৬০ বর্ষ ২৪ সংখ্যা / ২৭ জানুয়ারি, ২০২৩ / ১২ মাঘ, ১৪২৯
ডঃ বি আর আম্বেদকর ও আমাদের সংবিধানঃ একটি সাম্প্রতিক চিন্তা
নীতীশ বিশ্বাস
ভূমিকা
স্বাধীন ভারতের সংবিধান প্রযুক্তহয় ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি। যদিও তা গৃহীত হয় ১৯৪৯-এর ২৫ নভেম্বর। সে দিন ওই সভায় এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন সংবিধানের রূপকার ডঃ আম্বেদকর। তিনি বলেন, ‘‘১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি আমরা এক বৈপরীত্যময় জীবনে প্রবেশ করতে চলেছি। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের থাকবে সমতা; ...আর অসমতা থাকবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। অতিদ্রুত আমাদের এই বৈপরীত্য দূরকরতে হবে; না হলে এই অসমতার যারা শিকার, তারা এতো পরিশ্রমে এই সংসদ যে রাজনৈতিক গণতন্ত্রের কাঠামো গড়ে তুলেছে তা গুড়িয়ে দেবে।’’
ওই ভাষণে তিনি আরও একটি কথা বলেছিলেন সে হলো, ‘‘উৎকৃষ্ট সংবিধান রূপায়ণের দায়িত্ব যদি নিকৃষ্টদের হাতে পড়ে - তা হলে ওই সংবিধানও মানুষের যন্ত্রণার কারণ হয়। অন্যদিকে নিকৃষ্ট সংবিধান বাস্তবায়িত করার কাজ যদি জনদরদি মানুষের উপর বর্তায় - তা হলে ওই সংবিধানও জনকল্যাণে সহায়ক হতে পারে।’’
আজকের দিনে বোধহয় আমাদের কাছে এই সতর্ক বার্তাটি নির্মম সত্য হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই কংগ্রেসের সরকার বিশেষ করে শ্রেণি চরিত্রের দিক থেকে ধনিক-বণিকের স্বার্থ রক্ষাকারী সরকার হওয়া সত্ত্বেও তাদের নেতৃত্বে প্রস্তুত এ সংবিধানকে রক্ষা করার ডাক আজ দেশের সংখ্যালঘু - দলিত ও দরিদ্রের কণ্ঠে ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কারণ যে অপূর্ণ স্বাধীনতা এই সংবিধানের মাধ্যমেই একটু একটু করে গণতান্ত্রিক পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তাকে আরএসএস-এর ভয়ানক দক্ষিণপন্থী নেতৃত্ব আজ যেন স্বৈরাচারীর হাতের পুতুল করে তুলছে। সংবিধানের রক্ষা, ব্যাখ্যা ও কার্যকর করার দায় ও দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে নব্য ফ্যাসিস্তদের হাতে। ফলে ৭৫ বছরে লালিত গণতন্ত্র আজ এক সংকটের মুখে এসে পড়েছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে তাই মহামতি আম্বেদকরের বিশ্বশ্রেষ্ঠ মেধার স্পর্শধন্য এ সংবিধান রক্ষা করা প্রগতিপন্থী গণতান্ত্রিক ভারতের এক মহান কর্তব্য।
সংবিধান রচনার সুযোগ ও তার শ্রেষ্ঠতম প্রয়োগ
