৬০ বর্ষ ২৪ সংখ্যা / ২৭ জানুয়ারি, ২০২৩ / ১২ মাঘ, ১৪২৯
কলকাতার হৃদয়জুড়ে চে গুয়েভারা
প্রাণময় সংবর্ধনা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত হলেন চে কন্যা অ্যালাইদা গুয়েভারা
কলেজ স্ট্রিটের সংবর্ধনা সভায় বক্তব্য রাখছেন চে গুয়েভারার কন্যা অ্যালাইদা।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের প্রাণকেন্দ্র কলকাতা কিউবার চিরসহমর্মী। ২০ এবং ২১ জানুয়ারি কলকাতা ও সংলগ্ন একাধিক প্রান্ত বিভিন্ন কর্মসূচিতে প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট বিপ্লবী চে গুয়েভারার কন্যা অ্যালাইদা এবং দৌহিত্রী এস্তেফানিয়াকে ফুলমালায় এবং শান্তি, সংহতি, সম্প্রীতি, মৈত্রীর মুখরিত স্লোগানে বরণ করে উচ্চারণ করে একথাই। ভারত-কিউবা মৈত্রী বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে ‘সারা ভারত শান্তি ও সংহতি সংস্থা’ ও ‘ন্যাশনাল কমিটি ফর সলিডারিটি উইথ কিউবা’র উদ্যোগে কেরালা, বেঙ্গালুরু, চেন্নাইয়ের কর্মসূচির পর তাঁরা কলকাতায় এসেছিলেন ২০ জানুয়ারি।
তাঁদের বিমান মাটি ছুঁলে ২০ জানুয়ারি সকন্যা অ্যালাইদা-কে বিমানবন্দর এক নম্বর গেটের বিপরীতে ফ্লেক্স, ব্যানার ও ফুলের মালায় স্বাগত জানান স্কুল ছাত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বামপন্থী গণসংগঠনের কর্মী ও নেতৃবৃন্দ। উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এম) নেতা শমীক লাহিড়ী ও পলাশ দাশ।
কর্মসূচির অংশ হিসেবে চে-কন্যা এদিন দুপুরে বরানগরের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে (আইএসআই) আসেন। প্রসঙ্গত, ১৯৫৯ সালের ১০ জুলাই কিউবার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আর্নেস্টো চে গুয়েভারা ভারত সফরে এসে আইএসআই-তে এসেছিলেন। সবিস্তারে সেই সফরের কথা জানিয়ে চে গুয়েভারার আগমনের সময় তোলা ঐতিহাসিক ছবি এবং স্মারক উপহার তাঁদের হাতে এদিন তুলে দেওয়া হয়। পেশায় চিকিৎসক অ্যালাইদা এখানে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভায় যোগ দেন।
এরপর বনহুগলি মোড়ে এআইপিএসও’র উদ্যোগে সংবর্ধনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। অ্যালাইদা গুয়েভারা এবং এস্তেফানিয়া গুয়েভারা সেখানে উপস্থিত হওয়া মাত্রই তাঁদের অভিনন্দন জানিয়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে স্লোগান মুখরিত হয়ে ওঠে সমগ্র জমায়েত। বাংলা ও স্প্যানিশে স্বাগত ভাষণ পাঠ করেন এআইপিএসও’র উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সাধারণ সম্পাদক পারভেজ রহমান। বরানগরের নাগরিকদের পক্ষে সংবর্ধনা ও স্মারক উপহার দেন তন্ময় ভট্টাচার্য। হোসে মার্তির লেখা কবিতা অবলম্বনে বাংলা ও স্প্যানিশ ভাষান্তরে সঙ্গীত পরিবেশন করেন কঙ্কণ ভট্টাচার্য ও ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সাগ্নিক শাখা। অ্যালাইদা গুয়েভারা এবং এস্তেফানিয়া গুয়েভারার হাতে ‘স্টুডেন্টস স্ট্রাগল’ পত্রিকার কপি তুলে দেন এসএফআই’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ময়ূখ বিশ্বাস। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন দেবজ্যোতি দাস।
