৫৯ বর্ষ ৩ সংখ্যা / ২৭ আগস্ট, ২০২১ / ১০ ভাদ্র, ১৪২৮
শিক্ষিকারা আত্মহত্যার পথে কেন?
মালিনী ভট্টাচার্য
রাজ্যের শিশুশিক্ষাকেন্দ্র ও মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে যাঁরা পড়ান তাঁদের কাজ চুক্তিভিত্তিক। সর্বশিক্ষা অভিযানের কাজ করার জন্য তাঁদের নিয়োগ। কাজটা ফ্যালনা নয়। দারিদ্র্য বা অন্য কারণে যে শিশুরা স্কুলছুট হয়ে যায় বা পিছিয়ে পড়ে তাদের সংখ্যা সাধারণ স্কুলের মাধ্যমে কমাতে পারা যাচ্ছিল না বলেই সর্বশিক্ষা অভিযান এবং শিক্ষাকেন্দ্রগুলির উৎপত্তি। এমন শিশুদের শিক্ষার পরিসরে ফিরিয়ে আনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালন করেন কেন্দ্রে নিয়োজিত শিক্ষকরা। কিন্তু বিভিন্ন প্রকল্পকর্মীদের মতোই তাঁদের কাজের তুলনায় বেতন তো কম বটেই, সবচেয়ে বড়ো কথা সরকার ও সমাজের কাছে তাঁরা কাজের গুরুত্ব অনুযায়ী সম্মান পান না। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকাকালীন তাঁদের দাবিগুলির কিছু প্রাথমিক স্বীকৃতি মিলেছিল, বিল পাশও হয়েছিল তাঁদের অবস্থার সুরাহার জন্য একটি পর্ষদের অধীনে তাঁদের আনার। তৃণমূল সরকার আসার পরে দীর্ঘদিন তাঁরা ছিলেন অবহেলিত; এমনকী আগে বেতনবৃদ্ধির যেটুকু সুযোগ তৈরি হয়েছিল তাতেও কাটছাঁট হয়েছে। কেন্দ্রগুলিতে শূন্যপদও সৃষ্টি হয়েছে অনেক। নির্বাচনের আগে এই শিক্ষকদের অবশেষে শিক্ষাদপ্তরের আওতায় আনা হয়েছে বটে, কিন্তু তারপরে সব প্রতিশ্রুতির সমাধি ঘটেছে বিকাশভবন তথা নবান্নের স্বর্ণালি নীরবতায়।
বাইরে থেকে বলা খুব সোজা যে, দাবিটা বদলি রদের; তাহলে তা তুলতে এসে বিকাশভবনের সামনে প্রথম দিনেই পাঁচ শিক্ষিকা বিষপান করলেন কেন? কিন্তু আন্দোলনটা কি শুধুই বদলি রদের? অনেক আগে থেকেই তো তা চলছে সামগ্রিক দাবিপূরণে সরকারের স্পর্ধিত অনীহার বিরুদ্ধে। বদলির নির্দেশ তারই শাস্তি, এই শিক্ষকদের তো বদলি হবার কথাই নয়। বলা খুব সোজা যে, এদের কেউ প্ররোচিত করছে। প্ররোচিত করছে তো বটেই, তা করছে সরকারই। শিক্ষক বা হবুশিক্ষকদের ওপর পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া, শারীরিক নিগ্রহ, লাঠিবাজি, গ্রেফতার, মিথ্যা মামলায় ঝোলানো তো এরাজ্যে আজ প্রতিদিনের ব্যাপার। এই শিক্ষকরাও তো এমন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন; এগুলো কি প্ররোচনা নয়? শিক্ষামন্ত্রী আবার ‘রীতিপদ্ধতি’র কথা তুলছেন। শিক্ষকরা দাবিদাওয়া নিয়ে দেখা করতে এলে দেখা না করা, পুলিশ দিয়ে গলাধাক্কা দেওয়া নির্বাচিত সরকারের ‘রীতিপদ্ধতি’ নাকি? না এসব তাঁদের প্রতি সম্মানপ্রদর্শনের পদ্ধতি?
না, আমরা মনে করি না অসম্মানিত শিক্ষকদের সমস্যার সমাধান আত্মহত্যায়। মিডিয়াতে তাঁরা একদিনের জন্য জায়গা পেয়েছেন, শিক্ষামন্ত্রীর মুখ থেকে দুটো কথা খসাতে পেরেছেন, রাজ্যে বর্তমান প্রধান বিরোধীদের হঠাৎ করে শিক্ষার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে দেখেছেন। কিন্তু সে তো নিজেদের প্রাণকে বিপন্ন করে। আমরা কামনা করি এই পাঁচ শিক্ষিকা সুস্থ হয়ে উঠুন। যথার্থ সম্মান আদায় করার লড়াইতে ফিরে আসুন। কিন্তু আমাদের আহ্বান প্রতিটি অভিভাবকের প্রতি, প্রতিটি নাগরিকের প্রতি। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই বলা হচ্ছে, এর পিছনে রাজনৈতিক উসকানি আছে, যাতে তাঁদের সন্দেহ করে মানুষ এই আন্দোলনের ন্যায্য দাবির বিষয়টি ভুলে যান। আসলে এ ঘটনা কি রাজনীতিনির্বিশেষে সবার পক্ষে অশনিসংকেত নয়?
আজ একটি বিশেষ ঘটনায় তাঁদের দিকে আমাদের চোখ পড়েছে; কিন্তু তাঁরা সমাজের একটি অতি জরুরি কাজে যুক্ত একথা কি অস্বীকার করার? উচ্চকোটির মানুষ এঁদের প্রতি উদাসীন থাকতে পারেন, কারণ যে শিশুরা এঁদের হাতে মানুষ হয় তারা তো দরিদ্র প্রত্যন্ত বর্গের পরিবার থেকে আসে। কেন্দ্রে বা রাজ্যে শাসকও এই শিশুদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতেই চায়। কিন্তু যদি আমাদের কোনো সামাজিক বিবেক থাকে তাহলে শিশুশিক্ষাকেন্দ্র, মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষকদের লড়াইকে শিক্ষার অধিকারের জন্য, দেশরক্ষার জন্য লড়াইয়ের অংশ বলেই মনে করব। তাঁদের সম্মানকে নিজেদের সম্মান মনে করে এ লড়াইয়ের পাশে দাঁড়াব।।