৫৯ বর্ষ ৩ সংখ্যা / ২৭ আগস্ট, ২০২১ / ১০ ভাদ্র, ১৪২৮
৩১ আগস্টঃ আজকের প্রেক্ষিত
সুপ্রতীপ রায়
সেদিন ৮০ জন মানুষকে ঠান্ডা মাথায় পিটিয়ে খুন করেছিল পুলিশ।
৩১ আগস্ট পশ্চিমবাংলার গণ-আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিনটি খাদ্য আন্দোলনের শহিদ দিবস। গণ-আন্দোলনের শহিদ দিবস। ১৯৫৯ সালের ৩১ আগস্ট কেবলমাত্র খাদ্যের দাবিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ কলকাতায় মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। মিছিল থেকে স্লোগান উঠেছিল, ‘খাদ্য চাই-খাদ্য দাও-নইলে গদি ছেড়ে দাও’, ‘পশ্চিমবাংলায় নতুন করে দুর্ভিক্ষ করা চলবে না’ প্রভৃতি। মিছিল শান্তিপূর্ণ থাকলেও তৎকালীন কংগ্রেস সরকার মিছিলের উপর বর্বরোচিত আক্রমণ নামিয়ে এনেছিল। ঠান্ডা মাথায় ৮০ জনকে খুন করা হয়। বেসরকারি রিপোর্টে সংখ্যাটি আরও বেশি ছিল।
কিন্তু এই খাদ্য আন্দোলন কেন হয়েছিল? ১৯৫৬ সালে পশ্চিমবাংলায় ভয়ঙ্কর বন্যায় মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। স্বাধীনতার পর থেকে রাজ্যসরকারের ভূমিনীতি, কৃষি নীতি, খাদ্য নীতির ফলে খাদ্য সঙ্কট বাড়তে থাকে। ১৯৫৭ সালে রাজ্যে ব্যাপক খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। খাদ্য সঙ্কট সমাধানের দাবিতে কমিউনিস্ট পার্টি ধারাবাহিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ১৯৫৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কমিউনিস্ট পার্টি বিবৃতি দিয়ে বলেছিল, ‘‘...আমরা মনে করি এখনও সময় আছে। এখনও সর্বনাশ ঠেকানো যায়, কারণ, বাজারে বিক্রয়যোগ্য উদ্বৃত্ত ধান চাল এখনো পুরোপুরি বড়ো বড়ো মালিক, পাইকার ও মজুতদারদের হাতে চলিয়া যায় নাই। (১) ৫ লক্ষ টন মজুত; (২) কেন্দ্র হইতে সম্পূর্ণ ঘাটতি পূরণ; (৩) সর্বত্র ন্যায্যমূল্যে দোকান ও দোকান মারফত খাইবার যোগ্য চাল সরবরাহ; (৪) খুচরো বিক্রেতাদের জন্য চাউলের ব্যবস্থা; (৫) মিল মালিক ও পাইকারদের খুচরো বিক্রয় লাইসেন্স বাতিল এবং তাহাদের খুচরো দোকানদারদের চাউল সরবরাহ করিতে বাধ্য করা। এই ব্যবস্থাগুলি অবিলম্বে গ্রহণ করা হউক।...’’
খাদ্য সঙ্কট সমাধানের দাবিতে জ্যোতি বসু ২৪ আগস্ট, ১৯৫৯ বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন - ‘‘নিজেদেরই পলিসির ফলে রাজ্যে যে খাদ্য সমস্যা দেখা দিয়েছে তাহার সমাধানের চেষ্টা না করিয়া পশ্চিমবঙ্গ সরকার মুল্যবৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটির বিরুদ্ধে এবং যথেষ্ট খাদ্য সরবরাহের দাবিতে ও মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত জনগণের উপর বর্বর দমননীতি চালাইতেছে। যে সরকার বছরের পর বছর মজুতদার ও মুনাফাখোরদিগকে নির্বিবাদে সকল সরকারি নিয়ন্ত্রণাদেশ ভঙ্গ করিতে দিয়াছেন সেই সরকারই আজ গর্জন করিয়া উঠিয়াছেন যে, জনসাধারণের খাদ্য সুনিশ্চিত করিবার জন্য এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের ঘৃণ্য আচরণ নিয়ন্ত্রিত করিবার জন্য সরকারকে ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে বাধ্য করিবার উদ্দেশে চালিত জনসাধারণের আন্দোলন তাঁহারা বরদাস্ত করিবে না। পাইকারিহারে নিবর্তনমূলক আটক আইন, নিরাপত্তা আইন, ফৌজদারি কার্যবিধি আইন প্রযুক্ত হইতেছে। শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলনকে ধ্বংস করিবার জন্য সমগ্র পুলিশ বাহিনীকে মোতায়েন করা হইয়াছে। কিন্তু ন্যায্যভাবে খাদ্যশস্য বিতরণের জন্য এমন কর্মোদ্যম করিতে কখনো দেখা যায় না।...’’ (‘স্বাধীনতা’ ২৫ আগস্ট, ১৯৪৯)
