E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২৪ সংখ্যা / ২৭ জানুয়ারি, ২০২৩ / ১২ মাঘ, ১৪২৯

উত্তরবঙ্গের চা বাগানে চলছে নব্য উপনিবেশবাদ

অশোক ভট্টাচার্য


পানীয় জলের পর ভারত তথা এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সবচাইতে বেশি জনপ্রিয় ও ব্যবহৃত পানীয় অবশ্যই চা। চা-ই একটি প্রাকৃতিক সুগন্ধীযুক্ত পানীয়। ২০১৩ সালে দেশে ইউপিএ-২ সরকার থাকার সময়ে দেশের পরিকল্পনা কমিশনে চা’কে জাতীয় পানীয় বলে ঘোষণা করার বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল। যদিও তা কার্যকর হয়নি। বরং সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার টি বোর্ড-ই তুলে দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করছে।

১৮৪১ সালে প্রথম যিনি ভারতীয় চা চাষ শুরু করেছিলেন তার নাম মণিরাম দেওয়ান। পরবর্তীকালে চা বাগিচা শুরু করা হয় আসাম, ডুয়ার্স, দার্জিলিং ও তরাই এলাকাতেও। বর্তমানে ২৭৬টি চা বাগান রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশে ডুয়ার্স, দার্জিলিং ও তরাই অঞ্চলে। এক সময়ে অধিকাংশ চা বাগানের মালিক ছিল ইংরেজরা। আসামের পর উত্তরবঙ্গই দ্বিতীয় সর্বাধিক চা উৎপাদন কেন্দ্র। এই সমস্ত সংগঠিত চা বাগানগুলিতে প্রায় ৬লক্ষ চা শ্রমিক কাজ করে। তার অধিকাংশই মহিলা। এছাড়া রয়েছে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছোটো, বড়ো, মাঝারি মিলিয়ে আরও প্রায় ৫০০০ চা বাগান। এই সমস্ত চা বাগান গড়ে উঠেছে পরিত্যক্ত, অব্যবহৃত প্রায় ৫০,০০০ একর জমিতে। এইসব চা বাগানে যে সমস্ত কর্মী শ্রমিক হিসাবে কাজ করছে তাদের সংখ্যাও হবে প্রায় এক লক্ষ। তারা মূলত স্থানীয়। এদের বলা হয়ে থাকে নন ট্র্যাডিশনাল ওয়ার্কার। উত্তরবঙ্গে কম করেও ২৫ লক্ষ মানুষ নির্ভরশীল চা শিল্পের ওপর। উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলিতে নিযুক্ত শ্রমিকদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, শ্রমিকদের অধিকাংশই বিহার, ঝাড়খণ্ড বা ওডিশা থেকে আগত মাইগ্রেন্ট শ্রমিক। পাহাড়ের অধিকাংশ শ্রমিকই নেপাল থেকে আসা মাইগ্রেন্ট শ্রমিক। চা বাগানে কর্মরত শ্রমিকদের ৭০ শতাংশ মহিলা। এদের অধিকাংশ আদিবাসী বা উপজাতি, দলিত ও তপশিলি জাতি। যারা মূলত নেপালি বা হিন্দি ভাষায় কথা বললেও বিভিন্ন আদিবাসীদের ভিন্ন ভিন্ন ভাষা বা উপভাষা রয়েছে। সমতলের আদিবাসীদের সাধারণ ভাষা শাদরি বা মদেশিয়া, এছাড়াও ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীগুলির ভিন্ন ভিন্ন ভাষা আছে। নন ট্র্যাডিশনাল চা শ্রমিকদের ভাষা মূলত বাংলা, হিন্দি, রাজবংশী, মেচ, কিছু সাঁওতাল।

উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সের আদি আদিবাসী বলতে বহু বছর ধরে বসবাস করছে এই অঞ্চলে, এমন আদি আদিবাসীদের মধ্যে রয়েছে মেচ, রাভা, ডুকপা, শেরপা, ভুটিয়া, বোড়ো ইত্যাদি। এরা যুক্ত মূলত কৃষি কাজের সাথে। ১৮৭২ সাল পর্যন্ত জলপাইগু‍‌ড়ি জেলার ডুয়ার্স এলাকা ছিল ভুটান রাজের অন্তর্গত। ১৮৭২ সালে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ হয় ভুটান রাজের। সেই যুদ্ধে ইংরেজরা জয়ী হয়ে ডুয়ার্স এলাকাকে ভূটান থেকে বাংলার জলপাইগুড়ি জেলার সাথে যুক্ত করে। সেই সময় থেকে ডুয়ার্স এলাকায় চা চাষ শুরু হয়। যদিও তরাই বা ডুয়ার্সের চা বাগানগুলিতে নিযুক্ত শ্রমিকরা মূলত বাইরে থেকে আগত আদিবাসী ও নেপালি ভাষী। যদিও উত্তরবঙ্গে বর্তমানে রয়েছে ৮টি জেলা। তিন দশক আগে ছিল ৫টি জেলা। দেশ ভাগের আগে বর্তমান বাংলাদেশের দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী জেলাগুলি ছিল উত্তরবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ১৮শতাংশ উত্তরবঙ্গবাসী। উত্তরবঙ্গের মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার হার যথাক্রমে ১৪.৪৭ শতাংশ, ১৩.৭৭ শতাংশ, ১৩.৮৬ শতাংশ। সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২০১১ সালের জনগণনা রিপোর্ট অনুসারে ১৩.৯৩ শতাংশ, অথচ উত্তরবঙ্গের সমস্ত জেলাগুলির মোট বৃদ্ধির হার ১৬.১৩ শতাংশ। এক্ষেত্রে মাইগ্রেশনের একটি বড়ো ভূমিকা রয়েছে।

মানব উন্নয়নের নিরিখে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির মধ্যে অবস্থানগত পার্থক্য রয়েছে। যেমন মানব উন্নয়নের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দার্জিলিং জেলার স্থান চতুর্থ, অথচ উত্তরবঙ্গের অন্যান্য জেলার স্থান তার আশে পাশের মধ্যেও নেই। হিউমেন ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে সারা রাজ্যের গড় যেখানে ০.৬১, সেখানে দার্জিলিং জেলার ইনডেক্স ০.৬৫। উত্তরবঙ্গের অন্যান্য জেলাগুলি রয়েছে অনেক পিছিয়ে। দার্জিলিং জেলার স্থান ভালো হবার বড়ো কারণ হলো দার্জিলিং জেলার চা বাগান এবং সমতলে শিলিগুড়ি শহর ও গ্রামাঞ্চলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, অন্যদিকে চা শিল্পে সংগঠিত চা শ্রমিকদের ধারাবাহিক সংখ্যা বৃদ্ধি। ১৯৮৪ সালের পর থেকে উত্তরবঙ্গের কৃষি ক্ষেত্রের বড়ো বিপর্যয় হলো প্রায় ৬০,০০০ একর কৃষি জমি চা বাগানে রূপান্তরিত হওয়া। এর মধ্যে উত্তর দিনাজপুর জেলার ৩০,০০০ একর, জলপাইগুড়ি জেলার ১৫,০০০ একর, দার্জিলিং জেলার ১০,০০০ একর। বাকি অন্যান্য জেলার। এই সমস্ত জমির দখল বা মালিকানা সত্ত্ব ছিল মূলত রাজবংশী ও আদিবাসী কৃষকদের হাতে। আজ তাদেরই জমির মালিকানা সত্ত্ব হস্তান্তর হওয়ার ফলে বহু আদিবাসী ও রাজবংশী কৃষক আজ ক্ষুদ্র চা বাগানেই দিন মজুরে পর্যবসিত হয়েছে। কয়েক বছর আগের একটি তথ্যে দেখা যাচ্ছে, জলপাইগুড়ি-আলিপুরদুয়ার জেলার ৭২টি চা বাগান হয় রুগ্‌ণ হয়ে গেছে, অথবা বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে ৩০০০ স্থায়ী শ্রমিক কর্মহারা হয়েছে। আলিপুরদুয়ার জেলার ৫টি বড়ো সংগঠিত চাবাগান বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ১৫,০০০ স্থায়ী-অস্থায়ী শ্রমিক কর্মহারা হয়েছে, তাতে পরিবার পরিজন-সহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মোট ৪৫,০০০ মানুষ।

পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার ১৮.৮০ শতাংশ উত্তরবঙ্গের হলেও রাজ্যের মোট স্থায়ী মূলধনের ১.২ শতাংশ মাত্র উত্তরবঙ্গের, সারা রাজ্যে যে মোট সংগঠিত শ্রমশক্তি রয়েছে তার মাত্র ৫ শতাংশ উত্তরবঙ্গের, বাকি পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে ৯৫ শতাংশ।

