৫৯ বর্ষ ১৫ সংখ্যা / ২৬ নভেম্বর, ২০২১ / ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮
আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু স্মরণে
তপন মিশ্র
পেটেন্টের এবং মেধার বাণিজ্যিকীকরণের দুনিয়ায় আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু এক ব্যতিক্রমী বিজ্ঞানী। ঔপনিবেশিক ভারতে ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর বর্তমানের বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জে তাঁর জন্ম। তাঁর গবেষণার পেটেন্ট যদি তিনি করতেন তাহলে ভারতবর্ষের আলফ্রেড নোবেল হতে পারতেন তিনি। ডিনামাইটের মতো বিস্ফোরক আবিষ্কার করে তার পেটেন্ট করেন নোবেল। সেই অর্থ থেকে নোবেল পুরস্কারের ঝাঁপি তৈরি হয়। ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা একটি ‘শ্রোতা সমীক্ষা’-র আয়োজন করে। বিষয়টি ছিল - সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? প্রায় ৩০ দিন ধরে চালানো এই সমীক্ষায় শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০ জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ২০০৪-এর ২৬ মার্চ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। বিবিসি বাংলার সেই সমীক্ষায় শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় সপ্তম স্থানে ছিলেন জগদীশ চন্দ্র বসু।
আদর্শ হয়ে ওঠা
১৯০১ সালে মার্কোনির রেডিও তরঙ্গ সম্পর্কে ঐতিহাসিক পরীক্ষার পর জগদীশচন্দ্র বসু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একটা চিঠি লেখেন। মূল চিঠিটা পাওয়া যায় নি। চিঠিটা সম্ভবত বাংলাতেই লেখা হয়েছিল, তার ইংরেজি অনুবাদ থেকে আবার বাংলায় অনুবাদ করা হয়। তিনি যা লেখেন তার ভাবার্থ হলোঃ “আমার বক্তৃতার কিছু আগে একটা খুব বিখ্যাত টেলিগ্রাফ কোম্পানির কোটিপতি মালিক আমার কাছে একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে জানাল খুব জরুরি একটা ব্যাপারে সে আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি তাঁকে জানালাম আমার কোনো সময় নেই। উত্তরে সে বলল, সে নিজেই চলে আসছে। সত্যি সত্যি কিছুক্ষণের মধ্যে সে আমার সাথে দেখা করতে চলে এলো, হাতে একটা পেটেন্ট ফর্ম। সে এসে আমাকে সাংঘাতিকভাবে অনুরোধ করে বলল, আমি যেন আজকের বক্তৃতায় কিছুতেই আমার গবেষণার সব তথ্য সবাইকে জানিয়ে না দিই। সে বলল, “এর মাঝে অনেক টাকা! আমি তোমার জন্যে একটা পেটেন্ট করিয়ে দিই, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না তুমি কী পরিমাণ টাকা ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছ। ইত্যাদি ইত্যাদি”, মানুষটা অবশ্যই আমাকে জানিয়ে দিল, “আমি শুধু লাভের অর্ধেক টাকা নেব, পুরো খরচ আমার ইত্যাদি!” এই কোটিপতি মানুষটি আমার কাছে ভিক্ষুকের মতো হাতজোড় করে এসেছিল শুধুমাত্র আরও কিছু টাকা বানানোর জন্যে। প্রিয় বন্ধু আমার, তুমি যদি শুধু এই দেশের মানুষের লোভ আর টাকার জন্যে লালসা একটিবার দেখতে! টাকা টাকা আর টাকা - কী কুৎসিত লোভ! আমি যদি একবার এই টাকার মোহে পড়ে যাই তাহলে কোনোদিন এর থেকে বের হতে পারব না। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমি যে গবেষণাগুলো করি সেগুলো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয়। আমার বয়স হয়ে যাচ্ছে, আমি যা করতে চাই আজকাল সেগুলো করার জন্যেও সময় পাই না। তাই আমি মানুষটিকে সোজাসুজি না বলে বিদায় করে দিয়েছি।’’ গবেষণালব্ধ জ্ঞানের বাণিজ্যিকীকরণের কতটা বিরোধী ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু তা এই চিঠি থেকেই জানা যায়।
