৫৯ বর্ষ ৩ সংখ্যা / ২৭ আগস্ট, ২০২১ / ১০ ভাদ্র, ১৪২৮
স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় প্রবঞ্চনার চর্চা ব্যতীত আর কিছুই পাওয়া গেল না
বৃন্দা কারাত
দেশের স্বাধীনতা দিবসে ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী উদযাপনের সূচনাবাচক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় নিশ্চিতভাবেই সেইসকল মূল্যবোধের পুনরুল্লেখ থাকবে বলে আশা করা যায় যা কিছু আমরা আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্যে সফল লড়াই থেকে শিখেছি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদীর ক্ষেত্রে এই স্বাভাবিকত্ব ভঙ্গ হলো ৮৮ মিনিটের দীর্ঘ বক্তৃতায় স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং তার বীর সেনানীদের প্রসঙ্গ কেবল একবারই উল্লিখিত হলো। ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের সেনানীদের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর অস্পষ্টতা এত গুরুতর যে, বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম ব্যক্তিত্ব মাতঙ্গিনী হাজরাকে তিনি অসমের বাসিন্দা বলে উল্লেখ করলেন।
অনুচ্চারিত রয়ে গেল যা কিছু
উচ্চস্বরের বক্তৃতায় তার বলা কথা ছাপিয়ে উঠে কার্যত স্পষ্ট হলো সেগুলিই যা কিছু তিনি উচ্চারণ করলেন না। ‘‘ভারত ও ভারতের গণতন্ত্রকে ভালোবাসেন যারা’’ বলে শুরুতে সবাইকে একটিবার শুভেচ্ছা জানানো ব্যতীত তাঁর বক্তব্যে বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ অনুচ্চারিতই থেকে গেছে। সংবিধান, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্য, ঐক্য, বহুত্ববাদ, ন্যায়বিচার, শ্রমিক, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি - জাতীয় শব্দগুলি একবারও উচ্চারিত হয়নি। বন্ধুত্ব, শান্তি, সুসম্পর্ক - এই শব্দগুলিও বলা হলো না। স্বাধীনতার প্রাক্কালে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ যে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন তার সাথে তুলনায় প্রধানমন্ত্রীর বয়ানে উল্লিখিত শব্দগুলির অনুপস্থিতি আরও বেশি করে কানে লাগে। নিজের বক্তব্যে রাষ্ট্রপতি কিছু ধারণার উল্লেখ করেনঃ ‘‘ভারত - বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দেশ - সবচেয়ে বৃহৎ এবং প্রাণবন্ত গণতন্ত্র - আমাদেরই জন্য যারা স্বাধীনতার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে এখনও অনেক দূর পথ আমাদের যেতে হবে একথা মনে রাখতে হবে... আমাদের সংবিধানে উল্লিখিত চারটি শব্দ হলো বস্তুত সেই স্বপ্নেরই একটি সংক্ষিপ্তসারঃ ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, সমতা এবং ভ্রাতৃত্ব। এক অসম বিশ্বব্যবস্থায় আরও অধিকতর সমতা, অন্যায্য পরিস্থিতিতে আরও বেশি ন্যায়বিচারের জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে... ‘‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’’র চেতনায় আমরা একটি জাতি হিসেবে সঠিক পথ অনুসরণ করছি। কোভিড সংক্রমণের দ্বিতীয় তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ার সময় সারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশ আমাদের সাহায্য করেছে বলে রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছেন, অথচ একই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে এক অদ্ভুত উদাসীনতা লক্ষ করা গেল। এই দুটি ভাষণের মেজাজ এবং মেয়াদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হয়তো বর্তমান সরকারের স্বৈরাচারী চরিত্রে কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না, তবে এই অবসরে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তার আদর্শ এবং ভারতের শ্রমজীবী মানুষের প্রতি স্বাধীন ভারতের অপূর্ণ প্রতিশ্রুতিগুলি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর উদাসীন বিচ্ছিন্নতা আরও প্রকট হলো।
সাম্প্রদায়িক বিভাজনের স্মারক প্রতিষ্ঠাই কী লক্ষ্য?