উত্তরবঙ্গের সামগ্রিক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সংগঠিত শ্রমশক্তির দিক দিয়ে চাবাগানগুলির নিঃসন্দেহে রয়েছে একটি ইতিবাচক ভূমিকা। বিশেষ করে চাবাগানে যারা শ্রমিকের কাজ করে তার ৭০ শতাংশ মহিলা, ৯৫ শতাংশ আদিবাসী, উপজাতি, তপশিলি জাতি বা সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ। এটি অবশ্যই বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এখনও চা বাগানগুলিতে স্থায়ী শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও চা বাগানের শ্রমিকরা কি ভালো আছে? না। চা বাগানের শ্রমিকদের স্বার্থে প্ল্যান্টেশন লেবার আইন সর্বত্র সঠিকভাবে মেনে চলা হচ্ছেনা। চাবাগানগুলিতে এখনও চালু হয়নি ন্যূনতম মজুরি আইন, নেই ন্যূনতম জনস্বাস্থ্যের সুযোগ সুবিধা, নেই পরিশ্রুত পানীয় জল, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচালয়ের ব্যবস্থা। বেশির ভাগ শ্রমিকের জন্য নেই পাকা বাড়ি, নেই বাস্তু জমির মালিকানা বা নিরাপদ স্বত্ত্ব, শিক্ষা, শিশু সুরক্ষার ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অভাব রয়েছে।

কয়েক বছর আগে উত্তরবঙ্গের চা বাগান শ্রমিকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিয়ে একটি সমীক্ষা করেছিল টি-বোর্ড। স্ট্যাটিসটিক্যাল হ্যান্ড বুক অব টি-বোর্ড অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত নমুনা সমীক্ষা থেকে কিছু রিপোর্ট পাওয়া যায়। সেই নমুনা সমীক্ষা করা হয়েছিল পাহাড়, তরাই, ডুয়ার্সের ২৭৬টি চাবাগানের কিছু শ্রমিকদের মধ্যে। সমীক্ষা করা হয়েছিল মোট ২০,৪৮৫ জন শ্রমিকের সাথে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে। শ্রমিকদের মধ্যে ২৮.২ শতাংশ শ্রমিকের বয়স ছিল ১৮-৩০ বছরের মধ্যে, ৩৩.৩ শতাংশ শ্রমিকের বয়স ছিল ৩০-৪০ বছরের মধ্যে, ৩১.৬ শতাংশ শ্রমিকের বয়স ছিল ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে। ১৮ বছরের নিচের বয়সের শ্রমিকদের ধরা হয়েছিল শিশু শ্রমিক হিসাবে।

নমুনা সমীক্ষা থেকে সাধারণভাবে নিম্নলিখিত তথ্য পাওয়া যায়। এক কথায় এই সমস্ত চা বাগান শ্রমিকরা মাথা পিছু আয়, দৈনন্দিন জীবন যাপন, নিয়মিতভাবে মজুরি পাওয়া ইত্যাদি দিক দিয়ে ভালো অবস্থায় ছিল না। যে সমস্ত শ্রমিক বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে অংশগ্রহণ করেছিল, এদের মধ্যে ৩২.৬৭ শতাংশ পুরুষ, ৬৭.২৪ শতাংশ মহিলা। ২০১৫ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় বছরে গড় এবং তৃতীয় বছরে শ্রমিকদের মাথাপিছু দৈনিক গড় মজুরি ছিল যথাক্রমে ১১২.৫০ টাকা ও ১৩২.৫০ টাকা। মাসিক ৩০০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পেয়েছে ৩১.৭ শতাংশ, মাসিক ৩০০০-৬০০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পেয়েছে ৫০.৭ শতাংশ, মাসিক ৬০০০ টাকার উপরে মজুরি পেয়েছে ১৭.৬ শতাংশ শ্রমিক।

যাদের উপর সমীক্ষা চালানো হয়েছে তাদের শিক্ষার হার ছিল নিম্নরূপঃ
অশিক্ষিত - ৪৪.২৯ শতাংশ
প্রাথমিক শিক্ষা - ৩৬.০৫ শতাংশ
মাধ্যমিক - ১৭.৯৭ শতাংশ
উচ্চ মাধ্যমিক - ১.৬১ শতাংশ

