৫৯ বর্ষ ৩ সংখ্যা / ২৭ আগস্ট, ২০২১ / ১০ ভাদ্র, ১৪২৮
বিজ্ঞান আলোচনা
দ্বিশতজন্মবর্ষ স্মরণে
যুক্তিবাদী পাদ্রি গ্রিগর মেন্ডেলের কথা
তপন মিশ্র
মেন্ডেল নাস্তিক ছিলেন না, কিন্তু ভাববাদী ধর্মীয় দর্শনের গোঁড়ামি তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। অন্য ধর্মযাজকদের মতো তিনি যদি গোঁড়া হতেন তাহলে তথাকথিত ভগবানের সৃষ্টিকে অঙ্কের ছকে ব্যাখ্যা করার মেধা তাঁর মধ্যে থাকত না। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় নিজের গবেষণার জন্য বিখ্যাত হননি, যদি তাও হতো তাহলে অনেক যন্ত্রণার শিকার হতে হতো তাঁকে। যেমনটা হয়েছিলেন ব্রুনো,গালিলিও, এমনকি চার্লস ডারউইনও। এক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে থেকে জীবজগতের প্রবহমানতার বস্তুগত ব্যাখ্যা যিনি দিতে পারেন তিনি যুক্তিবাদী হবেন এটা আশ্চর্যের তো বটেই। এই অর্থে গ্রিগর জোহান মেন্ডেল ছিলেন একজন ধর্মযাজক হয়েও আপাদমস্তক বস্তুবাদী এবং বিজ্ঞানসাধক।
‘বস্তুবাদী’ কারণ তিনিই প্রথম বললেন যে, এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে পিতামাতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বহন করে নিয়ে যায় যেগুলি সেগুলি হলো এক ধরনের বস্তু বা ফ্যাক্টর (factor)। তার কয়েক বছর পরে বোঝা যায়, এই ফ্যাক্টরগুলি আসলে জিন। ১৯৫৩ সালে ওয়াটসন এবং ক্রিকের ডিএনএ অণুর গঠন আবিষ্কার এই বস্তুর আসল চেহারা আমাদের সামনে নিয়ে এলো। কেবল বস্তুবাদের কেতাব পড়লে বস্তুবাদী হওয়া যায় না, তার জন্য চাই এক বিশ্লেষণী মন।
১৮২২ সালের ২২ জুলাই অর্থাৎ আজ থেকে ২০০ বছর আগে বর্তমানের চেক রিপাবলিকে তাঁর জন্ম। বিজ্ঞানের ইতিহাস এবং দর্শন যাঁদের ভাবায়, আগামী ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত তাঁরা বিশ্বজুড়ে মেন্ডেলের চিন্তা নিয়ে আলোচনা করবেন। একজন ধর্মযাজক বস্তুবাদী হবেন, তাও আবার আজ থেকে প্রায় ১৫০ বছর আগেকার ইয়োরোপে, একথা ভাবাই কঠিন।
মেন্ডেল পরিবারের মাতৃভাষা ছিল ডয়েচ (জার্মানদের ভাষা)। জার্মানি লাগোয়া চেক রিপাবলিকের ব্রুন (Brunn, পুরাতন নাম Brno) শহরে অগাস্টিন আবে সেন্ট থমাস চার্চ ছিল তাঁর কর্মক্ষেত্র। তখন চেক রিপাবলিক অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। বাবা ছিলেন সাধারণ এক কৃষক, কিন্তু তাঁকে নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীতে অনেকদিন ধরে কাজ করতে হয়েছিল। মেন্ডেলের বয়স যখন ২৮, তিনি শিক্ষকতার যোগ্যতা অর্জনের জন্য ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পরীক্ষায় বসেন। এখানে তিনি বায়োলজি এবং ফিজিক্স উভয় বিষয়ে ফেল করেন। অথচ তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে সারাবিশ্ব হৃদয়ঙ্গম করে যে, তাঁর মতো জীববিজ্ঞানী এবং জীববিজ্ঞান গবেষণায় গাণিতিক পদ্ধতির প্রয়োগে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার কাজ সেই সময়কার বিশ্বে কেউ করতে পারেননি। জীববিজ্ঞানে অঙ্ক এবং রাশিবিজ্ঞানের প্রয়োগ বিশ্বে তিনি সর্বপ্রথম করেন। