৫৯ বর্ষ ১৫ সংখ্যা / ২৬ নভেম্বর, ২০২১ / ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮
বাঙালি চিন্তক হাসান আজিজুল হক স্মরণে
বিশ্বম্ভর মণ্ডল
১৯৩৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যব গ্রামে জন্ম। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ভারতে থেকে কিশোর বয়সের সাথীদের ও স্মৃতিকে পেছনে রেখে পরিবারের বড়োদের সিদ্ধান্তক্রমে চলে যান পূর্ববঙ্গে। ১৫ নভেম্বর, ২০২১ তাঁর দেহাবসানের সাথে সাথে দুই বাংলার দেশভাগ বিরোধী মানুষ, দ্বিজাতিতত্ত্ব বিরোধী মানুষ এবং যাঁরা মনেপ্রাণে ধর্মের ভিত্তিবিহীন ‘বাঙালি’ পরিচয়কে আঁকড়ে দিনযাপন করেন তাঁরা তাঁদের এক অগ্রণী বার্তাবাহক ও প্রিয়জনকে হারালেন।
১৯৬০-১৯৭৩ তিনি যথাক্রমে রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ এবং সরকারি ব্রজলাল কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। এর পরে ওই বছরেই তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ও একটানা ৩১ বছর কাজ করে ২০০৪ সালে অবসর নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার পদে ২০০৯ সালে যোগদান করে সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
সুবক্তা ছিলেন। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা ছাড়াও সমসাময়িক রাজনীতি, সমাজনীতি নিয়ে নিয়মিত লিখেছেন। তাঁর লেখা বইয়ের মধ্যে প্রথম গল্পের বই হলো ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ (১৯৬৪)। তাঁর বইয়ের তালিকায় এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে একের পর এক সংযোজন চলতে থাকে। কয়েকটি উল্লেখ করছি - ‘নামহীন গোত্রহীন’, ‘পাতালে হাসপাতালে’, ‘লালঘোড়া আমি’, ‘নির্বাচিত গল্প’, ‘রাঢ়বঙ্গের গল্প’, ‘রোদে যাবো’, ‘হাসান আজিজুল হকের শ্রেষ্ঠ গল্প’, ‘ফুটবল থেকে সাবধান’, ‘সক্রেটিস’, ‘আত্মজা’ ও ‘একটি করবী গাছ’। তার কয়েকটি গল্পের নাম আলাদা করে উল্লেখ করতেই হয়, যেগুলি পাঠক হৃদয়ে চিরস্থায়ী স্থান করে নিয়েছে। যেমন, ‘শকুন’, ‘একজন চরিত্রহীনের স্বপক্ষে’, ‘বিধবাদের কথা’, ‘আমরা অপেক্ষায় আছি’, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ’মা মেয়ের সংসার’, ‘লাঠি’, ‘পাষাণবেদী’, ‘মন তার শঙ্খিনী’, ‘তৃষ্ণা’, ‘পরবাসী’ ইত্যাদি। উপন্যাস লিখেছেন কয়েকটি। যেমন- ‘শামুক’, ‘শিউলি’, ‘বৃত্তায়ন’, ‘আগুন পাখি’, ‘সাবিত্রী’ উপাখ্যান। গল্প, উপন্যাস ছাড়াও তাঁর ঝুলিতে আছে আরও অজস্র বিষয়ে লেখা। যেমন - ‘কথাসাহিত্যের কথকতা’, ‘অপ্রকাশের ভার’, ‘অতলের আঁধি’, ‘ছড়ানো ছিটানো’, ‘চালচিত্রের খুঁটিনাটি’, ‘করতলে ছিন্নমাথা’ (প্রবন্ধ) ইত্যাদি। আত্মজীবনী লিখেছেন- ‘ফিরে যাই ফিরে আসি’, ‘উঁকি দিয়ে দিগন্ত’।
তাঁর গল্প ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, রাশিয়ান, চেক, জাপানি ইত্যাদি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। যে পাঠকরা শুধুমাত্র হাসির, প্রেমের বা রহস্যের গল্প পড়তে ভালোবাসেন, তাদের হাসানের বইয়ের থেকে দূরে থাকাই ভালো।
দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামের কথা তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর লেখায়। তাঁর লেখায় মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের পাওয়া, না-পাওয়ার ছবি স্পষ্ট। তিনি নির্মোহভাবে মরমি মন নিয়ে সেইসব প্রান্তিক মানুষের জীবনের কথা তুলে ধরেছেন যাদের বসবাস ছিল রাঢ় বাংলায়। নিখুঁত তুলির টানে ফুটিয়ে তুলেছেন রাঢ় বাংলার প্রকৃতি, সেখানকার পিছিয়ে পড়া মানুষের দৈনন্দিন অভাব-অনটন, জীবনসংগ্রাম। একইসাথে লেখক প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া মানুষদের একতার প্রয়োজনীয়তার যৌক্তিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন তাঁর লেখায়।