এই চিত্র সেই সময় উত্তরবঙ্গের সামগ্রিক শিক্ষা চিত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। একই সময়ে উত্তরবঙ্গের স্বাক্ষরতার হার ছিল ৭২শতাংশ। চা বাগানের ক্ষেত্রে এই হার ছিল অনেক কম। উত্তরবঙ্গের চা বাগান এলাকার ৪২টি চা বাগানে নেই কোনো স্কুল। এখনও ১৭ শতাংশ চা শ্রমিকগৃহে কোনো বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। ১৯.৩ শতাংশ গৃহে বিদ্যুৎ আছে, তবে তা মোটামুটি। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবস্থাও শোচনীয়। হাসপাতাল বা প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে ৬০.১৪ শতাংশ চা বাগানে। অর্থাৎ ৪০ শতাংশ চা বাগানে এই ব্যবস্থা নেই। নিয়মিতভাবে ডাক্তাররা শ্রমিকদের আবাসন পরিদর্শন করে এমন বাগানের সংখ্যা মাত্র ৫৬টি। অর্থাৎ ৮০ ভাগ চা বাগানে তা নেই, ৫৭.৯৭ শতাংশ চা বাগানে অ্যাম্বুলেন্স আছে, তার মানে ৪২ শতাংশ চা বাগানে নেই।

চা বাগান মানেই চা বাগানের কর্মরত শ্রমিক মাত্র নয়। প্রতিটি চা বাগানে রয়েছে অন্তত ৩০-৪০ শতাংশ অ-শ্রমিক। চা বাগানের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে শিক্ষার আগ্রহ বাড়ছে। অনেক ছেলেমেয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করছে। তারা চা বাগানে পাতি তোলা বা কোদাল বেলচা নিয়ে কাজ করতে চায় না। তারা জব করতে চায়। অনেক তরুণ প্রজন্মের ছেলে মেয়ে ঠিকাদারি, জমির কারবার, নির্মাণ কাজ, মরশুমি কাজ করে রোজগার করে থাকে। বছরের ৫-৬ মাস তাদের অনেকে বেশি মজুরির আশায় যায় দক্ষিণ ভারতে বাগিচায় কাজ করতে। সেখানে তুলনায় মজুরি বেশি। অনেকেই হয়ে যাচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিক। বহু চা বাগানে বাইরে থেকে ঠিকাদার বা এজেন্টরা এসে বাইরে যেতে ইচ্ছুক শ্রমিকদের নিয়ে যায় অন্য রাজ্যে বা আরব দুনিয়াতেও। এভাবে দেখা যাচ্ছে বহু চা বাগানের ৮০-৯০ শতাংশ শ্রমিকই মহিলা শ্রমিক। তারা পুরুষ শ্রমিকদের মতো বাইরে যেতে এতো বেশি আগ্রহী নয়।