অনেকেই জানেন যে আম্বেদকর জন্মেছিলেন ১৮৯১-এর ১৪ এপ্রিল আর তাঁর প্রয়াণ দিবস হলো ৬ই ডিসেম্বর ১৯৫৬ সাল। তাঁর মৃত্যুর পর এই বর্ণ বিভাজিত দেশের কোনো মন্ত্রীই যাননি তাঁর শেষকৃত্যে,তবে প্রধানমন্ত্রী নেহরু তাঁর শোক বার্তায় বলেছিলেন, ‘‘হিন্দু সমাজে যে নিপীড়নের বৈশিষ্ট্যগুলি আছে, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে আম্বেদকর স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।” আর ভারতের সংহতি ও সহিষ্ণুতার সংস্কৃতির প্রতীক বাবরি মসজিদ ভাঙা হয় এই মহা মানবের প্রয়াণ দিবসে (১৯৯২-এর এই ৬ ডিসেম্বর)। যিনি ভারতীয় গণতন্ত্রে দলিত অধিকারের কথাই কেবল নয়, বলেছিলেন গণতন্ত্রের পূর্ণতার জন্য আর একটি সাংবিধানিক সরকারের জন্য সংখ্যালঘুর অধিকারের মূল্য কত বেশি, সে কথাও। সংখ্যালঘুদের স্বার্থের প্রতি তাঁর দৃষ্টি ছিল প্রখর। তিনি তার ওই ২৫ নভেম্বরের ভাষণে উল্লেখ করেন, ‘‘ভারতে সংখ্যালঘুদের তাৎপর্যময় অস্তিত্বকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। এমন হতে হবে যাতে ভারতের সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুরা একটি অভিন্ন সত্তায় মিলিত হতে পারে। যারা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে মনোভাবপোষণ করেন, তাদের সম্পর্কে আমি এই কথাই বলতে চাই সংখ্যালঘুরা একটি বিস্ফোরক শক্তি। তাদের বিস্ফোরণ দেশের ঐক্যের সূত্রকে বিদীর্ণ করে দিতে পারে। কিন্তু তারা সংখ্যাগরিষ্ঠদের প্রতি আস্থা স্থাপন করেছে। এখন সংখ্যাগরিষ্ঠদের সেই আস্থার মর্যাদা দিতে হবে।’’ আম্বেদকরের মহৎ উদ্দেশ্যে উচ্চারিত এ শব্দমালার কোনো বিকল্প নেই। যা তিনি তাঁর সংবিধানের নানা ধারায় ধরে রেখেছেন বা সংযুক্ত করে গেছেন।
গণপরিষদের সদস্য
১৯৪৬ সালের জুলাই মাসে অবিভক্ত ভারতের গণপরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে প্রাদেশিক আইনসভায় নির্বাচন হয়। আম্বেদকর বোম্বাই প্রদেশে এই নির্বাচনে পরাজিত হন। সেই সময়ে সারা দেশের প্রাদেশিক আইনসভায় তফশিলিদের জন্য সংরক্ষিত আসন ছিল ত্রিশ। এর মধ্যে তফশিলি ফেডারেশনের একজন মাত্র প্রার্থী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল বরিশাল জেলা থেকে নির্বাচিত হতে পেরেছিলেন। আম্বেদকরের গণপরিষদে নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা সে অর্থে ছিলনা। কিন্তু অবিভক্ত বঙ্গের দলিতনেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের নেতৃত্বে তিনি বঙ্গপ্রদেশ থেকে গণপরিষদের প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালের ১৮ জুলাই বঙ্গপ্রদেশের আইন সভায় জয়ী হন। গণপরিষদে ভূমিকা পালন করার ক্ষেত্রে যে সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন বলতেই হবে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, দ্বারিকানাথ বারুরী, গয়ানাথ বিশ্বাস, নগেন্দ্র নাথ রায়, ক্ষেত্রনাথ সিংহ, মুকুন্দবিহারী মল্লিক এবং মুর্শিদাবাদের আদিবাসী সদস্য বীর বীরসার সমর্থনে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। বঙ্গপ্রদেশের আইনসভার উল্লেখিত দলিত সদস্যবৃন্দই তা সৃষ্টি করেছিলেন। তবে বাংলা ভাগের পর তাঁর সদস্যপদ চলে যায়। তাই নিজেদের এক সদস্যের পদত্যাগ করিয়ে কংগ্রেস তাঁকে মহারাষ্ট্র থেকে পুনরায় নির্বাচিত করে আনে। প্রসঙ্গত, ১৯৪৭ সালের ১৬ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতের স্বাধীনতা বিল পাশ হয়। ভারতের সংবিধান রচনার প্রশ্ন তখন বড়ো হয়ে দেখা দেয় এবং গান্ধিজির ইচ্ছানুসারেই নেহরু ডঃআম্বেদকরকে সংবিধানের কাজে যুক্ত করেন।
