E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১৫ সংখ্যা / ২৬ নভেম্বর, ২০২১ / ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

জনস্বাস্থ্য রক্ষায় কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা নেতিবাচক

সুপ্রতীপ রা‌য়


ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় জীবনেও স্বাস্থ্য এক মহামূল্যবান সম্পদ। এই সম্পদকে রক্ষা করতে পারলে এবং কাজে লাগাতে পারলে তবেই কোনো দেশের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব। দেশের সামগ্রিক উন্নতি এবং আর্থিক বিকাশের সঙ্গে জনসাধারণের স্বাস্থ্যের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সে কারণে উন্নত স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং নিরোগ ও সুস্থসবল নাগরিকের সংখ্যা বাড়ানো যে কোনো দেশেরই অন্যতম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে রাষ্ট্র তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন কর‍‌লে এটি সম্ভব। এই দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকার কতটা পালন করছে?

আমরা ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা লাভ করেছি। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে সংবিধান কার্যকর হয়েছে। সংবিধানে স্বাস্থ্যের অধিকারের কথাও বলা হয়েছে। আমাদের দেশের সংবিধানের ৪৭নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেঃ “The State shall regard raising the level of nutrition and standard of living of its people and improvement in public health among its primary duties”. স্বাস্থ্যের অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার। ভারতীয় সংবিধানের ৪৭তম ধারা অনুযায়ী - জনস্বাস্থ্য, দেশের নাগরিকদের পুষ্টিবিধান এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন রাষ্ট্রের অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।

কিন্তু সেই কর্তব্য রাষ্ট্র কতটা পালন করছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত স্বাস্থ্যের অধিকারকে সংবিধানের ২১নং অনুচ্ছেদের আওতায় জীবনের অধিকারের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ রূপে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু সেই অধিকার লাগু করার ব্যবস্থাপত্র নেই বললেই চলে। ১৯৮১ সালে ICSSR-ICMR-র প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে ভারত সরকার ১৯৮৩ সালে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ঘোষণা করে। ২০০২ সালে পরবর্তী জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ঘোষিত হয়। ২০০৫ সালে সূচনা হয় জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন (এনআরএইচএম)-এর। বলা হলো, দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থাপনাকে আরও শক্তিশালী করাই এনআরএইচএম-র লক্ষ্য। কিন্তু সে লক্ষ্য পূরণ হয়নি।

উন্নয়নের সঙ্গে জনস্বাস্থ্যের প্রশ্ন অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলি ‘সহস্রাব্দ ঘোষণাপত্র’-এ স্বাক্ষর করেছিল। এতে উন্নয়নের ৮টি লক্ষ্য স্থির হয়েছিল, যা ২০১৫ সালে পূরণ হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। এই লক্ষ্যগুলির মধ্যে ছিল দারিদ্র্য, ক্ষুধা, অসুস্থতা, নিরক্ষরতা, পরিবেশ ধ্বংস, নারীদের প্রতি অসম আচরণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই। বলা বাহুল্য, এর মধ্যে অনেকগুলি ছিল জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে ও‍‌তপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের দেশ উন্নয়নের ৮টি লক্ষ্য পূরণে যথেষ্ট পিছিয়ে পড়ছে। জনস্বাস্থ্যের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ আমাদের হয়নি।

আমাদের দেশে স্বাস্থ্য পরিষেবার চিত্রটি কেমন? দেশের সরকারের ভূমিকা কেমন? যে কোনো দেশের সার্বিক উন্নয়নে স্বাস্থ্য পরিষেবার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থা উন্নত ও শক্তিশালী হলে তবেই একটি সুস্থ জাতি গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু স্বাস্থ্য পরিষেবা বলতে কি বোঝায়? দৈহিক ও মানসিক সুস্থতার লক্ষ্যে একটি দেশে রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধের জন্য যে পরিষেবা ব্যবস্থা থাকে তাকেই সামগ্রিকভাবে বলে স্বাস্থ্য পরিষেবা। চিকিৎসা পরিষেবা কতটা সংগঠিত, কতটা অর্থ পাচ্ছে, কতটা মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে তার উপর নির্ভর করছে স্বাস্থ্য পরিষেবার মান। স্বাস্থ্য পরিষেবায় অর্থের ব্যবস্থা বিষয়টি নির্ভর করে চিকিৎসার জন্য খরচ কে দিচ্ছে তার উপর (সরকার, ব্যক্তিগত, বেসরকারি বিমা কোম্পানি প্রভৃতি)। আর পরিষেবা বিতরণ বলতে বোঝায় - কোথায়, কীভাবে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে তার উপর।

আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনও গ্রামে বাস করেন। অর্থনীতি কৃষি নির্ভর। বিপুল পরিমাণ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করেন। এই কারণে কম খরচে উপযুক্ত স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা করা আশু প্রয়োজন। আমাদের দেশের দরিদ্র জনসাধারণের সংখ্যা প্রচুর। আবার এই দরিদ্র জনসাধারণের একটা বড়ো অংশ বাস করেন গ্রামাঞ্চলে। এই অংশের মানুষ যাতে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা পান তার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সাধারণ মানুষের নিখরচায় স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার অধিকার থাকলেও রাষ্ট্র সে দায়িত্ব পালন করছে না। স্বাধীনতার পর কয়েকটি দশক অতিক্রম করলেও প্রাথমিক ও হাসপাতাল স্তরে চিকিৎসা ব্যবস্থা সংগঠিত করার কাজে উন্নতি আসেনি। গ্রাম ও প্রত্যন্ত এলাকায় যেতে স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারীদের অনীহা বিদ্যমান। রাষ্ট্র কোনো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে বলে মনে হয় না। এছাড়া ভারতে স্বাস্থ্য পরিষেবার মান ও সুরক্ষার ছবিটা যথেষ্ট উদ্বেগজনক।

পুষ্টির সঙ্গে জনস্বাস্থ্যের নিবিড় সম্পর্ক আছে। ভারতে অপুষ্টি সংক্রান্ত সমস্যাগুলি আমাদের জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে চলেছে। ভারতীয় সমাজের একটা বিরাট অংশ আজও অপুষ্টিতে আক্রান্ত। দেশের আর্থিক অগ্রগতির সঙ্গে পুষ্টির নিবিড় সম্পর্কটি সবার জানা। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে অপুষ্টি প্রতিরোধে বহু প্রকল্প তৈরি হলেও অশ্বডিম্ব প্রসব হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অপুষ্টির হার প্রতিবেশী দেশ, তথা সাব-সাহারান দেশগুলির তুলনায় বেশি।

রাষ্ট্রের চরম অবহেলার কারণে কম পুষ্টিজনিত সমস্যায় সব থেকে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু, মহিলা ও কিশোরীরা। প্রজননক্ষম মহিলা এবং ‍‌কিশোরীদের অপুষ্টির প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত ভাল সংখ্যক শিশু জন্মায় কম ওজন নিয়ে। সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কম ওজন ও কম উচ্চতার শিশুর বাস ভারতে। ভারতের শিশুদের মধ্যে অনেকে আয়রন, ভিটামিন-এ, জিঙ্ক, আয়োডিনের অভাবে ভুগছে। শিশুদের মধ্যে রক্তাল্পতা বাড়ছে। ভারতের ‘স্কুল ছুট’-এর পরিমাণ বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ শিশুদের অপুষ্টি। ভারত সরকারের স্বাস্থ্যনীতিতে পুষ্টির বিষয়টি বরাবর অবহেলিত।