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ বছর পড়াশোনা করার পর অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হওয়ার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েন তিনি। তখন তাঁর সামনে একটাই পথ খোলা ছিল - চার্চে পাদ্রির কাজের সাথে সাথে কম বেতনে অস্থায়ী শিক্ষক হিসাবে কাজ করা। মেন্ডেল ডয়েচ ছাড়াও লাতিন, সিরিয়ান, আরবি, গ্রিক ইত্যাদি জানতেন এবং তাই বিভিন্ন ভাষাভাষীদের পড়াতে তাঁর অসুবিধা হতো না। ১৮৪৩ সালে তিনি চার্চে এক শিক্ষানবিশ হিসাবে যোগ দেন এবং ১৮৪৬ সালে তিনি আবট (Abbot) অর্থাৎ চার্চের প্রধান হয়ে যান। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে মলিকুলার জেনেটিক্স জিনমিক মেডিসিন (Mol. Genet. Genomic Med. 2015 Nov; 3(6): 483-485) পত্রিকায় মেন্ডেলের নাতির নাতি (পত্রিকাটি মেন্ডেলকে কিল্মেন্সের ‘great-great-grand uncle’ হিসাবে পরিচিত করিয়েছে) কিল্মেন্স রিচার্ড, মেন্ডেলের তাঁর বন্ধুকে লেখা এক চিঠির উদ্ধৃতি দেন। তাতে লেখা ছিল “Even though I have experienced some dark hours during my life time, I am grateful that the beautiful hours have outweighed the dark ones by far. My scientific work has brought me great joy and satisfaction; and I am convinced that it won't take long that the entire world will appreciate the results and meaning of my work.”। হ্যাঁ, কিছু বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে। বাধা যেমন ছিল অস্ট্রিয়া সরকারের পক্ষ থেকে তেমনই ছিল অগাস্টিন সেন্ট থমাস চার্চের কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকেও।
যুক্তিবাদের প্রথম পাঠ
আবার তিনি ১৮৫৩ সালের আগস্টে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২২ মাস পড়াশোনা শেষ করে ফিরে আসেন। মেন্ডেল ব্রুনেতে ফিরে আসার পরে বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসাবে অনুমোদিত না হলেও বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং পদ্ধতি সম্পর্কে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেন। ভিয়েনাতে মেন্ডেলের উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন ফ্রাঞ্জ উঙ্গার (Franz Unger)। তিনি ১৮৫১ সালে উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি তত্ত্ব প্রণয়ন করেন। এই তত্ত্বের নাম “Unger’s theory of universal common descent” (Gliboff S,1999 Gregor Mendel and the laws of evolution. Hist Sci 37:217-235)। এই তত্ত্বে উঙ্গারের বক্তব্য ছিল যে, প্রত্যেকটি প্রজাতি কোনো একটি পূর্বতন প্রজাতি থেকে অভিব্যক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। উঙ্গারের কথায় - “not by any means a one-sided lineal progression, but a radiation broadening out on all sides” (Unger 1853, p. 107)। ফলে উঙ্গার চার্চের প্রবল সমালোচনার শিকার হন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি যে অভিব্যক্তিবাদ আঁকড়ে ধরেছিলেন তা বোঝা যায় প্রথমত ডারউইনের তত্ত্বের উপর তাঁর গভীর বিশ্বাস এবং ছাত্রদের তিনি যে নোট দিতেন সেগুলিতে প্রকাশিত তাঁর মত থেকে।