বিধানসভার ভিতরে ও বাইরে খাদ্য সঙ্কট সমাধানের দাবি উঠলেও সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। খাদ্য আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে ১৪ জুলাই-২০ আগস্ট বিভিন্ন জেলার আদালতগুলিতে ও সরকারি দপ্তরগুলিতে শান্তিপূর্ণভাবে স্বেচ্ছাসেবকগণের সীমাবদ্ধ আইন অমান্যের মধ্যেদিয়ে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল। এতে ১,৬৩১ জন স্বেচ্ছাসেবক আইন অমান্য করে গ্রেপ্তার হন। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০ আগস্ট থেকে ৩১ আগস্ট কলকাতা সহ সমস্ত জেলা শহরগুলিতে কেন্দ্রীয় গণ-অভিযান, জেলাগুলির সদর আদালতে গণ-আইন অমান্য ও কলকাতায় মিছিল, আইন অমান্য হয়। ৩ সেপ্টেম্বর রাজ্যব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট, হরতাল পালিত হয়।
১৯৫৯ সালের ৩১ আগস্ট কলকাতার মনুমেন্ট ময়দানে ৩ লক্ষ নরনারীর এক অভূতপূর্ব সমাবেশ ও সভাশেষে লক্ষাধিক মানুষের বিশাল মিছিল অগ্রসর হতে থাকে। ১৪৪ ধারার এলাকার বাইরেই বিশাল পুলিশ বাহিনী কর্ডন করে মিছিলের পথ অবরোধ করে। সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ নেতৃত্বের প্রথম ব্যাচ আইন অমান্য করে গ্রেপ্তারবরণ করেন। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ফাটাতে থাকে ও বেপরোয়া লাঠি চার্জ করতে থাকে। লাঠির ঘায়ে ৮০ জনের মৃত্যুর কথা তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় স্বীকার করেছিলেন। যদিও বেসরকারি হিসাবে সংখ্যাটা অনেক বেশি ছিল। ৩১ আগস্টের কলকাতার মিছিলে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে মোট গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ২১ হাজার, মোট আহত হয়েছিলেন ৩ হাজার।
খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন চলতে থাকে। কারণ তৎকালীন রাজ্য সরকারের নীতি ছিল কৃষক বিরোধী ও ভূস্বামীদের পক্ষে। জমির অধিকার থেকে কৃষকদের বঞ্চিত করে জমি কেন্দ্রীভূত করা হয়েছিল। ফলে সঙ্কট বাড়তে থাকে। ১৯৬৬ সালে আবার খাদ্য আন্দোলনে কেঁপে উঠেছিল রাজ্য। ১৯৬৭ সালে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট সরকার। খাদ্য আন্দোলন, কৃষক, উদ্বাস্তু, ছাত্র, শ্রমিক আন্দোলনের পথ ধরে পশ্চিমবাংলায় তৈরি হয়েছিল প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার।
পশ্চিমবঙ্গের সংযুক্ত বামপন্থী ফ্রন্ট বিকল্প সরকারের কার্যক্রম জনগণের সামনে উপস্থিত করেছিল। সরকার গঠন হলে প্রাথমিক কাজ কী কী হবে তা জানানো হয়েছিল। সেগুলি হলো - ১) জনগণের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা, ২) সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণ; ৩) মাঠে ও কারখানার কাজে নিরাপত্তা; ৪) জনসাধারণের দুর্গত অংশের জন্য সাহায্য দেওয়া; ৫) জনসাধারণের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা করা; ৬) কর্মহীনদের কাজের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি।
প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার খাদ্য সঙ্কটের সমাধান ও ভূমিহীন কৃষকদের ভূমি বণ্টনের কাজ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে করেছিল। আইনবহির্ভুতভাবে যাঁদের হাতে জমি ছিল তাঁদের কাছ থেকে জমি উদ্ধার সহজ হয়নি। গণ-আন্দোলন সরকার পরিচালনার সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করেছিল। ১৯৬৭-র ৭ জুলাই বিধানসভায় ভূমিরাজস্ব মন্ত্রী হিসাবে কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙার বলেছিলেন, ‘‘জমিদার-জোতদাররা এত শক্তিশালী যে, তাহাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলন বা কৃষক জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা ব্যতীত কোনো ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে কার্যকরি করা সম্ভব নহে। প্রশাসন যন্ত্রের অন্তর্নিহিত দুর্বলতার জন্য এইরূপ সক্রিয় হস্তক্ষেপ ও সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। এইরূপ সহযোগিতা কিছুটা পাওয়া গিয়াছে বলিয়াই কিছু করা সম্ভব হইয়াছে।’’ ‘‘বেনামি জমি দখল করো, দখলে রেখে চাষ করো’’ - এই আহ্বান সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিল সারা ভারত কৃষক সভা।