ভারতের শ্রেষ্ঠ মেধার সন্ধানে
এখানে আম্বেদকরের একটি কথা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, ‘হিন্দুরা বেদ চেয়েছিল তাই বেদব্যাস বর্ণ-হিন্দু না হলেও তাকে তাদের প্রয়োজন হয়েছিল। হিন্দুগণ মহাকাব্য চেয়েছিলেন তার জন্য অস্পৃশ্য বাল্মীকির দরকার হয়েছিল। হিন্দুগণ একখানি সংবিধান চেয়েছিলেন তার জন্য তারা আমাকে খুঁজে বের করেছিলেন।’’ সে যাই হোক এই সংবিধান ড্রাফট কমিটির অন্য সদস্যেরা ছিলেন - ১। স্যার আল্লাদি কৃষ্ণাস্বামী আয়ার, ২। স্যার বি. এন. রাউ, ৩। সৈয়দ এম. সাদুল্লাহ, ৪। এন. গোপালস্বামী আয়েঙ্গার, ৫। ডাঃ কে. এম. মুন্সি, ৬। বি. এল. মিত্র এবং ৭। ডি. পি. খৈতান, ৮। যুগল কিশোর খান্না। পরে উক্ত কমিটিতে যুক্ত হন ৯। এন. মাধবরাও এবং ১০। টি. টি. কৃষ্ণমাচারি। তবে নানা কারণে অন্য সদস্যেরা তেমন সক্রিয় ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত আম্বেদকরকেই এ সংবিধানের খসড়া প্রস্তুত ও তা পেশ করা ও তা নিয়ে উত্থাপিত হাজারো প্রশ্নের যথাযথ এবং তথ্যনিষ্ঠ উত্তর প্রদান করতে হয়। যা তাকে কেবল ভারতে নয় বিশ্বের প্রজ্ঞাবানদের মধ্যে অনন্য করে তোলে। সকলেই জানেন তাঁকে ১৯৯০ সালে ভারত রত্ন প্রাদান করা হলেও তার আগেই কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে এই অনন্য সংবিধান রচনার জন্য ১৯৫২ সালেই প্রদান করে এল এল ডি ডিগ্রি। আর ১৯৫৩ সালে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর সামগ্রিক জ্ঞানসাধনার জন্য প্রদানকরে সাম্মানিক ডি-লিট।
সংবিধান ও আমরা
এ কথা ঠিক যে এতো অবদান সত্ত্বেও আমরা বাবা সাহেব আম্বেদকরের প্রসঙ্গে আমাদের মতো বয়সিদের ছাত্রজীবনে তেমনকরে জানতাম না। কেবল আমাদের সংবিধান প্রণেতা হিসেবে তাঁর কথা শুনেছি। তারপর দিন যত যাচ্ছে প্রগতিশীল ও সাম্যবাদী ছাত্র যুব শ্রেণি যখন নানা দিকের প্রশ্ন করতে শুরু করেছে,আর বিশেষ করে ভারতীয় রাজনীতিতে যখন দক্ষিণপন্থার শক্তিবৃদ্ধি হতে লাগল এবং ভারতীয় সমাজের বিকাশের ধারায় কার্লমার্কসের বিশ্লেষণ থেকে নানা ভারতীয় মনীষী যেমন রবীন্দ্রচর্চা সহ ভারতীয় বিজ্ঞান- চিন্তাঋদ্ধ সমাজ বিশ্লেষণের জোয়ার এলো। দক্ষিণপন্থার নানা পশ্চাৎমুখীনতার নব নব আক্রমণের সামনে প্রাচীন শাস্ত্র থেকে নানা ভ্রান্ত ইতিহাসের জঞ্জাল ভেদ করে বিজ্ঞানবাদী বস্তুবাদের চর্চার জোয়ার এলো। এলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পতাকাবাহী যৌবন বনে আগুন ছড়াতে ছড়াতে। তখন বিশেষ করে দক্ষিণ ভারত থেকে দিল্লি প্লাবিত হলো নতুন করে ভারত চর্চায়। প্রাণ দিলেন প্রতিবাদের প্রতীক রোহিত ভেমূলা। এবং তার অজস্র তথ্যসূত্র আর সাংস্কৃতিক অভিমুখের সন্ধান নতুন নতুন ব্যাখ্যায় এলো আম্বেদকরের ভারত চিন্তা।
