৫৯ বর্ষ ৩ সংখ্যা / ২৭ আগস্ট, ২০২১ / ১০ ভাদ্র, ১৪২৮
জাতীয় ও রাজ্যের এক সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে গণসংগঠনগুলির রাজ্য সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে
আলিগড় থেকে এসএফআই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলনের লোগো প্রকাশ করছেন ইরফান হাবিব।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ দেশ ও রাজ্যের এক সঙ্কটময় পরিস্থিতির মধ্যে এরাজ্যে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে চারটি বামপন্থী গণসংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য সম্মেলন। সারা ভারত কৃষকসভা, সেন্টার অব ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নস (সিআইটিইউ), ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন (ডিওয়াইএফআই) এবং ভারতের ছাত্র ফেডারেশন (এসএফআই) - এই চারটি গণসংগঠনের রাজ্য সম্মেলন আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে। গণমানুষের একটি বিরাট অংশের প্রতিনিধিত্বকারী এই চারটি বৃহৎ গণসংগঠনের রাজ্য সম্মেলনকে সফল করতে ইতিমধ্যেই প্রস্তুতি শুরু হয়েছে, গঠিত হয়েছে সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটি।
সারা ভারত কৃষকসভার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ৩৭তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২২ থেকে ২৪ অক্টোবর হাওড়া জেলার যোগেশচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ে। এই সম্মেলন উপলক্ষে এলাকা ও মঞ্চের নামকরণ করা হয়েছে যথাক্রমে কমরেড আব্দার রাজ্জাক মণ্ডল নগর এবং কমরেড হীরেন সাহা মঞ্চ। গত ১৭ আগস্ট এই সম্মেলনকে সফল করতে কার্তিক দলুই সভাপতি, অরূপ রায় কার্যকরী সভাপতি, পরেশ পাল সম্পাদক ও মহেন্দ্র রায়কে কোষাধ্যক্ষ করে ১৩১ জনের অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এবারে সিআইটিইউ’র রাজ্য দ্বাদশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ২ অক্টোবর পশ্চিম বর্ধমান জেলার খনি অধ্যুষিত অঞ্চল জামুড়িয়ায় নজরুল শতবার্ষিকী হলে। সম্মেলন উপলক্ষে জামুড়িয়া শহরের নামকরণ করা হয়েছে কমরেড মহম্মদ আমিন নগর এবং সম্মেলন কক্ষের নামকরণ করা হয়েছে কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী মঞ্চ।
২১ আগস্ট এই সম্মেলনকে সফল করতে অভ্যর্থনা সমিতি গঠিত হয়েছে। বংশগোপাল চৌধুরী সভাপতি, তাপস কবি কার্যকরী সভাপতি এবং মনোজ দত্তকে সম্পাদক করে ২১১ জনকে নিয়ে অভ্যর্থনা সমিতি গঠিত হয়েছে।
রাজ্যের সর্ববৃহৎ যুব সংগঠন ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন (ডিওয়াইএফআই)-র রাজ্য ১৯তম সম্মেলন এবারে অনুষ্ঠিত হবে উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জে ২ থেকে ৪ অক্টোবর। এই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সম্মেলনস্থল এবং নগর নামাঙ্কিত হয়েছে যথাক্রমে প্রয়াত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষ স্মরণে। মঞ্চের নামকরণ করা হয়েছে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের দাবিতে লড়াইয়ে শহিদ কমরেড মইদুল ইসলাম মিদ্যার নামে। ২১ আগস্ট ডিওয়াইএফআই’র রাজ্য সম্মেলনের লোগো অনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেন অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী।