প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় উল্লেখ করা হলো এখন থেকে দেশভাগের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের স্মরণে ১৪ আগস্ট তারিখটিকে ‘‘দেশভাগের বিভীষিকাময় অতীত স্মারক দিবস’’ হিসাবে স্মরণ করা হবে। মুসলমান এবং হিন্দু উভয় সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সাথে রেখে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে যা কিছু দুষ্কর্মে সফল হয় তার মধ্যে দেশভাগ একটি অন্যতম দুর্ঘটনা। এতে কোনো সন্দেহই নেই যে, এর ফলে কয়েক লক্ষেরও বেশি প্রাণহানি ঘটে। দেশের ইতিহাসে এহেন বিভীষিকা মনে রাখতে চাইলে, নিশ্চিত তার অভিমুখ থাকবে যাতে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি এবং ‘‘অন্যের’’ প্রতি ঘৃণানির্মিত সাম্প্রদায়িক প্রচার যা দেশভাগের সময়ে জনগণকে এক বীভৎস হিংসার কবলে নিয়ে যায় তাকে দেশের মাটিতে আর কখনও মাথা তুলতে দেওয়া হবে না। কিন্তু বিজেপি’র নেতারা, যেমন তাদের সভাপতি জে পি নাড্ডা এবং সাধারণ সম্পাদক যিনি আরেকদিকে আরএসএস’রও প্রচারক সেই সন্তোষের বক্তব্যে তাদের আসল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটি যথেষ্ট স্পষ্ট হয়েছে, ‘‘তোষণের’’ রাজনীতিকে দায়ী করেছেন তাঁরা - সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিজেপি’র পক্ষ থেকে এই শব্দই বারে বারে প্রক্ষিপ্ত হয়। স্পষ্টতই, দেশভাগের সময় প্রাণ হারিয়েছেন যাঁরা - তাঁদের স্মরণ করার অছিলায় আসলে বিভাজন ও ঘৃণার রাজনীতি পুনর্নির্মাণই এঁদের উদ্দেশ্য। এই রাজনীতিই ভারতকে বিভাজনের দিকে পরিচালিত করেছিল। ঐতিহাসিক তথ্যে জানা যায়, আরএসএস শুরু থেকেই ব্রিটিশদের বিভাজন ও শাসনের কৌশলকে শক্তিশালী করেছে। ভি ডি সাভারকর যিনি আজও বিজেপি’র চোখে মহান নেতা এবং যাঁর মতাদর্শ এদের কাছে শ্রদ্ধেয় সেই সাভারকর হিন্দুত্ব, হিন্দু রাষ্ট্র এবং জাতীয়তার ধারণা গড়ে তুলেছিলেন ধর্মের উপর ভিত্তি করে - হিন্দু এবং মুসলমানদের দুটি পৃথক জাতি হিসাবে বর্ণনা করে। ১৯৩৭ সালে হিন্দু মহাসভার আমেদাবাদ অধিবেশনে সভাপতি হিসাবে তাঁর ভাষণে তিনি বলেছিলেনঃ “ভারতকে আজ একক ও সমজাতীয় মানুষের একটি দেশ হিসেবে বিচার করা চলে না, এদেশে পরস্পর বিরোধী দুটি প্রধান জাতি রয়েছে; হিন্দু এবং মুসলমানেরা”। ১৯৪০ সালে, লাহোর অধিবেশনে ভারতকে বিভক্ত করার পক্ষে যুক্তি হাজির করতে গিয়ে মহম্মদ আলী জিন্নাহ ধর্মের ভিত্তিতে দুই পৃথক সেই জাতিতত্ত্বেরই পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। ডঃ আম্বেদকরই সেই প্রথম ব্যক্তি যিনি সাভারকর এবং জিন্নাহর রাজনৈতিক অবস্থানের এহেন মিল সবার সামনে ব্যাখ্যা করেন। ১৯৪০ সালে আম্বেদকর লেখেনঃ “অদ্ভুত মনে হলেও একথা সত্যি যে, সাভারকর এবং জিন্নাহ এক জাতি বনাম দুই জাতির ইস্যুতে একে অপরের বিরোধী হওয়ার পরিবর্তে এই বিষয়ে একে অন্যর সাথে সম্পূর্ণ একমত। তাঁরা শুধু একমত নন বরং একথাও তাঁরা জোর দিয়ে বলছেন যে, ভারতে দুটি জাতির মানুষ আছেন - একটি মুসলিম জাতি এবং অন্যটি হিন্দু জাতি ...” দেশভাগের ভয়ানক দিনগুলিতে নিহত, ধর্ষিত, অনাথ, গৃহহীন এবং নিঃস্ব হয়ে যাওয়া মানুষের স্মৃতির প্রতি এহেন স্মরণিকা আসলে এক আঘাত। ব্রিটিশদের হাতে ভারত বিভাজনের সুযোগ তুলে দিয়েছিল যে বিভাজনের রাজনীতি, তাকে দূরে ঠেলে দেশের শাসকদলের পক্ষে উপযুক্ত কাজ হলো সেই সময়কে যথাযথরূপে স্মরণ করা যা মানুষকে সচেতন করবে।