এরপর সন্ধ্যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তাঙ্গনে এআইপিএসও’র উদ্যোগে এবং আফসু’র সহযোগিতায় সংবর্ধনা দেওয়া হয় অ্যালাইদা ও এস্তেফানিয়া গুয়েভারাকে। চে’র কন্যাকে স্বাগত জানাতে মিছিল করে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পৌঁছান যাদবপুর এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বামপন্থী কর্মী-সমর্থকরা। চে’র উত্তরাধিকারীদের দেখতে উন্মুখ হাজার জনতার ভিড়ে ছাপিয়ে যায় মুক্তাঙ্গন। সকন্যা অ্যালাইদা যাদবপুরে পৌঁছালে তাঁদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসেন যাদবপুর অঞ্চলের যুবকর্মীদের বাইক মিছিল। এআইপিএসও’র পরিমল দেবনাথ ও অঞ্জন বেরা, বিনায়ক ভট্টাচার্য, আফসু’র শ্রেয়সী ব্যানার্জি, ফ্রেন্ডস অফ লাতিন আমেরিকা, যাদবপুর ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (জুটা)’র সভাপতি পার্থপ্রতিম রায় ও সম্পাদক পার্থপ্রতিম বিশ্বাস তাঁদের সংবর্ধিত করেন। এসএফআই’র পক্ষ থেকে ময়ূখ বিশ্বাস ও প্রতীক উর রহমান ‘এডুকেশন ও এক্সক্লিউশান’ বইটি তুলে দেন অ্যালাইদার হাতে। অনুষ্ঠানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ উপাচার্য চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য, প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসু এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সঞ্জয় গোপাল সরকারও উপস্থিত ছিলেন। এখানে সংক্ষিপ্ত ভাষণে আলেইদা বলেন তাঁর মুগ্ধতার কথা। বলেন, টি শার্টে নয়, চে’র স্থান হৃদয়ে।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন অর্ক মুখার্জি, সাত্যকি ব্যানার্জি (বর্ণ অনন্য), দুর্নিবার সাহা, পটা, ভাস্কর রায়, আকাশ চক্রবর্তী, তৈষী, দেবদীপ মুখার্জি, পূরবী মূখার্জি, তিতুমীর কালেক্টিভ, গৌতম ঘোষাল প্রমুখ। শিল্পীদের নিবেদনে গানে রবীন্দ্র সঙ্গীত থেকে নজরুল ইসলাম, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সুকান্ত ভট্টাচার্য, হেমাঙ্গ বিশ্বাস সহ সমসাময়িক কম্পোজিশনের উপস্থাপনা এবং কবিতা পাঠে ছিল সুনীল গাঙ্গুলির রচনা ‘‘চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।’’ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বিশিষ্ট পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় এবং রঙ্গন চক্রবর্তী।
মুক্তাঙ্গনে উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, রামচন্দ্র ডোম সহ ছাত্র-যুব আন্দোলনের প্রাক্তন নেতা সুজন চক্রবর্তী, শমীক লাহিড়ী, পলাশ দাশ প্রমুখ।
২১ তারিখ সকালে উত্তরপাড়ার গণভবনে আ্যালাইদাকে সারা ভারত শান্তি ও সংহতি সংস্থার তরফে সংবর্ধনা জানানো হয়। এদিন বালি খাল থেকে জিটি রোড ধরে বর্ণাঢ্য পদযাত্রার মধ্য দিয়ে সকন্যা আ্যালাইদাকে উত্তরপাড়া গণভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সাধারণ মানুষের ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে তিনি গণভবনে প্রবেশ করেন। এদিন সিপিআই(এম) সহ বিভিন্ন বামপন্থী দল ও গণসংগঠনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে গণনাট্য সংঘের রাজ্য সভাপতি হিরণ্ময় ঘোষালের নেতৃত্বে শিল্পীরা পরিবেশন করেন ‘গুয়ানতানামেরা’ গান। পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী ও লোক শিল্পী সংঘের তারকেশ্বরের শিল্পীরা, টুসু ও ভাদু গান পরিবেশন করেন। তাঁদের গানে অংশ নেন আ্যালাইদা। সংবর্ধনায় আপ্লুত চে কন্যা বলেন, বিপ্লবী চে-র মৃত্যু হয় না। উত্তরপাড়ার সংবর্ধনার ফাঁকে শিশুদের সঙ্গে আলাপচারিতায় অংশ নেন তিনি। তাদের কয়েকজনকে চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ তিনি দিয়েছেন। এই সংবর্ধনা সভা পরিচালনা করেন শ্রুতিনাথ প্রহরাজ। উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এম) নেতা দেবব্রত ঘোষ।
