৫৯ বর্ষ ৩ সংখ্যা / ২৭ আগস্ট, ২০২১ / ১০ ভাদ্র, ১৪২৮
কর্পোরেট পুঁজির অবাধ লুটের স্বার্থেই এনএমপি
শংকর মুখার্জি
ন্যাশনাল অ্যাসেট মনিটাইজেশন পাইপলাইন প্রোগ্রামের ঘোষণা ২০২১-২২ সালের বাজেট ভাষণেই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন করেছিলেন। গত ২৩ আগস্ট পুস্তক প্রকাশ করে সেই প্রোগ্রামের বিস্তারিত প্রকাশ্যে আনলেন অর্থমন্ত্রী। এতদিন মোদী সরকারের বেচার তালিকায় ছিল লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি, এখন তার সঙ্গে যুক্ত হলো রাষ্ট্রায়ত্ত পরিকাঠামো সম্পদগুলিও। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি বেসরকারি পুঁজির হাতে তুলে দেবার পোশাকি নাম ছিল বিলগ্নিকরণ, স্ট্র্যাটেজিক সেল প্রভৃতি। আর ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইন (এনএমপি) প্রোগ্রামের মোড়কে বেচা হবে জাতীয় পরিকাঠামো সম্পদগুলিকে। এর জন্য ‘ওয়ান স্টপ শপ’ পোর্টাল খুলেছে কেন্দ্র। আগ্রাসী উদারবাদের এ এক নয়া সংস্করণ। এই সব সম্পদ দেশের মানুষের করের টাকায় তিল তিল করে গড়ে তোলা হয়েছিল। স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষে দেশের জনসাধারণের কাছে সরকারের পক্ষ থেকে এর চেয়ে বড়ো উপহার আর কী-ই বা হতে পারে!
এনএমপির’ ওই পুস্তকে ২০২১-২২ থেকে ২০২৪-২৫ - এই চার আর্থিকবর্ষে কোন কোন পরিকাঠামো সম্পদ কেন্দ্র বেচবে তার রোডম্যাপ রয়েছে। এটা তৈরি করেছে নীতি আয়োগ। নীতি আয়োগের সিইও অমিতাভ কান্ত বলেছেন, “১২টি মন্ত্রকের ২০টিরও বেশি সম্পদকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলির জন্য বেসরকারি পুঁজির আহ্বান করা হবে।” এর একটা বিস্তৃত তালিকা তৈরি করেছে তারা। এতে কী নেই। বিমানবন্দর, জাহাজ বন্দর, কয়লা ও অন্যান্য খনি, জাতীয় সড়ক, ট্রেন ও রেললাইন থেকে শুরু করে টেলিকম টাওয়ার, বিদ্যুৎ ট্রান্সমিশন এমনকী শহরের সরকারি আবাসন, স্টেডিয়াম, ওয়ারহাউস পর্যন্ত। চার বছরে এইসব সম্পদ বেসরকারি হাতে তুলে দিয়ে ৬ লক্ষ কোটি টাকা তোলার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
যদিও সরকারি ভাষ্য বলছে, এই প্রোগ্রামে আগামীদিনে যা করা হবে তা নাকি বেচা নয়। সম্পদ সংগ্রহের জন্য করা হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী এনএমপি’র ঘোষণা করতে গিয়ে বলেছেনঃ “এইসব সম্পদের মালিকানা সরকারের হাতেই থাকবে।একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর তা বাধ্যতামূলকভাবে সরকারের হাতে ফেরত আসবে। কোনো বিভ্রান্তি যেন না থাকে যে সরকার সব বেচে দিচ্ছে।” আসলে রাষ্ট্রের পরিকাঠামোকে দীর্ঘ সময়ের জন্য নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া আসলে যে বেসরকারিকরণেরই নামান্তর তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কেন না এই সম্পদগুলির ওপর নিজেদের ইচ্ছামতো মাশুল বসিয়ে দেশের জনসাধারণকে বছরের পর বছর শোষণ করার, আর হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা লোটার অবাধ ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে বেসরকারি সংস্থাগুলিকে। আসলে এটাই হচ্ছে ধান্দার ধনতন্ত্র।