উত্তরবঙ্গের চা বাগান শ্রমিকদের মধ্যে সব চাইতে বড়ো বিপদের সৃষ্টি করছে ট্রাফিকিং। বহু অল্প বয়স্ক মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হয়ে থাকে বাইরের রাজ্যে, বড়ো বড়ো শহরে, যুক্ত করা হচ্ছে দেহ ব্যবসার মধ্য দিয়ে রোজগারে। এই সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। এদের অধিকাংশই নিজ গৃহে বা গ্রামে ফিরে আসতে চায় না। তরাই-এর তুলনায় ডুয়ার্সে ট্রাফিকিং বেশি। চা বাগানের জমি চলে যাচ্ছে টি-টুরিজমের নামে বড়ো বড়ো হোটেল, রিসর্ট, বা আবাসন প্রকল্পে। হোম স্টে-র আড়ালে বে-আইনি রিসর্ট বা স্পার ব্যবসা প্রসার লাভ করছে। মুখে বলা হচ্ছে টি-টুরিজমের মাধ্যমে নাকি স্থানীয় চা বাগান শ্রমিকদের পরিবারের ছেলে মেয়েরা কাজ পাবে। কিন্তু আসল কথা চা বাগান শ্রমিক পরিবারের কেউ এই সমস্ত কাজ পাচ্ছে না। এদের কথা কোনো কালো চামড়ার ছেলে মেয়েদের এই সমস্ত হোটেল বা রিসর্টে নেওয়া হবে না। নেওয়া হতে পারে সাদা চামড়ার ছেলে মেয়েদের। সম্প্রতি সিআইটিইউ-র পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কোন কোন চা বাগানের জমি দেওয়া হচ্ছে টি-টুরিজমের জন্যে। প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে পাহাড়, তরাই, ডুয়ার্সের অনেকগুলি চা বাগানে কোথাও ১৬০ একর থেকে ৫০ একর পর্যন্ত বাগানের জমি দেবার প্রক্রিয়া জারি রয়েছে। একটি চা বাগানে বড়ো হোটেল করা হয়েছে যেখানে একটি স্যুটের নাম দেওয়া হয়েছে কলোনিয়াল স্যুট। সেখানে প্রবেশাধিকার থাকছে হোটেলের মালিকের নিয়ন্ত্রণে। একসময় ছোটনাগপুর থেকে যে ভাবে আদিবাসী শ্রম শক্তিকে উত্তরবঙ্গের বা আসামের চা বাগানে সর্দারদের মাধ্যমে নিয়ে আসা হয়েছিল, আজ দেখা যাচ্ছে একই কায়দায় উত্তরবঙ্গের চা শ্রমিকদের বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দক্ষিণে। বহু বাগানে নতুন করে কলোনিয়াল পদ্ধতিতে শ্রমিকদের আবাসন নির্মাণ করা হচ্ছে। শাদরি বা চা বাগানের শ্রমিকদের ভাষায় এই সমস্ত শ্রমিক কোয়ার্টার লাইনকে বলা হয় গিরমিক লাইন। রাজ্য সরকার বহু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নীতি চালু করার। আজও তা চালু হলো না। সুরাহা হলো না শ্রমিকদের বাস্তু জমি প্রদানের বিষয়টিও। কোথায় গেল চা সুন্দরী? ৩ লক্ষ গৃহ হবে, বলেছিল, হলো? বিজেপি-আরএসএস-র এখন একটাই কাজ, প্রতিটি বাগানে আরএসএস-র শাখা খোলা। নীরব তারা ন্যূনতম মজুরি আর বাস্তু জমির পাট্টা নিয়ে। চা বাগান শ্রমিকদের দাবি দাওয়া নিয়ে এরা থাকে নীরব। বরং সোচ্চার ধর্মান্ধতা আর ঘৃণার রাজনীতি নিয়ে।