স্বল্পস্থায়ী দু’টি যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময়ে তিন লক্ষ একর বেনামি জমি উদ্ধার করা হয় ও আড়াই লক্ষ একর উদ্বৃত্ত জমি বণ্টন করা হয়। যদিও যুক্তফ্রন্ট সরকার দু’টির পতনের পর জোতদাররা পুনরায় জমি কেড়ে নিতে থাকে। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার আসার আগে জমি কেন্দ্রীভূত ছিল জমিদার ও জোতদারদের হাতে। বামফ্রন্ট সরকার আইনিভাবে জমির অধিকার তুলে দিয়েছিল ভূমিহীন কৃষকের হাতে। পশ্চিমবঙ্গে ৩০ লক্ষেরও বেশি কৃষক ১১ লক্ষ ২৭ হাজার একরেরও বেশি জমি পেয়েছেন বিনামূল্যে। বামফ্রন্ট সরকারের এই পদক্ষেপে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। গরিব মানুষের হাতে অর্থ এসেছিল। বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্টেও পশ্চিমবঙ্গের এই সাফল্যকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ বলা হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকারের নীতির ফলেই খাদ্যে ঘাটতি পশ্চিমবাংলা উদ্বৃত্ত রাজ্যে পরিণত হয়েছিল।
২০২১ সালে আমরা যখন খাদ্য আন্দোলনের শহিদদের স্মরণ করছি তখন যে প্রশ্নটি জোরালোভাবে উঠে আসছে তা হলো - আমরা আর একটি খাদ্য সঙ্কটের সামনে? সারা দেশ ও রাজ্য ভয়াবহ কৃষি সঙ্কটের মুখে। মোদী সরকার ও মমতা সরকারের নীতি কৃষি ও কৃষক বিরোধী। কৃষি সঙ্কটের হাত ধরে খাদ্য সঙ্কট আসবে এটাই স্বাভাবিক।
চাষের খরচ কৃষকের হাতের বাইরে। দাম মিলছে না ফসলের। গরিব-প্রান্তিক কৃষক জেরবার ঋণের জালে। বিমার সুযোগের নামে কৃষককে প্রতারিত করা হচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তা বিপন্ন। অনাহারে থাকা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে আত্মহত্যা। গ্রামভারত-গ্রামবাংলায় বিপদে কৃষি ও কৃষক। বিজেপি এবং তৃণমূল সরকারের নীতির ফলে কৃষি ক্ষেত্রের সক্ষমতা বিপন্ন, কৃষকের স্বাধীন রোজগার নির্মূল হয়েছে। কৃষি উৎপাদনে সঙ্কট নেমে এসেছে। মোদীর প্রতিটি বাজেটেই কৃষকের স্বার্থের কথা বলে এমন সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে যা কর্পোরেট কৃষির কাজে লেগেছে। গ্রামভারতে সঙ্কট সমাধানের কোনো আশা নেই। বছরের পর বছর ধরে গোটা দেশে কৃষিতে সঙ্কট চলছে। যদিও কৃষির উপরেই দেশের সিংহভাগ মানুষের জীবিকা নির্ভরশীল।
সরকারি বিজ্ঞাপন আর প্রচারে মনে হতে পারে কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকৃতপক্ষেই কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে কাজ করছে। কিন্তু সরকার যদি আন্তরিক হতো তাহলে, প্রতিটি শস্যের উৎপাদনমূল্য থেকে ৫০ শতাংশ বেশি সহায়ক মূল্য নির্ধারণ ও ক্রয় কেন্দ্রের নিশ্চয়তা সুনিশ্চিত করতে আইন করতো, কৃষি প্রক্রিয়াকরণে জোর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কৃষকদের সামাজিক সমবায়ের মাধ্যমে গড়ে তুলতো বিপণন নেট ওয়ার্ক, প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সহ মকুব করতো মহাজনি ঋণ, কৃষক আত্মহত্যা মোকাবিলায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সুনিশ্চিত করতো সুদ মুক্ত ঋণ, সমস্ত কৃষক পরিবারের প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের সুযোগ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতো। এর কোনো কিছুই করা হয়নি।