মেন্ডেল ব্রুনোর চার্চে ফিরে আসার পর ভিয়েনায় তাঁর অভিব্যক্তিবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে তাঁকে অন্যান্য ধর্মযাজকরা সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে। কেউ কেউ তাঁকে ধর্মনিরপেক্ষতার দোষে দুষ্ট করে। ফলে তাঁকে অগাস্টিন চার্চে অফিসিয়াল সেন্সরের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে একটি কমিশনও গঠিত হয়। স্কাফগোতসচ নামে একজন পাদ্রি অনুসন্ধানের পর মেন্ডেলের বিরুদ্ধে লেখেনঃ ‘‘মেন্ডেল ভিয়েনার একটি পার্থিব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হওয়ার জন্য চার্চের ব্যয়ে অপবিত্র বিজ্ঞান অধ্যয়ন করেন।”কিন্তু এর ফলে তাঁর গবেষণার কাজে কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি এবং এই মন্তব্য মেন্ডেলের খুব একটা ক্ষতি করতে পারেনি কারণ সেই সময়ে বিজ্ঞানী মহলে মেন্ডেল ছিলেন অনালোচিত, তাই বিতর্কের বাইরে।
মেন্ডেলের ১৮৫৪ থেকে ১৮৬৩ পর্যন্ত মটর গাছের সংকরায়ন সম্পর্কিত কাজ পরবর্তীকালে তাঁকে জেনেটিক্স-এর পিতা (father of genetics) হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। চার্চের পিছনে একখণ্ড জমিতে সংকরায়ন এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষার তথ্য সংরক্ষণ ছিল তাঁর নিত্যদিনের কর্মপদ্ধতি। সংকরায়নের কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। তাঁর মূল প্রশ্ন ছিল, কিভাবে একটি জনু থেকে পরের জনুতে শারীরিক বৈশিষ্যের সঞ্চারণ ঘটে? পরীক্ষালব্ধ উত্তরের উপর ভিত্তি করে তিনি তিনটি সূত্রের প্রণয়ন করেন। সবগুলো সূত্র যে এখনকার জিন সংক্রান্ত জ্ঞানের বিচারে ঠিক ছিল তা নয়। কিন্তু তিনি এই সূত্রগুলির মধ্যদিয়ে বিজ্ঞানের যে দিকটায় আলোকিত করলেন তা আগে কেউ এমন করে ভাবেনি বা ভাবতে সাহস করেনি। ভগবানের বদলে প্রকৃতির নির্ধারিত নিয়মে (মেন্ডেলের সূত্র অনুযায়ী) বংশগতি নির্ধারিত হবে, একথা বলার সাহস আগে কেউ দেখায়নি।
পুনরুজ্জীবন
তাঁর জীবদ্দশায় এই সূত্রগুলি কেউ বোঝেনি। মেন্ডেলের মৃত্যু হয় ১৮৮৪ সালের ৬ জানুয়ারি। তার ১৬ বছর পর ভিন্ন ভিন্ন দেশের তিন বিজ্ঞানী কাকতালীয়ভাবে মেন্ডেলের সূত্রের পুনরাবিষ্কার করেন। ১৮৬৫ সালে মেন্ডেল তাঁর কাজের সারাংশ বিজ্ঞানীদের সামনে আনার চেষ্টা করেন। তার পরের বছর অর্থাৎ ১৮৬৬ সালে ‘Versuche uber Pflanzen-Hybriden (J Hered 42:3-47, ১৮৬৬ এবং পুনর্মুদ্রণ ১৯৫১)’ নামে এক পত্রিকায় প্রবন্ধটি ছাপা হয়। ৪৮ পাতার এই গবেষণাপত্র তিনি শতাধিক বিজ্ঞানীকে মতামতের জন্য পাঠান। একটি ডারউইনের কাছেও পৌঁছায়। ডারউইন যদি একবার তা পড়তেন সম্ভবত তাহলে ডারউইন তাঁর প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের কিছু অংশ নতুন করে লেখার উৎসাহ পেতেন। ডারউইনের মৃত্যু (১৮৮২)-র পর মুখবন্ধ খামটি পাওয়া যায়।