দুপুরে কলেজ স্ট্রিটের অনুষ্ঠানে এসএফআই, ডিওয়াইএফআই সহ সংবর্ধনা দেওয়া হয় সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ-পশ্চিমবঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ লেখক শিল্পী সংঘ, জনবাদী লেখক সংঘ, সারা ভারত শান্তি ও সংহতি সংস্থা, পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী ও লোকশিল্পী সংঘ, সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন, এবিটিএ, এবিপিটিএ, বিমা কর্মচারী ইউনিয়ন, ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ ফেডারেশন, পশ্চিমবঙ্গ কলেজ শিক্ষা কর্মচারী ইউনিয়ন প্রভৃতি সংগঠনের পক্ষ থেকে। সংবর্ধনা চলাকালীন চে গুয়েভারা ও কিউবার বিপ্লবের কথা রং তুলিতে মূর্ত করেন শিল্পী দীপালি ভট্টাচার্য, মনীষ দেব, কমল আইচ, সুব্রত বসু, দীপাঞ্জন বসু, রত্না বসু, পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও অনিরুদ্ধ মুখার্জি প্রমুখ।
কলেজ স্ট্রিটে সংবর্ধনা সভা সঞ্চালনা করেন তপারতি গঙ্গোপাধ্যায়। সংগীত পরিবেশন করে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ, ক্যালকাটা ইউথ কয়ার, বিপুল-অনুশ্রী, কাজী কামাল নাসের, কবীর চট্টোপাধ্যায়, সপ্তক দাস প্রমুখ।
উপস্থিত ছিলেন এসএফআই নেতা ময়ূখ বিশ্বাস, প্রতীক-উর রহমান, সৃজন ভট্টাচার্য, ডিওয়াইএফআই নেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির রাজ্য সম্পাদিকা কনীনিকা ঘোষ, গণনাট্যের দিব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের রজত বন্দ্যোপাধ্যায়, জনবাদী লেখক সংঘের রাম আহ্লাদ চৌধুরীসহ বিভিন্ন বামপন্থী গণসংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
এদিন সন্ধ্যায় হেদুয়ার আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় আ্যালাইদা গুয়েভারাকে সংবর্ধিত করা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এম) নেতা মহম্মদ সেলিম, কল্লোল মজুমদার, সুখেন্দু পানিগ্রাহী সহ নেতৃবৃন্দ।
কলেজ স্ট্রিটের সভায় আলেইদা গুয়েভারা বলেন, এখানে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে আমি দেখলাম ভালোবাসার প্রবাহ চলে এখানে। আমি এখানে দেখেছি আপনারা সবাই আমাকে ভালোবাসছেন। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এটাই যে, আমি নিজে কতোটা মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারি। আমার দেশের জনগণ আপনাদের সংহতি, ভালবাসা চায়। আমাদের লড়াই বাকি রয়েছে। আমাদের এমন সমাজ গড়তে হবে যা হবে মুক্ত। জীবন বড়োই ছোটো, সময় কম। বিভিন্ন দেশের গানে রয়েছে চে’র কথা। একজন চে চলে গেছেন, কিন্তু রয়ে গেছে হাজারো-লাখো চে। গানের মধ্য দিয়ে তিনি বলেন, তুমি যে শপথ করেছিলে/ আমি তা অনুভব করি/ তাই সে শপথ রক্ষায়/ আমিও আমার জীবন উৎসর্গ করতে পারি।
২০-২১ তারিখের সব কর্মসুচিতেই অ্যালেইদা গুয়েভারার শুভেচ্ছা ভাষণ বাংলায় অনুবাদ করেন শুভেন্দু সরকার।