এদিকে রাজ্যের অন্যতম বৃহৎ সংগঠিত ছাত্র সংগঠন ভারতের ছাত্র ফেডারেশন (এসএফআই)-র রাজ্য ৩৭তম সম্মেলন আগামী ২৪ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর নদীয়া জেলার নবদ্বীপে অনুষ্ঠিত হবে। সম্মেলন উপলক্ষে সংগঠনের প্রয়াত প্রাক্তন নেতা কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী, কমরেড নিরুপম সেন এবং কমরেড সুদর্শন রায়চৌধুরীর নামে এলাকার নামকরণ করা হয়েছে শ্যামল-সুদর্শন-নিরুপম নগর। সম্মেলন মঞ্চ নামাঙ্কিত হয়েছে শহিদ কমরেড মইদুল ইসলাম মিদ্যার নামে। দিয়োগো মারাদোনা কক্ষে অনুষ্ঠিত হবে এই সম্মেলন। গত ২৫ আগস্ট আলিগড় থেকে অনলাইনে সম্মেলনের লোগো প্রকাশ করেছেন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব।
যে পরিস্থিতির মধ্যে চারটি বামপন্থী গণসংগঠনের রাজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, তখন কৃষক আন্দোলনে উত্তাল দেশ। কেন্দ্রের তিন সর্বনাশা কৃষি বিল ও বিদ্যুৎ বিল বাতিলের দাবিতে গত প্রায় ৯ মাস ধরে সিঙ্ঘু, টিকরি সহ দিল্লির সীমান্ত অঞ্চলে শান্তিপূর্ণভাবে কৃষকদের অবস্থান-বিক্ষোভ চলছে। ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সহ বিভিন্ন দাবিতেও কৃষকদের সোচ্চার আন্দোলন পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এই কৃষক আন্দোলন দমন করতে কেন্দ্রের সরকার এবং উত্তরপ্রদেশ সহ বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি তীব্র দমনপীড়ন চালানো সত্ত্বেও আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যায়নি। আরও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো, কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০০ কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। এসবকিছু সত্ত্বেও কৃষক আন্দোলনের তীব্রতা এতটুকু কমেনি, বরং আরও নতুন উদ্যমে তাঁরা ঘোষণা করেছেন, কেন্দ্রের কৃষি আইন বাতিল না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন জারি থাকবে।
পশ্চিমবঙ্গেও তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় আসার পর কৃষকদের সঙ্কট মারাত্মক আকার নিয়েছে। কৃষকেরা ফসলের দাম না পেয়ে, ঋণের জালে ফেঁসে আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এমনই এক দূর্বিষহ অবস্থার মধ্যে শাসকদল তৃণমূলের দুর্বৃত্তরা পুরানো জোতদার, ভূস্বামীদের পক্ষ নিয়ে গরিব কৃষক, পাট্টাদার, বর্গাদারদের গায়ের জোরে জমি থেকে উচ্ছেদ করছে। পুলিশ প্রশাসন এক্ষেত্রে শাসকদলেরই তাঁবেদারি করছে। উলটোদিকে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো কৃষি ও কৃষকদের ‘স্বার্থ রক্ষার’ নামে রাজ্য সরকারের তুমুল বাগাড়ম্বর চলছে। ফসলের দাম না পাওয়া, কৃষির উপকরণের দাম ক্রমাগত বেড়ে যাওয়া, চাষের খরচ ক্রমাগত বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে কৃষকেরা তীব্র সঙ্কটের মধ্যে দাঁড়িয়ে রাজ্যজুড়ে আন্দোলন সংগঠিত করছেন। সংগঠনের রাজ্য সম্মেলনে আগামী দিনের লড়াই-আন্দোলনের রূপরেখা নির্মাণে বিস্তৃত আলোচনা করে দিশা ঠিক করবেন কৃষক আন্দোলনের সেনানীরা।
