৫৯ বর্ষ ১৫ সংখ্যা / ২৬ নভেম্বর, ২০২১ / ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮
স্কুল তো খুলল, কিন্তু স্কুলগুলোকে বাঁচানো যাবে তো?
অমর বন্দ্যোপাধ্যায়
গত ১৬ নভেম্বর অবশেষে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে। দীর্ঘ কুড়ি মাস স্কুলে পড়াশোনা হয়নি। যে শিশুটি পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল সে আজ সপ্তম শ্রেণিতে উঠেছে। সে যে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল সেই স্কুল সে দেখেনি, দেখেনি তার শ্রেণি কক্ষ, চেনে না তার কোনো মাস্টারমশাই বা দিদিমণিকে। তার স্কুলে এখনও যাওয়ার সুযোগ আসেনি কারণ সরকার নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল চালু করার নির্দেশ দিয়েছে। সে যখন স্কুলে যেতে পারবে, হয়তো বা পরের বছর কোনো এক সময়, তখন সে অষ্টম শ্রেণি থেকে স্কুল শুরু করবে। শিক্ষাজগতে এর থেকে বড়ো সর্বনাশ আগে হয়েছে বলে মনে হয় না। এবার যারা নবম শ্রেণিতে পড়ছে তারা শেষ স্কুলে গিয়েছিল ষষ্ঠ শ্রেণিতে।সপ্তম শ্রেণিতে উঠে এক মাস ক্লাস হয়েছে, যখন পঠন পাঠন সেভাবে শুরুই হয়নি।
সরকার, শিক্ষা দপ্তর এবং শিক্ষা প্রশাসন শুধু নির্দেশ দিয়েছে। পালন করতে হবে প্রধান শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষিকাদের যাঁরা প্রায় প্রতিদিন রাত জেগে শিক্ষা প্রশাসনের একের পর এক নির্দেশ পালন করে আসছেন। গত কয়েক বছর কন্যাশ্রী, শিক্ষাশ্রী থেকে শুরু করে সাইকেল প্রদান, চাল ও অন্যান্য জিনিস ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিলি করা ইত্যাদি কাজ এখন করেন প্রধান শিক্ষক-প্রধান শিক্ষিকা এবং সহ শিক্ষক-শিক্ষিকারা। ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয়ে না আসলেও সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাকেই পালা করে বিদ্যালয়ে আসতে হয়েছে।
আর বিদ্যালয়ের প্রধানের ডিউটি স্কুল ও বাড়ি মিলিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা। প্রতি মুহূর্তে সরকার আপডেট চাইছে, আর খাজাঞ্চিবাবুর মতো বিদ্যালয় প্রধানরা মাথা নত করে দিনরাত এক করে তা পালন করছেন। কে যে কাকে টাইট দিচ্ছে কে জানে, কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা লাটে উঠতে চলেছে।
নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল খোলা ও ক্লাস চালানো নিয়ে আজ পর্যন্ত তিনটে সারকুলার জারি করা হয়েছে। প্রথম সারকুলার জারি করে বোর্ড সভাপতি জানিয়েছিলেনঃ “টিচার্স মে বি অ্যালাওড” অর্থাৎ শিক্ষকদের স্কুলে আসা বাধ্যতামূলক নয়। এরপরের সারকুলারে আদেশ দেওয়া হলো, ন’টার মধ্যে শিক্ষকের অ্যাটেনডেন্স বাধ্যতামূলক। ৯টা ৩০ মিনিট থেকে নবম ও একাদশ শ্রেণির পড়াশোনা শুরু হবে এবং ১০টা ৩০ মিনিট থেকে দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির পড়াশোনা শুরু হবে। নবম থেকে একাদশ শ্রেণির পড়াশোনা চলবে ৩টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত আর দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির পড়াশোনা চলবে ৪টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। অর্থাৎ প্রতিদিন নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস চলবে। কোভিড বিধি মেনে কীভাবে সম্ভব এই বিদ্যালয় চালানো? যখন রিসেস বা টিফিন চলবে তখন অর্ধেক ছেলেমেয়ে ঘুরে বেড়াবে আর অর্ধেক ছেলেমেয়ে ক্লাস করবে? ছোটো কোনো প্রাইভেট স্কুলে তা কিছুটা সম্ভব হলেও সাধারণ বিদ্যালয়ে কোভিড বিধি মেনে কী সম্ভব এরকমভাবে স্কুল চালানো?
