোলন চালিয়ে যেতে যেতে হৃদয়ের ওঠাপড়া স্তব্ধ হয়েছে কোনো বয়স্ক আন্দোলনকারীর। কখনো পুলিশি অত্যাচারে আঘাতপ্রাপ্ত কৃষক শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর পথে ঢলে পড়েছেন। মাত্র কিছুদিন আগে লখিমপুর খেরিতে কৃষক হত্যার ঘটনা শুধু দেশের ভেতরে নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও আলোড়ন তুলেছে। কৃষক নেতৃত্ব বলছেন গত এক বছরে প্রায় ৭৫০ জন কৃষক জীবন হারিয়েছেন এই আন্দোলন চালাতে গিয়ে। তবু চোখের পলক পড়ে নি কৃষক সমাজের। অথচ কৃষক নেতারা অন্য সিদ্ধান্ত নিতেই পারতেন। আইনগুলিতে কিছু পরিবর্তন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে। সুপ্রিম কোর্টও ১২ জানুয়ারি একটি চার সদস্যের কমিটি তৈরি করে এই আইনগুলি সম্পর্কে মতামত দেওয়ার জন্য। ২৯ জানুয়ারিতে আপাতত দেড় বছরের জন্য আইনগুলিকে স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছিল দেশের সরকার। কিন্তু কোনো প্রস্তাবই আন্দোলনরত কৃষকদের টলাতে পারেনি। বরং আরও সংঘবদ্ধ, আরও দৃঢ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছে। সত্যি বলতে কি আমাদের জীবনকালে এইরকম সংগঠিত, নির্ভীক এবং পিছু না হঠা আন্দোলন কেউ দেখেছেন বলে মনে হয় না।
কৃষকদের এই জেদের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানতে, পিছু হঠতে বাধ্য হলো সরকার নিজেই। অন্তত ১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ থেকে সেইরকমই মনে করা যেতে পারে। যদিও যতক্ষণ না আইনসভা এই বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করছে ততক্ষণ আমরা নিশ্চিন্ত হতে পারছিনা। সংযুক্ত কিষান মোর্চার নেতৃত্বে থাকা কৃষক নেতারাও এই বিষয়ে এখনো নিশ্চিন্ত নন। তাই তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। আগামী দিনগুলিতে তাই অপেক্ষায় থাকা সরকারিভাবে এই তিন আইন প্রত্যাহারের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের।
তবে এই আন্দোলন শিক্ষা দিল যে, মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদী শক্তিই আসলে ইতিহাস রচনা করে। বাকিটা তো শুধু রাজা-রাজড়ার গল্প।