একইভাবে আজ দেশের বুকে শ্রমিকেরাও মারাত্মক সঙ্কটের মুখে। তাদের উপর নানাভাবে আক্রমণ নেমে আসছে। দীর্ঘ লড়াই-আন্দোলনের মধ্যদিয়ে অর্জিত অধিকার আজ আক্রমণের মুখে। তাঁদের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার আন্দোলনের উপর সরকারের নানা দমন-পীড়ন, বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে মালিকপক্ষের আক্রমণ, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার, কাজের অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা, মজুরি সঙ্কোচন, কাজের সময় বাড়িয়ে দেওয়া, অতিরিক্ত সময় কাজ করিয়ে ন্যায্য প্রাপ্য মজুরি না দেওয়া ইত্যাদি নানাদিক থেকে আক্রমণের শিকার হচ্ছেন শ্রমিকরা।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, মোদী জমানায় নতুন শিল্প গড়ে না তুলে একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বেসরকারিকরণের পথ নিয়েছে কেন্দ্রের সরকার। এছাড়া বেসরকারি শিল্প মালিকরাও স্থায়ী শ্রমিকের বদলে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ, যথেচ্ছ ছাঁটাই, মজুরি না দেওয়া ইত্যাদির পাশাপাশি শ্রমিকদের প্রাপ্য বেতন ও মজুরি বকেয়া রেখে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে। এরফলে চরম দূর্বিপাকে পড়ছেন শ্রমিকরা।
কেন্দ্রের নয়া উদারবাদী নীতি ও শ্রমিকবিরোধী নীতির পরিণতিতে আজ শিল্পে গভীর সঙ্কট তৈরি হয়েছে, ব্যাপক ছাঁটাই, লে-অফ ইত্যাদির ফলে শ্রমিকদের সঙ্কট ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এরই সুযোগ নিচ্ছে বেসরকারি মালিকরা। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার শ্রেণিস্বার্থে মালিকদেরই পক্ষ অবলম্বন করে ওদের অধিক মুনাফা অর্জনের পথ করে দিচ্ছে। এরই পাশাপাশি শ্রমিকদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় যে আইনগুলি ছিল তেমন ২৯টি শ্রম আইন বাতিল করে কেন্দ্রের সরকার ৪টি সর্বনাশা শ্রমকোড প্রবর্তন করে শ্রমিকদের শ্রমদাসত্বের যুগে টেনে নিয়ে যাওয়ার পরোয়ানা জারি করেছে। এসবের বিরুদ্ধে কেবল সিআইটিইউ’ই নয়, অন্যান্য কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনকে নিয়ে যৌথভাবে দেশব্যাপী আন্দোলন সংগঠিত করছে সিআইটিইউ।
আজ দেশের বুকে শিল্প ও শ্রমিকদের যে সঙ্কট তা থেকে পশ্চিমবঙ্গও মুক্ত নয়। এরাজ্যে শিল্পে বন্ধ্যা দশা তৈরি হয়েছে। তারফলে শ্রমিক সঙ্কটও আজ তীব্র আকার নিয়েছে। তৃণমূলের জমানায় নতুন শিল্প একটিও গড়ে ওঠেনি, উলটে পুরানো শিল্প যা ছিল, তা একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর করুণতম নিদর্শন হলো চটশিল্প। রাজ্যে চা শিল্পেও সঙ্কট গভীর। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে বন্ধ চা বাগান ও বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের জন্য যে মাসিক সহায়কভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ছিল, তা এখন না থাকায় অনাহার, অপুষ্টিতে, রোগে ভুগে অনেক শ্রমিকই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। আবার অনেক শ্রমিক অভাবের তাড়নায় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যাও করেছেন।