যে তিন বিজ্ঞানীর কথা আগে বলা হলো, এঁদের মধ্যে জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল করেন্স (Carl Erich Correns) ছিলেন বিখ্যাত সুইস উদ্ভিদবিজ্ঞানী কার্ল ভন নাগেলির (Carl Wilhelm von Nageli) ছাত্র। মেন্ডেল নিজের গবেষণাপত্রটি নাগেলিকে পাঠিয়ে মতামত জানতে চেয়েছিলেন। তিনি এই গবেষণাকে একেবারেই পাত্তা দেননি। স্বাভাবিকভাবেই, নাগেলি নিজের ছাত্রের কাছেও মেন্ডেলের কথা জানানোর প্রয়োজনবোধ করেননি। করেন্স কিন্তু ১৮৯২ সাল থেকে বংশগতি বিজ্ঞানের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষার ফল প্রকাশ করেন একটি প্রবন্ধে। ১৯০০ সালে প্রকাশিত এই প্রবন্ধের নাম ছিল ‘‘G. Mendel’s Law Concerning the Behaviour of the Progeny of Racial Hybrids’’ (Berichte der Deutschen Botanischen Gesellschaft. 18: 158-168)। এই প্রবন্ধটিতে মেন্ডেলের যে দুটি সূত্রের কথা উল্লেখ করেন, সেগুলি হলোঃ ‘law of segregation’ এবং ‘law of independent assortment’।
দ্বিতীয় জন হলেন ডাচ উদ্ভিদবিজ্ঞানী হুগো দে ভ্রিস (Hugo Marie de Vries)। তিনি ১৮৯৭ সালে বিশ্বকে জানালেন তাঁর তত্ত্ব, যেখানে উনি উল্লেখ করলেন যে, প্রজাতির এক একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণ, কোষে থাকা একটি ক্ষুদ্র কণা। দে ভ্রিস এই কণার নাম দিলেন প্যানজিন। ১৯০০ সালে দে ভ্রিস-এর বন্ধু তাঁকে একখানা চিঠি পাঠালেন, সাথে সাড়ে তিন দশক প্রাচীন এক গবেষণাপত্র। চিঠিতে ‘জনৈক মেন্ডেলের’ গবেষণাপত্রও যুক্ত করেন। একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন দে ভ্রিস। এতদসত্ত্বেও ও ১৯০০ সালে ভ্রিস-এর যে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হলো, সেখানে জনৈক মেন্ডেলের প্রসঙ্গ অনুল্লেখিত রইল। এর পর করেন্সের প্রবল সমালোচনার মুখে দে ভ্রিস মেন্ডেলের অবদানের কথা স্বীকার করেন এবং পরের সংস্করণে তা উল্লেখ করেন।
তৃতীয় জন হলেন অস্ট্রিয়ার কৃষিবিজ্ঞানী এরিক জারমার্ক (Erich con Tshermak)। ১৯০০ সালে তাঁর প্রকাশিত গবেষণাপত্র ‘Uber kunstliche Kreuzung bei Pisum sativum’ (Berichte der deutschen botanischen Gesellschaft 18:232-239)-তে মেন্ডেলের গবেষণার কথা উল্লেখ করেন। ১৯৫০ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ করে এই গবেষণাপত্র ‘জেনেটিক্স’(Genetics) পত্রিকায় পুনঃপ্রকাশিত হয় (Concerning artificial crossing in Pisum sativum. 35(42-47)।
মেণ্ডেলের প্রথম জীবনীকার ব্রুন শহরের একজন বিজ্ঞানী হুগো ইল্টিস (Hugo Iltis) লেখেন - “When he died, no one was aware of the importance of Mendel's work, and the few hand-written notes were carelessly put aside or burnt.”। অত্যন্ত অযত্নে তাঁর গবেষণার ফসল ছড়িয়ে ছিল। ১৯৬৫ সালে ব্রুন শহরের সেই চার্চের এক সভায় বলা হয় - “Mendel whose language is that of a Luther, Leibnitz, Kant, and Goethe, today not only belongs to the international scientific world, but he belongs to all of us.”। মেন্ডেলের উপেক্ষিত গবেষণা এখন এতটাই প্রাসঙ্গিক যে, বিশ্বের সমস্ত প্রান্তে মেন্ডেলিজম জিনতত্ত্বের প্রথম পাঠ হিসাবে স্বীকৃত।