জনস্বাস্থ্য নিয়ে রাষ্ট্রের চরমতম অবহেলার কারণে শিশু স্বাস্থ্যের অবস্থা খারাপ। পুষ্টির অভাবে শিশুরা বিপন্ন। ভারতীয় শিশুরা acute ও Chronic দু’ধরনের অপুষ্টিতেই আক্রান্ত। ভারতে প্রায় ৬.৫ কোটি পাঁচ বছরের কমবয়সি শিশু বয়স অনুযায়ী উচ্চতার সমস্যায় আক্রান্ত। রাষ্ট্রসঙ্ঘের হিসাব অনুসারে ভারতে প্রতি বছর ২১ লক্ষ শিশু তাদের ৫ বছর বয়সের আগেই মারা যায় এবং সংক্রমণ ও অপুষ্টি এইসব মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। কম উচ্চতার শিশুদের মৃত্যুর হারও উদ্বেগজনক।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মুখে যতই বড়ো বড়ো কথা বলুন না কেন, আসলে ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্য’ ভারতে অবহেলিত। স্বাস্থ্য বিধানের সঙ্গে জনস্বাস্থ্যের নিবিড় সম্পর্ক আছে। স্বাস্থ্য বিধানের গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞাটি হলো, ‘স্বাস্থ্যবিধান হলো এমন কিছু বিধি এবং ব্যবস্থাসমূহ যা মেনে চললে জনস্বাস্থ্য রক্ষিত হবে।’ কিন্তু এক্ষেত্রে ভারত সরকারের ভূমিকা হতাশাজনক। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় থেকেই সরকারিভাবে এই কর্মসূচিকে স্থান দেওয়া হলেও ১৯৮৬ সালেই প্রথম জাতীয়স্তরে গ্রামীণ স্বাস্থ্যবিধান কর্মসূচির সুনির্দিষ্ট নীতি ঘোষণা করা হয়। আর্থিক বরাদ্দও ছিল অতিসামান্য। এখনও স্বাস্থ্য বিধান কর্মসূচি সফল করতে রাষ্ট্রের যে সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ প্রয়োজন তা চোখে পড়ে না। ফলে জনস্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধান ব্যবস্থার নিবিড় সম্পর্ক আছে। কিন্তু এ সম্পর্কেও রাষ্ট্র উদাসীন।

প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবাকে যেভাবে উন্নত করা প্রয়োজন ছিল তা করা হয়নি। অথচ স্বাস্থ্য বিষয়ক ৮০ শতাংশ সমস্যার সমাধান হতে পারে এই প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার মাধ্যমে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলির বহির্বিভাগে মোট রুগীর মাত্র ১০ শতাংশ পরিষেবা পান (মা ও শিশুদের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা বাদে)। অথচ এই ব্যবস্থাতে আরও অনেক বেশি রুগীর চিকিৎসা সম্ভব।

স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশের জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা সমাধানের উদ্দেশে সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে যেভাবে সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন ছিল তা করা হয়নি। জনস্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ধারাবাহিক উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে।

নয়াউদারবাদী আর্থিক নীতি জনস্বাস্থ্যের সামনে বড়ো চ্যালেঞ্জ। কর্পোরেট সংস্থাগুলি ভারতে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে পুঁজি নিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করছে। কেন্দ্রের সরকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেও বেসরকারিকরণের ‍‌দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য রাষ্ট্রের যে ধরনের বরাদ্দ প্রয়োজন তা হচ্ছে না। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবাকে জোরদার করতে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলির এবং গ্রামীণ হাসপাতালগুলির উন্নয়ন জরুরি। কিন্তু জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের জন্য বাজেটে এর প্রতিফলন নজরে পড়ে না। জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের অন্তর্গত নগর স্বাস্থ্য মিশনকে বিগত আর্থিক বছরগুলির বাজেটে অবহেলা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য পরিষেবা মানুষের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কোনো উদ্যোগ কেন্দ্রের সরকারের নেই।

ভারতের সব মানুষ কি সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা পান? না। সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা বলতে এমন এক ধারণাকে বোঝায়, যাতে মানুষজন অর্থসংকটে না ভুগেই তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে পারেন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্বই প্রধান। ভারতের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জনগণকে ব্যক্তিগত খরচ করতে হয়। দরিদ্র পরিবারগুলির উপর এতে চাপ পড়ে। জিডিপি’র হারের নিরিখে বিচার করলে স্বাস্থ্য খরচের ক্ষেত্রে ভারত তার সমমানের মাথা পিছু আয়ের দেশগুলি থেকে অনেক পিছিয়ে। আবার সরকারি ভরতুকিতে সমাজের সচ্ছলতর অংশের মানুষেরাই বেশি লাভবান হয়েছেন।

জনস্বাস্থ্য বিষয়ে দায় আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার নিতে চাইছে না। কর্পোরেট আশীর্বাদ পুষ্ট সরকার সমস্ত ক্ষেত্রকেই বেসরকারিকরণ করবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। ফলে স্বাস্থ্য মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে বেসরকারি ক্ষেত্র প্রচুর বিনিয়োগ করছে। স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ আশানুরূপ না হওয়ার কারণে বাজার ধরার চেষ্টায় বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে। চড়া দামে বেসরকারি ক্ষেত্রের স্বাস্থ্য পরিষেবা কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা ক্ষেত্রে বিরাট খরচ ব্যক্তিগতভাবে বহন করার ঘটনা বেসরকারি স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে মোট খরচের ৮৬ শতাংশ। আর এর ফলে প্রতিবছর কয়েক কোটি মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ছেন। এখনও চিকিৎসার খরচের ৫ ভাগের ৪ ভাগই সাধারণ মানুষকে মেটাতে হয় নিজেদের পকেট থেকে।