চা বাগান-সহ বিভিন্ন দেশের বাগিচা শিল্পে ইংরেজরা প্রতিষ্ঠিত করেছিল ঔপনিবেশিক শোষণ। আসাম বা পশ্চিমবঙ্গে চা বাগানগুলিতে ইংরেজরা এই রাজ কায়েম করেছিল। চা-কে বলা হয় ঔপনিবেশিক পণ্য (Product of Colonialism)। মূলত রপ্তানির লক্ষ্যেই ইংরেজরা শুরু করেছিল চা বাগিচা বা চা উৎপাদন। ১৮৩৮ সালে ভারত থেকে লন্ডনে প্রথম চা রপ্তানির কনসাইনমেন্ট বা চালান পাঠানো হয়েছিল। ইংরেজরা ভারত বা বিভিন্ন উপনিবেশে প্রথমে দাস শ্রমিকদের নিয়ে এসে চা বাগানে নিযুক্ত করতো। পরবর্তীকালে তারা বাইরে থেকে চুক্তিবদ্ধ বা ইনডেনচার শ্রমিকদের চা শিল্পে শ্রমিকের কাজে নিযুক্ত করতো। তাদের হয়ে যারা এই কাজ করে তাদের বলা হয় সর্দার বা আড়কাঠি। অথচ স্থানীয়ভাবে প্রচুর শ্রমশক্তি থাকা সত্ত্বেও চা বাগানে তাদের ব্যবহার না করে আজকের ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, ওডিশা থেকে সামান্য মজুরিতে আদিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে আসতো। চা বাগানের ইংরেজ মালিকরা সব সময় চাইতো শ্রমের বাজারে অতিরিক্ত শ্রমিক সরবরাহ ব্যবস্থা বজায় রাখতে। এই কারণে স্থানীয় বিপুল সংখ্যক কর্মহীন শ্রমশক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা প্রথমে দাসপ্রথা পরে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের বাইরে থেকে নিয়ে আসতো। ইংরেজ চা বাগান মালিকরা মনে করতো এতে শ্রমিকদের পরিবর্তে মালিকদের হাতেই থাকবে শ্রমিক সংস্থান বিষয়ে দর কষাকষি করার ক্ষমতা। অন্যদিকে স্থানীয় শ্রমশক্তির বাজারে মজুরিও ছিল বাইরে থেকে আমদানিকৃত শ্রমিকদের থেকে বেশি। এভাবে চা শ্রমিকদের মালিকরা যত কম মজুরি দিতে পারতো, ততই মালিকদের মুনাফার হার বৃদ্ধি পেতো। কিন্তু উপনিবেশ-উত্তর চা বাগানের চিত্রের অনেক দিক দিয়েই বেশকিছু পরিবর্তন হলেও, (বিশেষ করে বাগিচা আইন ও বিধি সংক্রান্ত বিষয়ে), আবার অনেক বিষয়েই পূর্ব অবস্থার সাথে বেশ কিছু মিলও রয়েছে। স্বাধীনতার পর চা বাগিচা শ্রমিকদের পক্ষে সবচাইতে বড়ো পরিবর্তন অবশ্যই ১৯৫১ সালের প্ল্যানটেশন লেবার অ্যাক্ট (PLA-1951)। এই আইন অনুযায়ী ১৯৫২ সালে প্রথম চা বাগান শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম একটি মজুরি নির্ধারিত হয়। এর আগে ১৯৪৭ সালের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপুট আইন ও ১৯৪৮ সালের ফ্যাক্টরি আইনও চা বাগানে চালু করা হয়। পরবর্তীকালে বোনাস, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি আইনও চালু করা হয়। যদিও এই সমস্ত আইন বা বিধিগুলি চালু করা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা কার্যকর করার সদিচ্ছার অভাব অনুভূত হয়। যেমন ফ্যাক্টরি আইন অনুযায়ী প্রত্যেক বছর শ্রমিকদের জন্য ৮ শতাংশ করে পাকা স্থায়ী কোয়ার্টার নির্মাণ করার কথা চা বাগিচা মালিকদের। যদি চা বাগান মালিক বা সরকারের সদিচ্ছা থাকতো, তাহলে ১৯৬৯ সালের মধ্যে সমস্ত চা শ্রমিকের জন্য আইন অনুযায়ী স্থায়ী ও পাকা কোয়ার্টার নির্মাণ কাজ হয়ে যেত।

গত দুই দশক ধরে উত্তরবঙ্গের চা বাগান শ্রমিকরা দাবি ও আন্দোলন করে আসছে, ন্যূনতম মজুরি আইন ও শ্রমিকদের জন্য বাস্তু জমির নিরাপদ সত্ত্বা প্রদানের দাবিতে। আজও এই দুটি দাবি মানা হয়নি। আবার শুরু হয়েছে সর্দার বা আড়কাঠি ব্যবস্থা। অন্যদিকে নতুন করে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের জন্যে শ্রমিক লাইন কথাটি যাকে চা বাগান শ্রমিকদের নিজস্ব ভাষা শাদরিতে গিরমিক লাইন বলা হয়, তা চালু করা হয়েছে। চা সুন্দরী আবাসনের নামে রাজ্য সরকার কিছু আবাসন তৈরি করেছে, তাকে শ্রমিকরা বলে গিরমিক লাইন। যা চা বাগান শ্রমিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তারা চায় বাস্তু জমির পাট্টা। তরাই, ডুয়ার্স, দার্জিলিং পার্বত্য এলাকায় এখনও প্রায় ৪০টি চা বাগান বন্ধ হয়ে রয়েছে। কার্যত এতে ৫০ হাজারের মতো চা শ্রমিক কর্মহারা হয়ে রয়েছে। কয়েকশত চা শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। করোনাকালে কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রীর পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেছে। আজও তারা স্কুল অভিমুখে ফিরে যায় নি। তারা এদিক সেদিক কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছে। আগেই উল্লেখ করেছি চা বাগানের জমি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলে যাচ্ছে টি-টুরিজমের নামে। সম্প্রতি নতুন করে চালু হয়েছে, চা বাগানের জমিতে একটি পাঁচ তারা হোটেল। যেখানে চালু হয়েছে মহা ধূমধাম করে কলোনিয়াল স্যুট। কী বলবো একে নব্য উপনিবেশবাদ?