তারপর সারকুলারে নির্দেশ শনিবার পুরো সময়ের স্কুল হবে। এতদিন স্কুল হতো সপ্তাহে পাঁচ দিন। তাহলে, সপ্তাহে পাঁচ দিন স্কুল চালু রাখার নিয়ম সরকার বাতিল করে দিল? বোর্ড কী ভুলে গেছে আগে সপ্তাহে পাঁচ দিন স্কুল হতো?
গত ৩০ অক্টোবর এবিটিএ-র সাধারণ সম্পাদক সুকুমার পাইন স্কুল শিক্ষা দপ্তরে সমিতির মতামত জানিয়ে একটি চিঠি দেন। এ চিঠিতে যে দাবি ছিল তার যৌক্তিকতা মেনে না নিয়ে বৈরিতাসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অবৈজ্ঞানিক সারকুলার জারি করে শিক্ষা দপ্তর। এরপর এবিটিএ–এবিপিটিএ সহ সমস্ত শিক্ষক সংগঠন প্রতিবাদ ও ডেপুটেশন দেয়। সরকার কর্ণপাত করে না। তৈরি হয় স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠনগুলোর যুক্ত মঞ্চ রাইট টু এডুকেশন ফোরাম। এই মঞ্চ প্রতিবাদ সভা ডাকে; সভা হয় কলেজ স্ট্রিট কফি হাউজের সামনে। যোগ দেয় পশ্চিম বঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চও। অতঃপর সরকারের টনক নড়ে। সরকার আচার্য সমাজের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হন। গত ২১ নভেম্বর নতুন সারকুলার জারি করেছে সরকার। রাইট টু এডুকেশন ফোরাম-এর দাবি মতো কোভিড বিধি যথাযথভাবে পালন করে সপ্তাহে তিন দিন করে ক্লাস চালুর নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা দপ্তর। সোম, বুধ ও শুক্র বার দশম ও দ্বাদশ শ্রেণি এবং মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার নবম ও একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস চালানোর নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা দপ্তর। স্কুলের সময়ও বদলিয়েছে। প্রতিদিন ১০টা ৫০ মিনিট থেকে বিকেল সাড়ে চারটে পর্যন্ত ক্লাস রাখতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলে শুধু সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টে পর্যন্ত স্কুল চলবে। শনিবার নির্ধারিত হয়েছে রিভিশন, পূর্বপাঠ অনুশীলন ও বিভ্রান্তিমূলক ধারণার অবসানে শিক্ষকের সংশোধনমূলক পাঠদান। তাছাড়া, এই দিন অভিভাবকদের অভিমুখিকরণ ও সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সভা করার কথা বলা হয়েছে।
কিন্তু সরকার সব থেকে যে সর্বনাশা কাজ করছে তা হলো, শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি এবং যথেচ্ছভাবে ট্রান্সফারের মাধ্যমে বিদ্যালয়ব্যবস্থাকে ঢিলেঢালা করে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে। ব্যাপক ট্রান্সফার হচ্ছে। এটা ঠিক, কিছু শিক্ষকশিক্ষিকা বাড়ির সামনে আসতে পারছেন। যাঁরা মূলত দূরে গ্রামাঞ্চলে স্কুলে পড়ান, তাঁরা বাড়ির কাছে আসতে পারলে পড়ানোর কাজ আরও সুষ্ঠুভাবে করতে পারবেন এটি ঠিকই। কিন্তু এরফলে গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলো শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অভাবে বন্ধ করে দিতে হবে না তো?
