৬০ বর্ষ ২৪ সংখ্যা / ২৭ জানুয়ারি, ২০২৩ / ১২ মাঘ, ১৪২৯
শাসকদের হাতেই বিপন্ন দেশের সংবিধান
সুজন চক্রবর্তী
স্বাধীনতার ৭৫বছর পার হলাম আমরা। সংবিধানের এটি ৭২বছর। দেশ গঠনের শক্ত পোক্ত ভিত করবার জন্য সময়টা নেহাত কম নয়। আমাদের থেকে পরে স্বাধীনতা অর্জন করেছে এমন অনেক দেশই তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ নানাবিধ সূচকে এই দেশগুলি আমাদের চাইতে অনেক এগিয়ে। দারিদ্র্য, গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা - এরকম বহুবিধ ক্ষেত্রেই আমাদের হাল অনেকটাই তলানিতে। জাতীয়, আন্তর্জাতিক নানা তথ্য সমীক্ষায় দেশের এই দুর্বিসহ চেহারাটা প্রতিদিনই নতুন নতুন করে ধরা পড়ে যাচ্ছে।
ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতার বিস্তৃতিতে আমাদের দেশের ভিত যথেষ্টই শক্তিশালী। জমি-খনি-জলের সম্ভার অন্য অনেক দেশের চাইতেই বেশি এবং প্রাচুর্যে ভরা। স্বাধীনতার লড়াই এবং তার ভিতর থেকে গড়ে ওঠা দেশের সংবিধান সুগঠিত। তর্ক-বিতর্ক-যুক্তির লড়াইয়ের নির্যাস সংবিধানের ছত্রে ছত্রে। দেশের নানা বৈচিত্র্য এবং বিন্যাসের যথাযথ স্বীকৃতি দিয়েই গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিজ্ঞান মনস্কতার শপথ রক্ষা করেই আধুনিক দেশ গড়ে তোলবার শপথ ‘‘We the people of India’’-কে সঙ্গে নিয়েই রাজ্য-ভাষা-জাতি-ধর্মের বিভিন্নতার স্বীকৃতি দিয়েই দেশের সংবিধান। যুক্তরাষ্ট্রীয়। কেন্দ্রীভূত নয়। ন্যায়বিচার, যুক্তি, সাম্য, সৌভ্রাতৃত্বের শপথ নিয়েই সংবিধানের প্রস্তাবনা। আইন, প্রশাসন এবং বিচারের তিনটি মূল ভিত্তিকে শক্তিশালী করেই দেশ পরিচালনা। দেশকে শক্তিশালী এবং ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে নেওয়ার স্বার্থেই Legislature, executive এবং judiciary এই তিনটি ভিতকেই পারস্পরিকভাবে শক্ত এবং দায়বদ্ধ করাটা অত্যন্ত জরুরি। দেশ এবং দেশের সংবিধানকে রক্ষা করার ক্ষেত্রেই এই তিনটি অংশের ভূমিকাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৫০ সালে প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে সংবিধান রচয়িতা ডাঃ বি আর আম্বেদকর অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে যে কথা বলেছিলেন তার গুরুত্ব ক্রমশই বেশি করে স্পষ্ট হচ্ছে। তিনি সতর্ক করে দিয়েই বললেন, ‘‘On the 26th January 1950 We are going to enter into a life of contradiction. In politics we will have equality and in social and economic life we will have inequality. In politics we will be recognizing the principle of one man one vote, one vote one value. In our social and economic life we shall, by reason of our social and economic structure, continue to deny the principle of one man one value. This is the contradiction.’’ আম্বেদকর সাহেবের সতর্কতা ছিল স্পষ্ট। তিনি বললেন যে, এই অসাম্য যদি বেড়েই চলে তা দেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র এবং ভবিষ্যতের জন্যে সর্বনাশা হতে বাধ্য।
অথচ আজকের চেহারাটা কী? এই অসাম্য বেড়েই চলেছে। দেশের গুটিকতকের হাতে সম্পদের পাহাড় যখন ক্রমশ বাড়ছে, তখন একটা বড়ো অংশের মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। দেশে অল্প কিছু মানুষ অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বিশাল সম্পদের মালিক হচ্ছেন - এটা যতটা সত্য, ততটাই সত্য হচ্ছে এই যে, গরিব মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিংবা ন্যূনতম মজুরি পেয়ে টিকে থাকার লড়াইটাও তত বেশি বাড়ছে। ২০০০ সালে দেশে বিলিওনেয়ারের সংখ্যা ছিল ৯ জন। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৬ জন। এখন ২০২২ সালে কোভিডকাল পেরিয়ে তা বেড়ে হয়েছে ১৬৬ জন।
