E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২৪ সংখ্যা / ২৭ জানুয়ারি, ২০২৩ / ১২ মাঘ, ১৪২৯

ক্রিপ্টোর পতন

কুমারজিৎ মণ্ডল


শিক্ষকতার সূত্রে মাঝেমাঝেই বিভিন্ন কলেজে ডাক পড়ে কোনো না কোনো অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে ছাত্রদের বোঝার মতো করে বক্তব্য রাখার জন্য। গতবছর কলকাতার উপকণ্ঠে অবস্থিত এক কলেজে এমনই এক আমন্ত্রিত বক্তৃতার বিষয় ছিল মুদ্রা ব্যবস্থা। আমি উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম মানুষের আস্থা কীভাবে কোনো একটা দেশের মুদ্রা ব্যবস্থার চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে। বক্তৃতার শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে ছাত্রছাত্রীরা আবদার করলো ক্রিপ্টো সম্পর্কে বলার জন্য। মহানগরের বাইরে ক্রিপ্টো নিয়ে এহেন আগ্রহ আশা করিনি। তাদের অনুরোধ মতো বলতে শুরু করার পর অনুধাবন করলাম তারা বিশেষভাবে উৎসাহী ক্রিপ্টো বাজারে লগ্নি করে কীভাবে লোকজন রাতারাতি বড়োলোক হতে পারে সেই সম্পর্কে। স্বাভাবিকভাবেই ক্রিপ্টো সম্পর্কে আমার যে আকাডেমিক আগ্রহ তার থেকে ওই ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ শত যোজন দূরে। ক্রিপ্টো বাজারে কীভাবে ফাটকা খেলে বড়োলোক হওয়া যায় সে সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। উলটোদিকে আমার তরুণ শ্রোতাদের আগ্রহ সেই ফাটকা বাজারে বড়োলোক হবার সুলুক সন্ধানে।

এখন ক্রিপ্টো ব্যবহৃত হয় একাধারে মুদ্রা এবং পরিসম্পদ হিসাবে। অনেকটা ডলারের মতো। মার্কিন মুলুকে লোকজন ডলার ব্যবহার করে বিনিময়ের সাধারণ মাধ্যম হিসাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে লোকজন ডলারে বিনিয়োগ করে পরিসম্পদ হিসাবে। এখন ডলারের একটা রাষ্ট্রিক স্বীকৃতি আছে এবং সেই স্বীকৃতি প্রদান করে এক প্রবল আর্থিক সম্পদশালী দেশ। তাই দীর্ঘকালীন বিনিয়োগের জন্য ডলারের একটা উপযোগিতা থাকতে পারে। যদিও বিচক্ষণ বিনিয়োগকারীরা ডলার বা অন্য কোনো দেশের মুদ্রায় সাধারণত দীর্ঘকালীন বিনিয়োগ করে না। মুদ্রায় বিনিয়োগ সাধারণত স্বল্পকালীন এবং বিভিন্ন দেশের মুদ্রার বিনিময় হারের তারতম্যের ফলে মুদ্রার মূল্যে যে পরিবর্তন হয় তার ফায়দা তোলার জন্য।

কিন্তু ক্রিপ্টোর পক্ষে ডলারের প্রতিদ্বন্দ্বী পরিসম্পদ হয়ে ওঠার অনেক সমস্যা আছে। কারণ ক্রিপ্টোর পেছনে কোনো শক্তিধর রাষ্ট্রের স্বীকৃতি নেই। এল সালভাদর ক্রিপ্টোকে তাদের দেশের জাতীয় মুদ্রার মর্যাদা দিয়েছিল। কিন্তু এল সালভাদরের আর্থিক সামর্থ্য সীমিত। আরও সীমিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তার প্রভাব। তাই ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত ক্রিপ্টো কখনই বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে বাস্তবিক পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারেনি।

