৬০ বর্ষ ২৪ সংখ্যা / ২৭ জানুয়ারি, ২০২৩ / ১২ মাঘ, ১৪২৯
২০১৪: ভারতীয় রাজনীতিতে চরম দক্ষিণপন্থার উদয়কাল
সঞ্চিতা সান্যাল
সাধারণতন্ত্র, যে শব্দটি যাত্রা শুরু করেছিল ত্রিশের দশকে, এবং বহু আলোচনায়, সমালোচনায় তার একটা পৌঁছানোর সম্ভাবনাও ছিল হয়তবা সাধারণের দিকেই, তারই ধার ও ভারকে সমূলে উপড়ানো গেল এই নয় বছরে। এটা প্রথমেই বুঝে নিতে হয়, মোদি-প্রকল্পিত ভারত আসলে ‘ভারত’ শব্দটির বিপরীত একটা শব্দ। ভারত কোনো ভৌগোলিক ভূভাগ নয়, একটা প্রবহমান ঐতিহ্য। এর ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রমাণ করেছে বারবার, সরকারি ভাষ্যের পাশাপাশি বিরুদ্ধ ভাষ্যেরও স্থান আছে। এসবের মধ্যে দিয়েই ভারতবর্ষ শুধুমাত্র কোনো দেশ নয়, সে হয়ে উঠেছিল একটি দৃষ্টিভঙ্গি। বহু সভ্যতা, বহু সংস্কৃতির মেলবন্ধন। অর্থাৎ, ভারত কোনো নেশন নয়, সে এক আধার, এক সত্তা। এই ভারতের ধারণার বিরুদ্ধ এক ধারণা নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সফলভাবে গড়ে তোলা হলো। মোদির ভারত ম্যাসকুলিন, যুদ্ধবাজ, ব্রাহ্মণ্যবাদী, এক গর্বিত জাতিরাষ্ট্র। আর ঠিক সেই কারণেই ইতিহাসের তথ্য বিকৃত করে, পুরাণ নির্ভর এক ভাষ্যের নিরিখে একরৈখিক রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা হলো। হিন্দুত্ব একটি পুরোদস্তুর রাজনৈতিক শব্দ। এই শব্দটির মধ্যে দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সহমত আদায় করা হলো। রাজনীতি থেকে সামাজিক পরিসর জুড়ে হিংসা, ঘৃণা ও ধর্মীয় অহংকে ছড়িয়ে দেওয়া হলো।
সেই কারণেই, স্বাধীন ভারতের রাজনীতির গতিপথে ২০১৪ ছিল একটি বড়ো বাঁক। নেহেরুভীয় রাজনীতির ধারাটি এই সময়ে সামগ্রিকভাবেই অস্বীকৃত হলো। গণতন্ত্রের কাঠামোটি যেসকল বিষয়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে তার মধ্যে অন্যতম হলো প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাধীনতা, মানুষের মৌলিক অধিকার এবং সামাজিক নিরাপত্তা। মূল কথা হলো সামাজিক জীবনে কতটা সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারছে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, তার ওপরেই নির্ভর করে তার গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠার দাবি। ১৯৪৭-পরবর্তী অধ্যায়ে ভারতে রাজনৈতিকভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটা সচেতন তাগিদ লক্ষ করা গেছিল। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি যেমন, সংসদ, বিচারবিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা সহ বেশ কিছু কাঠামোকে গুরুত্বসহকারে গড়ে তোলার পেছনে কংগ্রেস সহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলগুলির অবদান ছিল। এই গড়ে ওঠা ব্যবস্থাটাকেই নরেন্দ্র মোদি সরকার নস্যাৎ করলেন। সচেতনভাবেই করলেন, তাঁদের বৃহৎ প্রোজেক্টের অংশ হিসেবেই করলেন। অথচ বললেন, ‘‘আমার সরকারের ধর্ম হলো ভারত, ধর্মগ্রন্থ হলো ভারতের সংবিধান এবং একমাত্র প্রার্থনা হলো সকলের উন্নয়ন।’’ এই কথাটিকে সমনে রেখে প্রশ্ন তোলাই যায়, কোন ভারত, কোন সংবিধান আর কার উন্নয়ন করলেন তিনি?