নয়াউদারবাদের পথে চলতে গিয়ে সর্বনাশ করা হয়েছে কৃষি ক্ষেত্রের, অবহেলিত কৃষি ও কৃষক। নয়াউদারবাদী চরিত্রের মধ্যেই লুকিয়ে আছে কৃষিক্ষেত্রের উপর বৈষম্যমূলক আচরণ। কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। উদারনীতির বাধ্যবাধকতায় বিদেশি ফসলের অবাধ আমদানির ছাড়পত্র ইতিপূর্বেই দেওয়া হয়েছে। অসংখ্য কৃষিপণ্যের আমদানির ওপরে আমাদের দেশে যে পরিমাণগত নিয়ন্ত্রণ ছিল, তা আগেই তুলে নিয়েছে কেন্দ্র। বিদেশি বড়ো বড়ো কোম্পানিগুলিকে কৃষিপণ্যের বাণিজ্যে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে। বিদেশে প্রচুর ভরতুকি পাওয়া পণ্যের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে না পেরে আমাদের কৃষকদের সর্বনাশ হয়েছে।
বিশ্বব্যাঙ্ক, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নির্দেশে স্বাধীন দেশের সরকার কৃষিক্ষেত্রে সরকারি ভরতুকি ধারাবাহিকভাবে প্রত্যাহার করে চলেছে। মোদী সরকার ভারতীয় কৃষকের ফসলের দাম ও ফসল সংগ্রহ ব্যবস্থা থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। সাম্প্রতিক কৃষির তিনটি আইনের মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানিগুলিকে ছলে বলে কৌশলে কৃষককে সর্বনাশ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কৃষকের সর্বনাশ আর ওয়ালমার্ট, ফিউচার, রিলায়েন্স কোম্পানিগুলির পৌষমাস।
ভারতে কৃষকদের বিপন্নতার জন্য দায়ী কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি। বহুজাতিক সংস্থাগুলিকে কৃষিক্ষেত্রে অনুপ্রবেশের পথ করে দিয়েছে ভারত সরকার। গত তিন দশকে বিশ্বব্যাঙ্কের সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তির ফলে বিদেশি সংস্থাগুলি ভারতের কৃষি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। ফলে ভারতীয় কৃষক গভীর সঙ্কটে। কৃষকদের দারিদ্র্যতা বাড়ছে আর কর্পোরেটদের মুনাফা বাড়ছে। ১৯৯০-র দশক থেকে কৃষিতে সঙ্কট আরও গভীরতর হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে কৃষিতে রাষ্ট্রের যে ভূমিকা ছিল তা থেকে সরকার কার্যত সরে দাঁড়িয়েছে।
নয়াউদারবাদী নীতিতে চলতে গিয়ে সর্বজনীন গণবণ্টন ব্যবস্থা ভেঙে ফেলা হয়েছে। বিপন্ন আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা, খাদ্য সার্বভৌমত্ব। মুক্ত বাণিজ্য ও কাঠামোগত সংস্কারের নামে ভারতীয় কৃষকের উপর বাড়তি বোঝা চাপানো হয়েছে। জমির ঊর্ধ্বসীমার বিনিয়ন্ত্রণ, সেচ-বিদ্যুৎ-ঋণের উপর ভরতুকি তুলে নেওয়া, খাল-সেচ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক অধিকার প্রদান, খাদ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বানচাল করা, আগাম বাণিজ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া ইত্যাদির মধ্যদিয়ে কৃষককে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মনস্যান্টো, কারগিল, পেপসিকো প্রভৃতি বহুজাতিক সংস্থাগুলি গোটা কৃষি ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করেছে। এরাই আজ নব্য জমিদার। ওয়ালমার্ট, টেসকো প্রভৃতিকে ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করার ফলে কৃষক জমি হারাচ্ছেন ও বঞ্চিত হচ্ছেন।