এর কিছুদিন আগে আম্বেদকর শতবর্ষ উপলক্ষে মহারাষ্ট্র সরকার যখন আম্বেদকরের রচনাবলির বিশাল বিশাল ২৫ খণ্ড ইংরেজিতে প্রকাশ করলো এবং সেই সূত্রে দিল্লির আম্বেদকর ফাউন্ডেশনের পক্ষে নানা ভাষায় সে সব (আংশিক হলেও) সহজলভ্য হলো, তখন তরুণ প্রজন্ম মার্কস থেকে মাও সে তুং, চে থেকে ভারততত্ত্ববিদ আম্বেদকর-চর্চার নতুন এক মানবিক প্রবাহের সামনে এসে দাঁড়ালো। বিশেষ করে সাবিত্রী বাই ফুলে থেকে আম্বেদকর এমনকী সাবঅল্টার্ন স্টাডিসের পথে আম্বেদকরবাদী ছাত্র শক্তির সঙ্গে মার্কসবাদী বস্তুবাদী প্রগতি পন্থার নতুন সংযোগ হলো। তারা ডাক দিলেন নীল আকাশে লাল তারার। আমরা দেখতে পেলাম সত্যিকারের এক জাতীয় নেতা আম্বেদকরকে। যিনি শ্রমিক ধর্মঘটে কমিউনিস্টদের সঙ্গে যৌথ আন্দোলনে নামেন। যিনি শ্রমমন্ত্রী থাকাকালে নারী শ্রমিক কল্যাণ থেকে কাজের ঘণ্টা কমান, যিনি মা-শ্রমিকের সন্তানের জন্য ক্রেশের ব্যবস্থা করেন, জননীত্বকালীন দীর্ঘছুটির ব্যবস্থা থেকে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ বসানো, আর ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারের জন্য আইন করেন। জনসংখ্যার অনুপাতে সরকারি অধিকার চান। যার সহজ নাম সংরক্ষণ। আর এসবকে চেষ্টা করেন সংবিধানে ঢোকাতে।দেশব্যাপী মানুষের কাছে তিনি সার্থকভাবে পৌঁছে যান দলিত দরিদ্রের মহান এক ত্রাতার বেশে। তাই আজকের ভারতে আম্বেদকরের মূর্তি গোটা ভারত জুড়ে যেন মাটি ফুড়ে উঠছে মানচিত্রের সমস্ত ভূগোলে।
এইভাবে হাজার হাজার বছরের পেছনে রাখা মনুষ্যকুলকে সামনে আনার সাধ্যমতো কাজ করে গেছেন তিনি। যিনি বলেন, আমি প্রথমে ভারতীয় এবং শেষেও ভারতীয়। বলেন, গোটা জাতির ৮০শতাংশকে পেছনে ফেলে যে যুদ্ধযাত্রা তাতো অবশ্যই পরাজয়ের যাত্রা। তাই তিনি ভারতীয় সমজের বিশেষত হিন্দু সমাজের বর্ণাশ্রম সমাজকে প্রগতির সবচেয়ে বড়ো বাধা হিসেবে বিবেচনা করেন। যা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ আর কার্লমার্কসও । তাই ১৯২৭ সালে চৌদাপুকুর অভিযানের সময় ২৫ ডিসেম্বর মনুসংহিতা ও মনুস্মৃতি দাহ করেন। নিজে মৃত্যুর আগে এই বর্ণ অভিশপ্ত হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে গ্রহণ করেন বৌদ্ধধর্ম। আমরা সংবিধানের যে ধর্মচক্র থেকে যে অন্যন্য প্রতীক পাই তা সেই শান্তি সহমর্মিতা আর সহিষ্ণুতার নানা ব্যঞ্জনায় উজ্জ্বল। তাই হিন্দুত্ববাদী, ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে এখন ভারত জোড়া যুদ্ধ বামপন্থী, আম্বেদকরবাদী ও মানবতাবাদীদের। আম্বেদকর সে যুদ্ধের এক মহান দিক দিশারি।