১৮৮০ আচার্য জগদীশচন্দ্র লন্ডনে উচ্চশিক্ষার জন্য পৌঁছান। ভারতে কালাজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি ছিলেন অসুস্থ। এক দিকে বর্তমান দিল্লির মতো বায়ুদূষণ এবং অন্যদিকে জনবিস্ফোরণে লন্ডন শহরের আবহাওয়া ছিল অত্যন্ত বিষাক্ত। প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা এবং মানব অ্যানাটমি নিয়ে চিকিৎসক হওয়ার পড়াশোনা শুরু হলো তাঁর। কিন্তু সেই দুষিত শহরে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এখান থেকে তিনি যান কেমব্রিজে। কেমব্রিজ তখন অনেকটাই দূষণমুক্ত। ১৮৮৩ সালে আচার্য বসু কেমব্রিজ থেকে ট্রাইপোস পাস করলেন এবং একইসঙ্গে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রি পেলেন।
বিএসসি’র পড়াশোনা শেষ করে ১৮৮৪ সালে দেশে ফিরে আসার পর তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেল রিপনের অনুরোধে জগদীশচন্দ্র বসুকে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক পদে নিযুক্ত করা হয়। যদিও কলেজের অধ্যক্ষ স্বয়ং এই নিয়োগের বিপক্ষে ছিলেন। যাই হোক, এই পদে অন্যান্য ইয়োরোপীয়দের তুলনায় তাঁর বেতন ছিল অনেক কম। ইয়োরোপীয় অধ্যাপকদের তুলনায় ভারতীয় অধ্যাপকদের কম বেতনের প্রতিবাদে জগদীশচন্দ্র বসু তিন বছর বেতন গ্রহণ করেননি, যদিও ছাত্রদের কাছে তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পদার্থবিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলি তিনি তাঁর ছাত্রদের কাছে অত্যন্ত সহজভাবে বিভিন্ন পরীক্ষা দ্বারা বুঝিয়ে দিতেন।
১৮৯৫ সালে কলকাতার টাউন হলে সর্বসমক্ষে রেডিও তরঙ্গ তৈরির সফল পরীক্ষা করেন জগদীশ বসু। তাঁর আবিষ্কার ছিল - অতি ক্ষুদ্র বেতার তরঙ্গ, যার থেকে তৈরি হয়েছে আজকের মাইক্রোওয়েভ, যা পরবর্তীতে ‘সলিড স্টেট ফিজিক্স’-এর বিকাশে সাহায্য করেছিল। পরে তিনি পদার্থবিজ্ঞানের আরও গুরুত্বপূর্ণ নানা আবিষ্কার করেন যেমন ‘ডিটেক্টর’, ‘রিসিভার’ ইত্যাদি।
১৮৯৮ সাল থেকে আচার্য বসুর নাম ঘুরেফিরে আবার বিজ্ঞানী মহলে উঠে আসে। তার কারণ সেই বছর আইইই (Institute of Electrical and Electronics Engineers)-এর প্রসিডিংসে একটা যুগান্তকারী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদনে লেখা হয় যে, রেডিও তরঙ্গের প্রকৃত আবিষ্কারক মার্কোনি নন বরং প্রকৃত আবিষ্কারক হলেন আচার্জ জগদীশচন্দ্র বসু। এর প্রায় দশ বছর আগে ১৮৮৯ সালে লন্ডনের রয়াল সোসাইটিতে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর এই পরীক্ষা নিয়ে একটা নিবন্ধও পাঠ করেন। তিনি যে যন্ত্রপাতিগুলো তৈরি করেছিলেন তার অনেকগুলোই কলকাতার বোস ইনস্টিটিউটে এখনও সংরক্ষিত আছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মার্কোনির অনেক আগেই তিনি কলকাতায় ওয়ারলেস বা বেতার দিয়ে সংকেত পাঠিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, তাই যদি সত্যি হয় তাহলে কেন পৃথিবীর ইতিহাসে রেডিও তরঙ্গের আবিষ্কারক হিসেবে জগদীশচন্দ্র বসুর নাম উপেক্ষিত।
সমন্বিত জ্ঞানের ধারক
উদ্ভিদের প্রাণ আছে কীনা বিষয়টি কখনওই আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুকে ভাবায়নি। উদ্ভিদের প্রাণের কথা আগেই প্রমাণিত হয়েছিল । এর থেকে অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ একগুচ্ছ প্রশ্ন তাঁকে ভাবিয়েছে। জীবনের যে সমস্ত লক্ষণ উদ্ভিদের মধ্যে দেখা দেয়, সেগুলির ধরন কেমন এবং কীভাবে কাজ করে তা পর্যবেক্ষণ করা এবং পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হওয়াই ছিল তাঁর গবেষণার বিষয়। টেলিগ্রাফ লতা (Desmodium gyrans) এবং লজ্জাবতী গাছ (Mimosa pudica) ছিল তাঁর গবেষণার অন্যতম উপকরণ, যদিও বিষয়বস্তু ছিল ভিন্ন। ভারতবর্ষে প্রথম জৈব-পদার্থবিদ্যার গবেষণা যাঁর হাত দিয়ে শুরু হয় তিনি আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু। ক্রেস্কোগ্রাফ (crescograph) নামে একটি সূক্ষ্ম যন্ত্রের আবিষ্কার করেন তিনি। বিজ্ঞানের কোনো প্রশ্ন কখনওই পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা বা জীববিজ্ঞানের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না - প্রকৃতিকে জানার ইচ্ছা বিজ্ঞানের কোনো ধারায় বদ্ধ নয়। বিশেষকরে জীববিজ্ঞান ও প্রকৃতি বিজ্ঞান হলো সম্মিলিত জ্ঞানের ধারা। এখানে রসায়নশাস্ত্র, পদার্থবিজ্ঞান, ভূগোল বিদ্যা, গণিতশাস্ত্র ইত্যাদির সমন্বয় ব্যতিরেকে জীবজগৎকে জানা সম্ভব নয়। ভারতবর্ষে আচার্য বসু এই ধারণা প্রথম প্রতিষ্ঠিত করেন। বলাইবাহুল্য এখনও আমাদের দেশে প্রকৃতিবিজ্ঞানে সম্মিলিত গবেষণার অভাব পরিলক্ষিত হয়।