আমাদের দেশে ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে। সবচেয়ে বেশি জমিচ্যুত হচ্ছেন আদিবাসীরা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আদিবাসীদের জমি ক্রয়-বিক্রয় বা অধিগ্রহণ নিষিদ্ধ হলেও জমি হস্তান্তর হয়েছে।বনাঞ্চলের জমিও হস্তান্তর হয়েছে। গত তিন দশকে জমির ঊর্ধ্বসীমা নিয়ন্ত্রণ আইন শিথিল করা হয়েছে। ফলে বহু পরিমাণ জমি সহজেই হস্তান্তরিত হচ্ছে। চুক্তিচাষ, গোষ্ঠী চাষের নামে বিপুল পরিমাণ জমি হস্তান্তরিত হচ্ছে কর্পোরেটদের হাতে। কৃষক জমিচ্যুত হচ্ছেন। কৃষকের আয় কমছে। যদিও মোদীর স্লোগান - ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করা হবে।
বাম আমলে পশ্চিমবাংলায় জমির মালিকানার বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছিল, জমির পুনর্বণ্টন হয়েছিল। ফলে জমির মাধ্যমে অনেক বেশি মানুষের আয় বেড়েছিল, খাদ্য নিরাপত্তাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকারের নীতির ফলে কৃষক জমির অধিকার ফিরে পেয়েছিল। আর তৃণমূল সরকারে এসেই এই সাফল্যকেই ‘বেআইনি’ ও ‘জমি ডাকাতি’র সঙ্গে তুলনা করেছিল। বামফ্রন্ট আমলে বেনামি জমি উদ্ধার করে তা খাস করে বিলি করা হয়েছিল গরিব-ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যেই। তৃণমূল সরকারে এসে গরিবের জমি কেড়ে নেওয়ার কাজ করতে থাকে। ‘মা-মাটি-মানুষ’-এর সরকারের আমলে গরিব-পাট্টাদার, খেতমজুর, বর্গাদার সবাই আক্রান্ত। ৩৪ বছরের বাম আমলে যে জমির অধিকার কৃষক পেয়েছিল তা হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রচুর রায়তকে তাদের জমি লিখে দিতে বাধ্য করা হয়েছে।
এক ভয়ঙ্কর অবস্থার মুখোমুখি বাংলার কৃষক। পরিবর্তনের বাংলায় ফসলের দাম নেই। ধান, পাট, আলুর দাম কৃষকরা পাচ্ছেন না। ধার করে অনেক দাম দিয়ে কৃষিজ উপাদান কিনে চাষের পর ফসলের দাম পাচ্ছেন না চাষি। তৃণমূলের আমলে এফসিআই, জেসিআই-কে নিয়ম মতো ফসল সংগ্রহে নামানো হচ্ছে না। এই সুযোগে গ্রামে গ্রামে ফড়ে, মজুতদাররা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অভাবী বিক্রয় বেড়েই চলেছে।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে অভাবী বিক্রয় রুখতে সমবায়, স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির মাধ্যমে প্রতি বছর ১৭/১৮ লক্ষ টন চাল সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কেনা হতো। তৃণমূল সরকার মিল মালিকদের কাছ থেকে বেশি দামে চাল কিনলেও, কৃষকের কাছ থেকে চাল কেনে না। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে আলুর দাম পড়ে গেলে সরকার ভরতুকি দিয়ে বেশি দামে কৃষকের কাছ থেকে আলু কিনেছে। আর গত এক দশক ধরে কৃষকদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছেন মাননীয়া। ফলে সঙ্কট বাড়বে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমছে। জিনিসের দাম বাড়ছে। ফলে খাদ্য মানুষের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে।
খাদ্যের নিরাপত্তার বদলে বাড়ছে ক্ষুধার নিরাপত্তা। খাদ্য নিরাপত্তা বিপন্ন করে ব্যক্তিগত পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে। সরকারের খাদ্যনীতি বাজার নির্ভর হয়ে পড়েছে। কৃষকের অবস্থান উৎপাদক থেকে ক্রেতায় পরিণত হয়েছে। লগ্নি পুঁজির দাপট ক্রমবর্ধমান। স্বভাবতই খাদ্যনীতিও সেই দাপটের বাইরে নেই। নয়াউদারবাদী নীতিতে খাদ্যকে একটি পণ্যরূপে দেখা হচ্ছে। গ্রামীণ কৃষিক্ষেত্র দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে প্রতিদিন। কৃষকদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজার ও পুঁজির খেয়ালের উপর। আমাদের দেশে বাড়ছে খাদ্যের জোগানের অনিশ্চয়তা, বাড়ছে আধপেটা মানুষের ভিড়। খাদ্য ও জীবিকার অনিশ্চয়তা বাড়ছে।
তাই আজও ৩১ আগস্ট প্রাসঙ্গিক। শ্রেণি ভারসাম্য পরিবর্তনের অঙ্গীকার ধ্বনিত হোক শহিদ দিবসে।