কাশ্মীরের প্রতি অবিচার
ভারতবর্ষ বিভক্ত হবার সময় পাকিস্তানের সাথে যুক্ত না হয়ে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য কাশ্মীর ভারতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় - এই ঘটনাই ছিল ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার মূর্তরূপ। সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারা যা জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দিয়েছিল তাকে নস্যাৎ করার উদ্দেশে দেশের সংসদে নির্লজ্জের ন্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ব্যবহার করা হলো। কাশ্মীরের জনগণের উপরে নামিয়ে আনা সেই আঘাতকেই আরেকবার খুঁচিয়ে ঘা করতে প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতার সময়কেই যথাযথ মনে করলেন। নির্বাচনী আসন পুনর্গঠন সম্পর্কিত ঘোষণা আসলে সেই রাজ্যের আইনসভায় অমুসলিম অধ্যুষিত এলাকার প্রতিনিধি সংখ্যা বাড়ানোর এবং রাজ্যের জনবিন্যাস পাল্টে দেবার কৌশল।
জনজীবনের দুর্দশাকেই নাকচ করে দেওয়া হলো
জনগণের স্বার্থ ও কল্যাণ সম্পর্কিত উদ্বিগ্নতা কি আদৌ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে প্রতিফলিত হলো? সংশ্লিষ্ট প্রতিটি প্রসঙ্গেই তিনি বাস্তবতাকে উপেক্ষা করলেন এবং যা আরও বিস্ময়কর তা হলো, মহামারীর প্রকোপে দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকেই চরম অবজ্ঞাভরে অস্বীকার করা। তিনি দাবি করলেনঃ ‘‘সমাজের উন্নয়নমুখী যাত্রায় কোনো ব্যক্তি বা কোনো শ্রেণি যেন পিছিয়ে না থাকে আমরা তা নিশ্চিত করতে পেরেছি’’। এসব তিনি বলছেন যখন ভারতে জনজীবনে বৈষম্য এক অকথ্য পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং মহামারী চলাকালীন সেই ফারাক আরও তীব্র হয়েছে। অক্সফ্যামের ‘‘ইনইক্যুয়ালিটি ভাইরাস রিপোর্ট’’ দেখিয়েছেঃ ‘‘২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে এখনো অবধি ভারতের ১০০ জন বিলিওনেয়ারের সম্পদ বৃদ্ধির পরিমাণ ১২,৯৭,৮২২ কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থে ১৩৮ কোটি দরিদ্র ভারতীয়র প্রত্যেককে ৯৪,০৪৫ টাকার চেক দেওয়া যায়।’’ ভারতের শ্রমজীবী জনতাকে যে বিশাল বোঝা বহন করতে বাধ্য হতে হচ্ছে তারই প্রতি প্রধানমন্ত্রীর অসংবেদনশীল স্লোগান ‘সবকা সাথ, সব কা বিকাশ’ - এদিন সেই অসার স্লোগানের সাথে তিনি ‘‘প্রয়াস’’ নামক নতুন এক ফাঁপা প্রতিশ্রুতির সংযোজিত করেছেন। এদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর রোজকার জীবনের কঠোর বাস্তবতা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী কি এতটাই অজ্ঞ যে তিনি এই অবস্থার জন্য ‘‘প্রার্থনার’’ অভাব, ভালো থাকতে ইচ্ছাশক্তির অভাবকে দেশের উন্নয়নে অন্তরায় বলে চালিয়ে দিলেন? প্রধানমন্ত্রী কি কখনও একটি এম এন রেগা’র একটিও কর্মক্ষেত্র পরিদর্শন করেছেন? একজন মহিলা শ্রমিক একদিনের ন্যূনতম মজুরি জোটাতে সংশ্লিষ্ট ‘আর্থওয়ার্ক’ (মূলত মাটিকাটা) প্রকল্পের কাজে প্রতিদিন গড়ে ২০০০ কিলোগ্রামের বেশি কাদা উত্তোলন করেন। এহেন