সম্প্রতি ওয়ার্লড ইকনমিক ফোরামের বৈঠকে প্রকাশিত অক্সফ্যাম রিপোর্টে ভারতে অসাম্যর ভয়াবহ চেহারাটা আরও স্পষ্ট হয়েছে। এই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে, ২০২২ সালে ভারতের বিত্তশালী অংশের সবচেয়ে ওপরের ১ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের সম্পদের ৪১ শতাংশ। আর সর্বোচ্চ ৫ শতাংশের হাতে ৬২ এবং উপরের ১০ শতাংশের হাতে ৭২ শতাংশ সম্পদ। দেশের সর্বাধিক ধনী ১০ জনের হাতে সম্পত্তির পরিমাণ ২৭.৫২ এবং ১০০ জনের হাতে ৫৪.১২ লক্ষ কোটি টাকা। এদের সম্পত্তি সর্বাধিক বেড়েছে বিশেষত করোনার সময়। এই সময় দেশের বিলিওনেয়ারদের সম্পদ বেড়েছে গড়ে প্রতিদিন ৩,৬০৪ কোটি টাকা। অথচ এই সময়ে দেশে দারিদ্র্য সীমার নিচে তলিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা পৌঁছেছে প্রায় ২৩ কোটিতে, যা গোটা দুনিয়াতে সবচেয়ে বেশি।
সরকার অসামান্য গতিতে এই অসাম্য বাড়তে দিয়েছে। সাধারণ মানুষকে প্রতিদিন লুঠ হতে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের টাকা লুঠ হয়ে যাচ্ছে। এমনকী ব্যাঙ্ক মারফত। ব্যাঙ্ক থেকে যথেচ্ছ ঋণ নিচ্ছে পুঁজিপতিরা। শোধ করছে না। মোদিজির ৮ বছরে বড়ো পুঁজির ঋণগ্রাহকেরা ব্যাঙ্ক থেকে স্রেফ ১২ লক্ষ কোটি টাকা উড়িয়ে নিয়েছে সরকারের অনুগ্রহে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ১৩ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে সংসদে প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন যে, ব্যাঙ্কগুলির নন-পারফর্মিং অ্যাসেট মার্চ, ২০১৪-র ২.৫১ লক্ষ কোটি থেকে চার গুণ বেড়ে মার্চ ২০১৮-তে হয়েছে ৯.৬৩ লক্ষ কোটি টাকা। করপোরেট লুঠের বীভৎস চেহারা ক্রমশ প্রকাশিত হচ্ছে। অথচ গরিব মধ্যবিত্ত মানুষের জন্যে খরচ কিংবা বরাদ্দের ক্ষেত্রগুলিকে সরকার ধারাবাহিকভাবেই ছাঁটাই করে চলেছে। এমনকী অক্সফ্যাম রিপোর্টে দেখানো হয়েছে যে, দেশে গরিব এবং নিম্নবিত্ত অংশের ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে সম্পদের মোট পরিমাণ যেখানে ৩ শতাংশ সেখানে তাঁরা জিএসটি-তে ট্যাক্স দেন ৬৪ শতাংশ। বিত্তশালী ওপরের ১০ শতাংশ যাদের হাতে সম্পদের ৭২ শতাংশ, তাঁরা জিএসটিতে ট্যাক্স দেন মাত্র ৪ শতাংশ।
স্পষ্টতই দেশে অর্থনৈতিক অসাম্য ক্রমশ বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ, ঋণ, ট্যাক্স সহ অর্থনৈতিক নীতির কারণেই ক্রমবর্ধমান এই ফারাক। একদিকে সম্পদের অতি কেন্দ্রীভবন। তার দাপট প্রতিটি ক্ষেত্রেই। রবীন্দ্রনাথের কথায় ‘‘ধনগরিমার ইতরতা’’ আর অন্যদিকে হত দরিদ্র চেহারা। ক্ষুধা, অপুষ্টি, ক্রমবর্ধমান বেকারি। এর সাথে সাথে সামাজিক অসাম্য। জাত-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের বিচারে অসমতা বহক্ষেত্রেই ভয়াবহ চেহারা নিচ্ছে। মোদিজির রাজত্বে এটা ক্রমশই বাড়ছে বিপজ্জনকভাবে।
ডঃ আম্বেদকর সতর্ক করেছিলেন। রাজনৈতিক সাম্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সাম্যের প্রতি জোর দিয়ে সংশয় প্রকাশ করেই তার সতর্কবাণী - ‘‘If we continue to deny it for long, we will do so only by putting our political democracy in peril... . We must remove this contradiction at the earliest or else those who suffer from this inequality will break the structure of this political democracy that this assembly has so laboriously built.’’