তাঁর গল্প মানেই এক নির্মম বাস্তবতা যা তিনি নির্মেদভাবে প্রকাশ করেছেন। তাই পাঠক তাঁর লেখায় পেয়েছেন দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পালাবদল, রাজনীতি, যন্ত্রণায় ক্ষত-বিক্ষত সমাজকে। উদ্বাস্তু জীবন, মধ্যবিত্ত আর নিম্নমধ্যবিত্তের জীবনের টানাপোড়েন, পিছিয়ে পড়া মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই, দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, অর্থনৈতিক মন্দা, কালোবাজারিকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে লিখে গেছেন একের পর এক কালজয়ী কাহিনি। তাঁর কলম যেন শিল্পীর তুলির আঁচড় দিয়ে জীবন ও প্রকৃতির নানান বৈচিত্র্যময় প্রাণবন্ত ছবি আঁকার কারিগর হয়ে উঠেছে। চোখের আড়ালে বা রাতের অন্ধকারে ঘটতে থাকা প্রভাবশালীদের দ্বারা প্রান্তিক মানুষের উপরে শারীরিক, মানসিক এমনকি যৌন অত্যাচারের নানান কাহিনি তিনি জনসমক্ষে এনেছেন। প্রতিটি গল্পের মধ্যে পাঠক খুঁজে পেয়েছেন তাঁর অসামান্য জীবনবোধ আর সাহিত্যবোধের।
১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৯-এ বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক, ‘আগুন পাখি’ উপন্যাসের জন্য ২০০৮-এ আনন্দ পুরস্কার পান। এছাড়াও আদমজি পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, আবদুর রউফ স্মৃতি পুরস্কার পান। সারা জীবনের সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৮ সালে ‘সাহিত্যরত্ন’ উপাধি পান। ২০১৯ সালে তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মান ‘স্বাধীনতা’ পুরস্কার পান। শেষ পুরস্কার পেলেন মৃত্যুর পরে। তাঁকে সমাধিস্থ করা হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের চত্বরে–এ হলো এক অনন্য সম্মান।
দেশভাগ তাঁকে ক্ষত-বিক্ষত করেছিল। মাধ্যমিক পাশ করে পরিবারের সাথে পাকিস্তানে চলে যান মাত্র ১৫ বছর বয়সে। সেখানে শাসকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধ মত দেওয়ায় তাঁকে পাকিস্তান সেনার হাতে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতে নিজেকে আত্মস্থ করেছিলেন, সাধ্যমতো অন্যদের মধ্যে সেই চেতনা সঞ্চারিত করার চেষ্টা করে গেছেন আজীবন। তিনি বলেছিলেন, “আমি যাদের কথা বলতে চাই তারা হচ্ছে আমাদের দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ। আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসটা তাহলে কি? এই ৯৫ ভাগ মানুষকে মুক্ত করতে হবে। আমার রাগের কারণ কি? আমার ক্রোধের কারণ কি? এই ৯৫ ভাগ মানুষের প্রতিভা ও কর্মশক্তির কোনো বিকাশ নেই এই সমাজে। ৯৫ ভাগ মানুষ এদেশে চাপা পড়ে আছে। এত বড়ো অন্যায় ও অমানবিকতা একজন লেখক যদি অনুধাবন করতে না পারেন তবে তিনি কিসের লেখক?” (১)
দুই বাংলাতেই একের পর এক অভিভাবকসম মানুষের বিদায় থেকে এক অভিভাবক শূন্যতার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। দুই বাংলার মধ্যেকার সাঁকোগুলো চলে যাছে। বর্তমান প্রজন্মের শিল্পী-সাহিত্যিক-সহ আধুনিক মননের চিন্তকদের এই বিষয়ে সচেতন ভূমিকা গ্রহণ ও অভিভাবকসম দায়িত্ব কাঁধে নেওয়াটাই বোধহয় এই সময়ের প্রধান দাবি।
তথ্যসূত্রঃ
১) রওশান আরা, হাসান আজিজুল হকের গল্পে গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতি, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি পত্রিকা, দ্বাত্রিংশ খণ্ড, শীত সংখ্যা, ডিসেম্বর, ২০১৪, পৃঃ-২০৩ [হাসান আজিজুল হকের বক্তব্য কুমারখালী নবপ্রচেষ্টা সাহিত্য সংসদের মুখপত্র ‘গৌড়ী’-তে প্রকাশিত]।