অমানবিক অবস্থার জন্য দায়ী নিষ্ঠুর উচ্চ উৎপাদনশীলতার সরকারি বিধি এবং অত্যল্প হারে মজুরি। ভারতের প্রায় ৪৩ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ এখনো কৃষিক্ষেত্রে কায়িক শ্রমের কাজে জড়িত। অবশ্য শ্রমিক বা মজদুর বলে আদৌ কিছু বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর শব্দভাণ্ডারে নেই বলেই মনে হয়। তিনি ‘‘সম্পদের সৃষ্টিকর্তা’’ কথাটি এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন। ভারতের শ্রমজীবী জনতাই সম্পদের স্রষ্টা, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে তাদের সম্পর্কেই কোথাও কোনো উল্লেখ ছিল না।
প্রধানমন্ত্রীর নয়া আবিষ্কার
প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ করেই ‘‘ক্ষুদ্র কৃষক’’-দের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে ঐতিহাসিক কৃষি আন্দোলনের সংগ্রামরত কৃষকরাও এই বিষয়টি খেয়াল করেছেন আশা করা যায়। তিনি তাঁর ভাষণে একটি নতুন আবিষ্কারের গল্প ফেঁদেছেন, ৮০ শতাংশ কৃষকেরই নাকি দুই হেক্টরেরও কম জমি আছে এবং “ছোটো কৃষক আমাদের সংকল্প এবং আমাদের মন্ত্র” বলে একটি স্লোগানও দিয়েছেন। ক্ষুদ্র কৃষকরাই হয়ে উঠুক দেশের গর্ব - একথাও বলেছেন। বাস্তবতা হলো, এই ক্ষুদ্র কৃষকরাই কৃষিক্ষেত্রের কর্পোরেটাইজেশনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, মোদীর শাসনে সেই নীতিই অত্যন্ত আগ্রাসীভাবে প্রচারিত হচ্ছে। ক্ষুদ্র কৃষক, যারা বিপাকে পড়ে কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হন তারাই বিক্রিত ফসলের উপরে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এম এস পি) নিশ্চিতকারী আইনের দাবিতে কিষান আন্দোলনে সংগ্রামরত রয়েছেন। কৃষি আইনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে একজোট কিষানদের মধ্যে ভাঙন ধরানোই যে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্য সেকথাই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে প্রতিফলিত হলো।
মহিলাদের উপরে বেড়ে চলা আক্রমণের বিষয়ে নীরব রইলেন
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে মহিলাদের উল্লেখ ছিল। কিন্তু মহিলাদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান আক্রমণের বিরুদ্ধে একটি শব্দও তাতে ছিল না। হাথরাস কিংবা সম্প্রতি রাজধানীর মধ্যেই পুলিশ নির্যাতিত দলিত শিশুটির বাবা-মাকে তাদের অভিযোগ প্রত্যাহার করানোর উদ্দেশে যেভাবে আটক রেখেছিল এহেন সবকটি ঘটনাতেই তাঁর নিজের দলেরই সরকার থাকা সত্ত্বেও ঘটনায় অভিযুক্ত অপরাধীদের বাঁচাতেই তারা ব্যাস্ত ছিল। মহিলাদের প্রতি আক্রমণের ঘটনাগুলির তীব্র নিন্দা এবং সংশ্লিষ্ট ঘটনায় ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ সম্পর্কিত ঘোষণার জন্য সেদিনের উপলক্ষটি যথার্থ ছিল; কিন্তু তিনি এই বিষয়ে চুপ করেই রইলেন।
রিসাইক্লিং স্কিম প্রসঙ্গে