শাসকেরা ক্রমশই বিপজ্জনক খাতে দেশকে বইয়ে নিয়ে চলেছে। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অসাম্য ভয়াবহভাবেই বেড়ে চলেছে। বিজেপি শাসনে এই ফারাক রেকর্ড পরিমাণেই বাড়ছে।
সংবিধান নির্দেশিত দেশের মূল কাঠামোটাকেও ক্রমশ দুর্বল করা হচ্ছে। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত প্রশাসনের হাতে। প্রশাসনকে ছাড়পত্র দেবে আইনসভা। আইনসভার কাছে প্রশাসন দায়বদ্ধ। তাকে জবাব দিতে হবে। প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার হতে হবে। ছাড়পত্র নিতে হবে। মানুষই সর্বশক্তির আধার। মানুষ নির্বাচন করে আইনসভা। আইনসভা ছাড়পত্র দেবে প্রশাসনকে। সেইমতো কাজ এবং জবাবদিহি করবে প্রশাসন। প্রশাসন স্বয়ম্ভু নয়। একইসাথে আইন এবং সংবিধান ঠিক মতো রক্ষিত হচ্ছে কিনা - তাই বিচারব্যবস্থা। তিনটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। কেউ কারুর ওপরে বা নিচে নয়। কিন্তু প্রত্যেকেরই এক্তিয়ার নির্দিষ্ট। পারস্পরিক। চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স। সবকিছুর ঊর্ধ্বে সংবিধান। এই হলো বিধিব্যবস্থা।
কিন্তু কী দাঁড়াচ্ছে। বিশেষত সাম্প্রতিক সময়ে, যেন সরকার কিংবা প্রশাসন সর্বক্ষমতাসম্পন্ন। আইনসভার গুরুত্ব দুর্বল করা হচ্ছে ক্রমশ। আইনসভা অধিবেশনের সময় ক্রমশ কমেছে। প্রশ্ন, উত্তর, সরকারের জবাবদিহি, বিতর্ক এসব এড়িয়ে যেতে পারলেই যেন সরকার বাঁচে। এমনকী বিল পাশ করা হচ্ছে জবরদস্তি। আলাপ আলোচনা নেই। খুঁটিয়ে দেখার দরকার নেই। সরকার সংখ্যা গরিষ্ঠতার জেরে, গায়ের জোরে আইনসভাকে এড়িয়ে চলতে চায়। যেমন কেন্দ্রীয় সরকার তেমনই রাজ্য সরকার। চুড়ান্ত অগণতান্ত্রিক। সংবিধান বিরোধী মনোভাব।
এরপর থাকলো বিচারব্যবস্থা, মানুষের শেষমেশ ভরসা। এখন তাকেও ধ্বংস করার প্রচেষ্টা। কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিদিনই চেষ্টা করে চলেছে বিচার ব্যবস্থাকে কলুষিত করতে। বিচারক নিয়োগ সহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকার নাক গলাতে চায়। যেন সরকার বা প্রশাসনের কথায় বিচারবিভাগকে চলতে হবে। পকেটে পোরার ব্যবস্থা করতে চায় কেন্দ্রীয় সরকার। বিচার পছন্দ না হলে, আইনের প্রক্রিয়া ছেড়ে বিষোদ্গার চলছে। ভয় দেখানো এবং গুন্ডামি চলছে। গুজরাটের নানাবিধ ঘটনাতে তো বটেই, কেন্দ্রীয় স্তরে বিজেপি’র নানাবিধ অপরাধের কৌশলে তা আরও স্পষ্ট হচ্ছে। ঠিক একইরকম এই রাজ্যে। টাকা দিয়ে, ভয়, প্রলোভন দিয়ে বিচার বিভাগকে কলুষিত করার নানা উদাহরণ। বিচার প্রক্রিয়া পছন্দ হচ্ছেনা বলে শাসকদলের পক্ষ থেকে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে গুন্ডামি। বিচারব্যবস্থাকে কলুষিত করার এই ভয়ঙ্কর প্রবণতা কেন্দ্র, রাজ্য উভয় শাসকদলেরই মজ্জাগত। এক কথায় সংবিধান বিরোধী কার্যকলাপ তো বটেই।
সংবিধান গ্রহণ করতে গিয়ে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ সঙ্গতভাবেই দেশবাসীকে সতর্ক করেছিলেন - ‘‘After all, a constitution like a machine is a lifeless thing. It acquires life because of the man who control it and operate it. India needs today nothing more than a set of honest man.’’
সংবিধান অনুযায়ী দেশ চালানোর দায়িত্ব যাঁদের তাঁরা এই সতর্কবাণীগুলি মানতে রাজি নন। বস্তুতপক্ষে সংবিধানের মূল্যবোধকেই যারা অস্বীকার করে, দুর্ভাগ্যক্রমে তারাই এখন দেশ চালানোর দায়িত্বে। ন্যায় বিচার, যুক্তি, সাম্য কিংবা সৌভ্রাতৃত্বের ধারণাগুলি তাঁরা নস্যাৎ করে। মানুষের অধিকারকে তাঁরা পদদলিত করে। আইনসভা কিংবা বিচারব্যবস্থার গুরুত্ব খাটো করে তাঁরা প্রশাসনের ক্ষমতাকেই একতরফা করতে চায়। স্বভাবতই আইনসভা এবং বিচার ব্যবস্থাকেও তাঁরা নস্যাৎ করে। সংবিধান বিরোধী এই মনোভাব দেশের স্বার্থেরই পরিপন্থী। একে রুখতেই হবে। দেশ এবং দশের স্বার্থেই তা জরুরি।