তৃণমূল জমানায় অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের অসহায়ত্ব, যন্ত্রণাও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। দেশব্যাপী করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতায় ভিন দেশে কাজে যুক্ত পরিযায়ী শ্রমিকরা রাজ্যে ফিরে নিদারুণ অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। একইভাবে করোনার আবহে হকার, মুটেমজুর, অটো চালক, পরিবহণ শ্রমিক ইত্যাদি বিভিন্ন পেশায় যুক্ত শ্রমজীবী মানুষদের জীবনযন্ত্রণা সীমাহীন। এছাড়া, টেট পাশ করা, চুক্তিভিত্তিক ও আংশিক সময়ের শিক্ষকরাও এই জমানায় আজ গভীর সঙ্কটের মুখে। কিন্তু এসব নিয়ে কোনো হেলদোল নেই রাজ্য সরকারের। তারা এখন ‘দুয়ারে সরকার’, ‘খেলা হবে দিবস’, ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ ইত্যাদির মাধ্যমে সরকারি তহবিল উজার করে দানছত্র করে সরকারের মহানুভবতা প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত হয়েছে।
রাজ্যে শ্রমিক ও বিভিন্ন পেশায় যুক্ত শ্রমজীবী মানুষেরা আজ তাদের অধিকার ও দাবি প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনে পথে নেমেছেন। নেতৃত্বে রয়েছে সিআইটিইউ। এই আন্দোলন আগামী দিনে আরও তীব্র হবে। সিআইটিইউ’র আসন্ন রাজ্য সম্মেলনে তারই সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরির জন্য রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামী প্রতিনিধিরা মিলিত হবেন শিল্পনগরী জামুড়িয়ায়।
আজ দেশের বুকে ছাত্র-যুবরাও কেন্দ্রের জনবিরোধী নানা নীতি ও পদক্ষেপের পরিণতিতে গভীর হতাশা ও দিশাহীন অবস্থার মধ্যে পড়েছে। কেন্দ্রের নতুন শিক্ষা নীতিতে সর্বজনীন শিক্ষার সুযোগ সঙ্কুচিত হবে। শিক্ষাক্ষেত্রও আজ বেসরকারি হাতে তুলে দিতে উদ্যত দেশের সরকার। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাত্রাতিরিক্ত ফি বৃদ্ধির ফলে গরিব, মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার খরচ চালানো কঠিন হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী শিক্ষার পরিবর্তে ছাত্র-ছাত্রীদের অধ্যাত্মবাদী ও পুরাণ ভিত্তিক অবৈজ্ঞানিক শিক্ষাদানের মধ্যদিয়ে অন্ধকারের আবর্তে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে বিজ্ঞান চেতনা, অতীত ইতিহাসের পরিবর্তে অন্ধ কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ইতিহাস এবং সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির ধোঁয়াশা তৈরি করে ছাত্র-ছাত্রীদের সর্বনাশ করা হচ্ছে। দেশের সুপ্রাচীন, ঐতিহ্যমণ্ডিত বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা কেন্দ্র, ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র ইত্যাদিতে সুযোগ্য পণ্ডিত ব্যক্তি এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের সরিয়ে দিয়ে সে সমস্ত জায়গায় কেন্দ্রের শাসক দলের তাঁবেদার, অধ্যাত্মবাদী, সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের বসিয়ে দিয়ে দেশের উচ্চশিক্ষা সহ সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