ক্রিপ্টোর যে ব্যাপারটা মানুষের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল সেটা হলো পরিসম্পদ হিসাবে তার উপযোগিতা। যদিও এখন বোঝা যাচ্ছে যে, বহু মানুষ ক্রিপ্টোয় বিনিয়োগ করেছিল স্রেফ হুজুগের বশে। সাধারণত বিনিয়োগ করার সময় যে সব বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া উচিত বা যে সব সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত তারা সেসবের তোয়াক্কা করেনি। অনেক ক্ষেত্রে তারা এই বিনিয়োগের ঝুঁকির ব্যাপারটা ভালো করে বোঝে নি। বেশিরভাগ উৎসাহী মানুষের কাছে এটা ছিল আর একটা ডিজিটাল পরিসম্পদ। কিন্তু তাতে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় না। ব্যাঙ্কে গচ্ছিত সেভিংস অ্যাকাউন্টও - যা এখন লোকজন অনলাইনে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে - সেটাও এক ধরনের ডিজিটাল পরিসম্পদ। কিন্তু ক্রিপ্টোর সঙ্গে ডিজিটাল ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের একটা বড়ো তফাত আছে। সেটা হলো মালিকানা নির্ধারণের ব্যাপারে। আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আইনের বলে আমার বলে স্বীকৃত। ব্যাঙ্কও বিভিন্ন পদ্ধতিতে সেই আমার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে সেই স্বীকৃতিতে সম্মতি দেয়। কিন্তু ক্রিপ্টোর ক্ষেত্রে তেমন কোনো আইনের রক্ষাকবচ নেই। এর মালিকানা নির্ধারিত হয় নির্দিষ্ট ব্লকচেনে - যেখানে ওই ক্রিপ্টো সংক্রান্ত সমস্ত লেনদেন এবং মালিকানা হস্তান্তরের তথ্য রক্ষিত থাকে। এখানে ব্যাঙ্ক বা অন্য কোনো পক্ষের হস্তক্ষেপ দরকার পড়ে না।

এহেন ঝুঁকিপূর্ণ ক্রিপ্টো পরিসম্পদে লোকজন কেন বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হলো সেটা লাখ টাকার প্রশ্ন। বিশেষ করে গত দু’বছর কোভিডের দাপাদাপিতে অধিকাংশ মানুষ যখন গৃহবন্দি হয়ে পড়েছিল তখন আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের বাজারে সবচেয়ে মহার্ঘ হয়ে উঠেছিল ক্রিপ্টো। চড় চড় করে বেড়েছিল ক্রিপ্টোর দাম। বিনিয়োগকারীরা সবসময় নতুন নতুন বিনিয়োগের রাস্তা খোঁজে। ক্রিপ্টোকে তারা পেয়েছিল বিনিয়োগের নতুন রাস্তা হিসাবে। এখনও পরিষ্কার নয় যে, ক্রিপ্টোর এমন বাড়বাড়ন্তর প্রকৃত কারণ কী। তবে খুব সম্ভবত বাজারে ক্রিপ্টোর চাহিদা এবং জোগানের মধ্যে ফারাকই ক্রিপ্টোর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ।

একদিকে আমেরিকা এবং পশ্চিম ইয়োরোপের দেশগুলোতে ক্রিপ্টোর চাহিদা দ্রুত বাড়ছিল। কোনো পরিসম্পদের চাহিদা যদি জোগানের তুলনায় বেশি বেড়ে যায় তাহলে সেই পরিসম্পদ মহার্ঘ হয়ে ওঠে। ক্রিপ্টো এর ব্যতিক্রম নয়। ব্যাঙ্ক অফ ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টের দেওয়া এক হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর মাসের মধ্যে ক্রিপ্টোর মূল্য ১০ গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ২.৮ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছিল। যে বিশাল পরিমাণ পরিসম্পদ ক্রিপ্টোর বাজারে খাটছিল তার অঙ্কটা ১০৯ বিলিয়ন ডলার - প্রায় ১০৮ গুণ বৃদ্ধির ধাক্কা। এমন বিশাল বৃদ্ধি অন্য কোনো পরিসম্পদের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। ক্রিপ্টোর বাজার যখন এমন বেলুনের মতো ফুলে ফেঁপে উঠছিল তখন পেশাদার বিনিয়োগকারীরা বিরাট অঙ্কের লাভ ঘরে তুলছিল। তাতে আবার সাধারণ মানুষ ভাবতে শুরু করলো যে, এমন সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত নয়। তাই তারাও এগিয়ে গেল ক্রিপ্টো বাজারে বিনিয়োগ করতে।