নিজের ভাষণে প্রতিশ্রুতি হিসাবে তিনি যা কিছু যা বললেন সেইসবই ২০১৯ কিংবা ২০২০ সালের বক্তৃতার এক পুনর্ব্যবহারযোগ্য সংস্করণ ব্যতীত আর কিছুই নয়। ‘পি এম গতিশক্তি’র দুর্দান্ত ঘোষণা - ১০০ লক্ষ কোটি টাকার পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ। ২০১৯ এবং ২০২০ সালের স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায় ওই একই পরিমাণে একই প্রকল্পের ঘোষণা করা হয়েছিল। ‘‘আজকের দিনের জন্য সুখবর’’ বলে উল্লেখ করে তার ঘোষণা প্রতিরক্ষা মন্ত্রক দ্বারা পরিচালিত সৈনিক স্কুলগুলি এবার থেকে মেয়েদের ভর্তি নেবে। প্রকৃতপক্ষে, ২০২১-২২ সালের মধ্যে সকল সৈনিক বিদ্যালয়কেই সহশিক্ষাকেন্দ্র করার সিদ্ধান্তটি অক্টোবর ২০১৯ সালেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রক ঘোষণা করেছিল। ‘‘আমি আজ এই তেরঙাকে সাক্ষী করে জাতীয় হাইড্রোজেন মিশন ঘোষণা করছি’’। প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন, অথচ অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন ফেব্রুয়ারিতেই বাজেট বক্তৃতার সময় এই মিশন ঘোষণা করেছিলেন। মিড-ডে মিল স্কিমে রেশন দোকান এবং স্কুল থেকে বিতরণের জন্য আয়রন এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ চাল দেবার পরিকল্পনা ২০১৯ সালে তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী রাম বিলাস পাসওয়ানও ঘোষণা করেছিলেন এবং ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে একটি পাইলট প্রকল্প এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে।” (তথ্যসুত্রঃ দ্য হিন্দু)
পেগাসাস এবং নাগরিক জীবনে হস্তক্ষেপ প্রসঙ্গে
সম্ভবত সবচেয়ে বিদ্রূপাত্মক কিংবা নির্লজ্জ ঘোষণাটি হলো প্রশাসন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য। তিনি বলেছেন, ‘‘আমরা এমন এক ভারত চাইছি যেখানে সরকার নাগরিকদের জীবনে হস্তক্ষেপ করে না... জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য, জনজীবনে সরকার এবং সরকারি প্রকরণের অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ বন্ধ করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।” কিন্তু পেগাসাসের কী হলো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহাশয়? বিরোধীদের বিরুদ্ধে সামরিক পর্যায়ভুক্ত স্পাইওয়ার ব্যবহারের বিষয়ে আপনি কী বলবেন - এই সরকার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এবং বিরোধী নেতাসহ ১৬১ জনেরও বেশি ব্যক্তিবর্গের উপর গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়েছে। আপনার সরকার একটি প্রশ্নের সোজা উত্তরটুকু অবধি দিতে রাজি নয় বলে সংসদের একটি গোটা অধিবেশন ভেস্তে দেওয়া হলো। প্রশ্নটি খুবই সহজ - সরকারের কোনো এজেন্সি কি পেগাসাস কিনে ব্যবহার করেছে? অথচ প্রধানমন্ত্রী নিজের ভাষণে ‘‘অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ’’ বন্ধ করার কথা বলেছেন। এহেন কপটতা সত্যিই বেশ চমকপ্রদ!
উপসংহার
একতার মূল্যবোধ, বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই - এগুলিই ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ফসল। আজকের ভারতে সবচেয়ে বড়ো দুর্ভাগ্য হলো যখন আমরা গৌরবময় স্বাধীনতা সংগ্রামের হীরক জয়ন্তী উদযাপন শুরু করতে চলেছি, তখনই দেশের সরকারে এমনসব পূর্বপুরুষের চেলারা বসে রয়েছেন যাঁরা সেইসব মূল্যবোধেরই আগাগোড়া বিরোধী ছিলেন যার চর্চায় ভারত স্বাধীনতা অর্জন করেছে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে সেই করুণ বাস্তবতাই প্রতিফলিত হয়েছে।