আর্থিক বিকাশ এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরির জন্য সম্পদ সংগ্রহের প্রয়োজনেই লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে বলে মোদী সরকার জানিয়েছিল। এক্ষেত্রেও সেই একই গল্প শুনিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ও পরিকাঠামো সম্পদগুলি দেশের আর্থিক স্বনির্ভরতা, বিকাশ এবং অবশ্যই কর্মসংস্থান তৈরিতে দীর্ঘদিন ধরে ভূমিকা পালন করে আসছে। সেইগুলি বেচে দিয়ে কিংবা বেসরকারি সংস্থার হাতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তুলে দিয়ে ওই কাজগুলি আরও ভালো করে কীভাবে সম্পাদন করা সম্ভব সেটাই প্রশ্ন। সাধারণ বুদ্ধিতে সেই ব্যাখ্যার কোনো যুৎসই উত্তর মেলে না।
দেখা যাক কোন কোন রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদকে লুট করার জন্য বেসরকারি পুঁজির সামনে উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো। তালিকাটি খুব দীর্ঘ - ২৬,৭০০ কিলোমিটার জাতীয় সড়ক, ৪০০টি রেল স্টেশন ও ১০৯ জোড়া দূরপাল্লাসহ ১৫০টি ট্রেন, ৪২৩০০ সার্কিট কিলোমিটার লাইন, ৫,০০০ মেগাওয়াট জল-বায়ু-সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকাঠামো, গেল’র ৮,০০০ কিলোমিটার পাইপলাইন, ইন্ডিয়ান ওয়েল ও হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়মের ৪,০০০ কিলোমিটারের পাইপলাইন, বিএসএনএল এবং এমটিএনএল’র টাওয়ার, ৯০০টি কয়লা খনি ও অন্যান্য খনি সম্পদ, ২৫টি বিমানবন্দর, ৩১টি জাহাজবন্দর এবং ১৫টি স্টেডিয়াম।
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এনএমপি’কে “প্রধানমন্ত্রী মুকুটের মণিমুক্ত বিক্রি করছেন’’ বলে কটাক্ষ করেছেন। কিন্তু ১৯৯১ সালে নরসিমা রাওয়ের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার দেশের অর্থনীতিতে নয়াউদারবাদের যে কার্যক্রম শুরু করেছিল, বিজেপি জমানায় তা আরও ডালপালা মেলেছে, আরও আগ্রাসী হয়েছে। নেহরু অর্থনীতির পথ থেকে দেশকে সরিয়ে আনার কাজের সূচনা হয়েছিল কংগ্রেসের হাত ধরেই। মোদী জমানা তার ওপর পাকাপাকি সিলমোহর চাপিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক সংস্থাগুলির সংস্কারের নামে বেসরকারিকরণ, বিলগ্নিকরণ শুরু হয়েছিল কংগ্রেস আমলে। মোদী-অমিত শাহরা পাকাপাকি বলেই দিয়েছে, স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রে কয়েকটি সংস্থা ছাড়া আর কোনো সরকারি সংস্থার অস্তিত্বই থাকবে না। নয়াউদারবাদের কোনো কার্যক্রমের সমালোচনা করার আগে তাই কংগ্রেসকে তার কৃতকর্মের আত্মসমীক্ষা করতে হবে। না’হলে তা হাস্যকর হয়ে যাবে।
ক্ষেত্র | বিস্তারিত | সম্ভাব্য আয় (কোটি টাকায়) |
---|---|---|
জাতীয় সড়ক | ২৬,৭০০ কিমি। | ১,৬০,২০০ |
রেল | ৪০০টি স্টেশন ও ১০৯ জোড়া দূরপাল্লার ও অন্যান্য ট্রেন। ১,৬৫৮ কিমি রেললাইন। |
১,৫২,৪৯৬ |