সবচেয়ে আশ্চর্য আমেরিকা বা ইয়োরোপের মতো দেশের তরুণ প্রজন্ম প্রলুব্ধ হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। পরিসংখ্যান অপ্রতুল। কিন্তু বোঝা যায় যে ক্রিপ্টোর বিপুল চাহিদার একটা বড়ো অংশ আসছিল এই তরুণ প্রজন্মের কাছ থেকে। এই শহরের উপকণ্ঠে এক কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ক্রিপ্টো নিয়ে সেদিনের আগ্রহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আমেরিকা ও ইয়োরোপের তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ। এই প্রজন্মের এত আগ্রহের কারণ কী সেটা নিঃসন্দেহে মনস্তাত্ত্বিক গবেষণার বিষয় হতে পারে। তবে এই প্রজন্ম বড়ো হয়েছে যখন আমেরিকায় অল্প সুদের আর্থিক নীতি বিরাজমান। তার ফলে আর্থিক বাজারে উপলব্ধ পরিসম্পদ থেকে প্রাপ্য লভ্যাংশ খুব কম। শিল্প এবং পরিষেবা ক্ষেত্রে কম্পিউটারাইজেশন উৎপাদন ব্যয় হ্রাসের নিত্য নতুন পন্থা বাজারে আনছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবসা - ই-কমার্স এবং ডিজিটাল স্টার্ট আপ - তাদের বাড়বাড়ন্ত। তাই এই নতুন প্রজন্মের প্রযুক্তির ওপর বিরাট ভরসা। ক্রিপ্টো যেহেতু প্রযুক্তির উৎকৃষ্ট ফসল তাই এর সাফল্য তাদের কাছে সন্দেহাতীত। তাদের ধারণা ছিল যে, ক্রিপ্টোর কোনোদিন পতন হবে না।

তার ওপর ২০০৮ সালে বিশ্বের আর্থিক বাজারে মন্দার পর মানুষের আর্থিক বাজারের ওপর বিশ্বাস তলানিতে ঠেকেছিল। তারা খুঁজছিল এমন এক পরিসম্পদ যা মুদ্রাস্ফীতি এবং অন্যান্য বাজারগত ঝুঁকি থেকে মুক্ত। যেহেতু ক্রিপ্টো ব্লকচেনের মাধ্যমে ব্যবহৃত হয় তাই এটা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক বা সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাই ক্রিপ্টো মানুষের কাছে সেই অভীষ্ট পরিসম্পদের আগমন বার্তা এনেছিল। তারা ক্রিপ্টোকে নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগের মাধ্যম ইয়োরোপ ও আমেরিকায় বহু চাকরিজীবী এবং ছোটো ব্যবসায়ী এই প্রলোভনের শিকার হয়ে তাদের আজীবনের সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগ করছিল ক্রিপ্টো পরিসম্পদে।

এর সঙ্গে ছিল প্রচারের ঢক্কানিনাদ। আমেরিকার দুটো শহর - নিউ ইয়র্ক এবং মায়ামি - নিজেদের ক্রিপ্টো মুদ্রা চালু করলো। হলিউডের অভিনেতা অভিনেত্রীরা জনসমক্ষে তাদের ক্রিপ্টোয় বিনিয়োগ নিয়ে সুখকর অভিজ্ঞতার কথা বলতে লাগলো। রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট - দু’দলের কিছু নেতা নেত্রী ক্রিপ্টোয় বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে লাগলো। তাই ক্রিপ্টোর দামের ঊর্ধ্বগতি ক্রমশ আরও বেগবান হচ্ছিল। তার ওপর কালো টাকা, ড্রাগের কারবারে বা অন্যান্য অপরাধমূলক কার্যকলাপে লভ্য টাকা চলে আসছিল ক্রিপ্টো বাজারে।