ভারত এমন এক দেশ যেখানে জাতি, ভাষা, বর্ণ, ধর্ম সহ প্রতিটি বিষয়ে বৈচিত্র্য রয়েছে। তবুও একথা অস্বীকার করা যাবেনা যে, এখানে ধর্ম হিসেবে হিন্দু মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের চূড়ান্ত আধিপত্য রয়েছে। ফলত, এই সামাজিক কাঠামো অবশ্যম্ভাবীভাবেই রাজনীতিতে তার প্রভাব খাটাবে একথা গান্ধীর মতো ব্যক্তিত্ব বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তিনি হিন্দু ধর্মের ভেতরে থেকে, তার গুরুত্ব অস্বীকার না করেও, তাকেই সংস্কার করার কথা ভাবতে পেরেছিলেন। এর প্রকৃত উদাহরণ হলো হরিজন নিয়ে গান্ধীর ভাবনা। স্বাধীন ভারতের সংবিধানে তাই সমাজিক সমতার ধারণাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রথম কাজ ছিল দেশ, রাষ্ট্র ও সংবিধান থেকে রাজনৈতিক ও সামাজিক সমতার ধরণাকে নিশ্চিহ্ন করা। অর্থনৈতিক সমতার ধারণা ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত না হলেও, সামাজিক সাম্য, ন্যায়বিচার,ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং প্রতিটি মানুষের কাছে সুযোগের সমতা রক্ষার অঙ্গীকার সংবিধানের প্রস্তাবনায় করা হয়। মোদি সরকার নিপুনভাবে সংবিধানের প্রতিটি অঙ্গীকারকে এক লহমায় অস্বীকার করেছে।
দুটি কাজ মোদি সাফল্যের সঙ্গে করেছেন। এক, এই বৈচিত্র্যের দেশটিকে সরাসরি দ্বিধাবিভক্ত (পোলারাইজড) করেছেন। ভারতের সমাজ ও রাজনীতি আজ সরাসরি দুই ভাগে বিভক্ত। দুই, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তরে সহনশীলতাকে নস্যাৎ করেছেন। ভারতের সাধারণ মানুষ ধর্মগ্রন্থ নির্ভর জীবন যাপন করেন না। তাঁরা বিশ্বাস,লজিক, আচার, সঙ্গীত দিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিকে প্রকাশ করেন। ফলত, ধর্মীয় সহনশীলতা সাধারণ মানুষের মধ্যেই সবথেকে বেশি। এই সহনশীলতাকে ধর্মীয় গ্রন্থ, পুরাণ ইত্যাদি প্রভৃতি দিয়ে নস্যাৎ করা হয়েছে। এটি বিজেপি, বিশ্বহিন্দু পরিষদ ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের দীর্ঘকালীন প্রোজেক্ট। ‘হিন্দুত্ব’ তাদের একমাত্র প্রকল্প। এই প্রকল্পটিকে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে জাগ্রত করে রাখা হয়। মোদি যে দিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন, সেইদিন প্রায় সব সংবাদপত্রে একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছিল, সংসদ ভবনের সিঁড়িতে তাঁর মাথা ঠেকিয়ে প্রণামের ছবি। সেই মোদিই সংসদকে কাজে লাগিয়ে সরকারিস্তরে এবং আরএসএস সহ তাদের সহযোগী গোষ্ঠীগুলি সামাজিক ও রাজনৈতিকস্তরে বিভাজন ও অসহিষ্ণুতার পরিবেশ এমন করেই নির্মাণ করেছে যে, তাদের হিন্দুত্বের প্রকল্পটির রূপায়ণ সহজ হয়েছে। দেশের মানুষের ব্যক্তিগত ও বাহ্যিক জগৎকে তারা তাদের রাজনীতির আওতায় এনে সামগ্রিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। নির্বাচনী প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া, সংসদ, বিচারবিভাগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করেছে। পূর্বেও, কংগ্রেসের সময়েও এই সকল প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছিল। তবে তার সঙ্গে এদের মূলগত ফারাক আছে। বিজেপি চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতি প্র্যাকটিস করে। তার সঙ্গে কংগ্রেসের উদারনৈতিক দক্ষিণপন্থার তফাত রয়েছে। বিজেপি সহ তার হিন্দুত্ব প্রকল্পের সহযোগী শাখাগুলি হাজার হাজার মানুষকে দীক্ষিত করে এই সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কাজ করতে পাঠায়। এভাবেই রাজনৈতিক ও সামাজিক হেজিমনি তৈরি করে তারা হিন্দুত্বের পক্ষে। বিজেপি এমন একটি রাজনৈতিক দল, যার নির্বাচন জেতাই একমাত্র লক্ষ্য নয়। তার নেটওয়ার্ক বহুস্তরীয়। যে কোনো সাধারণ ঘটনাকেই তারা হিন্দুত্বের মোড়কে পুরে খুব প্রাথমিক স্তর থেকেই সাম্প্রদায়িক চেহারা দেয়। ঠিক যেভাবে হিটলার ইহুদিদের বিরুদ্ধে জার্মানদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল সেইভাবেই নরেন্দ্র মোদিদের প্রকল্পই হলো