শিক্ষায় যখন এমনই অরাজকতা চলছে তখন স্বাভাবিকভাবেই তার রেশ এসে পড়ছে যুবজীবনে। দেশের এই সার্বিক সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় যেটুকু শিক্ষার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে শিক্ষান্তে কাজের সুযোগ মিলছে না। দেশের বিভিন্ন সরকারি সংস্থায় লক্ষ লক্ষ শূন্যপদ থাকা সত্ত্বেও সেসব জায়গায় নিয়োগ হচ্ছে না। সরকারি ক্ষেত্রে যখন নিয়োগ বন্ধ তখন দেশে ক্ষুদ্র, মাঝারি বা ভারি শিল্প গড়ে না ওঠার ফলে কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগই আর থাকছে না যুব সমাজের সামনে। আজকে দেশে এমনই একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে যে, ইঞ্জিনিয়ার, ম্যানেজমেন্ট শিক্ষায় শিক্ষিতরাও আজ কাজের অপেক্ষায় তীব্র হতাশার মধ্যে দিন গুনছেন। সব মিলিয়ে দেশে আজ বেকার সংখ্যা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। এই বেকার যুবকরা যখন কাজের দাবিতে সোচ্চারে দাবি তুলছে, তখন হয় তাদের প্রশাসনিক দমনপীড়নের মুখে পড়তে হচ্ছে, না হয় সাম্প্রদায়িক বিভেদের ছল-চাতুরির মধ্য দিয়ে তাদের বিভক্ত করার অপচেষ্টা চলছে।
এরাজ্যের ছাত্র-যুবরাও আজ সঙ্কটের মধ্যেই রয়েছে। কোভিড মহামারী যেমন ছাত্র-যুবদের সঙ্কটকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে, তেমনি রাজ্যের নীতি সেই সঙ্কটকে আরও গভীর করে তুলেছে। তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুরোপুরি বিনষ্ট হয়েছে। এই জমানায় শুধু ছাত্র-ছাত্রীরাই নন, আক্রান্ত হয়েছেন অধ্যাপক, শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীরাও। ছাত্রসংসদ থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালনা ব্যবস্থা পুরোপুরি কবজা করে নিয়েছে শাসক দল। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র ভরতি নিয়ে চলেছে ব্যাপক তোলাবাজি, দুর্নীতি। দুর্নীতির আভাস মিলছে ফলাফল প্রকাশেও। রাজ্য সরকার নিজেদের স্বার্থে খেয়ালখুশি মতো অফিস, আদালত, যানবাহন ব্যবস্থা সব খুলে দিলেও স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অনুমতি না দেওয়ায় চরম হতাশার মধ্যে পড়েছে ছাত্রছাত্রীরা। এসএফআই এই সমস্ত বিষয় সহ অবিলম্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে।
রাজ্যে বেকার সমস্যা আজ ভয়াবহ। আগেই উল্লেখিত হয়েছে এই জমানায় একটিও নতুন শিল্প গড়ে ওঠেনি। কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই রাজ্যে। ফলে বেকার সমস্যা তীব্র হয়েছে। এখানে কাজের সুযোগ না পেয়ে দলে দলে যুবকরা কাজের সন্ধানে পাড়ি দিচ্ছে ভিন রাজ্যে। আবার অন্যদিকে শিক্ষা ও কাজের দাবি জানাতে গিয়ে পুলিশ ও শাসকদলের হাতে আক্রান্ত হতে হচ্ছে ছাত্র-যুবদের। কর্মসংস্থানের দাবি জানাতে গিয়ে বাঁকুড়ার মইদুল ইসলাম মিদ্যার শহিদ হবার ঘটনা - রাজ্যের বর্তমান অন্ধকার সময়কেই স্পষ্ট করছে। এই অবস্থার মধ্যেও রাজ্যের ছাত্র-যুবরা তাদের অধিকার ও দাবি প্রতিষ্ঠায় কোভিড মহামারীর ভয়াবহতার মধ্যেও যেমন আন্দোলন-সংগ্রাম জারি রেখেছে, আবার অন্যদিকে মহামারীতে বিপন্ন ও আর্ত মানুষদের ত্রাণ ও সেবায় জীবনপণ উদ্যোগ নিয়ে নজির সৃষ্টি করেছে।
দেশ ও রাজ্যের এমনই এক সঙ্কটের আবহে যে চারটি বামপন্থী গণসংগঠনের রাজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, সেই সম্মেলনে বর্তমান সঙ্কট ও পরিস্থিতি মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাগ্রহণ এবং আলাপ-আলোচনার মধ্যদিয়ে আগামী পথ নির্দেশ স্থির হবে। যার মধ্যদিয়ে নিশ্চিতভাবেই রাজ্যের বহত্তর অংশের জনমানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্কট মোচনের লক্ষ্যে বৃহত্তর গণআন্দোলনের রূপরেখা নির্মাণ ও তার মধ্যে দিয়ে নিশ্চিতভাবেই রাজ্যের অগ্রগতির পথও সূচিত হবে।