বেসরকারি ক্ষেত্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রধান সমস্যা হলো, এখানে নাগরিকদের স্বাস্থ্য পরিষেবার চাহিদা ও পরিষেবা মূল্যের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। বেসরকারি ক্ষেত্রে প্রধানত অসুস্থ রুগীর পরিচর্যা তথা নিরাময়মূলক ব্যবস্থা ও রোগ চিহ্নিতকরণ পরিষেবার উপর জোর দেওয়া হয়। ফলে প্রতিরোধমূলক, প্রচারমূলক ও অন্যান্য জনস্বাস্থ্য পরিষেবার পর্যাপ্ত জোগান অনিশ্চিত থাকছে। জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের ঝোঁক বৃদ্ধির ফলে - শহর ও গ্রামের প্রচুর মানুষের বাড়তি ব্যয় বাড়ছে। আর্থিক সুরক্ষা ও সরকারি স্বাস্থ্যবিমার অপ্রতুলতার কারণে - সাধারণ মানুষ বিপদে পড়ছেন।

ডাক্তারি শিক্ষার বেসরকারিকরণ সাধারণ মানুষের চিকিৎসার উপর এক বড়ো আঘাত। বিপুল পরিমাণ টাকা দিয়ে ডাক্তারি পাশ করার পর সুদে ও মূলে মাসে ভাল পরিমাণ দেনার বোঝা তৈরি হয়। গোটা ব্যবস্থাটাই বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে। টাকা থাকলে চিকিৎসা পাবে, নইলে নয়। রাষ্ট্রের সহায়তায় এই নির্মম উদারিকরণের ফলে স্বাস্থ্যের অধিকার থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন।

ওষুধপত্রের দাম নির্ধারণের জন্য সরকারের সুস্পষ্ট নীতি থাকা দরকার। সরকার সবই বাজারের ওপর ছেড়ে দিচ্ছে। ভারতের স্বাধীনতার পর নেহরু সরকার সরকারি উদ্যোগে অনেকগুলি ওষুধের কারখানা তৈরি করে। কিন্তু উদারিকরণের নীতিতে হাঁটতে গিয়ে এই কারখানাগুলিকে রুগ্ন বা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই সুযোগে বেসরকারি ও বিদেশি ওষুধ কোম্পানিগুলি রমরমিয়ে ব্যবসা করছে। একই কম্পোজিশনের ওষুধ নানা কোম্পানি অনেক বেশি দামে বাজারে বিক্রি করছে।

ওষুধপত্রের দাম কী হবে তা বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার পরিণাম ভয়ঙ্কর। বিপদে পড়েই একজন ব্যক্তি ওষুধপত্র কেনেন। খুব ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তাঁর কাছে থাকে না। আবার এসব বিষয়ে সাধারণ মানুষের জ্ঞানও খুব কম। বাজারে প্রতিযোগিতা থাকা সত্ত্বেও ওষুধপত্রের দাম কমছে না। অনেক ওষুধ কোম্পানি থাকা সত্ত্বেও নামিদামি ব্র্যান্ডগুলিরই আধিপত্য।

গত কয়েক বছরে মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির আওতায় থাকা ওষুধপত্রের সংখ্যা ক্রমশই কমছে। ১৯৭৯ সালে মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির আওতায় ছিল ৩৪৭টি ওষুধ। ১৯৮৭ সালে এই ধরনের ওষুধপত্রের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১৪২-এ। বর্তমানে মূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতায় থাকা ওষুধের পরিমাণ আরও কমেছে। পাইকারি দামের থেকে খুচরো বাজারে ওষুধপত্রের দাম অস্বাভাবিক বেশি বলে এক সমীক্ষায় প্রমাণ করছে ন্যাশনাল কমিশন অব ম্যাক্রোইকনমিক্স অ্যান্ড হেলথ।