একটি ছোটো দুর্নীতির কথা বলি। করোনা ভাইরাস মুক্ত করতে স্কুল স্যানিটাইজ করার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। এ বাবদ একশো পঞ্চাশ কোটি টাকা ধার্য করেছে সরকার। সেই টাকা বণ্টন করার ক্ষেত্রে চরম পক্ষপাত এবং এর ফাঁক দিয়ে দুর্নীতি সবার চোখ এড়িয়ে গেছে। কারণ নিয়ম মেনে এই টাকা পুরসভাভিত্তিক বণ্টন করা হয়েছিল; কিন্তু কারা পেল টাকা। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, কিছু কিছু স্কুল যাদের ছাত্রছাত্রী সংখ্যা কম এবং যেখানে মাধ্যমিক পর্যন্ত পঠনপাঠন হয় তারা স্কুল পিছু তিন থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা পেয়েছে এবং অনেক স্কুল যাদের ছাত্রছাত্রী সংখ্যা অনেক এবং উচ্চমাধ্যমিক চালু আছে তাদের কোনো টাকা দেওয়া হয়নি। আবার মজা হলো, এই টাকা প্রধানশিক্ষক বা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ খরচ করতে পারবেন না। স্কুল শিক্ষা দপ্তর, এসডিও কিংবা ডিএম পর্যায়ের আধিকারিকরাও এব্যাপারে কিছু জানেন না। এই টাকা খরচ করবে পৌরসভা। তারা লোক নিয়োগ করে স্কুলগুলিকে স্যানিটাইজ করাবে। এখন রাজ্যের কোনো পৌরসভায় কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই। পৌর প্রশাসক পৌরসভা চালাচ্ছেন। এদের নিয়োগ করেছে সরকার এবং দলীয় নেতা ছাড়া সেখানে অন্য কাউকে এই নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তাহলে গল্পটা কী দাঁড়ালো?
এর মধ্য দিয়ে দুর্নীতিমুক্ত কাজ হওয়া কী সম্ভব? আশঙ্কা হচ্ছে, এই টাকার সিংহভাগ চলে যাবে পৌর নির্বাচনে শাসকদলের প্রার্থীদের জিতিয়ে আনতে।এই আশঙ্কা কী ভিত্তিহীন, অমূলক?
আর এসএসসি নিয়োগে দুর্নীতি এমন স্তরে পৌঁছেছে যে, আদালত খোদ সরকারকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। সরকার ল্যাজেগোবরে; দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে মন্ত্রী এবং শাসকদলের নেতানেত্রীদের নাম। কোটি কোটি টাকার লেনদেন। ফলে গত দশ বছর ধরে কোনো নিয়োগ নেই। শেষ নিয়োগ বামফ্রন্ট আমলে হয়েছে।এই অবস্থায় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ বন্ধ থাকা এবং গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলি থেকে ব্যাপক সংখ্যায় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বদলি করা - সাধারণের বিদ্যালয়গুলো তুলে দেওয়ার এক গভীর চক্রান্ত নয় কী? শিক্ষার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সকলকে এই চক্রান্ত বুঝতে হবে। এটাকে সরকারের অযোগ্যতা-অপদার্থতা বলে অনেকেই আত্মপ্রসাদ লাভ করতে চাইছেন। চক্রান্তের গভীরতা বুঝতে চাইছেন না। সরকার পরিচালিত হচ্ছে মুনাফাখোর করপোরেটদের দ্বারা। কর্পোরেটদের হাতিয়ার পেটোয়া সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া। সরকারের অধীনে শিক্ষা প্রশাসন শাস্তির ভয়ে শুকিয়ে গেছে।সবাই সবাইকে শাস্তির ভয় দেখাচ্ছে। আর অন্যদিকে মানুষের দুর্দশা, তাঁদের পিছিয়ে-পড়া চেতনাকে মূলধন করে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে সরকার হাজির হয়ে রাজ্যের আমজনতাকে হাত পেতে বেঁচে থাকার পথ দেখাচ্ছেন।
আত্মনির্ভর স্বাবলম্বী করার পরিবর্তে মানুষকে সরকার দান-দয়ার উপর নির্ভর করে বাঁচতে শেখাচ্ছে এবং তাঁকে কার্যত ভিক্ষাবৃত্তির পথে টেনে আনছে। নামতেই হবে সকল শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মী এবং অভিভাবক সমাজকে এর বিরুদ্ধে। লড়াই চাই শিক্ষাব্যবস্থাকে রক্ষা করতে, লড়াই চাই আমাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎকে বাঁচাতে। বৈজ্ঞানিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষা শেষে সম্মানজনক কাজ - এই দাবি ও অধিকার আদায়ের জন্য পথে নামতে হবে সকলকে। এর কোনো শর্টকাট পথ নেই।