একজন পদার্থবিদ্যার বিশ্ববন্দিত গবেষক এবং অধ্যাপক এমন কিছু ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র আগাছা গবেষণার উপকরণ করবেন এটা ভাবাই যায় না। আগাছা কথাটি বিজ্ঞানসম্মত নয়। বাস্তুতন্ত্রে প্রত্যেকটি উদ্ভিদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আগাছা বলে কোনো উদ্ভিদকে হেয় করা এক ঔপনিবেশিক এবং অবৈজ্ঞানিক ধারণা। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে, যেখানে ইয়োরোপীয় বণিকরা সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে সেখানে যে বৃক্ষ থেকে ব্যবসায়িকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাঠ পাওয়া যায় সেগুলি ব্যতিরেকে অন্য সমস্ত উদ্ভিদকে আকাঠ এবং আগাছা বা নেটিভ উদ্ভিদ বলে প্রচার করেছে। এর একটা কারণ তো আছেই। এটি এই প্রবন্ধের আলোচনার বিষয় নয়।
আজ থেকে প্রায় ১৩০ বছর আগে আচার্য বসু জানতেন যে, গবেষণার কাজে প্রত্যেকটি উদ্ভিদ প্রজাতির সমান গুরুত্ব। বৈদ্যুতিক স্পন্দন (impulse) ব্যতিরেকে জীবনের স্পন্দন সম্ভব নয়। প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি প্রমাণিত। হৃদযন্ত্র বিকল হলে পেশমেকারের মাধ্যমে হৃদযন্ত্রে বৈদ্যুতিক স্পন্দন জোগান দেওয়ার বিষয়টি আমাদের জানা। কিন্তু উদ্ভিদে এই স্পন্দন কী তৈরি হয়? এই প্রশ্ন আচার্য বসুকে ভাবিয়েছে। অন্য একটি বিষয়ও ওঁকে একইভাবে ভাবিয়েছে। তাহলো উদ্ভিদ জলশোষণ করার পর কয়েক মিটার উঁচুতে জল তোলে কীভাবে? যে উচ্চতায় জল তুলতে আমাদের বিদ্যুৎ বা খনিজ তেল চালিত মোটর এবং পাম্প লাগে সেই উচ্চতায় অনায়াসে বৃক্ষ জল তুলে নেয়। ১৯৯২ সালে অর্থাৎ আচার্য বসুর গবেষণার প্রায় ১০০ বছর পর ৯ জন গবেষক বিশ্ববিখ্যাত নেচার পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধটির নাম ‘Electrical signalling and systemic proteinase inhibitor induction in the wounded plant’ (Nature, 5th Nov. 1995)। ওঁরা এই গবেষণা প্রবন্ধে লিখলেন - তাঁদের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যে মুহুর্তে উদ্ভিদে এক ক্ষত তৈরি হয় সঙ্গে সঙ্গে ক্ষত নিরাময়ের জন্য একটি জৈব রাসায়নিক পদার্থ সক্রিয় হয়ে যায়। তাঁদের ভাষায় ‘activation of proteinase inhibitor (pin)’ এই ঘটনাটি ঘটে বৈদ্যুতিক স্পন্দনের মাধ্যমে। তাঁরা বলেন “We show that translocation in the phloem of tomato seedlings can be completely inhibited without effect on the systemic accumulation of pin transcripts and pin activity, and without hindrance to propagated electrical signals”। টমেটো গাছের চারায় সংবহন কলা ‘ফ্লোয়েম’-এর মাধ্যমে pin ক্ষতের জায়গায় পৌঁছে যায়। সূর্যমুখী গাছ ব্যবহার করে উদ্ভিদের সূর্যালোকের দিকে গতি (heliotropic movement)-র বৈজ্ঞানিক বাখ্যা করেন এই বিজ্ঞানীরা।
১৮৯৬ সালে জগদীশ চন্দ্র বসুর লেখা প্রথম সায়েন্স ফিকশনটি প্রকাশিত হয়। শিরোনাম ছিল ‘নিরুদ্দেশের কাহিনি’। বিজ্ঞানের কল্পকাহিনি কোনো আজগুবি চিন্তা নয়। যাঁরা কল্পকাহিনিকে অলৌকিকতার রূপ দেন তাঁরা বিজ্ঞান মানসিকতার বিরুদ্ধাচরণ করেন। কল্পবিজ্ঞান যখন পাঠকের কল্পনাশক্তি বৃদ্ধির কাজ করে তখন তা হয়ে ওঠে চিন্তাশক্তি বিকাশের হাতিয়ার। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু একজন বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী হওয়ার পাশাপাশি সেই চেতনা বিকাশেরও ছিলেন অন্যতম পথিকৃৎ।