ক্রিপ্টো ভীষণভাবে প্রযুক্তিনির্ভর। ক্রিপ্টো নিয়ন্ত্রিত হয় ব্লকচেনের কঠোর অনুশাসনের মধ্যে। ব্লকচেনগুলি বাজারে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখার জন্য ক্রিপ্টোর জোগানে পরিবর্তন করতে চাইবে না। তাই বাজারে চাহিদার তারতম্যে ক্রিপ্টোর জোগান বাড়ার সম্ভাবনা কম। তাই বিপুল চাহিদার মুখে ক্রিপ্টোর দাম হু হু করে বেড়েছিল। একটা হিসাব অনুযায়ী আমেরিকার সাধারণ দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যস্তর যখন বাৎসরিক চার শতাংশ হারে বাড়ছিল, তখন ক্রিপ্টোর মূল্য বেড়েছিল বাৎসরিক ৩৮০ শতাংশ হারে।

কিন্তু ক্রিপ্টোর বিজয়গাথা স্থায়ী হলো না।

আজকে ক্রিপ্টোর বাজারের অবস্থা বড়োই করুণ। ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে ক্রিপ্টোর বাজারে বিরাট ধস নামছে। ক্রিপ্টোর বাজারে অনেকগুলি উপাদানের আনাগোনা। তার মধ্যে সবচেয়ে পুরনো বিটকয়েনের বাজার রাতারাতি ৫০ শতাংশ মূল্য খুইয়েছে। লুনা নামক আর একটি ক্রিপ্টো একদিনে প্রায় ৯৭ শতাংশ মূল্য খুইয়েছে। গত ৬ই নভেম্বের থেকে এফটিএক্স লেনদেনের বাজারে ৭০ শতাংশের বেশি ধস নেমেছে। এফটিএক্স ক্রিপ্টো লেনদেনের সবচেয়ে বড়ো বাজার। যা বোঝা যাচ্ছে তা হলো যে, ক্রিপ্টোর পরিসম্পদ হিসাবে মুল্য নেই বাজারে। যেটুকু অবশিষ্ট আছে তা হলো বিনিময় মুদ্রা হিসাবে উপযোগিতা। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে ক্রিপ্টো কেন ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড বা ওয়ালেটের থেকে বেশি কাম্য হবে তার কোনো সর্বসম্মত গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নেই।

এদিকে ক্রিপ্টোর বাজারে এই ধসের কারণে আমেরিকা এবং ইয়োরোপে মধ্যবিত্ত মানুষজন যে বিনিয়োগ করেছিল তা খুইয়ে হাহাকার করছে। উচ্চবিত্তরাও তাদের পরিসম্পদ খোয়ালেও সেই লোকসান সামাল দেবার ক্ষমতা তাদের আছে। কিন্তু মধ্যবিত্তদের ওপর আঘাত বেশি অনুভূত হয়। যে সব সেলিব্রিটিরা ক্রিপ্টো নিয়ে লাফালাফি করেছিল তারা মুখ লুকিয়েছে অন্তরালে। এল সালভাদরের ক্রিপ্টোকে জাতীয় মুদ্রা করার প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে।

সৌভাগ্যবশত এদেশের মানুষের ক্রিপ্টো বাজারে বিনিয়োগ কম বলেই মনে হয়। যদিও এব্যাপারে বেশি তথ্য নেই। তবে মনে হয় যেটুকু বিনিয়োগ এদেশ থেকে হয়েছে সেটার সিংহভাগ কালো টাকা। তাই মধ্যবিত্তরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।

ক্রিপ্টো বাজার কি আবার চাঙ্গা হবে? ভবিষ্যৎই এর সঠিক উত্তর দিতে পারে। তবে সম্ভাবনা কম। যদি ক্রিপ্টো বাজার চাঙ্গা হয়ও তবে ক্রিপ্টোকে অন্যরূপ পরিগ্রহ করতে হবে। ক্রিপ্টোর বর্তমান রূপের রোমান্টিক যাত্রাপালার এখানেই সমাপ্তি।