বিদ্যুৎ পরিবহণ | ৪২,০০০ সার্কিট কিমি লাইন। | ৪৫,২০০ |
বিদ্যুৎ উৎপাদন | মোট ৫,০০০ মেগাওয়াট জল, বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন। | ৩৯,৮৩২ |
টেলিকম | বিএসএনএল এবং এমটিএনএল’র টাওয়ার। | ৩৫,১০০ |
খনি | ৯০০টি কয়লা খনি ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ। | ২৮,৭৪৭ |
বন্দর | ২৫টি বিমানবন্দর ও ৩১টি জাহাজবন্দর। | ৩৩,৬১০ |
প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইন | গেইল’র ৮,০০০ কিমি পাইপলাইন। | ২৪,৪৬২ |
তেলের পাইপলাইন | ইন্ডিয়ান ওয়েল, হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়মের ৪,০০০ কিমি পাইপলাইন। | ২২,৫০৪ |
ওয়ারহাউসিং | - | ২৮,৯০০ |
শহরের আবাসন | - | ১৫,০০০ |
স্টেডিয়াম | - | ১১,৪৫০ |
আর্থিক বর্ষ অনুযায়ী লক্ষ্যমাত্রা (কোটি টাকায়)
২০২১-২২ | ৮৮,১৯০ |
---|---|
২০২২-২৩ | ১,৬২,৪২২ |
২০২৩-২৪ | ১,৭৯,৫৪৪ |
২০২৪-২৫ | ১,৬৭,৩৪৫ |
নয়াউদারবাদের রূপায়ণের বিচারে চরিত্রগতদিক দিয়ে একটাই শুধু পার্থক্য রয়েছে এই দুই জমানায়। কংগ্রেসী আমলে বিলগ্নিকরণ কিছুটা বাছবিচার করে হতো। সংসদের ভিতরে বাইরে বামপন্থীদের নেতৃত্বে বেসরকারিকরণবিরোধী আন্দোলনে একটা তীব্রতা তৈরি করা গিয়েছিল; এর ফলে বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া বন্ধ করা যায়নি ঠিকই, গতি কিছুটা শ্লথ করা গিয়েছিল। মোদী জমানায় বিলগ্নিকরণ পাইকারিহারে হচ্ছে। বর্তমান সময়ে তীব্রতার তারতম্য থাকলেও সংসদের বাইরে বেসরকারিকরণবিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীরা ধারাবাহিকভাবেই আছে। কিন্তু সংসদের ভেতরে বামপন্থীদের শক্তি একেবারেই কমে গেছে। যার একটা বড়ো সুযোগ যে শাসকশ্রণি নিচ্ছে তা বলাইবাহুল্য। এই প্রেক্ষাপটে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো এনএমপি’র নামে দেশের সম্পদ বিক্রির পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক দিয়েছে।
১৯৯১ সাল থেকে দেশে মোট যে বিলগ্নিকরণ হয়েছে তার বছর অনুযায়ী বিশ্লেষণে মোদী জমানায় কীভাবে পাইকারি হারে বিলগ্নিকরণ হচ্ছে তার সপক্ষে প্রমাণ মেলে। গত ৩০ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার মোট বিলগ্নিকরণ হয়েছে ৫ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে গত ৭ বছরে মোদী জমানায় বিলগ্নিকরণের পরিমাণ ৩ লক্ষ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ৭২ শতাংশই মোদী জমানায়। আর ২০০৪ থেকে ২০০৮-৪ বছর ইউপিএ-১ সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করেছিল বামপন্থীরা। তখন বিলগ্নিকরণের পরিমাণ ছিল সর্বনিম্ন। বর্তমান ২০২১-২২ অর্থবর্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের বিলগ্নিকরণের লক্ষ্যমাত্রা ১ লক্ষ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। সেই তালিকায় রয়েছেঃ জীবনবিমা, বিপিসিএল, দুটি ব্যাঙ্ক, আইডিবিআই কনটেনার করপোরেশন প্রভৃতির মতো রাষ্ট্রায়ত্ত অতিলাভজনক সংস্থাগুলি।