মুসলিম ও খ্রিস্টান সহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করা। ২০১৪-র নির্বাচন এই কারণেই ছিল একটি সন্ধিক্ষণ যেখানে ভারতীয় রাজনীতি তার উদারনৈতিক দক্ষিণপন্থার থেকে ফ্যাসিবাদী দক্ষিণপন্থার দিকে মোড় নেয়। নরেন্দ্র মোদি নিজে পিছিয়ে পড়া (OBC) জনজাতির মানুষ হয়েও তাকে কখনোই সামনে আনেননি। বরং বেশি করে সামনে এনেছেন তাঁর হিন্দু পরিচয়, তাঁর ছেলেবেলার দারিদ্র্য। নিজেকে প্রোজেক্ট করেছেন একজন মসিহা হিসেবে। তাঁর পোশাকে, চেহারায়, চলনে, বলনে কোথাও যেন এক হিন্দু গুরু হয়ে ওঠার তাগিদ লক্ষিত হয়েছে বারবার।
এই যে বাঁক ভারতীয় রাজনীতিতে ২০১৪ থেকে দেখা গেল, একে কী বলা যেতে পারে? সমস্ত রকম ফ্যাসিবাদী প্রবণতা এখানে স্পষ্ট। ৩৭০ ধারা বাতিলের মধ্যে দিয়ে, রাম মন্দির নির্মাণের মধ্যে দিয়ে, গোহত্যা নিষিদ্ধ ঘোষণার মধ্যে দিয়ে, ঘর ওয়াপসি প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে, এনআরসি’র মধ্যে দিয়ে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ওপরে বুলডোজার চালানোর রাজনীতি শুরু হলো এবং হচ্ছে। সংসদীয় ব্যবস্থার মধ্যেও ক্রমশ মুসলিম প্রতিনিধিত্ব ক্রমহ্রাসমান। ২০০৪-এ, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের আমলে লোকসভায় মুসলিম প্রতিনিধিত্ব ছিল ৩৪। ২০১৯-এর লোকসভায় সে সংখ্যা নেমে হয়েছে ২৭। প্রসঙ্গত , লোকসভার বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৫৪৩। ২০১৪ সালে, জনৈক ক্যাবিনেট মন্ত্রী বলেছিলেন, ভারতের সমস্ত মানুষ হিন্দু। এই কথাটাই তাদের মূল অ্যাজেন্ডা। এক জাতি, এক ধর্ম, এক রাষ্ট্র। আর এই প্রকল্প রূপায়ণ করতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে দিতেই হয়। বিগত পাঁচ বছরে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে -
২০১৭ | ৭২৩ |
২০১৮ | ৫১২ |
২০১৯ | ৪৩৮ |
২০২০ | ৮৫৭ |
২০২১ | ৩৭৮ |
২০২২ | এখনো লিপিবদ্ধ হয়নি। |
তবে, হিন্দু উৎসবগুলিকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে ২০২২-এ। একটি সংবাদ সূত্র জানাচ্ছে, ২০২২-এ দাঙ্গার ঘটনার বৃদ্ধির হার ৪০০ শতাংশ। মুসলিম জনগণের জীবন, সম্পত্তি, সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয়েছে নিয়ম করে। এভাবে সমগ্র সমাজকে দুটি শিবিরে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
মোদির শাসনকাল ভারতের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের সামনে শুধু চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে তাই নয়, স্বাধীনোত্তর ভারতীয় রাজনীতি ও সমাজ কাঠামোর গতিপথটাই অন্য খাতে বইয়ে দিয়েছে। গণতন্ত্রের প্রাথমিক ধারণায় বলাই হয়, রাষ্ট্রের ক্ষমতা অবশ্যই জনগণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে। আইন, অধিকার, সংবিধানের প্রাধান্য, বিচারবিভাগের স্বাধীনতা তাই গণতন্ত্রের জীবনীশক্তি। কিন্তু, এও ঠিক, গণতন্ত্রের মধ্যেই থাকে গোষ্ঠীতন্ত্র গড়ে ওঠার প্রবল সম্ভাবনা। তাই বিশিষ্ট রাষ্ট্রদার্শনিক টকভিল মনে করতেন, গণতন্ত্রের সাফল্য দাঁড়িয়ে থাকে নাগরিক সমাজের ওপর। ভারতের ক্ষেত্রে এই বলিষ্ঠ নাগরিক সমাজের অভাব চিরকাল ছিল। মোদির শাসনকালের বৈশিষ্ট্য হলো, নাগরিকদের ভয় দেখিয়ে, প্রলোভিত করে, মোহিত করে, বিভ্রান্ত করে হিন্দুত্বের নাগালে পুরে ফেলা। সংবিধানের শাসনের স্থলে আজ ‘হিন্দুত্বের’ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নেতা প্রবীণ তোগাড়িয়া বলেছিলেন, ২০২১ সালেই ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা হবে। আজকের ভারতের যাত্রা তাই সাধারণতন্ত্রের দিকে নয়, চরম দক্ষিণপন্থার দিকে।
হিন্দুত্বের সর্বগ্রাসী এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে উচিত বিকল্প সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা। অতি সাধারণ বলে আমরা যাদের সীমানায় শুধু নয়, সীমান্তে রাখি, তাদের কাছে গিয়ে, এ দেশের সংস্কৃতির ও সহনশীলতার পাঠ নিয়ে আসতে হবে। তাদেরকেই সামনে রেখে বিকল্পের জন্য লড়াই হোক।